নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যা মানবতা বিরোধী তাই পরিত্যাজ্য মানবের সাধনা হোক মনুষ্যত্ব লাভ।
(১)
পলাশ বরাবরই খ্যাপাটে স্বভাবের ছেলে।ওর পাল্লায় পড়ে এক জীবনে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি আমাকে। কিন্তু ওর সঙ্গ ত্যাগ করবার কথা আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবি না। ওর হৈ হৈ করে বেড়ানো, দুমদাম পাগলাটেপনা, আমায় মাদকের মত আকর্ষণ করে।তবে পাগলামি শুধু ও করে না ওর সাথে সাথে আমিও করি এজন্যই পরিচিতজনেরা অবশ্য আমাদের দুজনকে "বাউণ্ডুলে মানিকজোড়" নামেই ডাকতে পছন্দ করে ।
সম্ভবত সালটা ১৯৯০। স্কুলে পুজোর ছুটি পড়তেই পরদিন সকালে পলাশ হঠাৎ ই ভোর ঘোরে আমাদের বাড়ি এসে হাজির। সাত সকালে হাঁক ডাকে আয়েশের ঘুম ভেঙে খানখান। যথেষ্ট বিরক্ত হলাম। অন্য কেউ হলে অবশ্য দু'চার কথা শুনিয়ে দিতে দ্বিধা করতাম না তবে পলাশের ক্ষেত্রে সাত খুন মাফ।ওর সাথে আমরা কেউ কখনও রূঢ় আচরণ করি না।
মুক্তিযুদ্ধে নিখোঁজ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ও।অসহায় এতিম ছেলেটি আমার মায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী রওশন আরার কাছে পালিত হচ্ছে। রওশন আরা সম্পর্কে পলাশের ছোট ফুপু হন ।
যাহোক অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমন করে পাঁচিলের দরজাটা একটুকু ফাঁক করে জানতে চাইলাম
- সাত সকালে কি মতলবে এদিকে? তোর জন্য কি একটু শান্তিতে ঘুমাতেও পারবো না? যা তো এখন এখান থেকে!খামোখা বিরক্ত করিস কেন?
পলাশ দু'হাত দু'কোমরে রেখে নিজস্ব স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে গলা উঁচিয়ে বললো
-সরে দাড়া! ভেতর ঢুকবো কি করে?
- সকাল সকাল পাগলামি না করলে পেটের ভাত হজম হচ্ছে না বুঝি? যা বাড়ি যা আমি এখন ঘুমাবো। বিকালে আসিস।
পলাশ আমাকে পাত্তা না দিয়ে নাক আর ঠোঁট বিশেষ ভঙ্গিতে বাঁকিয়ে কিছু একটার ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করে বললো
- রান্নাঘর থেকে ডিম ভাজির গন্ধ আসছে মনে হচ্ছে?আহ! তাহলে তো নাস্তা রেডি।ওহ পেটটা একেবারে খিদেয় চনমন করছে।রাতে শুধু আলু ভাতে ভাত খেয়েছি।বড্ড খিদে পেয়েছে রে।সরে দাড়া না ভাই !
-যাবি এখান থেকে !
-ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। খালাম্মার কাছেই তো আমার দরকার ছিল ।জরুরি কথা আছে।ফুপি পাঠালো সর সর সরে যা।
জানি ও নাছোড়বান্দা ছেলে,কিছুতেই ফিরে যাবার নয়। আমাকে এক রকম ধাক্কা দিয়ে পলাশ ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বেশ চড়া গলায় বলল
-ঘুমুতে যাস না আবার, কথা আছে ফ্রেস হ তাড়াতাড়ি ।এই ফাঁকে আমি রান্নাঘরে গিয়ে খালামার কাছ থেকে নাস্তাটা সেরে আসি।আবারও বলছি দেরি করিস না কিন্তু নতুন একটা এ্যাডভেঞ্চারে বেরুতে হবে।আজই এক্ষুনি । দেরি হলে কিন্তু ট্রেন মিস করবো।নটায় ট্রেন মনে রাখিস, সিরিয়াসলি বলছি ।
-তুই কিরে? বললেই হবে ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে। আমার অত সময় নেই।কাজ আছে। যাবো না কোথাও এখন। জোরে জোরে বললাম।পলাশ শুনতে পেল কি-না জানি না। এদিকে আমি
যাবো না যাবো না করেও।কখন যেন বাইরে বেরুতে টুকটাক যা যা জিনিস লাগে মোটামুটি গুছিয়ে নিলাম।
আমাকে আপাতত বাড়ি ছাড়তে হবে বিশেষ কিছু কারণে।মা অবশ্য যেতে দিতে রাজী হচ্ছিলেন না।
যাহোক পথে যেতে যেতে জানা হলো বাবুমশাই এর নতুন এ্যাডভেঞ্চারের বিস্তারিত।
অতি সম্প্রতি পলাশের মেজ মামা আমেরিকা থেকে শর্ট ভিজিটে দেশে এসেছেন।পলাশের ফটোগ্রাফি শখ ছোটবেলা থেকেই আর সে কারণেই ওর জন্য ওর মামা দামী একটা ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন আমেরিকা থেকে ।
ভাগ্নের হাতে ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন, তাঁর কিছু পদ্মফুলের ছবি চাই।পিওর লাল পদ্মফুল। তিনি ভাগ্নের ছবি তোলার হাত পরখ করতে চাইছেন সম্ভবত। তিনি কয়েক দিনের মধ্যেই আবার আমেরিকা ফিরবেন।আর তাই মামাকে দেবার জন্য ছবিগুলো দ্রুত তোলার ব্যবস্থা করা জরুরি । এদিকে আমারও বাড়ি থেকে বেরুনোর প্লান ছিলই কিন্তু কিভাবে বেরুবো বুঝতে পারছিলাম না পলাশের প্রস্তাবটা খারাপ মনে হলো না।আর তাই নয় নয় করেও বেড়িয়ে পড়লাম ।
এদিকে আমার বড় বোন দীপা বিকেল নাগাদ তার বাবার বাড়ি অর্থাৎ আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসছে সাথে তার মহা বিচ্ছু আন্ডা বাচ্চাগুলোও।চার বিচছু ভাগ্নে আর আমার ছিঁচকাদুনে বোন বাড়িটার কি যে হাল বানাবে ভাবতেই গতকাল থেকে অস্থির লাগছিল ।
মা অবশ্য অসন্তুষ্ট হলেন।বারবার নিষেধ করলেন। দীপারা কত দিন বাদে আসছে। কত কাজ বাড়িতে।আমি বেরুচ্ছি অকাজে।ওতগুলো বাচ্চা বাড়িতে পুরুষমানুষ না থাকলে কে সামলাবে বল?আমি গা বাঁচিয়ে বললাম আব্বা তো আগামীকাল সকালেই ফিরছে মা।একটাই তো রাত দেখো সব ম্যানেজ হয়ে যাবে।বাজার সদাই তো করাই আছে।তুমি চিন্তা করো না।
জানি মায়ের কষ্ট হয়ে যাবে তবুও....বাবা এসে সব নিশ্চয় সামলে নেবে।
