![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগের শাসনকাল আর পুঁজিবাজারের বিপর্যয় একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। শেয়ার মার্কেটের সোনালি হাতছানিতে দেশের সাধারণ মানুষ যেভাবে ঘটিবাটি বিক্রি করে উন্মত্তের মতো বিনিয়োগ করছিলেন, তখন তার সম্ভাব্য কুফল সম্পর্কে এসব মানুষকে সাবধান করতে সরকার পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়নি। সর্বশেষ কেলেঙ্কারির পর ইব্রাহিম খালেদের তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে এসেছে বড় অনেক সাপ। শেয়ার মার্কেটকে ঘিরে অনেক অনিয়ম চললেও সরকার বারবার আশ্বস্ত করেছে যে '৯৬-এর মতো বিপর্যয় আর ঘটবে না। কিন্তু সেই বিপর্যয় ঘটেছে। পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন লাখ লাখ মানুষ। শেয়ার কেলেঙ্কারি আর আওয়ামী লীগের শাসনকাল কি তবে একসূত্রে গাঁথা? আলোচনা করেছেন মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা আর শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ২১ বছর অপেক্ষার পর সরকার গঠন করে তার মাসখানেকের মধ্যে শেয়ারবাজারে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে তেজিভাব লক্ষ করা যায়। ঢাকা স্টক একচেঞ্জের সামনে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ভিড় যখন শাপলা চত্বরে থেকে শুরু করে ইত্তেফাক ভবন পেরিয়ে অভিসার সিনেমা হল পর্যন্ত বিস্তৃত হয় তখন খুশিতে বাকবাকুম হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। আচার-আচরণে তারা বুঝিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে বলেই শেয়াবাজার তেজি হয়েছে, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা পকেটভরে পয়সা উপার্জন করছে। তখন অবস্থা এমন দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগে ১০০ টাকায় যে শেয়ারের ক্রেতা পাওয়া যায়নি, সে শেয়ার পাঁচ হাজার টাকায়ও মিলছিল না। '৯৬ সালের জুনে যে কম্পানির একটি শেয়ারের দাম ছিল ৭০ টাকা, চার মাস পর নভেম্বরে তার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৭৫০ টাকা। নভেম্বরের ৫ তারিখ ফেটে যায় আওয়ামী লীগের সেই বেলুন। তখন তাদের অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এএসএম কিবরিয়া 'আমি শেয়ার মার্কেট বুঝি না' বলে তাঁর দায়িত্ব শেষ করেন। হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর কান্না সেই সময়ের পুরো পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগকে আর স্পর্শ করেনি। অবশ্য রুটিনওয়ার্ক হিসেবে শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতাদের ধরতে তদন্ত কমিটি হয়েছে, তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন মামলা করেছে। নিম্ন আদালত শাইনপুকুর হোল্ডিংস, বেঙ্মিকো, দোহা সিকিউরিটিজের কর্ণধারসহ অন্যদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। আলোচিত 'দুই ভাই' বীরদর্পে উচ্চ আদালতে গিয়ে জামিন নিয়ে এসেছে। সে মামলার বয়স হয়েছে ১৪ বছর। আজও কোনো কূলকিনারা হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে শেয়ারবাজারে আর বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় হয়নি। তারপর ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর '৯৬ সালের ঘটনাকে ম্লান করে দিয়ে শেয়ারবাজারে ঘটে সর্বকালের সর্বোচ্চ দরপতন, মাত্র সোয়া ঘণ্টায় বাজার থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় ২২ হাজার কোটি টাকা। অভিযোগের আঙুল আবারও সেই '৯৬-র নায়কদের দিকেই। অবশ্য নতুন দুই একজন যুক্ত হয়েছে ঠিকই, তার পরও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আস্থার সঙ্গেই বলেন, 'এদের নাম প্রকাশ করা যাবে না, করলে অসুবিধা আছে।' আওয়ামী লীগের দুই সময়ের দুই অর্থমন্ত্রীর 'গা-ছাড়া' মন্তব্য ৩০ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর নীরব কান্নাকে সরব করেছে। গায়েবানা জানাজা; আল্লাহর রহমত আশা করে মোনাজাত- এসবের কিছুই স্পর্শ করেনি আওয়ামী লীগকে। তারা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার, শুধু শেয়ারবাজার ছাড়া।
