![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যায়যায়দিন
শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০১৩: বৈশাখ ০৭, ১৪২০ বঙ্গাব্দ:
০৮ জমাদিউস সানী ১৪৩৪ হিজরি, ০৭ বছর, সংখ্যা ৩০৮
ব্যর্থ রাজনীতির উপহার তত্ত্বাবধায়ক সরকার
কার অধীনে অনুষ্ঠিত হবে তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, প্রতিটি ভালো মানুষই চায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। দুইদিন আগে হোক আর পরে হোক, রাজনৈতিক সরকারকেই তো করতে হবে সেই কাজ। আমাদের রাজনীতিকদের ব্যর্থতার কাদামাটি দিয়ে আর কতদিন আমরা তৈরি করব তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক পুতুল?
মো. রহমত উল্লাহ্
অনেকেই বলে থাকেন, বর্তমান মহাজোট সরকার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল না করত তাহলে বিরোধী জোটের আন্দোলন এত সহিংস রূপ নিত না বা নিতে পারত না। যারা এ বক্তব্য দিচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত করে বলতে পারেন যে আজকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট যদি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় থাকত তাহলে তারাও কি একইভাবে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি বাতিল করত না এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট যদি বিরোধী দলে থাকত তাহলে তারাও কি এ দাবিতেই আন্দোলন-সংগ্রাম করত না? কেউ স্বীকার করুক আর না-ই করুক, আসলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার এবং যাওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক দল/জোট যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এ জন্যই আমাদের রাজনীতিকদের ব্যর্থতার কাদামাটিতে জন্ম নিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। রাজনীতিকদের ওপর রাজনীতিকদের আস্থার অভাবই এর প্রধান কারণ। তার ওপর শ্রদ্ধা তো দূরের কথা, স্বীকারই করতে চায় না একে অপরের অস্তিত্ব। সরকারি জোট বলছে, দেশের মানুষ এখন আর চায় না সেই ভয়াবহ অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাদের ভাষায় মনে হয় যেন বিরোধী জোটের ৩৫ শতাংশেরও অধিক ভোটার এ দেশের মানুষ নয়! আবার বিরোধী জোট বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশের সব মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। তাদের কথায় মনে হয় যেন সরকারি মহাজোটের ৪০ শতাংশেরও বেশি ভোটার এ দেশের মানুষ নয়! নেতাদের এ হারজিত খেলায় জনসাধারণ বা কর্মী-সমর্থক দাবার ঘুঁটি ছাড়া আর কী?
আজ নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে বিরোধী জোটের চলমান আন্দোলন যতটা জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ততটা হচ্ছে না। এর নানাবিধ কারণের মধ্যে সরকারি দমন-পীড়ন ও বিরোধী জোটের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং তাদের রাজনৈতিক অবস্থান উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে তাদের অন্তরে-বাইরে দ্বৈত অবস্থান নিজেদের প্রগতিশীল নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং জনসাধারণের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় তারা এখন আগের তুলনায় অনেকটাই শুভশক্তিহীন বলে মনে করেন অনেকেই। সাম্প্রতিক হরতালজনিত নাশকতাও বিরোধী জোটে অপশক্তি বা বহিঃশক্তির সক্রিয়তারই প্রমাণ। এ অপশক্তি/বহিঃশক্তির অপকর্মের দায়ভার নেতাদের ঘাড়ে চাপার কারণে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে শুভশক্তির সমন্বয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার করার সুযোগ ও পরিবেশ এখন আর নেই বললেই চলে। তদুপরি গণজাগরণ আন্দোলন