নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার মনের খাতা

কবি কালিদাশ

মনের কথা নিজের মত করে বলতে চাই

কবি কালিদাশ › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার তুমি [আজ তৃতীয় তথা শেষ পর্ব]

২৫ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:১০

প্রথম পর্বের লিঙ্কঃ Click This Link
দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্কঃ Click This Link


দ্বিতীয় পর্বের পর...

নীলা আমার কথার কোন জবাব না দিয়েই চলে গেল। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। গোটা বাড়িতে জোর কদমে বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। মেঘনা আমাকে তার বন্ধু বান্ধবীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। তারা তো সবাই আমাকে দেখে অবাক। মেঘনার মুখে, আমাকে নিয়ে আলাদা একটা উচ্ছাস দেখতে পেলাম। তারও যে একটা বাবা আছে, সেটা নিজের বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজনদের দেখিয়ে, সে যেন অনেক বেশি খুশি। আমিও খুব খুশি হলাম, এতদিন পর, নিজের মেয়ের সাথে এতটা সময় কাটিয়ে। অবশেষে সন্ধ্যা নেমে এল, বিয়ের প্রস্তুতি তুঙ্গে, সেই সময় হঠাৎই আমার দরজায় নক। দরজা খুলতেই দেখি, বিয়ের সাজে, আমার মেয়ে মেঘনা দাড়িয়ে আছে। ওকে দেখে, আমি ভাষা হারিয়ে ফেবা, একটু ভিতরে আসতে দেলেছি। কিছু বলতে পারছি না। মেঘনাই বলল,
-“বাবা? তোমার সাথে কিছু কথা ছিল”।
আমি দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ওকে ভিতরে আসতে দিলাম। ও বলল,
-“দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এদিকে এসো বাবা”।
আমি দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে, মেঘনার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
-“বল মা, কি বলবি”।
-“বাবা, আজকে আমার বিয়ে। সেই কোন ছোটবেলায় তোমার থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছি। তারপর আজ আবার তোমাকে কাছে পেয়েছি। কত ঝড় ঝাপ্টা গেছে আমাদের উপর দিয়ে জানো। তোমাকে কত মিস করেছি বাবা। সবার বাবারা তাদের মেয়েকে কত আদর করে, কত গিফট দেয়। কিন্তু আমার বাবা, থেকেও, আমার কাছে নেই। আমি তোমাকে খুব মিস করেছি বাবা”।

কথা গুলো বলতে বলতে কান্নায় মেঘনার গলা জড়িয়ে এল। আমরা নিজেকে সমালাতে পারলাম না। ওর সাথে আমিও কেঁদে ফেললাম,
-“হ্যাঁ রে মা। জানি তো। আমার ছোট্ট পরীটা, যে রাতে আমাকে ছাড়া ঘুমোতে পারত না, তার আমাকে ছেড়ে থাকতে কত কষ্ট হয়েছে। কিন্তু কি করব বল মা। সবই ভাগ্যের পরিহাস। পারলে তোর এই অসহায় বাবাটাকে ক্ষমা করে দিস মা”।
-“এ তুমি কি কথা বলছ বাবা। এই কুড়ি বছরে তোমাকে যতটা মিস করেছি, আজকে তার সবটা সুদে আসলে তুলে নিয়েছি। সবাইকে আমি দেখিয়ে দিয়েছি, তুমিই আমার বাবা। আমার বাবা আছে। আমার কাছেই আছে”।
-“হ্যাঁ রে মা, হ্যাঁ। সবাইকে বলবি তুই, আমিই তোর বাবা”।
বাপ বেটিতে আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পরলাম। তারপর মেঘনা কান্না থামিয়ে বলল,
-“বাবা, জানত! মা না তোমার জন্য এখনো রাতের বেলা কাঁদে। সবাইকে উপরে উপরে দেখায়, তোমাকে কত ঘৃনা করে। কিন্তু মা আজও, শুধু তোমাকেই ভালবাসে বাবা।”
মেঘনার কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নীলা আজও আমাকে ভালবাসে? আমি মেঘনাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম,
-“তোর মাকে দেখলাম, শাঁখা, সিন্দুর পরে আছে, তোর মা কি আবার....”
আমি কথা শেষ করার আগেই মেঘনা বলে উঠল,
-“না বাবা, না। তোমাদের ডিভোর্স হওয়ার পরে, মা আর কাউকে বিয়ে করেনি। মা শুধু তোমাকেই ভালবাসে বাবা। সেই জন্যে, এখন তোমার কথা ভেবে শাঁখা, সিন্দুর পরে। বাবা, এত দিন মায়ের সাথে আমি ছিলাম, তাই মায়ের অনেক জোড় ছিল। কিন্তু আমার বিয়ে হলে পরে, মা ভিষন একা হয়ে যাবে। তখন মায়ের কি হবে বাবা? তুমি মাকে একটু দেখ।”
-“কিন্তু তোর মা কি আমার কথা শুনবে?”
-“কেন শুনবে না। তুমি মাকে বলে দেখ, অন্তত একবার বলে দেখ, আমার জন্যে”।
-“আচ্ছা ঠিক আছে, বলে দেখব”।

