![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দৈনিক ইত্তেফাক
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০১৪, ১০ মাঘ ১৪২০, ২১ রবিউল আওয়াল ১৪৩৫
Click This Link
আলোকপাত
নতুন বইয়ের পোড়া গন্ধ
মো. রহমত উল্লাহ্
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ধারাবাহিক সফলতার অংশ হিসেবে ২০১৪ শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগেই দেশের সকল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেয়া হয়েছিলো ২৯ কোটি ৯৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৮ কপি নতুন বই। জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে ছুটির দিন থাকায় ২ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে নতুন বছরের নতুন বই বিতরণ ও ক্লাস। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না, যখন কচি কচি নিষ্পাপ শিক্ষার্থীদের কোমল হাতে তুলে দিয়েছিলাম ফুরফুরে গন্ধেভরা চার রঙা নতুন নতুন বই তখন তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিলো কী যে আনন্দের ঝিলিক! নতুন বই হাতে পেয়ে মনের আনন্দে অভিভূত হয়ে নতুন উদ্যমে লেখাপড়া শুরু করার জন্য শিক্ষার্থীরা যখন বদ্ধ পরিকর, ঠিক তখই গত ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখের জাতীয় নির্বাচন প্রতিহত করার কর্মসূচি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পেট্রোল বোমা দিয়ে জ্বলিয়ে দেয়া হলো প্রায় সাড়ে পাঁচশ' শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেইসাথে পুড়িয়ে দেয়া হলো ছাত্রশিক্ষক কক্ষের চেয়ার টেবিল বেঞ্চ এবং বিলির অপেক্ষায় মজুদ থাকা বিপুল পরিমাণ নতুন নতুন বই। টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেলো অগ্নিদগ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বুকফাটা কান্নার দৃশ্য। বইয়ের পাতার সাথে জ্বলে-পুড়ে খাক হলো তাদের সবুজ সতেজ মনের প্রতিটি সম্ভাবনাময় পত্র। চুপসে গেলো বুকভরা আনন্দে ফুলে ওঠা রঙিন বেলুন। ছিঁড়ে গেলো তাদের মনের আকাশে উড়ন্ত রঙ-বেরঙের ঘুড়ির সূতা। নতুন বইয়ের পোড়া গন্ধে আর কালো ধোঁয়ায় যেনো ভয়ার্ত মূর্তি রূপ ধারণ করলো প্রতিটি শিশু। এবং সেইসাথে দুমড়ে-মুচড়ে রক্তাক্ত হলো সকল বিবেকবান মানুষের হূদয়। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন: আমাদের কী অপরাধ? কেনো আগুন দেয়া হলো আমাদের বিদ্যালয়ে? কেনো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হলো আমাদের বইপত্র? কোথায়, কীভাবে লেখাপড়া করবো আমরা? এইসব সহজ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর কারো জানা আছে কি না আমি জানি না। আমি জানি, এটি তাদের নয়, আমাদের অপরাধ। আমরা কতটা হিংস্র, কতটা অমানবিক, সন্তানদের প্রতি আমরা কতটা নিষ্ঠুর, কতটা দায়িত্ব-কর্তব্যহীন তারই বহিঃপ্রকাশ আমাদের এই অগ্নিমূর্তি আচরণ; যা হিংস পশুকেও হার মানায়!
সরকারি হিসাব অনুসারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ কোটি ৭৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬৭২ জন। তাদের অনেকেই এখনো ভয়ে কাতর হয়ে উপস্থিত হয় বিদ্যালয়ে। এতোদিন ভয় ছিলো পথে, এখন ভয় এসে বাসা বেঁধেছে ক্লাসে। তাদের চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠে সেই আগুনের দৃশ্য! প্রতিদিন প্রতিক্ষণ ভয়ে ভয়ে ক্লাস করতে হয় তাদের। বিদ্যালয়ে পড়তে আসাই যেনো তাদের অপরাধ! শুধু বিদ্যালয়েই নয়, রাতে বাসায় পড়তে বসেও শিশুরা বার বার উঠে এসে মা-বাবা, ভাই-বোনদের কাছে ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে: কালকে কি হরতাল আছে? অবরোধ কবে? আবার না কি নির্বাচন হবে? এই অবস্থায় তারা কীভাবে মনোযোগ দিবে লেখাপড়ায়?
