![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মাঝে মাঝে চমককে ক্যাম্পাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। একই গাড়িতে ক্যাম্পাসে পৌঁছাবার পরও দেখা যায়, সে মুহূর্তের মধ্যে উধাও। তখন আমার ভীষণ মেজাজ খারাপ হতো। কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলে ‘এই তো দেখলাম।’ বিষয়টি চিন্তার বৈ কি। ক্যাম্পাস জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিকথা
একদিন একটা জরুরি একাডেমিক কাজে ওকে খুঁজছি কিন্তু ও লা পাত্তা। কেউই তেমন নির্ভরযোগ্য সন্ধান দিতে পারল না। আমিও ছাড়ার বান্দা না। স্থির করলাম ওকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবই। মাথায় সূত্রটি জাগল, মনে পড়ল- একটা ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লেই ছেলেরা ঘন ঘন হারিয়ে যায়। ব্যাপারটি পাঠকরা একটু পরেই জানতে পারবেন।
কয়েক জায়গায় হানা দিয়ে শেষ পর্যন্ত ওর সন্ধান মিলল। ওর না ওদের। আমি দুষ্টুমী করার জন্য বিড়ালের মতো সতর্ক পা ফেলে ওদের কাছে যেতে থাকি। ওরাও সতর্ক কম ছিল না। এ সব কাজে বোধ করি সতর্ক একটু বেশিই হতে হয়। আমাকে দেখতে পেয়ে একজন হাসল, চমক হাসল। অন্যজন মনে হলো বড়ই অসন্তুষ্ট। শুধু ওড়না দিয়ে গলা মুছছে আর আমার দিকে তাকাচ্ছে ইয়া বড় বড় চোখে। অবশ্য ওর চোখ এমনিতেই একটু বড়, মানে যাকে বলে ডাগর চোখ। আমি বুঝতে পেরে আর অগ্রসর হওয়া উচিত মনে করলাম না। প্রায় ১৩ হাত দূরে থেমে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ঠিক সরল রেখার মতো। কত সময় ধরে আমাকে এবাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল সে কথা না হয় নাইবা বললাম।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রকৃতই এক বিচিত্র জায়গা। রোমাঞ্চ আর কিছু হতাশা, উচ্চতর ডিগ্রি আর না ভুলার মতো কিছু অভিজ্ঞতা নিয়েই এখান থেকে বিদায় নিতে হয়। এ সব অভিজ্ঞতা ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের প্রচণ্ডতম ব্যস্ততার মধ্যেও হয়ে থাকে স্মৃতির রংধনু। আর সে রংধনুর সাত রঙের মাঝে সবচেয়ে জ্বলজ্বলে হয়ে থাকে নিজচোখে দেখা চমকের মতো প্রেমিক জুটিদের প্রেম কাহিনীর ইতিবৃত্ত। বার বার স্মৃতিপটে এমন সব ঘটনার স্যা কাহিনী না চাইলেও ভেসে উঠে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেশের অন্য আর যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের চাইতে ভিন্ন। শহর থেকে দূরে এর অবস্থানের ফলে কোলাহলমুক্ত পরিবেশ আর সবুজ গালিচা বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল কাম্পাস। এখানে সেখানে শুধু গাছ আর গাছ। ক্যাম্পাসের হল সংলগ্ন দণি-পূর্ব এলাকাটা তো রীতিমতো সুন্দরবনের বিচ্ছিন্ন অংশ বলেই প্রতীয়মান হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা সেশনজটের সুবাদে একাডেমিকভাবে পিছিয়ে থাকলেও ক্যাম্পাসের এই শান্ত ছিমছাম সবুজ পরিবেশের সদ্ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র পিছিয়ে নেই তারা। তাই রোদ হোক ছায়া হোক গাছের নিচে জোড়ায় জোড়ায় জুটিদের বসে থাকতে দেখা যায়। একবার এ রকম এক জুটিকে ভিন্ন কারণে বেশ কয়েক ঘণ্টা চোখে চোখে রাখতে হয়েছিল । ল্য করলাম তারা বিভিন্ন গাছ তলায় তিন তিনবার জায়গা বদলিয়ে অবশেষে কাসে চলে গেল। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম তিন জায়গায়ই নাকি পিঁপড়ের শক্ত ঘাঁটি ছিল। বসার পর পরই পিঁপড়ের সন্ত্রাসী আক্রমণে তারা পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে। পিঁপড়ের কাছে যে প্রেম আত্ম সমর্পণ করল সে প্রেম কতখানি গভীর আর নির্ভেজাল তা নিয়ে তখন ভেবেছিলাম দীর্ঘ সময়। যদিও তার উত্তর তখনো মেলেনি এখনো হয়ত মেলাতে পারব না।