সত্যি বলতে কি একটা বিশেষ কারণে পলাশের এ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গী হলাম।আমার প্রায় নতুন বউ জবা, দিন পনের হলো বংশবৃদ্ধির জন্য বাবার বাড়িতে গেছে।বেশ কটা দিন দেখা সাক্ষাৎ নেই। মন চাইছে.. এই সুযোগে ফেরবার পথে একবার ওমুখো ঘুরে আসাও যাবে।কদিন ধরেই ভাবছিলাম কি করে এই কথাটাই মাকে বলি। আসলে এ ব্যপারটা মাকে বলতে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল।যাহোক যা হয় ভালোর জন্য ই হয়।
কথা না বাড়িয়ে আমরা সকাল নয়টার নির্ধারিত ট্রেন যথা সময়েই ধরলাম।নির্দিষ্ট স্টেশনে পৌছাতে ঘন্টাখানেক সময় লাগলো এরপর প্রথমে কয়েক দফা বাস বদলিয়ে তারপর রিকশা।এ পর্যন্ত এসেই টের পেলাম দারুণ এক বিদঘুটে জায়গা পৌঁছে গেছি।এদিকটায় না-কি আমাদের ওপাশের লোকজনের চলাচল সীমিত কথায় কথায় এক রিকশাওয়ালা জানালো ।তারপর রিকশা ছেড়ে ভ্যান গাড়িতে এবং অবশেষে পায়ে হেঁটে হাঁটু অবধি পঁচা কাঁদা মেখে মাইলখানেক পথ পেরিয়ে আলতানগরে এসে যখন পৌঁছলাম তখন আমি শেষ। মানে এনার্জির দফারফা শেষ।ধারনা ছিল হাঁটা পথ ঘন্টা খানেকে পেরোবো কিন্তু গত দুদিনের বৃষ্টিতে রাস্তা মারাত্মক পিচ্ছিল।পুরোটা পথ লোক চলাচলের ফলে আর গরুর গাড়ি যাওয়া আসায় জমে ধ্যাড়ধেড়ে ক্ষীর কাঁদা হয়ে গেছে । এ ক্ষীর কাদা দেখতে সত্যি সত্যিই ক্ষীর। সেই ক্ষীর কাঁদা ভেঙে ক্লান্তিতে শ্রান্তিতে আমার অবস্থা দারুণ কাহিল।
আসলে গাঁয়ের পথে এরম থকথকে চটচটে কাঁদায় যে না হেঁটেছে সে বুঝতে পারবে না কতটা পরিশ্রমের কাজ।সত্যি সে এক অদ্ভুত অবস্থা ।একবার মাঝ পথে চলে আসতে গিয়েও সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো।এতটা পরিশ্রম বিফলে যাবে? পলাশ বলল
- যা হয় হোক, আজ বাড়ি না ফিরতে পারলেও রাত কাটানের একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে ঠিক। তোকে অত ভাবতে হবে না।
প্রায় হাঁটু অবধি কাঁদা দেখে বাধ্য হয়ে প্যান্ট ছেড়ে হ্যাফ প্যান্ট পরতে হয়েছে আমাকে।পলাশের অবশ্য হাফপ্যান্ট ছিল না।
কাঁধে ব্যাগ হাটু অবধি কাদা সমেত ওকে বেশ অদ্ভুত দেখাচ্ছিল।এর মধ্যে দুবার আছাড় খেয়েছি।বিভৎস সে আছাড়।
এদিকে পথচলতি গ্রামবাসীরা আমাদের নাজুক অবস্থায় দেখে দারুণ কৌতুহলী হয়েছিল। তাদের কেউ কেউ তো কাঁদা ভেঙে আমাদের পিছু নিল তাতে করে আমরা বেশ বিরক্ত হলাম।
অবশেষে কাঙ্ক্ষিত স্থানে যখন পৌঁছলাম তখন কিন্তু সূর্য মামা হাই তুলছে অর্থাৎ বেলা শেষ।এদিকে পেটে ছুঁচো বুকডন দিচ্ছে।যদিও আসতে আসতে হালকা খাবার খেয়েছি কিন্তু এখন লেগেছে ভাতের ক্ষুধা।
যাহোক আলতানগরে ঢোকার মুখে সহজেই পদ্ম দীঘির খোঁজ পাওয়া গেল।নামে আলতানগর হলেও আদতে এটি কোন নগর নয় স্রেফ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অজ পাড়া গাঁ।পদ্ম দীঘিটা সত্যি দারুণ। পলাশ গায়ে পায়ে কাঁদামাটি অবস্থাতেই।ক্যামেরার রিল ভরে ফটাফট ছবি তুলতে লাগলো।এদিকে আমার বার বারই মনে হতে লাগলো ক'টা ছবির জন্য এত কষ্ট করে এতদুর আসার কোন মানে হয়! কি আছে এখানে?প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললাম
-ফিরবো কখন?
পলাশের নির্লিপ্ত উত্তর
- এই তো এলাম।
-তোর কি মাথা খারাপ?
-একথা কেন বলছিস?
-রাত নামছে থাকবি কোথায়?
