![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
০১.
সকাল গড়ানোর আগেই খালি মাঠে নেমে আসে সুমন্ত। পিছনে বাড়ির দেউড়ি। বেশ খানিকটা এলাকা নিয়ে বাড়ি। আরো বড় পরিধি নিয়ে ইটের পাঁচিল। সীমানা। সীমানার ভেতরেই একটা জগৎ। বাইরে আরেকটা। ভেতরেই তো জঙ্গল, ফল-ফলাদির গাছ, নানা জাতের প্রাণির অস্তিত্ব আছে। তবুু বাহির কেন ডাকে বোঝে না সুমন্ত। এমন হতে পারে যে, এখন গ্রামে এসে পড়লেও আসলে তো সে গ্রামের মানুষ নয়। তার জন্ম শহরে। কাস ফাইভ পর্যন্ত শহরে পড়াশোনা। কিন্তু কিছু পারিবারিক সমস্যার কারণে যখন তাকে দাদা-বাড়ির গ্রামের অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হলো, তার খুব মন-খারাপ হয়েছিলো। তারচেয়ে বেশি ঈর্ষা; কেননা ছোট দুই ভাই বাবা মায়ের সাথে শহরেই রয়ে গেছে। কেবল তাকেই পাঠিয়ে দেয়া হলো গ্রামে। গ্রাম তো গ্রাম, একেবারে বদ্ধ গ্রাম। বিদ্যুৎ পর্যন্ত নেই। কিন্তু শহরের বারো ফুট বাই বারো ফুটে আটকে থাকা তার শরীর এই অনাবিল অবারিত মাঠ, সবুজ চরাচর, ওই দূরের সামান্য জলবহতা নদী, তার ওপাড়ের জঙ্গলকে হাতের কাছে পেয়ে যেন আর বাগ মানতে চায় না। চায় সারাক্ষণ ত্রস্ত হরিণের গতি নিয়ে মাঠে মাঠে, মাছের মতো জলে জলে ভেসে বেড়াতে।
মন খারাপ নিয়ে পাঁচ সাত মাস কাটানোর পরে সুমন্ত টের পায়, বিদ্যুৎ না থাকতে পারে, রাতের অন্ধকার চিড়ে দেয়া স্ট্রীটল্যাম্পের হলুদ আলো না থাকতে পারে, চকচকে নতুন পোষাক পরা ছাত্রছাত্রীর ভিড়ে ডুবে যাওয়া স্কুল না থাকতে পারে, এখানেও কম কিছু নেই। মানুষজন আছে, শহরের মতো এত না হলেও। পুকুর আছে। ইচ্ছা হলেই মাছ ধরা যায়। সাঁতার কাটা যায়। এই কয় মাসে সে সাঁতারটাও শিখে নিয়েছে বেশ। শুধু সাঁতার নয়। ডুব-সাঁতারও। প্রায় তিরিশ শতক জায়গাজোড়া পুকুর সে দুই ডুবেই পার হতে পারে। মাঝে মাঝে তিন ডুব লাগে কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই দুই ডুবে কাবার।
বাড়ির সীমানার ভেতরেই মাঠের মতো ছড়ানো বিস্তৃত খোলা জায়গা আছে। খেলাধুলার জন্য বাইরে যাওয়ারও দরকার নেই। কাকা ছাড়াও অন্যান্য আত্মীয় পরিজনদের ছেলেপিলেতে বাড়ি একেবারে ঠাসা হওয়ায় তার সমান বয়সী বা একটু আধটু কম-বেশি বয়সী ছেলে অনেক। ফলে তাদের সাথে খেলা যায়। শহরে যেখানে তাদের বাসা, বাসা মানে ভাড়া বাসা, তার ঠিক উল্টোদিকে, বড় রাস্তার ওপারেও একটা মাঠ আছে। কিন্তু এই মাঠের তুলনায় সেটা কিছুই নয়। সেখানে খেলাধুলা করার জন্য ছেলেপিলেও কম। সংখ্যায় একেবারেই নগণ্য। তারাও মাঝে নাচ শিখতে যাবো, গান শিখতে যাবো, আঁকা শিখতে যাবো বলে মাঠে আসে না। ঘরের ভেতরেই কাটিয়ে দ্যায় দিনমান। কিন্তু সুমন্ত তা পারে না। রোদ থাক, বৃষ্টি থাক, আলো বা অন্ধকার যাই থাক বিকালে বাইরে আসা চাই-ই চাই। এমনিতে তার পড়তে খারাপ লাগে না। কিন্তু বিকালে বই দেখলে মনে হয় শত্রুর বিষ্ঠা। ছি, ছি।