মেঘনার মুখে বাচ্চাদের মতো হাসি খেলে গেল। ও আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে, ঘরের কাবাড খুলে, সেখান থেকে একটা শেরওয়ানী বের করে নিয়ে এল।
-“এটা কার শেরওয়ানী জানো বাবা?”
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,
-“কার?”
-“তোমার”

আমার মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল,
-“আমার?”
-“হ্যাঁ বাবা। আর এটা কে কিনেছে জান?”
-“কে?”
-“মা কিনেছে। তোমার জন্য। আমার বিয়েতে তুমি এটা পরবে”।

মেঘনার কথা শুনে আমি তো অবাক। নীলা আমার জন্য শেরওয়ানী কিনেছে? মেঘনা কি সত্যি বলছে নাকি আমার সাথে মজা করছে।
-“বাবা, এই শেরওয়ানীটা পরে বাইরে এসো। সবাই অপেক্ষা করছে”।
শেরওয়ানীটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষন বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। নীলা! নীলা আমার জন্য শেরওয়ানী কিনেছে? ভাবতে পারছি না। বেশি সময় নষ্ট না করে শেরওয়ানী পরে বাইরে এলাম। আমাকে দেখে তো সবার চোখ ছানাবড়া। মেঘনা যেখানে বসে ছিল, সেখানে যেতেই, ও চোখ দিয়ে আমাকে ইশারা করে বলল, “তোমাকে হেব্বি লাগছে”। আমি উত্তরে একটু হাসি দিলাম। হঠাৎই দেখি, নীলা আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ও বেশ চিন্তায় পরেছে, আমাকে শেরওয়ানী পরে দেখে, আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম,
-“জিনিসটা আমার পছন্দ হয়েছে। থ্যাঙ্কস”।
ওর চোখে তখন অবাক বিস্ময়। কি বলবে বুঝতে পারছে না। আমি ওকে আরো অবাক করে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলাম। একটু পরেই বড় চলে এল। তাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে গেল। তারপর বিয়ে শুরু হল। মেঘনার সম্প্রদান আমিই করলাম। দেখতে দেখতে আমার মেয়েটা অন্যের হয়ে গেল। পরদিন সকালে মেঘনা ওর বরের সাথে চলে গেল। যাওয়ার আগে, আমাকে ওর কথাটা মনে করিয়ে দিতে ভুলল না। আমিও, নীলাকে দেওয়া কথা রাখতে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। যাওয়ার আগে একবার নীলার সাথে দেখা করতে হবে। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ প্রথম দিনের সেই কাজের ছেলেটির সাথে দেখা। তার কাছে নীলার কথা জিঞ্জেস করতেই সে বলল, নীলা, উপরে চিলে কোঠার ঘরে আছে। আমি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতেই, চাপা কান্নার আওয়াজ পেলাম। একটু এগিয়ে যেতেই দেখি, নীলা মাটিতে বসে কাঁদছে। আমি একটু সময় নিলাম, তারপর শান্ত চাপা স্বরে ডাকদিলাম –“নীলা”
ও আমার দিকে ঘুরে তাকাল। দেখলাম, ওর দু চোখ বেয়ে জল পরছে। আমাকে দেখেই নিজের চোখের জল মোছার চেষ্টা করল। আমি এগিয়ে গিয়ে ওর পাশেই মাটিতে বসে পরলাম। ও তখনো নিজেকে সম্বরণ করার চেষ্টা করছে। ওদের চিলে কোঠা থেকে আকাশটা খুব সুন্দর দেখা যায়। আমি সেই দিকে তাকিয়ে বললাম –
“তোমার সেই দিনটার কথা মনে আছে নীলা, যেদিন মেঘনার জন্ম হয়েছিল?”
নীলা কোন জবাব দিল না। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “Third December Nineteen ninety. দিনটা আমার আজও মনে আছে। কত ছোট্ট ছিল ও। আমি যখন ওকে হাসপাতালে দেখতে যাই, নার্স ওকে আমার কোলে দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি নেইনি। কেন জান? ওত ছোট বাচ্চা, আমার জন্যে যদি ওর কোথাও চোট লাগে। কিন্তু সেই মেঘনারই মনে চোট দিয়েছি আমি, তোমার থেকে আলাদা হয়ে। আর সেটা এমন এক চোট, যেটা কোন মলম বা ওষুধ সারাতে পারে না। কালকে ও যখন আমাকে ওর বন্ধুবান্ধব সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল, ওর মুখের হাসি দেখে আমি বুঝতে পারলাম, গত কুড়িটা বছরে আমি কি হারিয়েছি।” কথাটা বলে নীলার দিকে ফিরে তাকালাম, সে দেখি মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর দিকে ফিরে থেকেই বললাম, -“গত কুড়ি বছরে আমি শুধু আমার মেয়েকে না। আমার ভালবাসাকেও হারিয়েছি। প্রতিটা পদে পদে, তাকে শূণ্যতা অনুভব করেছি। কিন্তু আমি, আমার বাকি জীবনটা আর একা থাকতে চাইনা। অনেক তো মান, অভিমান, ঝগড়া ঝাটি হল; ভালবাসাটা কি হতে পারে না?”
কথা গুলো নীলার চোখের দিকে তাকিয়েই বলছিলাম, তাই দেখলাম, আমার শেষ কথাটা শুনে সে আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল? আমি তার চোখের দিকে তাকিয়েই বললাম,
-“আমি ভুল করেছি নীলা। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি আর একা থাকতে পারছি না। প্লিজ তুমি ফিরে চল”।
নিরবতা ভেঙ্গে নীলা বলল,
-“ফিরে যাব? কোথায় ফিরে যাব? তোমার বাড়িতে? যে বাড়ি ছেড়ে একদিন বেরিয়ে এসেছিলাম?”
-“দোষটা কি শুধু একা আমার নীলা? একটা ছোট ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। তার জন্যে তুমি, আমাকে ছেড়ে, আমার সংসার ছেরে চলে এলে। মা তোমাকে কত করে বোঝাল, তবুও ফিরলে না...”
-“কই তুমি তো আমায় একদিনের জন্যেও বোঝাতে আসোনি, তুমি তো আমায় একবারও বলনি, নীলা ফিরে এসো?”
-“সেটাই তো আমার ভুল ছিল। জেদের বসে তোমাকে বলেনি। জেদের বসে তোমাকে ডিভোর্স দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি বিশ্বাস কর, তোমার প্রতি আমার ভালবাসা আজই একই আছে। আর আমি এটাও জানি, তুমিও আমাকে ভালবাস”।
-“কে বলল তোমাকে এই কথা?”
-“সব কথা সবাইকে বলতে হয় না। নিজেকেও অনেক সময় বুঝে নিতে হয়। আর আজ এত বছর পরেও আমি সেটা বুঝতে পারছি।”

