নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিল্পের ছাত্র...

প্রশান্ত মন্ডল হেমন্ত

আমি একজন শিল্পের শিক্ষার্থী। শিল্প নিয়ে জানতে ও জানাতে ভালোবাসি।

প্রশান্ত মন্ডল হেমন্ত › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রথম বাংলা হরফ ব্যবহৃত বই ‘আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল লেঙ্গুয়েজ’

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৫:১৫

বাংলা ভাষার গদ্যরূপ ও ব্যাকরণ নির্মাণে কেবলমাত্র বাংলাভাষী নয়, অন্যভাষী মানুষও অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। আর তাই বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনার কৃতিত্বও অন্যভাষীদের হাতেই। শুধু বাংলা ভাষার ব্যাকরণই নয়, নব্যভারতীয় প্রাদেশিক ভাষাগুলির অধিকাংশেরই ব্যাকরণ রচনার সূত্রপাত তাঁদের হাতে। বিদেশীরা নানা প্রয়োজনে ভারতবর্ষের আঞ্চলিক ভাষাসমূহ শিখতে ও সহগামীদের শেখাতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে তাঁদের প্রয়োজনই বাংলাসহ অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষার ব্যাকরণ রচনায় তাঁদেরকে উৎসাহিত করেছিল। আর এরকম প্রয়োজনের তাগিদেই পর্তুগিজ ধর্মযাজক মনোএল দ্য আসসুম্পসাঁউ (Manoel da Assumpcam) পর্তুগিজ ভাষায় প্রথম বাংলা ভাষাকে নিয়ে ব্যাকরণ রচনা করেন। তবে বাংলা হরফ ব্যবহৃত প্রথম ব্যাকরণ বইটি প্রকাশিত হয় ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে। হুগলি থেকে প্রকাশিত এ বইটির লেখক একজন ব্রিটিশ। তাঁর নাম নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড। ইংরেজির ফাঁকে ফাঁকে বাংলা হরফ সহযোগে লেখা এই ব্যাকরণ বইটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙগুয়েজ’। ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনার দিক দিয়ে এই গ্রন্থটি দ্বিতীয়।

