নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যা মানবতা বিরোধী তাই পরিত্যাজ্য মানবের সাধনা হোক মনুষ্যত্ব লাভ।
(১২)
আমার জীবনটা যত রকম ঘটনা বা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে তা সম্ভবত খুব কম মানুষের জীবনেই ঘটেছে। সবচেয়ে বড় কথা আমার জীবনের অনেক ঘটনাই অতি নাটকীয়তা ভরা।
নিরিবিলিতে ভাবতে বসলে মাঝে মাঝে কোন কোন ঘটনা নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হয়।
জীবনের এই যে এতগুলো বছর কাটালাম। পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখি মনে হয়,যত যাই ঘটুক না কেন একেবারে মন্দ কাটেনি জীবনটা। আসলে জীবনের সৌন্দর্য এখানেই।
এটা সত্য আমি অনেক সম্পদ ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বাড়ি গাড়ির মালিক হতে পারিনি। আমি এক বাক্যে বড় গলায় বলবো অনেক বড় কিছু হয়ে মানুষকে দেখিয়ে দেবো।ফাটাফাটি জীবন কাটাবো এমন সাধ কখনও আমার মনে জাগেইনি।
কোন কাজে আমার একাগ্রতার কমতি থাকলে সফলভাবে কোন কাজ সম্পন্ন করার ক্ষমতা আমার আছে সেই বিশ্বাসটুকু আমার আছে।
আসলে নিতান্ত সাধারণ থাকতে চেয়েছি সবসময়।অসাধারণ হয়ে ওঠার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হতে কখন আমার ইচ্ছে হয়নি। সবার তো সাধ একরকম নয়।আসলে আমার মতো আমি।
তবে আন্তরিকভাবে মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছি নিজের সাধ্যের মধ্যে থেকে। উল্লেখযোগ্য কিছু একটা করতে পারিনি বলে আফসোসটা বয়ে বেড়াই একথাও সত্যি ।আসলে একজীবনে অনেক কিছু করার ছিল।
একসময় বিলাসী জীবনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সব ছেড়ে চলে এসেছি এক বস্ত্রে। আজ অবধি শত প্রলোভনেও সে জীবনে ফিরে যাইনি।
এর প্রধান কারণ অস্থির অসুস্থ জীবনযাপন আমার কোনকালে পোষায়নি।
এটা সত্য আমি অতিরিক্ত চাপ কখনও নিতে পারি না।টার্গেট বাঁধা জীবন আমার কাছে অসহ্য লাগে।
একটা আপাত অবিশ্বাস্য কথা হচ্ছে। আমি একসাথে অনেকগুলো টাকা কখনও একবারে গুনে শেষ করতে পারি না।কি যে অনীহা জাগে।টাকা পয়সা আমার যে লাগে না তা কিন্তু নয়।
কিন্তু টাকাপয়সা আমায় আকর্ষণ করে না আর তাই বুঝি হিসাব নিকাশ আমার কাছে কিছুটা বিরক্তিকর আবার কিছুটা জটিল মনে হয়।
এজন্য আমাকে কখনও কখনও ভুগতে হয়েছে। তারপরও আমি ভালো আছি, শান্তিতে আছি।
যাহোক এ প্রসঙ্গে আজ আমার জীবনের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল
এক ঝুম বরষার সকালে সুফিয়া এবং তার নানী জয়নব খালা ভিজতে ভিজতে আমার কর্মস্থলে এসে পৌঁছলো।