এখানে সেই সব সমস্যা নেই। খেলব কথাটা মুখ দিয়ে বের করলেই খেলোয়ারের অভাব হয় না। ফুটবল, ক্রিকেট, কাবাডি, ডাংগুলি আরো অনেক। কিছু কিছু খেলা তো প্রথম বারের মতো খেলেছে এখানে এসে। শহরের বন্ধুরা এইসব খেলার নামও শোনে নি। এ তো গেলো বাড়ির ভেতরের হাল হকিকত। বাইরেরটা বাকিই থাকলো। বাইরে বলতে প্রথমত স্কুল। বাড়ি থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে। এতদ্ অঞ্চলের সবচে নামী স্কুল। প্রতিবছর পাঁচ দশটা করে ছাত্র-ছাত্রী স্টার মার্কস পেয়ে বের হয়ে যায়। শহরের স্কুলের সাথে খুব বেশি পার্থক্য আছে বলে সুমন্ত বোঝে না। পড়াশোনার মান নিয়ে কোনো কথা নেই। কেবল বলা যায় পোষাক আষাকের বিষয়ে। এখানে পোষাকের কোনো স্ট্রিক্ট কোড মানা হয় না। ছাত্রছাত্রীরা তো মানেই না। অনেক শিক্ষকও মানে না। ফলে বাজার করতে এসেও স্কুলে ঢুকে পরা যায়। খেলতে এসেও। সে রোজ পুরোনো ফিনিক্স সাইকেল চালিয়ে টিং টিং ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে যখন স্কুলের পথে রওনা হয়, তখন মনে হয় গোটা পৃথিবীটাই একটা সাইকেল আর সেই সাইকেলের সিটে বসে আছে সুমন্ত নামের কেউ। সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকে কেননা কেউ জানে না চালক তাদের কোথায় কোন দিকে নিয়ে যাবে এবার।
ছাত্র হিসাবে একেবারে ফেলনা না হওয়ায় আর তাদের বিশাল বাড়ির একটা খ্যাতি থাকায় সুমন্ত এক মাসের মধ্যেই সবার সাথে মিশে যেতে পারে। টিফিন আওয়ারের যে পৌনে একঘণ্টা সময় পাওয়া যায় তা খেলেই কাটে। বমবাস্টিং বা ওই ধরনের কিছু। বিকালে ছুটির পরে ক্রিকেট বা ফুটবল বা ওই ধরণের কিছু।
এতসব ওই ধরণের কিছুর পরেও তার যেনো কোথায় কমতি থেকে যায়। সবসময় সেটা মাথাচাড়া দ্যায় না ঠিক, কিন্তু যখনই দোতলায় তার এবং অন্য কয়েকটা ছেলের পড়ার জন্য নির্দিষ্ট ঘর থেকে সে বাড়ির সীমানা ডিঙিয়ে বাইরে তাকায়, খোলা মাঠ দেখা যায়, ফসল কাটা হয়ে গেলে ন্যাড়া মানুষের মাথার মতো ফোলা ফোলা চুলের গোড়ার অস্তিত্ব নিয়ে শুয়ে থাকা জমি দেখা যায়, দূর দিগন্তে দেখা যায় হালকা একটা নদীর রেখা, নদীর ওইপাশে দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকা জঙ্গল; তখন তার আর কিছুই ভালো লাগে না। মনে হয় জীবন আছে বাড়ির সীমানার