ফিরে দেখা ১৯৯৬-এর শেয়ারবাজার
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর পরই শেয়ারবাজার চাঙ্গা হতে শুরু করে। ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের (ডিএসই) সামনে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ভিড় জ্যামিতিকহারে বাড়তে থাকে। ডিএসই ভবনের সামনে বাঁশের ব্যারিকেড তৈরি হয় ভিড় সামলাতে। মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে শুরু করে ইত্তেফাক ভবন পেরিয়ে অভিসার সিনেমা হল পর্যন্ত ঠেকে বিনিয়োগকারীদের ভিড়। শেয়ারবাজার চলাকালীন পুরো মতিঝিল স্থবির হয়ে পড়ে যানজটে। পুলিশকেও হিমশিম খেতে হয় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সামলাতে এবং যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে। সে সময় অবস্থা এমন দাঁড়ায় হাজার হাজার বিনিয়োগকারী সকালে রাজধানীতে এসে শেয়ারের কাগজ কেনাবেচা করে বিকেলে পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে এলাকায় ফিরে যেতে থাকে।
১৯৯৬ সালের ১৫ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার এক মাস পর যার শুরু, তার শেষ চার মাসের মাথায়, ১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর। তিন মাসে শেয়ারবাজারের ক্রমাগত চাঙ্গাভাব দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে থাকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের মন্ত্রিপরিষদ। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে এক বিবৃতিতে বলেন, 'জনগণ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে বলেই দেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইছে। শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মুখে হাসি দেখে তা-ই বোঝা যাচ্ছে। আসলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই জনগণ কিছু পায়।' প্রধানমন্ত্রীর এ বিবৃতির তিন মাসের মাথায় যখন শেয়ারবাজার থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা হাওয়া হয়ে যায়। কয়েক লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়ে শূন্য পকেটে এবং আলোচিত কয়েকটি কম্পানির শেয়ারের কাগজ হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। তখন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়া এক বিবৃতিতে বলেন, 'আমি শেয়ার মার্কেট বুঝি না।'
ঢাকা স্টক একচেঞ্জের সামনে যখন সুনসান নীরবতা, বাঁশের তৈরি ব্যারিকেড যখন তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তখন সরকার শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতাদের ধরার জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি ব্যাপক তদন্ত শেষে ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। রিপোর্টের সারবস্তু ছিল শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে ১৫টি কম্পানির ৩২ পরিচালক জড়িত। উল্লেখ্য, ১৫টি কম্পানির মধ্যে অন্যতম তিনটি কম্পানি ছিল বেঙ্মিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, শাইনপুকুর হোল্ডিংস ও দোহা সিকিউরিটিজ।
তদন্ত রিপোর্টকে ভিত্তি ধরে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ১৯৯৭ সালের ২ এপ্রিল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলা করে। মামলার পর পরই অভিযুক্ত আসামিদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
নিম্ন আদালতে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর দিনই শাইনপুকুর হোল্ডিংসের সালমান এফ রহমান, এবি সিদ্দিকুর রহমান, বেঙ্মিকো ফার্মাসিউটিক্যালসের সালমান এফ রহমান, সোহেল এফ রহমান ও ডিএইচ খান উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান। শুধু জামিনই নয়, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই গঠন করা যাবে না বলে উচ্চ আদালত থেকে জানানো হয়। উচ্চ আদালতের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে এসইসি, সেই আপিলের নিষ্পত্তি আজ পর্যন্ত হয়নি।
কী করেছিল শাইনপুকুর হোল্ডিংস