এবং হেফাজত ইসলামের আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যক্তির বিরোধিতা বা সমর্থন- অংশগ্রহণের ফলে এ দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষের বিশেষ করে গণ্যমান্যদের আসল চেহারা এখন সবার কাছেই পরিষ্কার। কেউ রাজনীতিতে সক্রিয় থাকুক বা না-ই থাকুক তাদের অবস্থান এখন আর অস্পষ্ট নেই। এমনকি, যে ইমাম সাহেবের পেছনে নামাজ আদায় করছেন মুসলমানরা সেই ইমাম সাহেব কোন মার্কায় ভোট দিতেন বা দেবেন তা জানা ছিল না এতদিন। এখন তা-ও পরিষ্কার সবার কাছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি কোনো চাপের কারণে বা সদিচ্ছা জাগ্রত হওয়ার ফলে যদি ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে, তাহলে কি বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা কেটে যাবে, নাকি আরো বেড়ে যাবে? প্রথমত, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার জন্য সব দলের বিশেষ করে পুরনো দুই জোট এবং সাম্প্রতিক আবির্ভূত দুই শক্তির সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ মানুষ বাছাই বা নির্বাচন করা। বর্তমানে দেশে এমন দু-একজন বিচারপতি, ব্যারিস্টার, অ্যাডভোকেট, সম্পাদক, সাংবাদিক, ভিসি, অধ্যক্ষ, হেডস্যার, শিক্ষক, শিল্পপতি, শিল্পী-সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, এনজিওপ্রধান, সচিব, আমলা, ইমাম, হুজুর, মোয়াজ্জিন খুঁজে পাওয়া যাবে না যাদের নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বা সদস্য হিসেবে সবাই সাদরে মেনে নেবে। বিরোধীদলীয় নেতার কথামতে বলতে হয় পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নেই। আসলে সত্য পক্ষই তো নিরপেক্ষ। এমন মানুষ তো থাকতে হবে এবং আছেন যিনি সত্য পক্ষ অবলম্বন করবেন তার প্রতিটি কথায় ও কাজে। কিন্তু বর্তমান রাজনীতির ময়দানে তারা আসবেন না এবং তাদের আনাও হবে না। এই রাজনৈতিক ময়দানে নিরপেক্ষ হিসেবে হয়তো স্থান পাবেন এমন জন, যাদের দৃষ্টিতে সত্য-মিথ্যার মিশ্রণই সত্য বা সঠিক। যেমন : একজন বললেন, 'তিনে দুয়ে পাঁচ'। আরেকজন বললেন, 'না, তিন দু'গুণে ছয়'। অন্য একজন (তথাকথিত নিরপেক্ষ) এসে বললেন, 'তোমাদের কারোরটাই সঠিক নয়; তিনে দুয়ে মিলে সাড়ে পাঁচই হয়'। এমন বর্ণচোরা নিরপেক্ষ কিংবা পাগল/শিশু দিয়ে তো আর সরকার গঠন করা চলবে না। যারা দুই পক্ষকেই খুশি রাখার অসদুদ্দেশ্যে বলে থাকেন, 'তিনে দুয়ে মিলে সাড়ে পাঁচই হয়' সেই নিরপেক্ষরা (?) আসলে কি সত্য পক্ষ? দ্বিতীয়ত, আদালতের অলটারনেটিভ অপশন অনুসারে আসন্ন দুই টার্মের জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হয় এবং এখনকার মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে যদি পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে, তাহলে তারা কি একইভাবে এ ব্যবস্থা বাতিল করতে পারবে না? একইভাবে কি তখনকার বিরোধী দল আন্দোলন করতে পারবে না? কিংবা আদালতের প্রস্তাবিত দুই টার্ম যখন শেষ হবে, তখনো তো কোনো না কোনো দলীয় সরকারই ক্ষমতায় থাকবে এবং কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল/জোট বিরোধী দলে থাকবে। তখনকার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন মেনে নেবে কি তখনকার বিরোধী দল? তখন কি আবার চলবে না এমন জ্বালাও-পোড়াও? তৃতীয়ত, পরস্পরের প্রতি অনাস্থার কারণে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে বার বার ক্ষমতা প্রদানের ফলে আরো বেশি রুদ্ধ হয়ে পড়বে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ওপর মানুষের আস্থা ফিরে আসার পথ। রাজনীতিকরা আস্থাহীনতার চরমে পেঁৗছে গেলে অনিবার্যভাবে কি ক্ষমতাসীন হয়ে যাবে না অন্য কোনো শক্তি?