অপরদিকে এখনো পুনঃনির্মাণ বা মেরামত করা হয়নি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন। প্রতিস্থাপন করা হয়নি দরজা-জানালা, টেবিল-চেয়ার-বেঞ্চ। খোলা আকাশের নিচে চেষ্টা চলছে ক্লাস করার। অতিদ্রুত ক্লাসের উপযোগী করা প্রয়োজন এই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সরবরাহ করা জরুরি শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় পাঠ্যবই। একই সাথে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে নিশ্চিত করতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। কোনরকম লুকোচুরি নয়; সবার সামনে উন্মোচন করতে হবে এইসব শিক্ষা-বিরোধী, দেশ ও জাতি-বিরোধী অমানুষদের চেহারা। সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের নেতা-কর্মীদের গ্রহণযোগ্যতার প্রয়োজনেই এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, তাদের দ্বারা আর কোনদিনই বিপন্ন হবে না এদেশের শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর কোনদিন শিশুদের নাকে লাগবে না নতুন বইয়ের পোড়া গন্ধ। মোটকথা, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যে কোন মূল্যে ভয়মুক্ত, আনন্দঘন ও নিরবচ্ছিন্ন করতে হবে সকল শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। তা না হলে নিশ্চিত ভেস্তে যাবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও অগ্রগতির রূপকল্প।
লেখক: অধ্যক্ষ, কিশলয় উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ
Email- [email protected]
দৈনিক ইত্তেফাক
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০১৪, ১০ মাঘ ১৪২০, ২১ রবিউল আওয়াল ১৪৩৫
Click This Link
আলোকপাত
নতুন বইয়ের পোড়া গন্ধ
মো. রহমত উল্লাহ্
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ধারাবাহিক সফলতার অংশ হিসেবে ২০১৪ শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগেই দেশের সকল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেয়া হয়েছিলো ২৯ কোটি ৯৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৮ কপি নতুন বই। জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে ছুটির দিন থাকায় ২ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে নতুন বছরের নতুন বই বিতরণ ও ক্লাস। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না, যখন কচি কচি নিষ্পাপ শিক্ষার্থীদের কোমল হাতে তুলে দিয়েছিলাম ফুরফুরে গন্ধেভরা চার রঙা নতুন নতুন বই তখন তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিলো কী যে আনন্দের ঝিলিক! নতুন বই হাতে পেয়ে মনের আনন্দে অভিভূত হয়ে নতুন উদ্যমে লেখাপড়া শুরু করার জন্য শিক্ষার্থীরা যখন বদ্ধ পরিকর, ঠিক তখই গত ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখের জাতীয় নির্বাচন প্রতিহত করার কর্মসূচি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পেট্রোল বোমা দিয়ে জ্বলিয়ে দেয়া হলো প্রায় সাড়ে পাঁচশ' শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেইসাথে পুড়িয়ে দেয়া হলো ছাত্রশিক্ষক কক্ষের চেয়ার টেবিল বেঞ্চ এবং বিলির অপেক্ষায় মজুদ থাকা বিপুল পরিমাণ নতুন নতুন বই। টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেলো অগ্নিদগ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বুকফাটা কান্নার দৃশ্য। বইয়ের পাতার সাথে জ্বলে-পুড়ে খাক হলো তাদের সবুজ সতেজ মনের প্রতিটি সম্ভাবনাময় পত্র। চুপসে গেলো বুকভরা আনন্দে ফুলে ওঠা রঙিন বেলুন। ছিঁড়ে গেলো তাদের মনের আকাশে উড়ন্ত রঙ-বেরঙের ঘুড়ির সূতা। নতুন বইয়ের পোড়া গন্ধে আর কালো ধোঁয়ায় যেনো ভয়ার্ত মূর্তি রূপ ধারণ করলো প্রতিটি শিশু। এবং সেইসাথে দুমড়ে-মুচড়ে রক্তাক্ত হলো সকল বিবেকবান মানুষের হূদয়। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন: আমাদের কী অপরাধ? কেনো আগুন দেয়া হলো আমাদের বিদ্যালয়ে? কেনো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হলো আমাদের বইপত্র? কোথায়, কীভাবে লেখাপড়া করবো আমরা? এইসব সহজ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর কারো জানা আছে কি না আমি জানি না। আমি জানি, এটি তাদের নয়, আমাদের অপরাধ। আমরা কতটা হিংস্র, কতটা অমানবিক, সন্তানদের প্রতি আমরা কতটা নিষ্ঠুর, কতটা দায়িত্ব-কর্তব্যহীন তারই বহিঃপ্রকাশ আমাদের এই অগ্নিমূর্তি আচরণ; যা হিংস পশুকেও হার মানায়!
সরকারি হিসাব অনুসারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ কোটি ৭৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬৭২ জন। তাদের অনেকেই এখনো ভয়ে কাতর হয়ে উপস্থিত হয় বিদ্যালয়ে। এতোদিন ভয় ছিলো পথে, এখন ভয় এসে বাসা বেঁধেছে ক্লাসে। তাদের চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠে সেই আগুনের দৃশ্য! প্রতিদিন প্রতিক্ষণ ভয়ে ভয়ে ক্লাস করতে হয় তাদের। বিদ্যালয়ে পড়তে আসাই যেনো তাদের অপরাধ! শুধু বিদ্যালয়েই নয়, রাতে বাসায় পড়তে বসেও শিশুরা বার বার উঠে এসে মা-বাবা, ভাই-বোনদের কাছে ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে: কালকে কি হরতাল আছে? অবরোধ কবে? আবার না কি নির্বাচন হবে? এই অবস্থায় তারা কীভাবে মনোযোগ দিবে লেখাপড়ায়?
অপরদিকে এখনো পুনঃনির্মাণ বা মেরামত করা হয়নি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন। প্রতিস্থাপন করা হয়নি দরজা-জানালা, টেবিল-চেয়ার-বেঞ্চ। খোলা আকাশের নিচে চেষ্টা চলছে ক্লাস করার। অতিদ্রুত ক্লাসের উপযোগী করা প্রয়োজন এই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সরবরাহ করা জরুরি শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় পাঠ্যবই। একই সাথে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে নিশ্চিত করতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। কোনরকম লুকোচুরি নয়; সবার সামনে উন্মোচন করতে হবে এইসব শিক্ষা-বিরোধী, দেশ ও জাতি-বিরোধী অমানুষদের চেহারা। সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের নেতা-কর্মীদের গ্রহণযোগ্যতার প্রয়োজনেই এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, তাদের দ্বারা আর কোনদিনই বিপন্ন হবে না এদেশের শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর কোনদিন শিশুদের নাকে লাগবে না নতুন বইয়ের পোড়া গন্ধ। মোটকথা, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যে কোন মূল্যে ভয়মুক্ত, আনন্দঘন ও নিরবচ্ছিন্ন করতে হবে সকল শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। তা না হলে নিশ্চিত ভেস্তে যাবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও অগ্রগতির রূপকল্প।
লেখক: অধ্যক্ষ, কিশলয় উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ
Email- [email protected]
©somewhere in net ltd.