জয়নব খালাকে আমি ছোট বেলা থেকে চিনি।তিনি আমার নানীবাড়িতেই মানুষ। আমার নানাজান তাকে ছোটবেলাতেই যশোর রেলস্টেশন থেকে কুড়িয়ে এনেছিলেন।উনি না-কি সেই বয়সে খাবারের জন্য স্টেশনে ভিক্ষা করছিলেন।এরপর কেউ তাঁর খোঁজ খবর না করাতে সেই থেকে তিনি নানাজানের সংসারেই থেকে গিয়েছিলেন।নানীজানের ফাই ফরমাইস খাটাই তাঁর জীবনের ধ্যান জ্ঞান ছিল।আসলে ভাতের খিদে বড় খিদে, এ খিদে এড়ায় সাধ্য কার।
যাহোক বয়সকালে আমার নানীজান জয়নব খালার বিয়ের ব্যবস্থা করেন।ছেলেটিও ভালো ছিল ।তারই ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে ঘর সংসার করে থিতু হন তিনি।
সবচেয়ে বড় কথা সে দাসীর জীবন ছেড়ে নিজের একটা সংসার পেয়েছিল।রবিও পরবর্তীতে রাজমিস্ত্রী হিসাবে ভালোই নাম কামায়।
একসময় তাদের চার সন্তান হয়। তিন মেয়ে এক ছেলে।বড় মেয়ের ঘরে সুফিয়ার জন্ম।সুফিয়া বেশ লক্ষী ধরনের মেয়ে।এখানে বলা ভালো যে,সে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আমার কাছেই পড়েছে।বেশ মেধাবী মেয়েটি এবং পরিশ্রমী। সে ক্লাস ফাইভে বৃত্তিও পেয়ে আমার সম্মান বৃদ্ধি করেছিল।
সেই সুফিয়া এই ঝড় জলের দিনে তার নানীর হাত ধরে আমার কাছে এসে হাজির। বিশেষ দরকার না থাকলে দূর্যোগের দিনে কেউ এভাবে আসে না।
সাধারণ কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর ওদের বসতে বললাম। বর্ষার মধ্যে স্কুলে ছাত্র ছাত্রী আসেনি।অতএব আপাতত ক্লাস নেই।
জয়নব খালাকে খানিকটা চিন্তিত দেখে আমি জানতে চাইলাম
- কোন সমস্যা খালা?
-মামা! তুমি সুফিয়ার একটা ব্যবস্থা করে দাও।
- কেন কি হয়েছে? কি ব্যবস্থা করবো?
- তুমি ওর মাস্টার ওর বাবা মায়ের মত তুমিই পারবা একটা ব্যবস্থা করতে।
- কেন কি হয়েছে? কি সমস্যা?
- ওর যে লেখাপড়া বন্ধ হবার জোগাড়। তুমি তো বলেছিলে যে কোন মূল্যে ও যেন লেখা পড়া চালিয়ে যায়।
-বই কিনতে হবে?কোন ক্লাসে যেন ও?
জয়নব খালা সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে
- এই ক কোন ক্লাসে যেন তুই। কথা বলিস না ক্যান? বোবায় ধরেছে। ধমকেও ওঠে জয়নব।
আমি নরম সুরে বললাম
- ঠিক আছে আমি দেখছি।কোন ক্লাসে পড় তুমি মা? টেন এ?
- হু দশম শ্রেণি।
- আচ্ছা ।
জয়নব খালা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেন
- ওই বদমাশ আর পড়তে চায় না।
- কেন? পড়াশোনা ভালো লাগে না তোমার?
- লাগে কিন্তু
- কিন্তু কি
- আমি স্কুলের পড়া খুব একটা বুঝি না। ইংরেজি গনিত আর বিজ্ঞান অনেক কঠিন লাগে।
- টিচার আছে?
জয়নব খালা আবারও কথা কেড়ে নিয়ে বলে
- ভাতই জোটে না। আবার মাস্টার রাখবে। তুমি একটু দেখো।তোমার মা কিন্তু সুফিয়াকে অনেক ভালোবাসতো।ওরে লেখাপড়ায় দারুণ উৎসাহ দিতো।সবই নসীব। তোমার মা বেঁচে থাকলে.....