- এটাই তো এ্যাডভেঞ্চার।
-তুই একটা উদ্মাদ।
ক্যামেরার লেন্সে চোখ রাখতে রাখতে পলাশ বললো
-মাঝে মাঝে উন্মাদ হতে হয়।একটু ম্যানেজ কর।চিন্তা করিস না একেবারে কিছু না হলে গ্রামের ভিতর একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই।
- তুই শিওর।
-হুহ।অভিজ্ঞতা তো তাই বলে।
-নিকুচি করি তোর অভিজ্ঞতার।যা করবার তাড়াতাড়ি কর। দেখছিস তো আলো কমে আসছে। আমার কথা ওর কানে গেল কি-না জানি না।
কি আর করা। কি করা যায় তাই ভাবছি।জায়গাটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর এটা মানতেই হবে।দীঘি ওপার থেকে শন শন হাওয়া বইছে।হঠাৎ সড়সড় আওয়াজে চমকে উঠলাম।সম্ভবত সাপ।হাড় হিম হয়ে গেল। কি সাপ কে জানে।পলাশকে ডাকবো কি-না ভাবছি।না ওকে ডাকা যাবে না। খোঁচা খুঁচি শুরু করবে। সাপটা একসময় বিদেয় হলো
আমি পলাশের কাছে জানতে চাইলাম ওর হলো কি-না?
-পাঁচ মিনিট দাড়া।ছবিগুলো মনে হয় ভালো হবে না। আলো কমে এসেছে যে।
দুশ্চিন্তায় বিষন্ন মন নিয়ে কেবল একটা মরা গাছের ডালে বসেছি সেই মুহুর্তে হঠাৎ ই বাঁশির অপার্থিব সুর ভেসে এলো।কোথেকে আসে সুর? এমন বিজন এলাকায় এই অবেলায় কে বাঁশি বাজায়? তাও আবার এমন মাতাল করা সুরে।আমরা দুজনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম।
সব বাদ দিয়ে শুধু আমি না পলাশও বাঁশি উৎস খুঁজতে লাগলো। আমরা বাঁশি সুরে এতটাই মোহিত হলাম,যে কি বলবো। অচিরেই বাঁশিওয়ালার খোঁজ মিলল।
পলাশ বলল
- শোন মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।এই বাঁশিওয়ালার সাথে ভাব জমাতে হবে,বুঝেছিস। দেখবি থাকার একটা না ব্যবস্থা হবেই।
শান বাধানো ঘাটের পটভূমিতে হাজার হাজার পদ্ম ফুল আর বাঁশিওয়ালার বাঁশির মুগ্ধ আওয়াজ। অন্য দিকে পড়ন্ত বিকেলের অপূর্ব লালচে আভা।অপার্থিব দৃশ্য দেখে আমরা আরো একবার মন্ত্র মুগ্ধ হলাম।
নিজের অজান্তেই বলে উঠলাম
অপূর্ব!
আমরা সত্যি সত্যি বিষ্মায়াভিভূত!পৃথিবীতে কত কিছু অজানা অদেখা থাকে।
আহ! এমন পরিবেশে এতক্ষণে পথ চলার ক্লান্তি অনেকটাই দুর হলো ।জাগতিক সকল কর্ম ভুলে সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে আমরা।
কতক্ষণ দাড়িয়ে আছি জানি না বাঁশির সুর থামতেই দুজনে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। পলাশ আমাকে ইশারা করল।
ভাবলাম, সব এত সহজ না-কি? এদিকে অন্ধকার নেমে আসছে।এখন কি হবে?এই দীঘির ঘাটে রাত কাটাতে হবে? সাপ পোকামাকড় কি আমাদের ছেড়ে দেবে? একটু আগেই তো...
পলাশ সরে এসে একফাঁকে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল
-যে করেই হোক একটা দিন এখানে থাকতেই হবে।একটা উপায় বের কর প্লিজ ।ওকে ম্যানেজ কর।কুঁড়েঘর হলেও চলবে।খালি রাতটা কাটাবো।
- তোর কাজ শেষ হয় নি?
-সবে তো শুরু তাছাড়া এখন ফিরতে চাইছিস? পারবি ফিরতে, এই জনবিরল জায়গা থেকে?
- আমি তাই তো তখন থেকে তোকে এই কথা বোঝাচ্ছিলাম। এমন বোকামি কেউ করে।আসবার আগে মানুষ নূন্যতম খোঁজ খবর তো করে না-কি?