১৯৯৭ সালে অতিরিক্ত দায়রা জজ মিয়া মো. শরীফ হোসেনের আদালতে শাইনপুকুর হোল্ডিংসের বিরুদ্ধে উপস্থাপিত অভিযোগে বাদীপক্ষ (এসইসি) বলেন, 'শাইনপুকুর হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান সোহেল এফ রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি সিদ্দিকুর রহমান ১৯৯৬ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কম্পনির ব্যবস্থাপনায় থেকে নিজেরা এবং কম্পানির পক্ষে শেয়ারবাজারকে অবৈধভাবে প্রভাবিত করতে আইন ও বিধিবর্হিভূত এবং প্রতারণামূলক কৌশল নিয়েছিলেন।
অভিযোগে বলা হয়, উলি্লখিত সময়ে শাইনপুকুর হোল্ডিংসের ৫১ লাখ ৬৬ হাজার ৭৬০টি শেয়ার বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ডেলিভারি ভার্সেস পেমেন্টের (ডিভিপি) মাধ্যমে যেসব শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে তার অধিকাংশেরই ঢাকা স্টক একচেঞ্জে কোনো রেকর্ড নেই। এই শেয়ার কেনাবেচায় মূল ভূমিকা পালন করেছে দোহা সিকিউরিটিজ। শাইনপুকুরের শেয়ার কেনাবেচা মূলত এই কম্পানির সহযোগী বেঙ্মিকো ইনভেস্টমেন্ট কম্পানি, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ, সাতক্ষীরা ফিশারিজ, বাগখালি ফিশারিজ ও মৃত্তিকা লিমিটেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এর বাইরে যেসব ক্রেতা-বিক্রেতা ছিল তারা হলো বেঙ্মিকো গ্রুপের বেনামী শেয়ারহোল্ডার ও কর্মকর্তা কর্মচারী।
অভিযোগে বলা হয়, শাইনপুকুর হোল্ডিংস ১৯৯৫ সালে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। এমনকি হোটেলব্যবসা বা জমি-সম্পত্তি কেনাবেচার কোনো নিদর্শনও দেখাতে পারেনি। অথচ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি করার মিথ্যা ঘোষণা ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার করে জনসাধারণকে মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে শেয়ারের দর বাড়িয়েছে। কৃত্রিমভাবে দর বাড়ানোর কৌশল হিসেবে বেঙ্মিকো গ্রুপের সহযোগী কম্পনিগুলো নিজেদের মধ্যে স্বনামে ও বেনামে লেনদেন দেখিয়েছে। কম্পানির কর্মচারীরাও সরাসরি শেয়ার কেনাবেচায় অংশ নিয়েছে।
অভিযোগে আরো বলা হয়, আসামিরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কম্পানির নাম ও উদ্দেশ্যগুলো পরিবর্তন করে পরিশোধিত মূলধন দুই কোটি টাকার জায়গায় ২৫২ কোটি টাকা দেখিয়েছে। এটি করে তারা প্রত্যেক শেয়ারহোল্ডারকে প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে ১২৫টি রাইট শেয়ার দেয়। কিন্তু কম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে শেয়ারের বিপরীতে ওই পরিমাণ টাকা কম্পানির নামে জমা ছিল না। শেয়ারের মূল্য বাড়ার পর বেঙ্মিকো গ্রুপের অন্য কম্পানির মাধ্যমে বাড়তি শেয়ারগুলো তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে উচ্চমূল্যে বাজারে বিক্রি করেছে।
কেন হয়নি বিচার
১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর শেয়ার কেলেঙ্কারির সময় সর্বোচ্চ ২৩৩ পয়েন্ট বা ছয় শতাংশের মতো সূচক কমে যায়। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এটা ছিল সর্বোচ্চ পতন। এই পতনের আগের তিন মাসে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তেজিভাব বিরাজ করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের সময় তাদের অত্যন্ত কাছের এক ব্যক্তির আওতাধীন কম্পানির যে শেয়ারের দাম ছিল ৭৩ টাকা, চার মাসের মাথায় সে শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ৭৫৪ টাকা। সে সময় শাইনপুকুর হোল্ডিংস, বেঙ্মিকো গ্রুপসহ কয়েকটি কম্পানির শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। যে কয়টি কম্পানির শেয়ারের দামে মারাত্মক তেজিভাব লক্ষ করা যায়, তার বেশির ভাগেরই শীর্ষ ব্যক্তি ছিল আওয়ামী লীগের লোক। তারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের শুধু তিন মাস ধরে দিতেই থাকে। এভাবে তিন মাসের মোট দেওয়া তারা একবারেই নিয়ে যায় ১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর। আওয়ামী লীগ সরকারের বয়স তখন মাত্র চার মাস। এই চার মাসে তাদের দলের লোকই যে তাদের দলের অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর পকেট ফাঁকা করে দিয়েছে, এটা আওয়ামী