![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনস্ক এবং মুক্তচিন্তার অধিকারী
এবার জি-২০ সম্মেলনের আয়োজক ছিল ভারত। বৈশ্বিক নেতা হিসেবে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজের সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন।
সম্মেলন উপলক্ষে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে নয়া দিল্লিতে বুলডোজার চালানো হয়েছে গরিব মানুষের বস্তির ওপর দিয়ে। তারা কোথায় গেল, কোথায় রাত কাটাল তা নিয়ে প্রশাসনের মাথাব্যথা ছিল না। তাদের শহরছাড়া করতে পেরেই যেন প্রশাসন খুশি।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজিপি)-এর নির্বাচনী প্রতীক পদ্মফুল। পদ্মফুল এঁকে চারদিক ভরিয়ে ফেলা হয়েছে। বিলবোর্ড জুড়ে কেবল পদ্মফুল আর মোদীর ছবি। রাস্তার দুপাশ ঢেকে গেছে সেইসব বিলবোর্ডে।
এখানে জি-২০ সম্মেলনের আয়োজন হচ্ছে, সবাই তাকিয়ে আছে বিশাল সুযোগ-সুবিধার দিকে। এখানে ব্যবসায়িক চুক্তি হবে। সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে কথাবার্তা। ভৌগলিক কৌশল নিয়ে বোঝাপড়া হবে। তাই এখানে যারা আসছেন তাদের একজনেরও এ নিয়ে চিন্তা নেই। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান হন আর যে-ই হন, জানেনই না ভারতে আসলে কী হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের মতো দেশগুলোর মূলধারার মিডিয়া ভারতে কী ঘটছে তার সমালোচনা করছে। কিন্তু, সরকারগুলোর এজেন্ডা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই আমি মনে করি না যে, এখানে আগত লোকদের এটা আদৌ গোণায় ধরার কোনো বিষয়। তারা নিশ্চয়ই এতটা নিবোর্ধ নন।
সংখ্যালঘুদের সাথে সরকার যে আচরণ করেছে ভারতে জি-২০ অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ বিষয়ে নেতাদের সতর্ক করার কোনো সুযোগ আছে?
কেউই তাদের এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আমার সেরকম আশাও নাই। কিন্তু, যেটা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে তা হলো, আপনি যদি এখন নয়া দিল্লি থাকতেন, যেমনটা আমি আছি, প্রচার-প্রচারণা দেখে আপনি অবাক হতেন। জি-২০ সম্মেলনের সমস্ত আয়োজন, ব্যানার- বিলবোর্ড দেখলে আপনি ভাববেন এই সম্মেলনের আয়োজন বিজেপিই করেছে, ভারত সরকার নয়। প্রতিটা ব্যানারেই বিশাল পদ্মফুল আঁকা। পদ্মফুল মোদীর বিজেপির প্রতীক।
ভারতে যা ঘটেছে তা খুবই বিপজ্জনক। অত্যন্ত লজ্জানক। দেশ, জাতি, সরকার এবং এর প্রতিষ্ঠানগুলি একটি দলের সাথে মিশে গেছে- আর সেটি হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। আর ক্ষমতাসীন দল মানেই এখন মোদী। এক ব্যক্তিই এখন একটি দল। বস্তুত কোনো ক্ষমতাসীন দল এখন নাই বললেই চলে। আছে একমাত্র একজন শাসক। তাই এটা বলাই যায় যে, মোদীই জি-২০ সম্মেলনের আয়োজক। আমরা সবাই তার হাতে বন্দী। এর বাইরে যাওয়ার উপায় নাই আমাদের। গরিবদের শহর থেকে তাড়ানো হয়েছে। বস্তিগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছে। চোখের আড়ালে চলে গেছে সেসব। রাস্তায় যত্রতত্র ব্যারিকেড। গাড়ি চলাচল বন্ধ। মৃত্যুপুরীর মতো নিস্তব্ধ সব। দেখে যেন মনে হয়, তিনি আমাদের সবাইকে নিয়ে লজ্জিত। শহরের গরিবি হাল তিনি কাউকে দেখাতে চান না। সম্মেলনের জন্য সব পরিষ্কার করা হয়েছে। শহরজুড়ে লক-ডাউন চলছে।
এটা মোদীর দম্ভ দেখানোর একটা মাধ্যম ছিল?