A GRAMMAR OF THE BENGAL LANGUAGE: ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড (১৭৫১-১৮৩০) কর্তৃক ইংরেজি ভাষায় রচিত ‘আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল লেঙ্গুয়েজ’ আধুনিক বাংলা ব্যাকরণ বই। এটিই বাংলা হরফ ব্যবহৃত সর্বপ্রথম বাংলা ব্যাকরণ। ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত এই বইটি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির হুগলিতে এনড্রজ ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত হয়। হ্যালহেড এই বইয়ে বাংলার ক্যাক্সটন নামে খ্যাত চার্লস উইলকিন্স ও পঞ্চানন কর্মকার যৌথ প্রচেষ্টায় ছাপাখানার জন্য যে বাংলা হরফ (font) প্রবর্তন করেছিলেন তা এই বইয়ের বাংলা হরফে ব্যবহার করেন। পঞ্চানন কর্মকার ও তাঁর জামাতা মনোহর কর্মকার পরবর্তীতে উইলিয়াম কেরীর শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেসে হরফ তৈরির কাজ করেছিলেন। যতদূর জানা যায়, আখ্যাপত্র বা নামপত্রটিই ব্যবহৃত হয়েছিল এই বইয়ের প্রচ্ছদ হিসেবে। প্রচ্ছদের জন্য আলাদা করে হরফ কাটার প্রয়োজন পড়েনি। গ্রন্থের নামপত্রে অংশ রয়েছে চারটি। মধ্য ভাগে গ্রন্থের নাম ও লেখকের নাম : A GARMMAR OF THE BENGAL LANGUAGE BY NATHANIEL BRASSEY HALHED, এর ওপরে নামপত্রের শীর্ষ ভাগে লেখা হয়েছিল : বোধপ্রকাশ শব্দশাস্ত্র ফিরিঙ্গিনামুপকারার্থক্রিয়তে হালেদঙ্গেজী। এর অর্থ হলো, হ্যালহেড ফিরিঙ্গিদের সাহায্য করতে এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন; বাংলায় নিযুক্ত ব্রিটিশ রাজকর্মচারি ও বণিকদের জন্য, যারা বাংলা ভাষা শিক্ষায় আগ্রহী। হ্যালহেড ইংরেজি এৎধসসধৎ শব্দের অর্থ করেছিলেন শব্দশাস্ত্র। নামপত্রের তৃতীয়ভাগে অর্থাৎ গ্রন্থ ও গ্রন্থাকারের নামের পরে লেখা হয়েছিল: ইন্দ্রাদয়োপি যস্যান্ত নয়যুঃ শব্দবারিধেঃ। প্রক্রিয়ান্তস্য কৃৎস্নস্য ক্ষমোবক্তু নরঃ কথ।এর অর্থ হল: ইন্দ্র প্রমুখও(দেবতা) যে শব্দসমুদ্রের কুলকিনারা পেলেন না, সেই শব্দবারিধির কলাকৌশল মানুষের পক্ষে কী করে বলা সম্ভব! নামপত্রের শেষভাগে মুদ্রণ এবং প্রকাশ-এর বিষয়ে উল্লিখিত ছিল: PRINTED AT HOOGLY IN BENGAL M DCC LXXVIII. অর্থাৎ গ্রন্থটি বাংলা দেশের হুগলিতে মুদ্রিত এবং ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে (বাংলা ১১৮৫ সন) প্রকাশিত। কিন্তু মুদ্রকের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
হ্যালহেডের এই বই প্রকাশের পূর্বে কিছু বাংলা পদ্য বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেলেও কোনো গদ্যের সন্ধান পাওয়া যায় নি। তৎকালীন সময়ের পূর্বে বঙ্গদেশে গদ্যের চর্চা হতো না। একারণে হ্যালহেড এই বইয়ে কোনো গদ্যের উদ্বৃতি রাখেন নি। তবে তিনি কাশিরাম দাসের মহাভারতের অনুবাদ, মহাপ্রভুর লীলাময় বৈষ্ণব গ্রন্থসমূহ এবং ভারতচন্দ্র রায়ের বিদ্যাসুন্দর প্রভৃতি বই থেকে উদাহরণ সংগ্রহ করেছিলেন। এই বইটি ইংরেজি ভাষায় রচিত হওয়া সত্ত্বেও হ্যালহেড বিভিন্ন স্থানে উদৃতিসমূহ বাংলা হরফে সাজিয়েছেন। ইংরেজিতে লেখা বাংলা ভাষার এই ব্যাকরণ বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৪৮। এর মধ্যে মূল বইটির শুরু প্রথম ত্রিশ পৃষ্ঠার পর। প্রথম শিরোনাম-পৃষ্ঠার পর পঁচিশ পৃষ্ঠা ধরে রয়েছে লেখকের ভূমিকা এবং তার পরের পাঁচ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে সূচীপত্র আর রয়েছে সংশোধন ও সংযোজনের বিজ্ঞাপন। বইটির আকৃ্তি এখনকার এ ফোর (A4) সাইজের চেয়ে খানিকটা ছোট, যাকে বলা হত ক্রাউন আকারের কাগজ তার এক-অষ্টমাংশ। ছাপা এলাকার মাপ কমবেশি ৬.৫ / ৪.৫ ইঞ্চি। পাতার শীর্ষভাগে (Header) বইয়ের নাম ও পৃষ্ঠা সংখ্যা ছাপা হয় এইভাবে – বেজোড় সংখ্যক পৃষ্ঠার শীর্ষভাগে বাঁ দিকে এবং জোড়সংখ্যক পৃষ্ঠার ডান দিকে পৃষ্ঠা সংখ্যা উল্লেখ করা ছিল। শীর্ষভাগে বইটির দুটি অংশে ছাপা হয়েছিল: বেজোড় সংখ্যক পাতার শীর্ষে A GRAMMAR OF THE এবং জোড় সংখ্যক পাতার শীর্ষে BENGAL LANGUAGE।হ্যালহেডের গ্রন্থে ব্যবহৃত বাংলা অক্ষরের উচ্চতা প্রায় আধা ইঞ্চি। জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সূত্রে জানা যায়, হুগলিতে অবস্থিত অ্যান্ড্রুজ সাহেবের ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়েছিল A Grammar Of The Bengal Language। এর জন্য উন্নতমানের কাগজ ও কালি আমদানি করা হয়েছিল ব্রিটেন থেকে। মুদ্রণের মান ছিল উন্নত তাই আজ প্রায় আড়াইশো বছর পরও কাগজ ও ছাপার মান অনেকাংশে অক্ষত রয়েছে।

