নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যা মানবতা বিরোধী তাই পরিত্যাজ্য মানবের সাধনা হোক মনুষ্যত্ব লাভ।
৪র্থ পর্ব
(৫)
সাল ১৯৯১, এপ্রিল মাসের ২৬ তারিখ। সময়টা গ্রাম্য জনপদে জন্য এমনিতেই আনন্দের।নতুন ধান কাটা পড়েছে,চারদিকে উৎসব মুখর পরিবেশ।বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য বেশ বড় আকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাঁচা পাকা ধানের অন্য রকম গন্ধ চারপাশে ।সিদ্ধ ধানের মাতাল ঘ্রান, কৃষাণ কৃষাণীর ব্যস্ততা, গরুর গাড়ির ছন্দোবদ্ধ ক্যাঁচর কোঁচড় আওয়াজ, ঢেকিতে রাত কী দিন বিরামহীন ধাক কুড় কুড় পাড়ের শব্দ গ্রামীন জনপদে নতুন প্রাণের জোয়ার এনেছে ।ঘরে ঘরে নবান্ন। পিঠা পুলির আয়োজন। দারুণ খুশির সময় সকলের জন্য ।
তবে মোল্লাবাড়িতে খুশির মাত্রা একটু বেশি। কাশেম মোল্লা অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ। তার ছোট ছেলের বিয়ে আসন্ন। এটাই তার শেষ কাজ। তাই আড়ম্বরটাও বেশি।
বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি ভর্তি লোকজন গিজগিজ করছে , তিল ধারণের ঠাই নাই কোথাও।
হৈ হুল্লোড় ,বাজি, পটকা, রঙ, কাঁদামাটি মাখামাখি কি বাদ আছে এ সময়ে তাই ভাবনার বিষয়।
অন্দরমহলে চলছে ভিন্ন আয়োজন। মেয়েরা কে কোন পোষাক পরবে,গায়ে হলুদ আর বিয়েতে, কোন গহনা কার সাথে মানাবে তাই নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত ।
এদিকে শহর থেকে মাইক ভাড়া করে এনেছে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী ছেলে ছোকড়ার দল । সেই মাইকে চলছে বাংলা সিনেমার গান। মাইক বাঁধা হয়েছে সবচেয়ে উঁচু শিমুল গাছটার মাথায়।দুরবর্তী কয়েকগ্রাম পর্যন্ত সেই গান বাতাসে বেড়াচ্ছে।
সাথে টুনি বাল্ব,জেনারেটরের ব্যবস্থাও আছে ।এসবে কাশেম মোল্লার আপত্তি ছিল কিন্তু তাঁর আপত্তি এক্ষেত্রে ধোপে টেকেনি। ছেলে ছোকরারা দলে ভারি,সাথে গুটিকয়েক মুরুব্বিও যোগ দেওয়াতে কাশেম মোল্লার কথা বেনো জলে ভেসে গেছে।
এত আড়ম্বর তার মধ্যে একটা খবর জানতে পেরে কাশেম মোল্লার কপালে দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দিয়েছে। আকাশ ঘন মেঘে ছেয়ে আসছে। বাড়ি ভর্তি লোকজন,এত লোকের দায় দায়িত্ব , তার মধ্যে শোনা যাচ্ছে উপকূলের দিকে দারুণ শক্তিশালী এক ঝড় ধেয়ে আসছে।
সাবধান হতে হবে দ্রত নয়তো বড় আকারের ক্ষতি হয়ে যাবে কিন্তু কেউ ই কথা কানে তুলছে না।
বাড়িতে অতিথি প্রায় সকলে চলে এসেছে অনেকের সাথে অনেকের বহুদিন পরে দেখা। হৈ হুল্লোড় পরস্পর ভাব বিনিময় পুরোদমে চলছে। কারো সাথে ঝড় নিয়ে কথা বলতে গেলেই সে মহা বিরক্ত হচ্ছে। উটকো ঝামেলা মনে করছে, বড় জোর স্বান্তনা দিয়ে বলছে আল্লাহ ভরসা এত ভাবেন কেন মুরুব্বি? ইনশাআল্লাহ সমস্যা হবে না। ঝড় বৃষ্টি তো আল্লাহর নেয়ামত।
কাশেম মোল্লা অভিজ্ঞ মানুষ তিনি বিপদ বেশ খানিকটা আঁচ করতে পারছেন।কিন্তু অন্যরা এসব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাচ্ছে না কেন তা তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। তারা ব্যস্ত আনন্দ উৎসব নিয়ে। মাত্রা ছাড়া আনন্দ ফুর্তি কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না।কে বোঝাবে কাকে?