অবশ্যই দম্ভ দেখানোর মাধ্যম। সামনে নির্বাচন, এ নিয়ে তিনি এখন নাচবেন। তার নির্বাচনী প্রচারণায় এটা এখন তেল যোগাবে। পশ্চিমের যেসব নেতা গণতন্ত্রের কথা বলেন- ট্রাম্পের মতো কাউকে আপনি ক্ষমা করতে পারেন, কারণ, তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসই করেন না। কিন্তু বাইডেন, ম্যাখোঁ, এরকম যারা গণতন্ত্রের কথা বলেন, তারা তো জানেন এখানে ঠিক কী হচ্ছে। তারা জানেন মুসলমানদের গণহত্যা করা হয়েছে, যেসব মুসলমানরা প্রতিবাদ করেছে তাদের বাড়িঘরের ওপর দিয়ে বুলডোজার চালানো হয়েছে। যার অর্থ হলো সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান- কোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট, সংবাদমাধ্যম এর সঙ্গে জড়িত। তারা জানে কিছু শহরে মুসলমানদের ঘরের দরজায় এক্স চিহ্ন দেওয়া আছে এবং তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়েছে। তারা জানেন, মুসলমানদের একঘরে করা হয়েছে, কোণঠাসা করা হয়েছে। এবং যারা প্রকৃত খুনি, মুসলমানদের যারা হত্যা করেছে তারাই আবার এই সংঘ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো নিয়ে তথাকথিত ধর্মীয় মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা জানেন এসব অতন্দ্রপ্রহরীরাই তরবারি হাতে সব পাহারা দিচ্ছে, ধ্বংসের ডাক দিচ্ছে, গণহারে মুসলিম নারীদের ধর্ষণের ডাক দিচ্ছে। তারা সবই জানেন। কিন্তু, তাতে তাদের কিছু আসে-যায় না। কারণ, কিছু পশ্চিমা দেশ সব সময়ই মনে করে, ‘গণতন্ত্র আমাদের জন্য’ আর ‘স্বৈরাচার বা ওরকম কিছু আমাদের অশ্বেতাঙ্গ বন্ধুদের জন্য’। তাই আমাদের কী হলো এতে তাদের কিছু যায়-আসে না।
একশ চল্লিশ কোটি মানুষের দেশে যে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র ছিল- এখন তা এক প্রকার… আমি শুধু ফ্যাসিজম শব্দটাই ব্যবহার করতাম, এই ফ্যাসিজম বাকি পৃথিবীতে প্রভাব ফেলবে না, এটা ভাবলে আপনারা খুবই ভুল করবেন।
আমি সাহায্যের জন্য আবেদন করতাম না। আমি বলতাম, ‘আপনারা চারপাশে ঘুরে দেখেন আপনি কোথায় আছেন। আসলেই আপনারা কী গড়তে সাহায্য করছেন?’ ২০০২-এ এরকম একটা সময় ছিল, গুজরাটে মুসলিমদের গণহত্যা করার পর, যুক্তরাজ্যের মতো দেশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে মোদীকে জাতিগত নিধনের জন্য দায়ী করা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে মোদীর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। সবই এখন ভুলে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু, তিনি তো একই মানুষ আছেন। আর এখন যারা তাকে আরো নাচাতে চায়, আরো তা দিতে চায় তারাই বলে যে, তিনিই তো একমাত্র মানুষ যিনি এইসব ক্ষমতাধর মানুষদের ভারত পর্যন্ত টেনে আনতে পেরেছেন। নতজানু, আজ্ঞাবাহী, দাসসুলভ চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে এই প্রচার হাজার গুণ বেড়েছে। সম্মিলিত জাতীয় নিরাপত্তাহীনতা, হীনমন্যতা এবং মিথ্যা আত্মম্ভরিতার অনুভূতিকে এসব আরো দুধকলা খাওয়ায়। এটা ফুলেফেঁপে উঠে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে। মানুষের বোঝা উচিত, এটা শুধু ভারতের জন্যই সমস্যা হবে না। আমাদের এমন অবস্থা আছে যেখানে আমরা এক জাতি, এক ভাষা, এক নির্বাচনের কথা বলছি। কিন্তু আসলে আমরা আছি এক স্বৈরশাসক আর এক কর্পোরেশনের হাতে।