- আরে এখানেই তো এ্যাডভেঞ্চারের মজা।খামোখা ভয় পাচ্ছিস। তুই কিছু চিন্তা করিস না। একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই।আর শোন ভালো ছবির জন্য পরিপূর্ণ আলো আর সময় নিয়ে ছবি তুলতে হয়।যা তুললাম এতে মনে হয় ছবি ভালো ফুটবে না। প্লিজ ভাই আমার আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ।আর লোকেশনটা মনে ধরেছে। কিছু ভালো ছবি তুলতে চাই। মামাকে ইমপ্রেস করা ভীষণ ভীষণ জরুরি। বুঝিস না তুই ?
অগত্যা দুর্ভাবনাকে সঙ্গী করে নিমরাজী হয়ে আমি বাঁশিওয়ালা ছেলেটির সাথে ভাব করতে গেলাম।প্রথমে ওর বাঁশি সুরের প্রশংসা করলাম তারপর ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম।
ছেলেটি এতক্ষণ আমাদের লক্ষ্য করছিল মনে হয়।সে আমাকে দেখে হাসিমুখে তাকালো। দোহারা গড়ন। বেশ উঁচু লম্বা।পরণের বসনে পরিপাটির ছোঁয়া। বয়স উনিশ কুড়ি হবে।ছেলেটি আমার প্রশ্নের উত্তরে বেশ নিচু স্বরে নিজের নাম বলল
-সংগ্রাম। আমার নাম সংগ্রাম।
-তুমি লজ্জা পাচ্ছো?
- না তো!
টুকটাক কথায় কথায় ওর সাথে আমার ভাব জমাতে সময় লাগলো না। এদিকে ততক্ষণে সত্যি সত্যি অন্ধকার নামছে প্রকৃতিতে।
ছেলেটি জানালো
- আমাকে ফিরতে হবে।
- তোমার বাড়ি কোথায়? কাছেই
- হ্যাঁ,এই তো। আপনারা কোথায় যাবেন কাদের বাড়ি এসেছেন । চলুন পৌঁছে দেই।
এই সুযোগে চট করে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলে ফেললাম।
একটুখানি কি যেন ভাবলো ছেলেটি তারপর বলল
-আপনারা বহুদূর থেকে আলতানগরে রায় বাহাদুরের পদ্মদীঘির পদ্ম দেখতে এসেছেন। এ আমাদের সৌভাগ্য। হিসাবে আপনারা আমাদের অতিথি।অসুবিধা যদি না হয় আপনারা আমাদের বাসায় আসতে পারেন। আমি ছোট মায়ের সাথে কথা বলে নেবো।আপনাদের দেখলে ছোট মা খুশিই হবেন। যদি আপত্তি না থাকে তো আপনারা আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করতে পারেন। এতো মেঘ না চাইতে জল।
এত সহজে ঝামেলা মিটবে ভাবি নি অবশ্য। তবু একবার ভদ্রতার খাতিরে বললাম
- কিন্তু বলা নেই কওয়া নেই এমন অযাচিতভাবে আপনাদের বাসায় ওঠা কি ঠিক হবে।
পলাশ মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল
-একটা রাত থাকবো শুধু। খাবার আমাদের সাথেই আছে।আপনাদের একটুও জ্বালাবো না।একটু থাকার ব্যবস্থা
সংগ্রাম মৃদু হাসলো।