বাইরে। থ্রিল আছে। এখানে তো কিছুই নেই খেলা আর পড়া। এ কোনো জীবন হলো! ফলে সে মনে মনে ভাবে আরেকজন সঙ্গী জোটাতে পারলেই সবার চোখ এড়িয়ে, বিশেষত সনতুসিয়া দারোয়ানের নজর এড়িয়ে ঠিক বাইরে চলে যাওয়া যেতো। অবশ্য ভয়ও যে নেই তা নয়। ধরা পড়লে মার না হোক, ধমক ধামকের অভাব হবে না। তার ক্ষেত্রে কিছুটা কম হতেও পারে কেননা বাড়ির সবচেয়ে বড় ছেলের সবচেয়ে বড় ছেলে হওয়ায় সবাই যেনো কেমন একটা বিশেষ চোখে দ্যাখে। মুখে হয়তো কেউ কিছু বলে না। কিন্তু আচরণে টের পাওয়া যায়। হাজার হোক একটা সময় সেই হয়তো হবে এই বাড়ির প্রধান। অন্তত তার পিতার পরেই। আর সুমন্ত জানে যেহেতু তার পিতা শহর ছেড়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এখানে, এই বদ্ধ পাড়াগ্রামে আসবে না, তাই হয়তো সে আগে ভাগেই বাড়ির মূল নেতা হয়ে যাবে। হয়তো একারণেই দাদাজানও তাকে বিশেষ ¯েœহ করে। এইসব কারণে তার ভাগ্য অন্যদের চেয়ে খানিকটা ভালো হতে পারে। কিন্তু লজ্জার অবশেষ থাকবে না। এমন আগুপিছু ভাবতে ভাবতে তার অনেক সময় চলে যায় আর মনে মনে সে খুঁজতে থাকে একজন সঙ্গীকে। পাওয়াও যায় একজনকে। সনতুসিয়া দারোয়ানের ছেলে নরজনি। বয়সে সুমন্তর চেয়ে কিছু বড়। গায়ে গতরে আরো। শরীর দেখে যে কারো মনে হবে নরজনির বয়স বিশ পেরিয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু আসলে তো সে পনেরই পেরোয় নি। তাছাড়া আরেকটা সুবিধাও এসে জোটে। সনতুসিয়া দারোয়ান যখন দেখবে তার নিজের ছেলেও এই অপকর্মের সাথে জড়িত এবং বলা যায় না তার ইন্ধনেই হয়তো বাড়ির অন্য ছেলেপিলেগুলি বাইরে যাবার সাহস জোগাতে পেরেছে, তখন সে তাদের কিছুটা হলেও আড়াল করার চেষ্টা করবে। এইসব ভেবে ভেবে সুমন্তর দিন যায়। রাত কাটে।
একদিন স্কুলে এক সহপাঠীর কাছে সুমন্ত শোনে হালকা শীর্ণতোয়া নদীর ওই পাড়ে যে জঙ্গল তার মধ্যেই নাকি কোথাও একটা কুঠি বাড়ি আছে। কুঠি বাড়ি মানে একসময় ওটা একজন নীলকর সাহেবের বাড়ি ছিলো। নীল চাষের জমানা শেষ হবার আগেই নাকি স্থানীয় কিছু স্বাধীনতাকামী বীর তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দ্যায়। ফলে বাড়িটা আপাদমস্তক পুড়ে যায়। বৌ-বাচ্চা, চাকরবাকরসহ ওই নীলকর সাহেবও পুড়ে মারা যায়। এই ঘটনার পরে পরে ইংরেজরা বিশেষ পুলিশদল পাঠায় এই অঞ্চলে। তারা এসে প্রায় মাসখানেক ওই বাড়িতেই আস্তানা গাড়ে। বাড়িটাকেও কিছুটা বাসযোগ্য করে তোলে আর তলে তলে সন্ধান করতে থাকে ওই বাড়িতে আগুন দেবার সাথে কারা কারা জড়িত। সত্য মিথ্যা যাচাই করা সম্ভব না হলেও কম করে