- আমি সব জানি।ঠিক আছে আমি কাল গিয়ে আপনার সাথে দেখা করবো।দেখি কতদূর কি করা যায়,জানেনই তো আমার সাধ্য। এর আগে প্রয়োজনীয় কিছু কথা জেনে নিতে ভুল করলাম না। যা বুঝলাম।সমস্যা অনেক। আমার তেমন সাধ্য নেই তবু কিছু একটা করা দরকার। ওর কিছু বইয়ের অভাব ছিল।পরদিন পুরানো মার্কেটে গিয়ে বইগুলোর দামদর করে এলাম। একটা কোচিং সেন্টারে যোগাযোগ করে বুঝলাম।এখানে মাসিক তিন হাজার টাকা লাগবে।এছাড়া ভর্তি ফি তিন হাজার। বেশ সমস্যায় পড়লাম।সেই সময় নিজের নির্ধারিত আয় থেকে টাকা বের করা সম্ভব ছিল না। কিছু পুরানো বই পত্র ছিল বিক্রি করে দিলাম। ঈদে নিজের জন্য একজোড়া স্যান্ডেল সু কিনবো বলে টাকা রাখা ছিল সেখান থেকে টাকা নিয়ে এক রীম কাগজ কিনলাম।
কাকতালীয়ভাবে ক্লাসটেন এর পুরানে বই জোগাড় হয়ে গেল আমার এক ছাত্রের কাছ থেকে।এবার পড়াশোনা শুরু।অবস্থা বুঝে নিজেই দায়িত্ব নিলাম।কিন্তু যে বস্তিতে ওরা থাকে সেখানে ওদের একটাই ঘর। প্রতিদিন ওকে নিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময় পড়তে বসাই।নাইন টেনে ইংরেজি মোটামুটি বুঝলেও গণিত নিয়ে বেশ বিপদে পড়লাম। রাত জেগে গাইড দেখে গনিত বুঝে বুঝে করি পরদিন আবার ওকে বোঝাই।
এরমধ্যে ওদের ঝুপড়ি ঘরে নতুন অতিথি হাজির।সুফিয়ার মায়ের আরেকটা মেয়ে হয়।এতে নবজাতকের আর দোষ কি? সে তো আসবেই।কিন্তু কোথায় পড়াই। নিতান্ত বাধ্য হয়ে আঁতুড়ঘরেই পড়াশোনা চলতে লাগলো। আঁতুড়ঘরে ঢোকার আবার বিশেষ নিয়ম ছিল।মালসার আগুনে হাত পা ছেঁকে ঢুকতে হতো। তার আগে আমি এক প্রস্থ হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে আসতাম বাড়তি সাবধানতার জন্য । কিন্তু সমস্যা হলো জোরে কথা বলা যাচ্ছিল না। হাঁচি কাশি আসলে তো আরও মুশকিল ।যতই চেপে চুপে সারি, শব্দে বাবুটার ঘুম ভেঙে যায়।সবচেয়ে খারাপ লাগে বাচ্চাটার মা অর্থাৎ সুফিয়া মায়ের জন্য।
আমি থাকাকালীন উনাকে বাইরে বসে থাকতে হয়।না হয় বস্তির অন্য ঘরে আশ্রয় নিতে হয়। দুদিন পরে আমি বললাম এক কাজ করা যাক আমরা না হয় ঘর সংলগ্ন বাইরের খোলা জায়গাতে বসি।কিন্তু সেখানে মলমূত্রের উৎকট গন্ধে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা তৈরি হলো। অবশেষে আমরা আদর্শ স্কুলের মাঠের এক কোনায় পড়ার জায়গা হিসাবে নির্বাচন করি। যদিও....