লীগের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বুঝতেই পারেননি। যখন বুঝতে পেরেছেন, তখন দেখেছেন কেলেঙ্কারির হোতারা সব আওয়ামী লীগেরই লোক। ফলে মামলা হয়েছে সত্য; কিন্তু সে মামলাকে এগোতে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ ভেবে দেখেছে, দেশের আদালত যদি বিচারপ্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে এবং রহমান ভ্রাতৃদ্বয়সহ অন্যদের সাজা দিয়ে দেয় তাহলে ক্ষতি আওয়ামী লীগেরই। ১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বরের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির কোনো আদালতগত প্রমাণ আওয়ামী লীগ রাখতে চায়নি। ফলে কেলেঙ্কারির নায়করা রাজনৈতিক আশকারায় পার পেয়ে আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটালেও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সুযোগটি তারা কাজে লাগায় ১৫ বছর পর ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর একই সরকারের দ্বিতীয় শাসনামলে। এবারও তারা ভেবে নেয়, রাজনৈতিক কারণেই আওয়ামী লীগ তাদের বিচার করবে না বা করতে পারবে না। আওয়ামী লীগ যদি তাদের বিচার করে, তাহলে কেলেঙ্কারির নায়করা যেহেতু মোটামুটি একই, সেহেতু '৯৬ সালে কেন বিচার করল না_জনগণের কাছে সেই অভিযোগে আওয়ামী লীগ অভিযুক্ত হবে। শেয়ার কেলেঙ্কারির নায়করা হিসাব কষে দেখেছে তাদের বিচার করে আওয়ামী লীগ কখনোই তার পিঠে এই দায়ভারের লেভেল সাঁটবে না।
সর্বকালের সর্বোচ্চ দরপতন
দেশের শেয়রবাজারে সর্বকালের সর্বোচ্চ দরপতন ঘটে ৮ ডিসেম্বর ২০১০, বুধবার। ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জে এদিন সাধারণ মূল্য সূচক আগের দিনের চেয়ে ৫৪৭ পয়েন্ট বা সাড়ে ছয় শতাংশ কমে যায়। একদিনে ডিএসইর বাজার মূলধন কমে ১৮ হাজার কোটি টাকা। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১২টা ২৩ মিনিটের মধ্যে লেনদেন হওয়া ২৩২ কম্পানির মধ্যে দাম হারায় ২২৩টি। অর্থাৎ শতাংশের হিসাবে ৯৬ শতাংশ শেয়ারেরই দরপতন ঘটে। পতন সামলাতে সোয়া ১২টার দিকে এসইসি থেকে জারি করা দুটি নির্দেশনা প্রত্যহার করা হয়। এরপর সূচক কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায়। দুপুর ২টার দিকে সূচক আবার ৫৯৩ পয়েন্ট বেড়ে ৮৬২৫.৫৫ তে পেঁৗছায়। শেষ দিকে তা আবার নেমে ৮৪৫১.৫৯ পয়েন্টে স্থির হয়।
এদিন এসইসি থেকে জারি করা যে দুটি নির্দেশনা প্রত্যাহার করা হয়, পরে জানা যায় এই নির্দেশনার বিষয়টি খোদ এসইসির চেয়ারম্যানই জানতেন না। চেয়ারম্যানকে না জানিয়ে এ রকম দুটি মূল্য সংবেদনশীল নির্দেশনা জারি এবং তার অপব্যাখ্যা ছড়ানোর সঙ্গে ১৯৯৬ সালের নায়কদের এক ধরনের যোগসূত্র স্পষ্টই লক্ষ করা যায়।
ঘটনার দিনই দুটি নির্দেশনা জারির নির্দেশদাতা কমিশন সদস্য মনসুর আলমকে শোকজ করে এসইসি। ঘটনার পরের দিন সার্ভেল্যান্সের দায়িত্ব থেকে মনসুর আলমকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং ঘটনা তদন্তে এসইসি চার সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটি বুধবারের ওই সোয়া ঘণ্টায় যেসব মার্চেন্ট ব্যাংক শেয়ার কেনা বন্ধ রেখে শুধু বিক্রি করেছে, তাদের লেনদেনের হিসাব খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সময় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপকহারে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা দেখা যায়। এসইসির চেয়ারম্যানকে না জানিয়ে দুটি নির্দেশনা জারি ও পরে প্রত্যাহার এবং কয়েকটি হাউসের শেয়ার কেনা বন্ধ রাখার মধ্যে বড় ধরনের যে যোগসূত্র আবিষ্কার হয় তাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে ফিরতে থাকে যোগসূত্রকারীদের নাম। ৮ ডিসেম্বর দুপুরের পর থেকে যে খলনায়কদের নাম আনাড়ি বিনিয়োগকারীরাও জেনে যায়, এসইসির গঠিত তদন্ত কমিটি টানা তিন মাসের তদন্ত শেষে সে নামগুলোই প্রকাশ করে। দেখা যায়, যে নামগুলো বেরিয়ে আসে তাদের শীর্ষ ব্যক্তি হলেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ২২ হাজার কোটি টাকা