এগারো জন লোককে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয় ওই বাড়িতেই এবং আরো তিনজনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে যখন ইংরেজরা শহরের দিকে রওনা হবে তখন নাকি বাড়ির প্রতিটি পোড়া ইট আবার জ্বলে ওঠে এবং ইংরেজ বাহিনীর সবাই পুড়ে মারা যায়। কিন্তু বন্দী তিনজনের কিছু হয় না। তারা পালিয়ে যেতে পারে। এই ঘটনার পরে লোকজন নাকি আশঙ্কা করেছিলো আরো বড় কোনো ইংরেজ পুলিশদল এখানে আসবে। এলাকার সব মানুষকে ওই বাড়িতে জড়ো করে পুড়িয়ে মেরে ফেলবে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আর কোনো ইংরেজ আসেনি। বোধহয় অন্যান্য অনেক ঝামেলার মধ্যে পড়ে এই ঝামেলাকে তারা ততটা গুরুত্ব দিতে পারেনি। যাই হোক বাড়িটা কিন্তু ভূতুড়ে বাড়ির তকমা পেয়ে যায়। আশপাশের দু’দশটা গ্রামের লোকজন শুধু বাড়িটাকেই নয় ওই বাড়ি যে জঙ্গলে অবস্থিত সেই জঙ্গলটাকেও এড়িয়ে চলতে শুরু করে এবং ওই বাড়ি পরিণত হয় হানাবাড়িতে।
এমন তথ্য পাওয়ার পরেই সুমন্তর মন আনচান করে ওঠে। ওই বয়সের আর দশটা ছেলের মতো তার মন থেকেও উঁকি দিতে থাকে একজন শার্লক হোমস কেননা শার্লক হোমসের বেশ কিছু গল্পই ততদিনে তার পড়া হয়ে গেছে। কিন্তু ওয়াটসন হিসাবে নরজনিকে তার ততটা পছন্দ হয় না। একে তো বেচারা ইস্কুলের ধারকাছ মাড়ায়নি। একেবারে নিরক্ষর বলতে যা বোঝায় আর কি। তার উপর গায়ে গতরে তাগড়াই হওয়ার পরও ব্যাটা অত্যন্ত ভীরু। সন্ধ্যার পর প্র¯্রাব করার জন্যও ঘর থেকে বেরুতে চায় না। কিন্তু গায়ে শক্তির অভাব না থাকায় তাকেও দলের একজন হিসাবে রাখতে সুমন্তর বাধে না এবং শেষমেশ স্কুলের একজন বন্ধুও তার পরিকল্পনার কথা শুনে দলে ভীড়ে যায়। লম্বা, চওড়া, বাড়িও তাদের বাড়ির কাছাকাছি, ভূতের ভয় কম। সবচেয়ে বড় কথা কৌতুহল আছে। বলা যায় সেই কৌতুহলের মাত্রা সুমন্তর চেয়ে কম না কোনোমতেই। আলোচনা করে তারা সিদ্ধান্ত নেয় স্কুল যখন অন্তত তিন দিনের জন্য বন্ধ থাকবে তখনই কাজটা তারা করে ফেলবে। কাজ বলতে আর তেমন কি। মাইল দুই হাঁটা। নদী পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢোকা, কুঠিবাড়ির খোঁজ-সন্ধান করা, না পেলে বা পেলেও প্রথম দিনের জন্য ফিরে আসা।
কথায় কথায় সে নরজনিকে একদিন ইঙ্গিত দ্যায় ওই বাড়িটা সম্পর্কে। নরজনি চোখ বড় চোখ আরো বড় করে বলে, হা ছোটা মিয়া, হো রকম একঠো বাড়ি হই জঙ্গলে আছে। দো বার আগুন লেগা সব শেষ। কিন্তু হইখানে তো যাওয়া ছম্ভব না।
ছম্বব না বললেই সুমন্ত তো আর তা মানবে না। সে আবার প্রশ্ন করে কেন সম্ভব না?