এদিকে আমাদের বাসাটি ভাড়া বাসা। বাড়িওয়ালা বাসায় বাইরের লোক তেমন এলাও করেন না। বিশেষ করে ছাত্র ছাত্রী আসা নিষেধ । না হলে.... যাহোক অবশেষে সুফিয়া পড়ার জায়গা পেল।সুফিয়া বেশ পরিশ্রম করলেও আমার জ্ঞানের ঘাটতি কারণে কি-না জানি না অল্পের জন্য সুফিয়া জিপিএ ফাইভ পেল না।
তবু পরিবারটিকে এই রেজাল্টে দারুণ খুশি দেখে আমার মনটা ভরে উঠলো।আসলে আমি সিক্স সেভেন পর্যন্ত বাচ্চা পড়াই।
যাহোক সুফিয়া অবশেষে কলেজে ভর্তি হলো এবং বেশ কয়েকটি টিউশনিও জোগাড় করে ফেলল।
এর বেশ অনেক দিন পরে জয়নব খালা একদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।তাঁর বয়স বেড়েছে। নানা রোগ শোকে সে প্রায় অস্থির। কথায় কথায়
সে জানালো সুফিয়া হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়ে গেছে।
পরে জানতে পারি এর পিছনে কারণ আছে।ওর পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপাচাপি করাতে ও বাড়ি ছেড়ে পালায়।সে চেয়েছিলে আরও পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। তবে সে একা বাড়ি থেকে পালায়নি। কোন এক অজানা ছেলের হাত ধরে সে বাড়ি ছেড়েছিল।
দিন বসে থাকে না।
শীতের শুরুতে আমি খুলনার দিকে এক ছোট শহরে কি একটা কাজে গিয়েছি।কাজ শেষে বাস আসতে দেরি দেখে একটা চায়ের দোকানে বসে অপেক্ষা করছি হঠাৎ দেখি চায়ের দোকানে সুফিয়া। বেশ অবাক হই। ও আমাকে দেখে কেন জানি লজ্জা পেয়ে যায়।
যাহোক প্রাথমিক দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে কথায় কথায় জানতে পারি। এই চায়ের দোকানটি ওর স্বামীর আর এখন ও অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী । সেই সাথে কিছু টিউশনিও করে। যদিও এদিকে টিউশনিতে তেমন টাকা নেই। তবু তার ভালো চলছে। সে ভালো আছে। সে আরও জানায় আমার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে নাকি সে একাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছে আর তাই মানুষকে নিজের সাধ্য মত শিক্ষা দেবার চেষ্টা করছে।
মনটা হঠাৎ ফুরফুরে হয়ে উঠলো। কারও একটা ভালো কাজের পিছনে নিজের যদি বিন্দুমাত্র অবদান থাকে। মনে অন্য রকম এক প্রশান্তি নেমে আসে। জীবন আসলেই সুন্দর।
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
১৭ ই জুন, ২০২৪ রাত ৮:১০
ইসিয়াক বলেছেন: Yes.100% true.
২| ০৫ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৩
জোবাইর বলেছেন: বেঁচে থাকার সংগ্রাম, এগিয়ে যাওয়ার আদম্য ইচ্ছা এবং প্রেরণা ও সাহায্যের বদান্যতায় অনেক জীবন এভাবে এগিয়ে যায়। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে প্রতিকুল আর্থ-সামজিক কারণে এদের জীবনের চারিপাশে খাড়া দেওয়াল! এ দেওয়াল টপকানোর জন্য এদের প্রয়োজন একটি সিঁড়ি। আপনার মতো পরোপকারী মহান হৃদয়ের মানুষেরা সহায়-সম্বলহীন হতভাগ্য এসব মানুষকে উপরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিজের জীবন দিয়ে সেই সিঁড়িটি বানিয়ে দেন। অভিনন্দন আপনাকে।
৩| ১৫ ই জুন, ২০২৪ সকাল ১১:০৫
রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: দারুণ। সুফিয়া নিশ্চয়ই জীবনে বড়ো কিছু করবে।
©somewhere in net ltd.
১| ০৫ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭
নতুন বলেছেন: life is stranger than fiction