৮ ডিসেম্বর ২০১০, বুধবার সকাল ১১টা থেকে ১২টা ২৩ মিনিট পর্যন্ত সোয়া ঘণ্টায় শেয়ারবাজার থেকে কত টাকা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল তার পরিসংখ্যানে কেউ বলেছে ১৮ হাজার কোটি টাকা, কেউ বলেছে ২২ হাজার কোটি টাকা। আবার কারো কারো মতে ৮৬ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখের হিসাবের সঙ্গে এর আগের অন্তত ১৫ দিনের হিসাব মিলালে ৮৬ হাজার কোটি টাকা হাওয়া হয়ে যাওয়া বাস্তব ভিত্তি পায়। তবে সে ৮৬ হাজার কোটি টাকা, পরবর্তী সময়ে যাঁরা অভিযুক্ত হয়েছেন তাঁরা একা নিতে পারেননি। সে টাকা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছেও গিয়েছে। ফর্মুলাটি ছিল নেই-দেই, নেই-দেই, নেই-দেই, নেই আর-দেই না। ৮ ডিসেম্বর এসে দেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে। একবারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। ৩০ লাখ বিনিয়োগকারী সে টাকা নেয়নি, নিয়েছে পাঁচ থেকে ছয়জন ব্যক্তি। যাদের ছবি প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়। তদন্ত প্রতিবেদনে তাদের নাম উঠে এসেছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে ডিএসই, সিএসই, এসইসি, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা সবাই নিশ্চিত হয়েছে পাঁচ-ছয়জন দুরাচারের বিষয়ে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অর্থমন্ত্রী নিশ্চিত হতে পারেননি কারা সে কালপ্রিট। তাই তো অর্থমন্ত্রী তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পরও বলেন, 'তাদের নাম প্রকাশ করা যাবে না; করলে অসুবিধা আছে।' কী সেই অসুবিধা তা অর্থমন্ত্রী বলেননি। তিনি খুব সম্ভবত চাপ অনুভব করছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার দিক থেকে।
প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা কোথায় গেল? বিপুল এ টাকা যদি ব্যাংকেই যাবে তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তারল্য সংকট বিরাজ করছে কেন? অথচ ২০১০-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, নভেম্বরের পত্রপত্রিকা দেখলে বোঝা যায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে টাকার স্তূপ জমেছিল। চারদিক থেকে গ্রাহকরা শুধু ক্যাশ টাকা নিয়ে আসছিল ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য। ক্যাশিয়াররা টাকা গুনে কুলোতে পারছিল না। ব্যাংকের শাখায় টাকা রাখার পাত্রের অভাব দেখা দিল। ছালায় টাকা, ব্যাগে টাকা, ট্রাঙ্কে টাকা, টাকা, টাকা আর টাকা। ক্যাশ টাকার যন্ত্রণায় ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। তারা ভালো করেই বুঝেছিল, এগুলো শেয়ার ব্যবসা থেকে উদ্ভূত টাকা।
বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের এই অগুণতি টাকা ৮ ডিসেম্বর মাত্র দুই ঘণ্টায় উত্তোলন শুরু হলো। যারা ৮ ডিসেম্বর কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত তাদের বাড়ির, অফিসের বয়, বেয়ারা, বাবুর্চি থেকে শুরু করে নিচু, মধ্যম, উঁচু শ্রেণীর কর্মকর্তারা কেউ পাঁচ লাখ, কেউ ১২ লাখ, কেউ ১৬ লাখ, কেউ ২৮ লাখ, কেউ ৫৮ লাখ টাকার চেক নিয়ে ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারের লাইনে গিয়ে দাঁড়ান। মতিঝিলের অফিস পাড়ায় ব্যাংকের শাখা থেকে শুরু করে নোয়াখালীর মাইজদী কিংবা ঢাকার নবাবগঞ্জের ব্যাংক শাখায়ও সেই চেকের অধিকারীরা গিয়ে হাজির হলো। ব্যাংক ব্যবস্থাপকরা হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। যে যত বড় চেক নিয়েই হাজির হলো সে চেক ক্যাশ হয়ে গেল খ্যাত-অখ্যাত সব ব্রাঞ্চ থেকে। বিচ্ছিন্নভাবে এক একজন ব্যাংক ব্যবস্থাপক ভাবলেন তাঁর শাখা থেকেই হয়তো বড় অঙ্কের টাকা গ্রাহকের হাতে গেছে। অন্য ব্যাংক থেকে যায়নি। কিন্তু পরে দেখা গেল সব ব্রাঞ্চেরই এক অবস্থা। মোটামুটি সবাই ৮ ডিসেম্বর তারিখে ভালোই লেনদেন করেছে। অর্থাৎ সব ব্যাংক মিলে প্রায় ২০-২২ হাজার টাকা গ্রাহকের হাতে তুলে দিয়েছে।
প্রশ্ন হলো গ্রাহকের হাতে টাকা না হয় গেল, কিন্তু সে টাকা তো আবার ঘুরেফিরে ব্যাংকেই ফিরে আসার কথা। বাস্তবতা হলো ৮ ডিসেম্বরের উত্তোলন করা এক টাকাও আর কোনো ব্যাংকে ফিরে আসেনি। তবে কি সে টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে?