‘আমরা এখন একটি ভিন্ন অবস্থায় পৌঁছেছি’ বলতে আমি বুঝিয়েছি যে, এখন আর শুধু একজন নেতৃত্বের ভয়েই আমরা কাবু না, বরং এমন এক অনুশাসন জারি হয়েছে, এমন এক মন্ত্রমুগ্ধ জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে যারা সংখ্যালঘুদের জন্য রাস্তায় মূর্তিমান আতংক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সন্ত্রাস এখন আর সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সন্ত্রাস এখন মামুলি ব্যাপার। ঘটনার পর ঘটনা আমরা দেখছি। হানা আরেন্ট হয়তো এর ভালো ব্যাখ্যা করতে পারতেন। উত্তর ভারতের একটি সাধারণ স্কুলের শ্রেণিকক্ষের দৃশ্য সারা পৃথিবী দেখেছে, যেখানে একজন শিক্ষক, স্কুলের অধ্যক্ষ সাত বছরের এক মুসলমান ছাত্রকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, আর ক্লাশের সব ছাত্ররা এসে তাকে থাপড়াচ্ছে।
আমাদের মণিপুরে গৃহযুদ্ধ চলছে। রাজ্য সরকার সেখানে পক্ষপাতদুষ্ট। কেন্দ্রও এর সঙ্গে জড়িত। নিরাপত্তাবাহিনীর কোনো চেইন অব কমান্ড নেই। বলকান অঞ্চলে যা ঘটেছে তার সঙ্গে এর মিল হতে শুরু করেছে। আমরা নারীদের নগ্ন করে হাঁটাতে এবং গণধর্ষণের দৃশ্য দেখেছি। আমরা জেনেছি যে মণিপুরের পুলিশই নারীদের দাঙ্গাকারীদের হাতে তুলে দিয়েছে।
আগেই যেমন বলেছি, হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা, খুনিরা, মুসলিম যুবকদের পুড়িয়ে মারা নরঘাতকেরা এখন ধর্মীয় মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমরা এখন এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে আছি যখন স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী নারীর অধিকার নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে বিলকিস বানুকে গণধর্ষণ এবং একই পরিবারের ১৪জন সদস্যকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ১৪ ব্যক্তিকে তার সরকার ক্ষমা করে দিচ্ছে। আর এখন তারা সমাজের সম্মানিত সদস্য। এরা সেইসব মানুষ যাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল।
তাই আমরা এমন পরিস্থিতিতে আছি যেখানে সংবিধান কমবেশি অকার্যকর, একপাশে সরিয়ে রাখা। তারা যদি পরের বছর নির্বাচনে জয়ী হয়, তাহলে ২০২৬ সালে, যাকে আমরা বলি “সীমানির্দেশকরণ”, যা এক ধরনের জেরিম্যান্ডারিং (নির্বাচনে কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে অন্যায় সুবিধাদানের জন্যে অসদুপায় অবলম্বন করা) যেখানে আসনসংখ্যা এবং নির্বাচনী এলাকার ভূগোল পরিবর্তন করা হবে, এবং হিন্দু ভাষী অঞ্চল যেখানে বিজিপি শক্তিশালী, তারা বেশি ভোট পাবে, যা প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার ভারসাম্যকে বদলে দেবে। দক্ষিণ অবশ্যই এ নিয়ে খুব খুব উদ্বেগে পড়বে। তাতেও বলকানাইজেশনের (বলকানাইজেশন হলো একটি বৃহত্তর অঞ্চলকে ছোট ছোট অঞ্চলে ভাগ করা, যাতে একে অপরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হতে পারে) ক্ষমতা ও সম্ভাবনা বাড়বে।