-আসুন।আমাদের বাসায় ভালো লাগবে।চাইলে কয়েকদিন থাকতে পারেন। সমস্যা নেই। বিরক্ত হবো না কথা দিলাম।
আমি বললাম
- তাহলে যাওয়া যাক। জায়গাটা নিরাপদ নয় মনে হচ্ছে ।পোকামাকড়ের আড্ডা।
ছেলেটার মুখে মিষ্টি মায়াবী হাসি।এ হাসির অন্য কোন অর্থ আছে কি-না আমি জানি না !যাকগে অত ভাবনার সময় নেই এখন।
যেতে যেতে কথা হচ্ছিল বাঁশিটি হাতে ধরে দেখবার ইচ্ছে পোষণ করলাম। আসলে এই বাঁশির সুর ধরেই তো আমাদের আশ্রয় জুটলো। সংগ্রাম বাঁশিটি এগিয়ে দিলো।নেড়েচেড়ে বুঝলাম বাঁশিটিও বিশেষ ধরনের বাঁশ দিয়ে তৈরি।গ্রামের মেলা থেকে সংগ্রহ করা নয়,অর্ডার দিয়ে বানানো ।কথায় কথায় বাঁশি বাজানো নিয়ে ওর মনের নানান আক্ষেপ শুনলাম। সে তার কাজের স্বীকৃতি এই অজ পাড়া গায়ে পায় না। আমাদের প্রশংসায় সে আপ্লূত। সে যে একজন সহজ সরল সুখী মানুষ তা বুঝতে সময় লাগলো না। জীবনের জটিলতা সম্ভবত তাকে স্পর্শ করতে পারে নি এজন্য হয়তো সরলতাটুকু এখনও অটুট আছে।
কিছু সময় বাদে সংগ্রামের পেছন পেছন আমরা পৌঁছলাম একটা ভাঙাচোরা পুরানো বাগানবাড়িতে। প্রাচীন বনেদি বাড়ি। পাঁচিল ঘেরা বাগান তার ওপাশে বিশাল এক বাড়ি। বাড়ি না বলে রাজপ্রাসাদ বলাই উত্তম। বাড়িটি দোতলা তবে বাইরের অংশ মারাত্মক জীর্ণ।এই সন্ধ্যায় এই পরিবেশে বাড়িটি কেমন অদ্ভুত রহস্যময় দেখতে লাগছে।গা ছমছমে নিস্তব্ধতা।এ যেন আদিকালের কোন পাষাণপুরী । সম্ভবত এখানে আর কেউ থাকে না।সংগ্রামকে অনুসরণ করে বিশাল সিংদরজা পেরিয়ে ধীর পায়ে ভিতরে ঢুকেই বিশাল বড় হল ঘর ।ও আমাদের হলঘরে বসালো।
তারপর হাঁক দিলো
- ইদ্রিস এই ইদ্রিস কোথায় তুই?
সংগ্রামের ই বয়সী একটা ছেলে এগিয়ে এলো হাতে হারিকেন নিয়ে ।
- মুরগীর খামারে ছিলাম।
আমাদের বসতে বলে সংগ্রাম ওকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল।
পলাশ আমার দিকে ফিরে বললো
- অদ্ভুত না বাড়িটা।মনে হচ্ছে রূপকথার পাষাণপুরি।
-বনজঙ্গল থেকে ভালো এটা মানতেই হবে। আমি ওই দীঘির জঙ্গলে কিছুতেই রাত কাটাতে পারতাম না।
পলাশ হেসে বললো
- তুই এতো ভিতুর ডিম কেন?
মিনিট পনেরোর জন্য কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল সংগ্রাম।আমরা একটু চিন্তিত ই ছিলাম আর দেহে ছিল ক্লান্তি সেকারণেই ঘুমেও চোখ এঁটে আসছিল।সেই সঙ্গে....