রাজনীতিকদের ব্যর্থতার কাদামাটিতে জন্ম নেওয়া এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় আসেন সেই তারা তো এই তারাই, যারা এখন সরকার দলে বা বিরোধী দলে। তারা সবাই যদি এতই আস্থাহীন হন তো যতই নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক তাদের কারোর হাতেই তো মনে হয় নিরাপদ নয় আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতা! বার বার অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লোকজন নিরপেক্ষতার পরীক্ষায় পাস করে পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দিতে হবে কেন (রাজনীতিকদের ভাষায়) অনিরপেক্ষ অনির্ভরশীল রাজনীতিকদেরই হাতে? যারা রাজনীতি করে তাদেরই তো দিতে হবে নিরপেক্ষতার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করে হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়ার অথবা অনাস্থা কুড়িয়ে অাঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সুযোগ। এখন তো আর 'না হ্যাঁ, হ্যাঁ হ্যাঁ, সব হ্যাঁ' অথবা 'হুন্ডা গু-া ডা-া, নির্বাচন ঠা-া' সেই দিন নেই। এখন তো মোবাইল ফোনের ভিডিও এবং প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ক্যামেরার বদৌলতে সঙ্গে সঙ্গেই সবাই দেখতে পারে অজপাড়াগাঁয়ে সংঘটিত নারী/পুরুষ নির্যাতন বা জানমালের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। আগের মতো ভোট চুরি/ডাকাতি করে গোপন রাখা এখন কি আর সম্ভব? একান্ত গোপনীয় স্কাইপে সংলাপ, ফেসবুক/বস্নগের লেখাই তো গোপন থাকছে না এখন। কে কখন কোথায় কীভাবে গাড়িতে পেট্রল ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে চলে যাচ্ছে হেঁটে হেঁটে, তা তো আমরা সবাই (পুলিশ ছাড়া?) দেখতে পাই পরিষ্কার। সাম্প্রতিক হানহানিতে যা দেখা যাচ্ছে তাতে এটিও এখন পরিষ্কার যে গ্রামের মানুষেরও রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ চিহ্নিত এবং সক্রিয় আছে। একজনের ভোট চুরি/ডাকাতি করে নিয়ে যাবে অন্য জনে, অথচ প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে পড়বে না, দেশ-বিদেশে জানাজানি হবে না, সরকার গঠন ও পরিচালনায় তীব্র প্রতিকূলতায় পড়বে না, চিরতরে অাঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে না এমন চিন্তাভাবনা এখন আর বাস্তব নয়।
তাই রাজনীতিকদের পরীক্ষা রাজনীতিকদেরই দিতে দেয়া উচিত। যাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যাওয়ার ইচ্ছা এবং সম্ভাবনা আছে তাদের অবশ্য পছন্দ হবে না আমার এ কথা। যাদের এ ইচ্ছা ও সম্ভাবনা নেই তাদের দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে রাজনীতিকদের নিরপেক্ষতা পরীক্ষার হলে ডিউটি করার জন্য হওয়া উচিত ঐক্যবদ্ধ। যারা ফর্মুলা দিচ্ছেন তাদেরও আসা উচিত এই ভাগে। সরকারের কাছে উত্থাপন করা উচিত এমন কিছু দাবি_ ১. নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করা হোক। ২. নির্বাচনের স্বচ্ছতা পর্যবেক্ষণের জন্য উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষক এবং সাংবাদিক আনার ব্যবস্থা পাকা করা হোক। ৩. প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ভিডিও ক্যামেরা স্থাপন করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক। ৪. বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধের জন্য সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগানো হোক ইত্যাদি। এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভূমিকা কতটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক তা বোঝা যাবে বর্তমান সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কতটা আন্তরিক এবং সেই সঙ্গে বোঝা যাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন কতটা যৌক্তিক।
কার অধীনে অনুষ্ঠিত হবে তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, প্রতিটি ভালো মানুষই চায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। দুই দিন আগে হোক আর পরে হোক, রাজনৈতিক সরকারকেই তো করতে হবে সেই কাজ। আমাদের রাজনীতিকদের ব্যর্থতার কাদামাটি দিয়ে আর কতদিন আমরা তৈরি করব তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক পুতুল?
[ মো. রহমত উল্লাহ্: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ।
Email- [email protected] ]
http://www.rahamot.wordpress.com
©somewhere in net ltd.