Ñ হোই বাড়িতে তো কই লোক থাকে না। তামাম দুনিয়ার ছব চুড়েল, শকশ আর ভূতেরা ঘুসে থাকে সারাদিন। রাতের বেলায়, ঘুমতে ফিরতে থাকে জঙ্গলে। বিছ পঞ্চাশ বছরে কেউ হোই জঙ্গলে ঘুসে নি।
এই কথায় সুমন্ত অনেকটা নিরাশ হয়ে পড়ে। সে ভেবেছিলো যেতে রাজী না হলেও ফুসলিয়ে অন্তত নদীটা পর্যন্ত নরজনিকে নেয়া যাবে। যাতে ধরা পড়লেও বলা যায় নরজনি তাদের সাথেই ছিলো। কিন্তু নরজনির চোখের পরিধি আর বাড়িটা সম্পর্কে কথা বলার সময় হোই বাড়ি, হোই বাড়ি বলা দেখে সুমন্ত আশা ছাড়ে। না এই ব্যাটাকে বাদই দিতে হবে। বাড়ি থেকেও আর কাউকে নেওয়ার উপায় নেই। সবকটা ছেলেই একেবারে ভূতবিদ্ধ। শেষবারের মতো সুমন্ত একটা ট্রাই করে।
Ñ আমরা তো ওই বাড়িতে যাবো। তুই যাবি আমাদের সাথে?
নরজনি আকাশ থেকে পড়ে। মুখ হা হয়ে যায়। চোখ আরো বড়। ই কি বোলেন ছোটা মিয়া?
Ñ হ্যাঁ, হ্যাঁ। অত কথায় কাজ নেই। ভূত না আরো কিছু! তুই গেলে চল আর না গেলে চুড়ি, ঘাগড়া পরে ঘরের মধ্যে ঘুসে থাক। ভীতু ইন্দুরের দল কোথাকার। তুই কোনো দিন দেখেছিস ভূত, না তোর মা-বাপ দেখেছে। কোই ব্যাটা দেখেছে বলতে পারবে? হোই বাড়ি, হোই বাড়ি, চুড়েল, শকশ, ভূতেরা ঘুসে থাকে সারাদিন! এতবড় শরীরটা দিয়ে করবি কী? ঘরের মধ্যে বসে বসে খৈনি পাকিয়ে পাকিয়ে মরবি। আমি গিয়ে ওই বাড়ি থেকে তামাম মোহর খুঁজে নিয়ে আসবো। কিন্তু সাবধান কোই যেন না জানে! জানলে সব দোষ তোমার কাঁধে চাপিয়ে দেবো, বুঝেছ সোনা-মাণিক?
সুমন্তর কথায় নরজনির ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগে। ইগো জখম হয়। সে একবার নিজের বাইসেপের দিকে তাকিয়ে আবার সুমন্তর দিকে তাকায়। ই কোথা বোলিয়েন না ছোটা মিয়া, ষাঁড়ের মাথা হামি ভাঙিয়ে দিবো শিঙ্গে ধরে এক মোচড়া মেরে। চুড়ি ঘাগড়া হামি পরবো কেনে?
একবার নিজের বুকে হালকা চাপড় মেরে আবার বলে, হামার সাথে কেউ বাদমাশি কোরলে হাড্ডি গুড়া করে দেবো। লেকিন ছোটা মিয়া, মোহরকা পাতা হাপনাকে কোওন দিলো? হামরা তো মোহর কা বাত কুছু শোনি নাই! শেষের কথাগুলো বলার সময় তার গলা একেবারে খাদে নেমে যায়। এত কম ভলিউমে যে নরজনি কথা বলতে পারে তা সুমন্ত আশাই করতে পারে না। আর সাথে সাথে সুমন্ত এটাও বুঝে যায় যে ইগোতে আঘাত যতটা লেগেছে তার চেয়ে বেশি জেগেছে লোভ।
সুমন্ত বলে, আমার আরেক বন্ধু আছে, সেও যাবে আমাদের সাথে। তার কাছেই শোনা। নীলকর সাহেব নাকি তার সব সোনাদানা ওই বাড়ির মেঝের নীচে এক চোরা কুঠুরীতে লুকিয়ে রেখেছিলো। এখন পর্যন্ত তো কেউ সরাতে পারে নি, তাই আমরা ভাবলাম একবার ট্রাই করে দেখি। বলা তো যায় না ভাগ্যে থাকলে কিছু না কিছু জুটেও যেতে পারে।
নরজনি বলে, হা, তা পারে। আচ্ছা ছোটা মালিক, কুছু মোহর যদি হামরা পায়ে ফেলি, ছেইটা দিয়ে হামরা কী কোরবো?