কিছু সময় পর সংগ্রাম আমাদের নিয়ে চমৎকার একটা ঘরে হাজির হলো।এ যেন মেঘ না চাইতে জল। রাজকীয় ব্যপার স্যাপার বললে অত্যুক্তি হবে না।প্রসস্থ বিছানা দেখে হঠাৎ করে ক্লান্তিটা জাকিয়ে এলো।অন্য প্রসঙ্গে আমরা অবশ্য গেলাম না।ঝটপট ইঁদারার পানিতে গোসল সেরে ইদ্রিস মিয়ার দেখিয়ে দেওয়া ঘরে আমরা খুব দ্রুত বিশ্রাম নিতে ঢুকে পড়লাম।সন্ধ্যা প্রায় গত অজস্র ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। বাইরে তখন শতশত জোনাকি।শুয়ে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে শুকনো কিছু খাবারও চলে এলো যদিও আমাদের সাথে নিজেদের খাবার ছিল।সেগুলো অবশ্য পুরোদস্তুর শহুরে। আর ওর আনা এই পদগুলে নির্ভেজাল গ্রাম্য।মুড়ি মুড়কি বাতাসা আর নারকোল কোরা।খিদে পেয়েছিল।সাবাড় করতে সময় লাগলো না। এটাই সম্ভবত রাতের খাবার। অসুবিধা নেই। আমরা ভোজন পর্ব খুব দ্রুত সারলাম।খাবার পেটে পড়তে আমরা কখন যেন টুপ ঘুমিয়ে গেলাম নিজেরাও বুঝতে পারলাম না।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না সংগ্রামের সাহায্যকারী ইদ্রিস মিয়ার ডাকে ঘুম ভাঙলো।ঘড়িতে তখন রাত বারোটা বেজে আটাশ মিনিট।
এতো রাতে এই আয়োজন দেখে সত্যি অবাক হলাম।
খেতে খেতে জানলাম রান্না যা কিছু সংগ্রাম নিজের হাতে করেছে। দেশি মুরগির ঝোল।ডিম ভাজি আর খিচুড়ি । গ্রামের মধ্যে একটা বাচ্চা ছেলে এত সুন্দর রাঁধতে পারে জেনে অবাক হলাম।
কৌতূহল মেটাতে প্রশ্ন করলাম
- এত বড় বাড়িতে তুমি কি একাই থাকো? রান্নাবান্না কার কাছ থেকে শিখলে?
সংগ্রাম উত্তর দিলো না শুধু রহস্যময় একটা হাসি দিলো প্রসঙ্গ এড়াতেই বুঝি প্রশ্ন রাখলো
- সামান্য ব্যবস্থা।ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার নেই বলে এখানেই খেতে দিলাম। খিদে পেয়েছিল খুব আমরা নিঃশব্দে খাচ্ছি। সংগ্রাম আবার বললো
- রান্না কেমন হলো?বললেন না তো ?
-রান্না অতীব সুস্বাদু হয়েছে।পলাশ সোউৎসাহে বললো।বাড়িয়ে বলেনি অবশ্য রান্নাগুলো সত্যি অপূর্ব ছিল।
রাতের খাওয়া পর্ব শেষে ঘুমের অপেক্ষায় আছি।যেহেতু এক ঘুম হয়ে গেছে সেহেতু সহজে ঘুম আসবে না।শুয়ে শুয়ে আধো অন্ধকার মিশ্রিত ঘরটাকে দেখছি। রুমটা স্বভাবিকের চেয়ে অনেকটা বড়।কাপড়ে ঢাকা বেশ কিছু পুরানো দিনের আসবাবপত্র আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সম্ভবত এ ঘরে কেউ থাকে না। হঠাৎ ই দরজার পাশে কুলুঙ্গি দিকে চোখ গেল।কুলুঙ্গি ঘেঁষে একটা বড় আয়না।আয়না দেখে মাথায় হাত দিয়ে বুঝলাম। চুল সব এলোমেলো।উঠে গিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে চুল ঠিক করতে করতে কুলুঙ্গির ভিতর একটা মোটা হাতে বাধানে খাতা দেখে আমার কৌতুহল হলো। কিসের খাতা এটা।যদিও ব্যপারটা ঠিক না তবু কি এক আকর্ষণে পাতা উল্টাতে দেখি চমৎকার সব কবিতা । সবগুলো হাতে লেখা।
কার কবিতার খাতা এটা? একেবারে আনকোরা। এমন কবিতা তো আগে পড়ি নি।এটা এখানে কোথেকে এলো।এ সম্পর্কে সংগ্রামের কাছে কি জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে? ও যদি কিছু মনে করে? একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কি?
হ্যারিকেনের মিটি মিটি আলোয় সময় নিয়ে কিছু কবিতা পড়ে আমার মুগ্ধতা বাড়লো। আমার কেন জানি মনে হলো এটি কোন মেয়ের হাতের লেখা। চমৎকার গেটা গোটা।মহিলা কবি। এই অজ পাড়া গায়ে! কে সে?