১৯৯২ সালে ক্যাম্পাসে আসার পর থেকেই কুসুমের সাথে আমার পরিচয়। বেশ সুন্দরী আর দেহ সৌষ্টবে দারুন আকর্ষণীয়। চোখ দুটো একদম যেন পটলের দুটি ভাগ। গায়ের রঙ তো একবারে দুধে আলতা। মাস্টার্স শেষ করে ক’দিন বাদেই সে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ওকে দেখে একেবারেই বুঝা যায় না যে ওর বয়স হয়েছে। এই নিয়ে ক’দিন আগে এক বিপত্তি ঘটলো। এই তো সেদিন দেখলাম কমনরুমের সামনে ও মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ভীষণ মন খারাপ। অনুমান করতে বাকী রইল না, নিশ্চয়ই ওর গুরুতর কিছু হয়েছে। কিন্তু অনুমানের সত্যতা যাচাই করার কোন পথ পাচ্ছিলাম না। পাব কি করে ? অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলেই কুসুম আমার সামনে ঠিক শামুকের মতো মুখ বন্ধ করে থাকে। ও ধারণা করে যে, আমি এ সব তথ্য নিয়ে ওর নামসহ পত্রিকায় লিখব। ইতোপূর্বে একবার অন্য একটি বিষয় নিয়ে লিখেছিলামও বটে। সেই থেকে আমার উপর ওর প্রচণ্ড রাগ।
যাহোক, গোয়েন্দা লাগিয়ে তথ্য উদ্ধার করলাম। জানলাম, ফার্স্ট ইয়ারের এক ছাত্র সুযোগ বুঝে ওর কাছে প্রেম নিবেদন করেছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার ! প্রেমের কাছে বয়সটা ত্রেভেদে হয়ত তেমন কোন ব্যাপার নয়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রেক্ষাপটে জন্য জুনিয়র সিনিয়র অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কুসুম আরো বেশি লজ্জিত এ জন্য যে, ছেলেটা নাকি তার তিন বন্ধু সহ তাকে ঘিরে এই প্রস্তাব দিয়েছিল। ছেলেটা সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিল কুসুম ফার্স্ট ইয়ারেরই ছাত্রী হবে।
বলতে লজ্জা কি ? ছেলেরা যখন কোন মেয়ের প্রেমে পড়ে তখন তার সামনে এমন ভাব করতে রাজী হয়না যাতে তাকে ছোট হতে হয়। যেভাবেই হোক পরিস্থিতি সামলে লজ্জার হাত থেকে রেহাই পেলেই তারা পুরুষ জনম সার্থক জ্ঞান করে। এই যেমন চমককে দেখলাম একদিন ক্যান্টিনে যাচ্ছে। আমি জানি ওর পকেটে টাকা নেই। সকালে ও আমার কাছ থেকে ৫০ টাকা ধার নিয়ে মেসে জমা দিয়েছে। তাও সাথে আবার বিথীর এক বান্ধবী- বেশ মোটা সোটা। মোট মিলে ওরা ৩ জন। অর্ডার হচ্ছে- খাচ্ছে। একটা আইটেম শেষ হলেই আরেক আইটেমের প্রস্তাব। একেবারেই সেই The Luncheon গল্পের পেটুক লেডি গেস্টের মতো। চমক মুখে খুব হাসছে আর স্বাগত জানাচ্ছে নতুন আইটেমের প্রস্তাবকে। কিন্তু আমি জানি এ হাসির আড়ালে ও কতখানি সমস্যা আর বিরক্তি লুকাচ্ছে।
যা হবার তাই হলো। বিপত্তি ঘটলো খাওয়া শেষে। আমি আগেই বলেছি চমকের পকেট একেবারেই শূন্য। অবশেষে বিথীর ভ্যানিটি ব্যাগের দিকে নজর দিতে হলো। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। ওরা কি আর সহজে ছেলেদের পিছনে পয়সা খরচ করতে চায় ? দিব্যি বললো, ‘আমার কাছেও যে টাকা নেই’ ! বেচারা চমকের সে কি লজ্জাজনক পরিস্থিতি তখন !