আটটি অধ্যায় রয়েছে HALHED এর ব্যাকরণ বইতে। তাঁর নিজের লেখা দীর্ঘ ভূমিকার পর একটি বিষয়সূচী রয়েছে –

১ম অধ্যায়ঃ ভাষার উপাদান–পৃ: ১

২য়অধ্যায়ঃ বিশেষ্য পদ–পৃ: ১৬

৩য় অধ্যায়ঃ সর্বনাম–পৃ: ৭৫

৪র্থ অধ্যায়ঃ ক্রিয়াপদ –পৃ: ১০০

৫ম অধ্যায়ঃ শব্দবিশেষণ ও শব্দযোগ — পৃ: ১৪৩

৬ষ্ঠ অধ্যায়ঃ সংখ্যা লিখন– পৃ: ১৫৯

৭ম অধ্যায়ঃ বাক্যে পদ সংস্থাপনের ক্রম –পৃ: ১৭৭

৮ম অধ্যায়ঃ উচ্চারণ ও ছন্দপ্রকরণ –পৃ: ১৯০।

আটটি পৃথক অধ্যায়ের পর রয়েছে সংযোজনী বা Appendix। সূচীপত্রের পর রয়েছে শুদ্ধিপত্র।
বাংলা ভাষা ব্যাবহৃত এই প্রথম ব্যাকরণ বইটিতে বড় আকারের বাংলা অক্ষর ব্যবহারের কারণে একটি পৃষ্ঠায় পংক্তির সংখ্যা কমবেশি ২০। যে পৃষ্ঠায় যুক্তাক্ষর, রেফ, হসন্ত ইত্যাদি রয়েছে সে পৃষ্ঠায় পংক্তি সংখ্যা আরও কম। অর্থাৎ দুটি পংক্তির মধ্যে যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা রয়েছে। যে পৃষ্ঠায় বাংলা অক্ষর নেই সে পৃষ্ঠায়ও পংক্তির সংখ্যা ২২ অতিক্রম করেনি। এই কারণে মূল বইটি আজও সহজ এবং স্বল্পায়াসে বোধগম্য।

বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ গ্রন্থ-প্রণেতা নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড। তিনি অবাংলাভাষী ব্রিটিশ হলেও তিনিই প্রথম বাংলা ব্যাকণের রচয়িতা। হ্যালহেড ভাল সংস্কৃত জানতেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলা ভাষার উদ্ভব সংস্কৃত থেকে। তাই তাঁর ব্যাকরণে সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাব লক্ষণীয়। হ্যালহেডের ব্যাকরণের বিষয়বিন্যাস সেকালের ইংরেজি ব্যাকরণের অনুরূপ হলেও মাঝে মাঝে তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণের মূল সূত্রগুলিও ব্যাখ্যা করেছেন। মনোএল যেমন বাংলা ভাষাকে লাতিন ব্যাকরণের ছাঁচে ফেলে তাঁর গ্রন্থ প্রণয়নের চেষ্টা করেছেন, হ্যালহেড তেমনি অনেকাংশেই বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের ছাঁচে ফেলে বিশ্লেষণ করেছেন। একারণে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণের পারিভাষিক শব্দকে বাংলা ব্যাকরণের পারিভাষিক শব্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। হুগলি থেকে প্রকাশিত এই বই নিয়ে আমাদের গৌরববোধ করতে হবে।

তথ্যসূত্র:

১। A GARMMAR OF THE BENGAL LANGUAGE, NATHANIEL BRASSEY HALHED.
২। চারু ও কারুকলা, ‘বাংলায় একজন বই লিখেছিলেন’, প্রকাশ মজুমদার,
৩। বাংলাপিডিয়া ও
৪। ছবি: ইন্টারনেট।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.