৮ ডিসেম্বরে মাত্র দুই ঘণ্টায় উত্তোলন করা কোনো টাকাই বিদেশে পাচার হয়নি। বিদেশে পাচার করতে হলে টাকাকে ডলার বানাতে হবে। যদি ধরে নেওয়া হয় মানিলন্ডারিং আইনের ভয়ে কেউ কার্ব বা অবৈধ মার্কেট থেকে টাকাকে ডলার বানাল, তাহলে অবৈধ মার্কেটের যার হাতে টাকা গেল, সে টাকা তিনি কোথায় রাখলেন? সে টাকাও তো ঘুরেফিরে ব্যাংকে ফেরত আসার কথা। আসেনি কেন? এখনো কেন ব্যাংকে তারল্য সংকট। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় ৮ ডিসেম্বরের নায়করা বনখেকো ওসমান গনির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন? বয় বেয়ারা বাবুর্চি দিয়ে চেককে ক্যাশ বানিয়ে সে ক্যাশ দিয়ে তোষক বানিয়ে তার ওপর শুয়ে আছেন?
বিচিত্র নয়। বাজার থেকে ২০, ৫০, ও ১০০ টাকার নোট হাওয়া হয়নি। সবচেয়ে বেশি হাওয়া হয়েছে এক হাজার টাকার নোট। বাজারে এখন এক হাজার টাকা নোট নেই বললেই চলে। আর বাংলাদেশে এক হাজার টাকার নোটটিও বেশ প্রাচীন নয়। যে সরকারের দুই টার্মে দুইবার শেয়ার কেলেঙ্কারী ঘটল, সেই সরকারই বিশাল আগ্রহ নিয়ে এক হাজার টাকার নোট তৈরি করল। এখন সেই দলই এক হাজার টাকার নোট চোখে দেখছে না।
এক হাজার টাকা নোটের দ্রুত হাওয়া হয়ে যাওয়া স্পর্শ করল বাংলাদেশ ব্যাংককেও। তারা প্রমাদ গুনল এই নোটের বিষয়ে। মাঝখানে শোনা গিয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মতো এক হাজার টাকার নোটও বাতিল করা হবে। কিন্তু শোনা পর্যন্তই। বাতিল আর হয়নি। হয়তো সরকারের সদিচ্ছাও ছিল। কিন্তু শর্ষের ভেতরে যে ভূতরা আছে তারা তো আর বসে বসে আঙুল চোষে না। তারা সরকারকে অন্য রকম গল্প শোনাল। এক হাজার টাকার নোট বাতিল বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ফ্রিজ হয়ে গেল।
এ কথা হলফ করে বলা যায়, ২২ হাজার কোটি টাকার এক হাজার ও ৫০০ টাকার নোটগুলো এগুলো উদ্ধার করা সম্ভব যদি সরকার তার বিভিন্ন সংস্থাকে টাকা উদ্ধারে আন্তরিকভাবে দায়িত্ব দেয়। তবে বোঝা যায়, সংগত কারণে এ দায়িত্ব সরকার কাউকে দেবে না। তাহলে টাকা বেরিয়ে আসবে, তদন্ত কমিটি যাদের প্রতি অভিযোগের আঙুল তুলেছে তাদের বেড রুম কিংবা গ্যারেজ থেকে। যা সরকারের জন্য সুখকর হবে না।
বিষয়টি যে সুখকর না হয়ে সরকারের গলার কাঁটা হয়ে রইবে তা ভালোই বুঝতে পেরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই হয়তো তিনি সাত-পাঁচ ভেবে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন শেয়ারমার্কেটে বিনিয়োগের জন্য কালো টাকাকে সাদা করার অনুমতি দিতে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধানমন্ত্রীর এ অনুরোধ ফেলতে পারেননি। যদিও তিনি বছরজুড়ে কালো টাকাকে সাদা করার অনুমতি দেওয়া হবে কি না, এ-জাতীয় প্রশ্নের জবাবে বেশ আস্থার সঙ্গেই বলেছিলেন নো, নো, নো, নো...।