পরিস্থিতি সেদিন যাই হোক, বড় কথা হলো ওরা এখন সংসার করছে। সব সংশয়-লজ্জা পিছে ফেলে, বাঁধা বিপত্তি পায়ে দলে ক’দিন আগে ওদের বিয়ে হলো। আর ঠিক বিয়ের পর থেকেই চমক আর আমার মাঝে সৃষ্টি হয়েছে এক অদৃশ্য দূরত্ব। আমি জানি বন্ধুর বিয়ে হলে তাকে নিশ্চিত হারাতে হয়। এটাই সত্য- এটাই বাস্তবতা। নারী সংসর্গ পাবার পর ক’জনই বা তার দীর্ঘদিনের গভীর বন্ধুত্বের কথা স্মরণে রাখতে পারে ? অথচ এ দূরত্ব যে কতখানি কষ্টের ! তদুপরি জানতে পারলাম চমকের বউ নাকি আমায় একদম দেখতে পারে না। কথাটা শুনার পর জীবনের প্রথম চা খাওয়ার সময় প্রত্যেকে যেমন তার গাল পুড়িয়ে ফেলে ঠিক সে রকম মন পুড়িয়ে ফেলেছিলাম। কেননা, এই প্রথম কোন নারীর সরাসরি নেতিবাচক মন্তব্য শুনলাম। তাও কিনা আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর বউয়ের মুখে। এ বড় এক কঠিন পৃথিবী, বড়ই নিষ্ঠুর নিয়তি।
সেদিন বিকেলে ক্যাম্পাসের কাশবনে একা একা বসে আছি। চমৎকার পরিবেশ। পাখিরা উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে। গোধূলীর বিচিত্র রং নিয়ে পশ্চিমাকাশে মেঘেরা খেলছে লুকোচুরি খেলা। মনের মধ্যে বইছে এক বিপ্তি ভাবনার ঝড়। দেখলাম চমক আর বিথী আসছে পূর্ব দিক থেকে পোস্ট অফিসের সামনের রাস্তা ধরে। আমাকে দেখে বিথী এমন ভাব প্রকাশ করল যে, এমন পরিস্থিতির জন্য সে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। বিথী দূরে দাঁড়িয়ে থাকল আর চমক এগিয়ে এলো আমার কাছে। ‘কি করছিস একা একা বসে ?’-কথা দিয়ে সূচনা হলো। বললাম, ‘দুর্ভাগ্য আমার, দু’জন হবার সাধ থাকলেও সাধ্য কই ?’
গুনে গুনে এগারটি কথা হলো। তারপর ও বিথীকে সাথে নিয়ে হাসি মুখে ধীরে ধীরে চললো খালেদা জিয়া হলের দিকে। বিথীকে সেখানে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। আমি চেয়ে রইলাম উদাস এক বাউলের মতো ওদের পথের দিকে। গোধূলী তখন লাল আভায় রক্ত ছড়াচ্ছে গোটা ক্যাম্পাসে। সূর্যটা এই বুঝি অদৃশ্য হয়। দেখলাম এক ঝাঁক পাখি ক্ষ্যাপা মেঘের মতো আকাশ জুড়ে উড়ে এলো। এদিক সেদিক ঘুরে শেষে পাখিগুলো ওদের মাথার উপর দিয়ে খালেদা জিয়া হলের পাশের বনে লুকিয়ে গেল।
©somewhere in net ltd.