২৭ এপ্রিল সকাল থেকে বৃষ্টির প্রকোপ বাড়তে লাগলো সেই সাথে বাতাসের গতিবেগ দেখে কাশেম মোল্লা সহ বয়স্কদের টনক নড়ল অচিরেই। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার মত পরিস্থিতি তখন আর নেই।কারণ আশ্রয় কেন্দ্রটি অনেকটা দুরে, বাড়ি ভর্তি শ’দুয়েক লোক। এত লোক...
তারপর আলোচনা করে ঠিক করা হলো মেয়ে আর বাচ্চাদের না হয় পাঠিয়ে দেওয়া যাক আশ্রয়কেন্দ্রে।
কিন্তু উথাল পাতাল ঝড় চারপাশটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে ঝড়ের গতি বাড়ছে খুব দ্রুত । হুশ হাশ শব্দে গাছের ডাল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক ঝটকায়। বৃষ্টি আর সেই সাথে শো শো ভয়ংকর আওয়াজ। অচিরেই আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার ভাবনা বাদ দিতে হলো। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করলো খুব শিঘ্রি।
এতক্ষণে সবাই কমবেশি পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন ভরসা নিয়তির উপর। এছাড়া কিছু করার নেই সম্ভবত ।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে
মেয়ে আর শিশুদের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ঘরে রাখা হলো আর পুরুষেরা আলাদা ঘরে। বাতাস এত জোরে বইতে লাগলো যে দশ ইঞ্চি পুরু পাকা দেওয়াল গুলো থরথর করে কাঁপতে লাগলো বাড়ি খেয়ে।
ঘর সংলগ্ন টিনের চালগুলি প্রতি মুহুর্তে মনে হতে লাগলো এই বুঝি উড়ে গেলো।বাড়তি সাবধানতার জন্য টিনের চালগুলো গরু বাধা মোটা মোটা দড়ি দিয়ে বেধে রাখা হলো। জানালার কপাটের খটখট ভীতিকর আওয়াজ সহজেই ভয় ধরিয়ে দিলো ছোট বড় সকলের। কিভাবে যেন একটা জানালার পাল্লা খুলে নিমেষে বাতাসে ভাসতে ভাসতে উড়ে চলে গেল আর ঘরের মধ্যে ঝড়ো হাওয়া হু হু করে ঢুকতে লাগলো প্রচন্ড গতিতে।
বাচ্চারা হাঁউ মাঁউ করে কাঁদতে লাগলো।অনেক মহিলাও ভয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। মুরুব্বিরা দোয়া দরুদ পড়তে লাগলেন জোরে জোরে। কাশেম মোল্লা সুউচ্চ স্বরে আযান দেয়া শুরু করতে পাশের পাড়া থেকে কেঁপে কেঁপে বাতাসের তালে তালে শঙ্খধ্বনি বেজে উঠলো।
মহাবিপদ! মহা বিপদ!!