আমরা এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি, আপনারা জানেন, আমরা এক জাতি, এক ভাষা, এক নির্বাচনের কথা বলছি। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে, আমাদের এখন এক স্বৈরশাসক, এক কর্পোরেশন। আমাদের কর্পোরেট প্রধান মোদীর পুরনো বন্ধু, সেই গুজরাট ঘটনার সময় থেকেই। যিনি শুধু শর্ট-সেলিং কোম্পানি, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চে অভিযুক্ত নন, এখন সাংবাদিকদের একটি সম্পূর্ণ জোট, যারা সংগঠিত অপরাধের প্রতিবেদন করে, তারা তাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কর্পোরেট কেলেঙ্কারী হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
কিন্তু, এতেও কিছুই হবে না। তাই আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে আছি যেখানে বিশ্বকে মূল্যায়ন করতে হবে আইন যদি কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয় এবং অন্য লোকের ক্ষেত্রে ভিন্নভাবে প্রযুক্ত হয় তাহলে কী ঘটে। সব আইনই। আপনারা জানেন, আমাদের আইনের বিধিবিধান আছে। আমাদের অত্যন্ত পরিশীলিত একটি আইনশাস্ত্র আছে। কিন্তু, এর প্রয়োগ এখন নির্ভর করে কারো ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণী নির্ধারণের ওপর। যা খুবই বিপজ্জনক একটি ব্যাপার।
ভারতের বর্তমান অবস্থা?
ভারত এখন খুবই অনিশ্চিত, খুবই সংঘাতময়। বিজেপি এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাজনৈতিক দল। সব নির্বাচনী যন্ত্রই কম-বেশি আপসমূলক। তবুও এক প্রকার বিরোধীশক্তি এখন গড়ে উঠছে। এটা শুধু সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার কারণে নয়, যা অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের বিরোধীতার কারণ শুধু নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য নয়, বরং বেকারত্বের কারণেও। আমরা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ অসম সমাজে বাস করি। অসমতার ফলেই এই বিরোধিতা গড়ে উঠছে। এই সরকার একেও পিষে ফেলতে চাইছে, কারণ, তারা কোনো বিরোধিতাই সহ্য করতে পারে না।
আমরা এখন একটা বিশাল পরিবর্তন-প্রবাহের মধ্যে আছি। আমরা আশা করি না যে, ভারতের বাইরের কেউ ভারতের জন্য দাঁড়াবে। ভারতের বাইরের কেউ ভারতের এসব পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্যও করবে না। কারণ, তাদের দৃষ্টি ডলারের দিকে নিবদ্ধ। এখানে এক বিলিয়ন মানুষের বিশাল বাজার। কিন্তু, এই দেশ যদি যুদ্ধ আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে তাহলে বাজার বলে আর কিছু থাকবে না। যেরকমটা এর মধ্যেই মনিপুরে শুরু হয়েছে। তারা বুঝতে পারছে না যে, এই বিশাল দেশটি যখন বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়বে তখন আর এই বাজারের অস্তিত্ব থাকবে না। ভারতের সৌন্দর্য আর মহিমাকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র করে ফেলা হচ্ছে, হিংস্র নখদন্তের কামড়ে-আঁচড়ে একে ছিন্নবিছিন্ন করে ফেলা হচ্ছে। যখন এটি বিস্ফোরিত হবে, এর মতো ভয়ঙ্কর আর কিছু হবে না।
©somewhere in net ltd.