কিছু বাদে সংগ্রাম এলো আমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে কি-না খোঁজ নিতে । শৌচাগারের পথটা ভালো করে দেখিয়ে দিলো।কৌতুহল দমন করতে না পেরে আমি কবিতার খাতার ব্যপারে জানতে চাইলাম ওর কাছে। আসলে লেখাগুলো নিয়ে আমি ভীষণ উত্তেজিত ছিলাম।
সংগ্রাম জানালো খাতাটি তার ছোট মায়ের।তিনি অবসরে কবিতা লেখেন।
মনে মনে ভাবলাম যে এত সুন্দর কবিতা লেখে সে না জানি কত জ্ঞানবান।সাক্ষাতের লোভ হল তাছাড়া তিনি এই গৃহের গৃহকর্ত্রীও বটে।একবার দেখা না করলে অভদ্রতা হয়ে যায়।কিন্তু উনি কোথায়?
আমি বললাম উনার সাথে সাক্ষাৎ করা যাবে? তাছাড়া আমার অন্য একটি ব্যপারে কৌতুহলও ছিল।
সংগ্রাম জানালো, বাড়ির বর্তমান মালকিন না-কি নিজে এসে আমাদের দেখে গেছেন। আমরা তখন ঘুমে বিভোর ছিলাম।সংগ্রাম আরও জানালো ভদ্র মহিলা নাকি আমার মুখের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ছিলেন।কি দেখছিলেন কে জানে। আমার আগ্রহ বাড়ছিল। তিনি নাকি জানতে চাইছিলেন আমি কোথেকে এসেছি।সংগ্রাম চলে গেছে অনেক আগে। পরিপুর্ণ নিস্তব্ধতা। কোথাও শেয়ালের দল ডাকাডাকি করছে।জানালার ওপাশে লক্ষ হাজার জোনাকি পোকা।
সবাই ঘুমে শুধু আমার চোখে ঘুম নেই। বারবার ভাবছি পাষাণ পুরির সেই কবির কথা। যার পুরো কবিতার খাতা জুড়ে শুধু হাহাকার! তিনি আবার আমাকে দেখে কৌতূহল প্রকাশ করেছেন।কেন? ব্যপারটা অদ্ভুত তো। আমাকে জানতেই হবে তার সম্পর্কে।হারিকেনের টিমটিমে আলোয় কড়ি বরগা গুনছি।
তখন কত রাত জানি না। বড় বড় জানালা গলে সমানে অপার্থিব জোছনার জোয়ার বয়ে চলেছে।বিশাল চাঁদ আকাশে । আমি মুগ্ধ চোখে চাঁদ দেখছি।অতিরিক্ত সুন্দর কোন কিছুর দিকে একটানা তাকিয়ে থাকা যায় না।আমার চোখ জ্বালা করছে। হঠাৎ কানে এলো চাপা গোঙানির শব্দ কিছুক্ষণ শুনে বুঝলাম এটা গোঙানি না কান্নার আওয়াজ। কোথাও কে যেন কাঁদছে। কে কাঁদে এত রাতে?
পাশ ফিরতে পলাশ যে জেগে আছে এটুকু বুঝতে পারলাম। আমরা দুজনে সেই দুঃখী মানুষটির কান্না শুনতে লাগলাম। মনে হলো কোন প্রাসাদ বন্দীনি বেদনার্ত করুন রোদন।কে সে? মোহাবিষ্টের মত অচেনা মানবীর দুঃখে দুঃখী হলাম।
চলবে
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
পাঁচ পর্বে সমাপ্ত।
©somewhere in net ltd.
১| ১৪ ই জুন, ২০২৪ রাত ১২:২০
মিথমেকার বলেছেন: লেখা পুরোটুকু পড়েছি।
লেখার ফ্লো বেশ ভালো, ফিলার কম।
কিছু অসামঞ্জস্য মনে হয়েছে; লেখার প্লট ৯০ দশকের বাংলা সিনেমা এবং সমসাময়িক কিছু বাচন ভঙ্গি রয়েছে, যেটা অদ্ভুত লাগছে কিছুর হাইওয়েতে হঠাৎ স্পিডব্রেকার এর মতো লেখার প্রোটাগনিস্টসদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং তাদের বয়স অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
ওভারেল বেশ ভালো, পাঠক হিসাবে বাকি টুকু পড়ার আগ্রহ থাকে।