অনেক দিন এমন ঝড় দেখেনি তারা কেউই।তাই ঝড় আসছে জেনে গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি প্রথমটায়।
পারিবারিক জরুরি কাগজ দলিল দস্তাবেজ, গহনা ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিস কয়েক স্তরের পলিথিন মোড়কে মুড়িয়ে মাটির গভীরে পুঁতে রাখা হলো।
রাতে জলোচ্ছ্বাস হতে পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা।
টর্চ,ব্যাটারি প্রাথমিক চিকিৎসার বাক্স নিরাপদে রাখা হলো।
এর মধ্যে ঝড়ের গতি আরো ভয়ঙ্কর হলো সন্ধ্যার পর পর নদী ফুলে উঠলো।
মেয়েরা যে ঘরে ছিল, যে ঘরটিকে অপেক্ষাকৃতভাবে সবচেয়ে নিরাপদ মনে হয়েছিল সেটির চাল এক ঝটকায় উড়ে চলে গেলো সন্ধ্যার কিছুটা পরে । ভয়ে আতঙ্কে মেয়েরা এদিকে ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলো,শিশুদের অবস্থা আরো্ খারাপ। ভালো করে খেয়াল করলে সে সময় দেখা যেত আকাশে গাছের মোটা মোটা ডাল,টিনের চাল ঘরের তৈজসপত্র এমনকি মানুষও উড়ে যাচ্ছে।
মোল্লা বাড়িতে অবস্থানকারী অনেককেই এ সময় মারাত্মক ঝড়ো বাতাস ও জলোচ্ছ্বাসে উড়িয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। সারারাত ধরে চলল দূর্বিষহ তান্ডব।
প্রতিটি প্রণিই ক্ষতি গ্রস্ত হলো নির্মমভাবে। মাঠ ফসল , পশু পাখি গাছ লতাপাতা কেউ রক্ষা পেল না।
পরের দিনটা ছিল আরো ভয়াবহ।, চারিদিকে শুধু প্রাকৃতিক তান্ডবলীলার চিহ্ণ আর মৃত্যু। এত মৃত্যু দেখেনি কেউ আগে। কোন কিছু আর আস্ত নেই, ভেঙেচুরে তছনচ করে,কাদা পানিতে মাখামাখি মানুষ গৃহপালিত পশু, বনে পাখি পশু সব, যত্র তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে মরে পড়ে আছে। কোথাও কোন সাড়া নেই, আকাশে শকুণেল দল ঝাকে ঝাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সময়টা এখন তাদের।
যারা বেঁচে আছে তারাও যেন নিস্প্রাণ অসাড়।
তবুও জীবনের ধর্ম বয়ে চলা। দিন শেষে আবার বাঁচার তাড়নায় একটু একটু করে প্রাণের স্পদন ফিরে আসতে লাগলো সমস্ত চরাচরে। আবার কর্ম চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো জনজীবনে। প্রকৃতিতে।
অনেকটা পরে জানা গেলো মোল্লা বাড়ি থেকে মোট নয়জন হারিয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে। এদের মধ্যে বেশির ভাগ মেয়ে আর শিশু। কাশেম মোল্লার ছোট ভাইকে দুই পা ভাঙা অবস্থায় তিনদিন পরে পাওয়া গেলে পাঁচ মাইল দূরে জগন্নাথপুর গ্রামে। বাকিদের বিস্তীর্ণ মাঠ,বাড়িঘর,গাছের মগডাল কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। তারা যেন উবে গেছে।
কাশেম মোল্লার ছোট নাতনি কামরুন্নাহারেরও আর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না।