কথাটা বলেই আমি নীলার ডান হাতটা ধরলাম। দেখলাম ও আমার হাতটা সরিয়ে দিল না। ওর হাতে দেখি, আমার মায়ের সেই সোনার বালাটা রয়েছে। যে দুটো আমি ওকে বিয়ের আগে দিয়েছিলাম। আজও সেই একই রকম সুন্দর আছে জিনিসটা। আমি ওর হাতটা তুলে বললাম,
-“জিনিসটা তুমি আজও যত্ন করে রেখেছ। আর বলছ, আমাকে তুমি ভালবাস না?”
নিজের অজান্তেই চোখের কোনায় জল চলে এল। আমি ওকে বললাম,
-“নীলা, আমরা একে অন্যেকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। বয়েস হচ্ছে। আমি আর কষ্ট সহ্য করার মতো অবস্থায় নেই। মা তো অনেক দিন আগেই আমায় ছেরে চলে গেছে। তুমি আর মেঘনাই আমার ছিলে। দূরে থাকলেও, ছিলে তো, আজ তো মেঘনাও অন্যের হয়ে গেল। এই বুড় বয়েসে, একা থাকতে আর ভাল লাগে না। তোমার উপরে আর রাগও করতে পারি না আমি”।
-“কিন্তু আমি তো পারি। তুমি চিরকালের বোকা লোক। কুড়ি বছর আগে যখন ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছিলাম, তখন তাতে সই না করে, আমাকে এসে নিয়ে যেতে পারোনি তুমি? কুড়িটা বছর সজল, কুড়িটা বছর। আমি কি ভাবে কাটিয়েছি, তা শুধু আমি জানি।”

নীলার চোখে জল। ঝরঝর করে ও কাঁদছে। এই কান্না ভালবাসার কান্না। এই কান্না, অল্প বয়েসে করা ভুল গুলোর কান্না। এই কান্না, রাগ, দুঃখ, অভিমানের কান্না। আমি এগিয়ে গিয়ে, ওর মুখটা তুলে ধরলাম। এই নীলাকে আমার বড় চেনা মনে হল। এই নীলা, আমার সেই নতুন বিয়ে করা বৌ নীলার মতো। একটু অভিমানী, একটু জেদি, কিন্তু আমাকে সে অনেক ভালবাসে। কাঁদতে কাঁদতেই সে আমার উপর ঝাপিয়ে পরল। প্রায় কুড়ি বছর পর, আমি আমার নীলাকে কাছে পেলাম। ভাবতেই অবাক লাগছে। আমাদের মাঝের রাগ, দুঃখ, অভিমান, সব ভ্যানিস। ভালবাসার জোর বোধহয় একেই বলে।

[সমাপ্ত]

প্রথম পর্বের লিঙ্কঃ Click This Link
দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্কঃ Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.