১০ শতাংশ কর দিয়ে এখন শেয়ারবাজারে কালো টাকাকে সাদা করা যাবে। প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থাটি করে দিয়েছেন যাঁরা টাকার স্তূপে বসে হাঁসফাঁস করছিল তাদের সুবিধার্থে। ৩০ লাখ বিনিযোগকারীর ২২ হাজার কোটি টাকা থেকে সরকার এখন দুই হাজার কোটি টাকা কর পাবে, বাকি ২০ হাজার কোটি টাকা হয়ে যাবে পাঁচ-ছয়জনের। সেই পাঁচ-ছয়জন বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় লেপ বালিশের ভেতরে লুকানো ৫০০ আর এক হাজার টাকার নোট শেয়ারমার্কেটে বিনিয়োগ করবে। ব্যাংকের তারল্য সংকট কেটে যাবে। ব্যাংক ঋণ দেবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনার জন্য। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আরো বেশি উদ্দীপনায় ব্যাংকঋণ নিয়ে শেয়ার কিনতে থাকবে ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে ডাবল লাভের আশায়। তারপর ফিরে আসবে আবার সেই ৫ নভেম্বর কিংবা ৮ ডিসেম্বর। আবার কাটা পড়বে বিনিয়োগকারীদের পকেট, সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের ভোট। দুঃখ হলো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ভোটের ধার আওয়ামী লীগ ধারে না। যেহেতু অর্ন্তবর্তী সরকারব্যবস্থায় তারাই এখন ভোটের নিয়ন্ত্রক, সেহেতু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ভোটে তাদের কী আসে যায়।
ঠুঁটো জগন্নাথ নিয়ন্ত্রক সংস্থা
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের কাজ কী তা খুব সম্ভবত ভালো করে জানে না তারা নিজেরাই। অথবা বলা যায়, জানলেও তাদের করার কিছু থাকে না সরকারের তোষামোদ করতে গিয়ে। বাজারের প্রয়োজন এবং চাহিদা অনুযায়ী আইনি দিকনির্দেশনা তৈরি করে দেওয়া এবং তা প্রয়োগের ব্যবস্থা তৈরি করে দেওয়া এসইসির কাজ হলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে তারা আজ পর্যন্ত সে নজির রাখতে পারেনি। ১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর শেয়ারবাজারে ভরাডুবির পর গঠিত তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছিল। তার ভিত্তিতে একই বছরে ৩ এপ্রিল ১৫ কম্পানি ও ব্রোকারেজ হাউসের মালিকসহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে যে মামলা এসইসি করেছিল তার নিষ্পত্তি ১৪ বছরেও তারা করতে পারেনি। এ বিষয়ে তাদের মাথাব্যথাও নেই। মামলায় যাদেরবার যে একই ঘটনা ঘটাবে এ বিষয়ে এসইসি নিশ্চিত হলেও তারা উচ্চ আদালতে মামলাটির নিষ্পত্তির বিষয়ে কোনো চেষ্টা করেনি।পৃথিবীর সব দেশেই সিকিউরিটিজ কমিশনের কাজ বাজারমুখী। শেয়ারবাজারে যারা বিনিয়োগকারী তাদের চাহিদা পূরণ, বাজারের উন্নয়ন এবং নতুন উদ্ভাবনসহ বাজারকে সুসংগঠিত ও সমৃদ্ধশালী বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা প্রধান হলেও বাংলাদেশের এসইসি এমনই এক প্রতিষ্ঠান, যারা রাজনৈতিক লিডারদের গোপন নির্দেশে শেয়ারমার্কেটের বিনিয়োগকারীদের জন্য নির্দেশনা প্রয়োগ করে। আবার সেই নির্দেশনার ফাঁক গলিইয়ে যখন দেখে গোপন নির্দেশদাতারা চোখের সামনে দিয়ে হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন, তখন ত্বরিতগতিতে একজনের দোষ-আরেকজনের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টায় থাকে। ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর সব দোষ গিয়ে এঙ্চেঞ্জ কমিশনের সদস্য মনসুর আলমের ওপর গিয়ে পড়ে। যদি ধরে নেওয়া হয় মনসুর আলম বিরাট লেনদেনের মাধ্যমে ওই দুই নির্দেশনা দিয়েছিলেন_তার পরও প্রশ্ন থাকে, তখন কমিশনের চেয়ারম্যান কোথায় ছিলেন?