সুমন্ত বোঝে ব্যাটা গোঁফে তেল মাখতে শুরু করেছে। যাই হোক ব্যাটাকে কাঁঠালের আরেকটু কাছে নিয়ে যাওয়া যাক। সুমন্ত বলে, কুছু মোহর না, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকার মোহর। আমরা যা পাবো তা সমান তিন ভাগ হবে। একভাগ আমার, একভাগ আমার বন্ধুর, আর একভাগ তোর।
Ñ কোতো টেকা হোবে?
Ñ হোবে চার পাঁচ লাখ।
লাখের কথা শুনে নরজনির চোখ চোখেখাটো একটা ডিমের আকৃতি পেয়ে যায়। নিজের মনেই সে বলতে শুরু করে লাখ টেকা দিয়ে হামি কী করবো? আবার সুমন্তর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, আচ্ছা ছোটা মালিক, এতো টেকা চুড়েলরা লিয়ে যায় না কেনে? সুমন্ত ভাবে এই ব্যাটার ভেতরেও তাহলে কৌতুহল বলতে কিছু আছে। সে উত্তর দেয়, এই বিষয়ে এখন আর কথা বলা যাবে না। পরে তোকে সব বলবো। ওখানে যাওয়ার আগের দিন তোকে সব জানিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু সাবধান কেউ যাতে কিছু না জানে। জানলে সব দোষ আমি তোর কাঁধে চালান করে দেবো।
Ñ হুজুর কী কথা বোলেন! পেটে বুমা মারিয়া ভি কোই এক বাত উছালতে পারবে নাই। আচ্ছা মালিক, ই বাড়িটা গড়তে কোতো খরচা পড়িয়াছিলো আন্দাজা লাগাতে পারেন?
সুমন্তর কপাল কুঁকড়ে যায়। মনে মনে বলে, বাবু হে, লোভ সংবরণ করো। অত লোভ ভালো নয়। অতি লোভে তাতী নষ্ট। কিন্তু মুখে বলে, লাখ টাকা হবে না। হলেও সামান্য কিছু উপর নীচ। নরজনি সম্মোহিত মানুষের মতো তার দিকে তাকিয়ে উপর নীচ মাথা দোলায়। কেমন আধবোজা চোখ তার। ঘুমে ঢুলু ঢুলু। স্পষ্টই বোঝা যায় ব্যাটা স্বপ্ন দেখতে লেগেছে। দেখুক। তারপরও অন্তত নদী পর্যন্ত যদি এটাকে পাওয়া যায় খারাপ হবে না। একে তো সে এই এলাকার আদি বাসিন্দা। এই বয়সের অন্য ছেলেদের সাথেও সম্পর্ক আছে। আর বলা যায় না, মুখে মুখে অস্বীকার করলেও, হয়তো বারকয়েক ওই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকেও থাকতে পারে। কেননা ব্যাটা তো স্কুলে পড়ে না। সকাল সকাল বাড়ির গোরু চারটা নিয়ে সামনের মাঠে চলে যায়, দুপুরের আগে আগে ফিরে আসে। বলা যায় না নদী তো কখনো পেরিয়েও থাকতে পারে। ভেতরের সত্যটা একবার যাচাই করার জন্যই সুমন্ত প্রশ্ন করে, নরজনি, সত্যি করে বল তো, তুই কি নদীর ওইপাড়ে কখনোই যাস নাই?