কামরুন্নাহারের মা জুলেখা বানু পাগল প্রায় হয়ে গেলেন মেয়ের শোকে। সেই সাথে রওনক শিকদারও।রওনক শিকদারের নিকার বউ জুলেখা বানু অতি আদরের তার কষ্টে এই দোর্দন্ড প্রতাপশালী রওনক শিকদারের জীবনে শোকের ছায়া নেমে এলো অচিরেই। তিনি ঘোষণা দিলেন জীবিত বা মৃত যে কামরুন্নাহারের খোঁজ এনে দিতে পারবে তাকে পুরস্কৃত করা হবে।
চলবে
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
ছবিঃ গুগোল
ফুটনোটঃ পরভৃত ১. /বিশেষণ পদ/ পরপুষ্ট, পরের দ্বারা প্রতিপালিত। ২. /বিশেষ্য পদ/ পরের দ্বারা প্রতিপালিত এইজন্য. কোকিল। /পর+ভৃত/। /বিশেষণ পদ/ স্ত্রীলিঙ্গ. পরভৃতা।
গল্পটি সাত পর্বে সমাপ্ত। আশা করি সবাইকে পাশে পাবো। শুভকামনা।
২৫ শে মার্চ, ২০২১ বিকাল ৪:৪৮
ইসিয়াক বলেছেন: মন্তব্যে অনুপ্রেরণা পেলাম।
শুভকামনা জানবেন।
২| ২৩ শে মার্চ, ২০২১ সকাল ১১:৩৫
কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: পরের পর্বের অপেক্ষায়
২৫ শে মার্চ, ২০২১ বিকাল ৪:৪৯
ইসিয়াক বলেছেন: রবিবার পোস্ট দেবো আপু।
ভালো থাকুন সবসময়।
৩| ২৩ শে মার্চ, ২০২১ দুপুর ১:২৩
রাজীব নুর বলেছেন: যেহেতু ধারাবাহিক, তাই একই ছবি ব্যবহার করবেন। একেক পর্বে একেক ছবি থাকলে পাঠক বিপাকে পড়তে পারে।
২৫ শে মার্চ, ২০২১ বিকাল ৪:৪৯
ইসিয়াক বলেছেন: ঠিক আছে বন্ধু
৪| ২৩ শে মার্চ, ২০২১ বিকাল ৪:৩০
করুণাধারা বলেছেন: কামরুন্নাহার কে নিয়ে কিছু রহস্য আছে। দেখি পরের পর্বে কী বলেন।
দেরি না করে পর্ব দিচ্ছেন, অনেক ধন্যবাদ।
২৫ শে মার্চ, ২০২১ বিকাল ৪:৫০
ইসিয়াক বলেছেন: আপু ইনশাআল্লাহ রবিবার পোস্ট দেবো।
ভালো থাকুন সবসময়।
৫| ২৮ শে মার্চ, ২০২১ রাত ১১:৪২
পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: আগেই পড়েছি। কমেন্ট করা হয় নি। যদিও সর্বশেষ পর্বও পড়া হয়েগেছে।
ঠিক আছে গল্প এগোচ্ছে।
শুভেচ্ছা জানবেন।
২৯ শে মার্চ, ২০২১ রাত ৯:৩৬
ইসিয়াক বলেছেন: যাক কিছুটা চিন্তা মুক্ত হলাম।
শুভ কামনা রইলো প্রিয় দাদা।
৬| ০২ রা এপ্রিল, ২০২১ রাত ২:১৩
মা.হাসান বলেছেন: রওনক শিকদারের বাবার নাম জানা গেলো। মোল্লার ছেলে শিকদার কেনো তা জানা গেল না। সাধারণতঃ এই শ্রেণীর লোকেরা নামের বিষয়ে খুব অহংকারি হয়।
৯১এর সাইক্লোন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর সাইক্লোন। লক্ষাধিক লোক মারা গিয়েছিলো। ঐ সাইক্লোনে স্বজন হারা অনেকেই উপকূল এলাকায় এখনো ভলান্টিয়রের কাজ করে চলেছেন। ফ্ল্যাশব্যাকে অনেক কিছভু দেখিয়ে দিলেন। দেখা যাক পরের পর্বে কি হয়।
কুমিরের জন্য চিন্তা হচ্ছে। গাছে ঝুলতে যেয়ে চিৎপটাং হলো না তো।
©somewhere in net ltd.
১| ২৩ শে মার্চ, ২০২১ সকাল ১০:১২
জুল ভার্ন বলেছেন: ভালো লাগলো।