নিয়ন্ত্রক সংস্থার নাকের ডগায় ছোটোখাট তো প্রতিবছরই, আর বড় ধরনের পুকুরচুরি সংঘটিত হলো '৯৬ ও ২০১০ সালে। এত বড় ঘটনা ঘটার পরও তাদের দৃষ্টান্তমূলক কিছু হয়নি_শুধু চেয়ারম্যান পরিবর্তন করা, দু-একজন সদস্যকে সরিয়ে নতুন সদস্য নিয়োগের মতো লোকদেখানো কার্যক্রম ছাড়া এসইসির কারো কিছু হয়নি। তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলেও তাদেরও তো কারো নিয়ন্ত্রণে থাকা দরকার। কিন্তু তারা যেন বল্গাহীন ঘোড়া। তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় বাজার অথচ তাদের সাত চড়েও রা নেই। তাদের শৈথিল্যের কারণে বারবার মানুষের আমানত নষ্ট হয়, অথচ দায়দায়িত্ব নেওয়ার বেলায় তারা নেই। বড় বড় আপ্তবাক্য প্রয়োগ করেই তারা খালাস। তারা নিয়ন্ত্রিত হয় আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা। যাদের প্রয়োজনে এবং যাদের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য রেগুলেশন, তাদের কোনো প্রতিনিধি এ ব্যবস্থায় রাখা হয় না। এখানে চেয়ারম্যান হিসেবে যেতে চায় যারা ১৪ বছরের ব্যবধানে দুইবার একই ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের শীর্ষ ব্যক্তি হতে চায় এসইসির চেয়ারম্যান। এর চেয়ে প্রহসনের বিষয় আর কী হতে পারে।
যার চিন্তা তাকেই করতে হবে
একসময় এ দেশে কিছুসংখ্যক লোক শখের বশে বিনিয়োগকারী হিসেবে শেয়ারমার্কেটে আসত। এখন অবস্থা পাল্টে গেছে। ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই শেয়ারমার্কেটের দিকে ঝুঁকছে। কেউ ঋণ করে, কেউ সঞ্চয় ভেঙে, কেউ স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে, কেউ বিদেশে কাজ করা কষ্টার্জিত অর্থ নিয়ে শেয়ারবাজারের দিকে ছুটছে। কোন শেয়ার কেনা যায়, কোনটা যায় না_এ ধরনের পরামর্শ দেওয়ার কেউ নেই তাদের। একজন আরেকজনের দেখাদেখি শেয়ার কেনে আবার বেচে। এমনও দেখা যায়, যে কম্পানি এখনো উৎপাদনে যায়নি সে কম্পানির শেয়ার দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। আর বিনিয়োগকারীরা কিনছে।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বুঝতে হবে তাদের সঙ্গে এসইসি নেই, আওয়ামী লীগ নেই, বিএনপি নেই, হাসিনা খালেদা নেই। কেউ নেই। তাদের চিন্তা তাদেরই করতে হবে। কোনো বিনিয়োগকারী যেন প্রাইমারি মার্কেটের অভিজ্ঞতা না নিয়ে সেকেন্ডারি মার্কেটে না আসে, সে চিন্তাটা সবার আগে করতে হবে। কম্পানির মৌল ভিত্তি দেখে শেয়ার কিনতে হবে, পিই রেশিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
রেখো না ভালে এ কলঙ্করেখা
বাংলাদেশের ইতিহাসে শেয়ার কেলেঙ্কারির দুটি ঘটনাই ঘটেছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে। প্রথম কেলেঙ্কারির যদি বিচার হতো, বিশেষজ্ঞদের অভিমত তাহলে দ্বিতীয় কেলেঙ্কারি ঘটত না। তাই দাবি উঠেছে, এ কলঙ্ক মোচনের জন্য আগের ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নইলে নতুন কেলেঙ্কারিতে জড়িতরা একই কায়দায় বেরিয়ে যাবে। আওয়ামী লীগকে এখন বিবেচনায় নিতে হবে তার কাছে কে বড়। ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী না পাঁচ-সাতজন ব্যক্তি। তাদের বুঝতে হবে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর সঙ্গে ৩৩ লাখ পরিবার জড়িত। এ পরিবারগুলোর ভোট কোটি দাঁড়িয়ে যাবে। মানুষ পুত্রশোক ভুলে যায়, টাকার শোক ভোলে না। এই শোক প্রতিটি বিনিয়োগকারীর পরিবার যুগ যুগ বয়ে বেড়াবে। তারা সময়ে সময়ে ভোটের লাইনে গিয়েও দাঁড়াবে। তখন ব্যালটের মাধ্যমে তারা যে জবাব দেবে তা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের পক্ষে যাবে না। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির অপবাদ পাকাপোক্তভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেঁটে গেছে। এ অপবাদ তাদেরই উৎরাতে হবে। তারা যদি তাদের কপালের এ কলঙ্করেখা মুছতে না পারে তাহলে কোনো ফর্মুলাই তাদের তৃতীয়বার ক্ষমতায় আনতে পারবে না, তাদের দলের অল্প কয়েকজনকে আরেকটি শেয়ার কেলেঙ্কারির জন্ম দিতে।
[link|http://|আওয়ামী লীগের কলঙ্করেখা]রাজনীতি পাঁচ জুলাই
©somewhere in net ltd.