সরাসরি সুমন্তর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ তার সহসাই নেমে যায়। মাটির দিকে। মুখে কোনো কথা বলে না। সুমন্ত আবার তাগাদা দিলে বলে, ছোটা মিয়া, কিসিকো বলিয়েন না, কয়েকবার হামি ওই নদী পার হয়ে গেছি, জংলামে ঘুছি নাই; একলা তো, দম পাই না। লেকিন, নদীর ধারেই ফল ফলাদির গাছ মেলা আছে। পাড়লে কেউ কুছ বোলে না ভি, কার বাবার জমিন যে কুছু বোলতে আছবে। নরজনি কুছ পরোয়া ভি করে না। লেকিন মালিক, জংলামে ঘুছি নাই।
সুমন্ত মনে মনে হাসে। ভাবে একে রাখাই উচিৎ। ক্ষুধা টুধা লাগলে অন্তত ফল ফলাদির গাছের সুলুক সন্ধান দিতে পারবে। আর যেহেতু নদী পাড় হওয়ার অভিজ্ঞতার আছে, মোহরের লোভ আছে কুঠিবাড়ী পর্যন্ত নিতে কোনো সমস্যা হবে না।
০২.
স্কুলের বন্ধু লোকমানও এই প্রস্তাবে রাজী হয়। সামনেই চারদিন একটানা স্কুল বন্ধ থাকবে। তখন এই সুযোগটা নেয়া যেতে পারে। একেকজন একেক কথা বলে বাড়ি থেকে সারাদিনের মতো বেরিয়ে আসবে। নরজনিকে বের করা তেমন অসুবিধা নয়। সে মোটামুটি সকালের দিক থেকে দুপুর পর্যন্ত বাইরেই থাকে। গোরু চরায়। কিন্তু সমস্যা হলো সুমন্তর। স্কুল বন্ধ থাকলে তো তার বেরোনোর কোনো উপায় নেই। অবশ্য আশার কথা এই যে বাড়ির আর কেউ এই স্কুলে পড়ে না। কেউ পড়ে মক্তবে। আর কারো কারো এখনো পড়ার বয়স হয় নাই। পড়ার বয়স হয় নাই কথাটা বলাও একেবারে ঠিক হয় না। আসলে পড়ার বয়স আরো আগেই হয়েছে কিন্তু অভিভাবকরা এখনো সেই বয়সটাকে ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারেনি। ফলে তারা বলে বাইচ্চাডার পড়ার বয়স হইল বইল্ল্যা। আর বেশিদিন আদর দিয়া বান্দর বানানি যাইতো না।
কিন্তু আদর বহাল থাকে। বাঁদর হওয়াও। অবশেষে বহুৎ বুদ্ধিবাদ্ধা করে তারা ঠিক করে যে, কাসের ছেলেরা বনভোজন করবে বলে সেই দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে সে। সঙ্গে থাকবে কিছু চাল, সামান্য লবন, আর কয়েকটা কাগজের পুরিয়ায় রান্নার মসলা টসলা। এগুলো থাকায় বাড়ির কেউ সন্দেহ করতে পারবে না তার উদ্দেশ্য নিয়ে। আরো ঠিক হয় যে, লোকমানও তার বাড়ি থেকে কিছু নিয়ে আসবে যাতে দুপুরের খাবারটা দিগন্তজোড়া মাঠে তারা নিজেরাই রান্না করে নিতে পারে। রান্নার বিষয় নিয়ে তেমন না ভাবলেও চলবে। নরজনি টুকটাক রান্নাবান্না করতে জানে। নিজের মাকে রান্নায় সহায়তা করতে করতে তার বেশ খানিকটা রান্নার অভ্যাস হয়ে গেছে। মায়ের অসুখ টসুখ হলে, সে নাকি দুইচার দিন ভাত, ডিমের ভুনা ইত্যাদি রান্না করে কাজ চালাতে পারে। যদিও নরজনিকে এখনো ব্যাপারটা জানানো হয়নি যে, মাঠ পেরোনোর বনভোজনে তাকে রান্নাও করতে হবে। কিন্তু সুমন্ত জানে, নরজনি না করবে না। মোহরের কথাটা যদি মাথায় থেকে থাকে, অবশ্য তা না থাকার কোনো কারণ নেই, তাহলে মোহরের জন্য রান্নার সামান্য ঝামেলা পোহাতে সে কোনো দ্বিধা করবে না। একেবারে শেষ মুহূর্তে তাদের দলে আরো একজন ভিড়ে যায়। নাম অয়ন। সুমন্তর কাসের সেকেন্ড ক্যাপ্টেন। লম্বা লিকলিকে শরীর। বয়সের তুলনায় একটু বেশি লম্বা। ক্রিকেট ফুটবল খুব ভালো খেলে। পড়াশোনায়ও একেবারে খারাপ না। সুমন্তর মতো অত ভালো না হলেও প্রথম তিন জনের মাঝে তৃতীয়জন বলা যায় তাকে। ব্যাটার একমাত্র দুর্বলতা হলো গণিত। অন্য বিষয়গুলোতে ভালো, ইংরেজিতে খুব ভালো। কাসে যে স্যাররা ইংরেজি পড়ান, তারা সবাই অয়নকে বেশ ভালোবাসে। লম্বা লম্বা ইংরেজি ট্রান্সলেশন মুহূর্তে বলে দিতে পারে। কোনো বিষয়ে ইংরেজিতে কিছু লিখতে বললে যখন কাসের অন্য ছাত্ররা মুখস্ত রচনার বাইরে কিছুই লিখতে পারে না, তখন তাদের পাশে বসেই অয়ন কলম চালাতে থাকে। বুঁদ হয়ে থাকে লেখায়। কিন্তু গণিত পরীক্ষায় দেখা যায় সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। কেউ কেউ বলে পাশের জন্য অয়ন নাকি অংকও মুখস্ত করে আসে। এই নিয়ে একদিন তাকে সরাসরি প্রশ্ন করার ইচ্ছা ছিলো সুমন্তর। কিন্তু একে তো অয়ন তার চেয়ে প্রায় একমুঠো লম্বা, তার উপরে কথাবার্তা বলে খুব কম।
সুমন্ত যখন কাসের প্রায় শেষদিকে বসে কুঠিবাড়ি অভিযান নিয়ে কথাবার্তা বলছিলো তখন ঠিক পিছনে বসেই তাদের কথাবার্তা মন দিয়ে শুনছিলো অয়ন। আলোচনায় এত মশগুল হয়েছিলো সুমন্ত আর লোকমান যে, পেছনে বসেই একজন যে তাদের কথাবার্তা উদগ্রীব শ্রোতার মতো গিলে খাচ্ছে তা তারা টেরই পায়নি। ওই দিনের শেষ কাস শেষ হবার পরে সবাই যখন একে একে কাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, লোকমান আর সুমন্তর কাছে এসে অয়ন বললো, আমিও যাবো তোদের সাথে। একহালি ডিম আর কয়েকটা পেঁয়াজ নিয়ে আসবো। পকেটে দেখি খুচরা কিছু টাকাও জোটাতে পারি কিনা। কথাগুলো এভাবে বললো যেন তাকে দলে নেওয়ার বিষয়ে আর কারো কোনো মতামত থাকতেই পারে না। নতুন কারো সাথে এমন ব্যবহার করলে তারা হয়তো মনে করতো ছেলেটা ব্যবহার জানে না। কিন্তু সুমন্ত এবং লোকমান দুজনেই জানে অয়ন খুবই ভদ্রগোছের ছেলে। কিন্তু তার ব্যবহারটাই এমন। তাই তারা আর কোনো কথা বললো না। কথা না বললেও, খুশিই হলো। অয়ন খেলাধূলায় ভালো। মোটাসোটা না হলেও গায়ে শক্তি আছে। কোনো বিপদ আপদ আসলে সহজে পালাবে না। সুমন্ত এবং লোকমান দুজনেই হেসে অয়নকে বললো, রান্না করতে পারিস? অয়নের মুখ শুকিয়ে গেলো, না। রান্না করতে পারি না। সুমন্ত বললো, ঠিক আছে যোগারযন্ত্র করে দিবি, পারবি না? পারবো, অয়ন খুব কনফিডেন্সের সাথে বললো।
ঠিক আছে কাল সকাল নয়টায় আমরা স্কুলেই চলে আসবো সবাই। তারপর স্কুল থেকেই রওনা হবো।
©somewhere in net ltd.