![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাঙ্গালীত্বের নতুন সঙ্কটঃ ভাষিক সাম্রাজ্যবাদ ও বিবাঙ্গালীআয়ন প্রক্রিয়া
১. ভূমিকা
বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা, জাতীয় ভাষা ও রাষ্ট্র ভাষা। এ ভাষা আমাদের জাতিসত্ত্বার পরিচয় বাহক। সে অর্থে এ ভাষা হলো বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রতীক। কিন্তু ইংরেজি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের কবলে মানুষের ভাষিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সংঘটনের কারণে এ ভাষার মর্যাদা, প্রায়োগিকতা ও গঠন অবনমনের দিকে অগ্রসরমান রয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে এখন বাঙ্গালী জাতি বিবাঙ্গালীআয়ন প্রক্রিয়াধীনে অনুবর্তিত হয়ে জাতিসত্ত্বা বিনাশের ঝুঁকিতে রয়েছে। নিম্নে কয়েকটি অনুচ্ছেদে পর্যায়ক্রমে বিষয়টি সবিস্তারে তুলে ধরা হলো:
২. ভাষিক সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে আমাদের জাতীয় অজ্ঞতা
ভাষা প্রধানত সংজ্ঞাপনের মাধ্যম হলেও, এটি সমাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গও বটে। নিম্নে অর্থনৈতিক, জাতীয়তাবাদী, সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক অনুষঙ্গ হিসাবে ভাষাহলো নিম্নরূপ:
১) অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো―
ক) সংজ্ঞাপনের মাধ্যম,
খ) আভিজাত্যের প্রতীক,
গ) জ্ঞান-গর্বের প্রতীক,
ঘ) পাশ্চাত্যে অভিবাসনের সুযোগ ও
ঙ) সামাজিক গতিশীলতার সিঁড়ি।
২) জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো―
ক) বৃহত্তর জাতীয় সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম,
খ) সামাজিকীকরণের মাধ্যম,
গ) জাতীয়তাবাদের প্রতীক,
ঘ) সভ্যতার বাহন,
ঙ) সামাজিক সম্পদ ও
চ) সাংস্কৃতিক সম্পদ।
৩) সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো―
ক) সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার,
খ) ভিন সংস্কৃতিকে কলুষিত করার হাতিয়ার,
গ) অন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে পরাধীন করার হাতিয়ার বিশেষ।
উপরে বর্ণিত ভাষার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনুষঙ্গ থেকে সহজেই প্রতিমেয় যে, ভাষা হলো সাম্রজ্যবাদীদের কাছে অনুবর্তী জাতির উপর সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের একটি মোক্ষম অস্ত্র বিশেষ। এই অস্ত্র ব্যবহার করে, একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অন্য একটি অনুবর্তী জাতির ভাষার গঠন, মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা নষ্ট করার মাধ্যমে সে জাতির জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে ভাষাকে বিশেষ করে ইংরেজি ভাষাকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক লাভালাভ বিবেচনায় বিদেশি ভাষাকে দেশি ভাষা হিসাবে ব্যবহারের নানারূপ বিপদ রয়েছে। বিষয়টি বোঝানোর জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ভ্রমণপিপাসু মানুষ মাত্রই জানেন যে, বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ ও সর্ব উত্তরের স্থানিক বিন্দু হলো- যথাক্রমে টেকনাফ ও তেতুলিয়া, যা যথাক্রমে কক্সবাজার ও পঞ্চগড় জেলায় অবস্থিত। ধরা যাক, পরাশক্তি সম্পন্ন কোনও দেশ 'ক' ও 'খ' এসে বললো যে, এই দু'টি জেলার উন্নয়নে নিচের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো গ্রহণ করা হবে:
ক) বাড়িঘর নির্মাণের জন্য নগদ অর্থ দান করা হবে,
খ) প্রয়োজন অনুযায়ী রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হবে,
গ) স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল গড়ে তোলা হবে এবং তা পরিচালনার দায়িত্ত্ব নেওয়া হবে,
ঘ) প্রত্যেককে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকুরী দেওয়া হবে ও
ঙ) আধুনিক শিল্প ও কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।
কিন্তু শর্ত হলো যে-
১) এই দুই জেলায় যথাক্রমে 'ক' ও 'খ' ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হবে,
২) বেসরকারি অফিসসমূহও এই ক ও খ ভাষায় পরিচালনা করা হবে ও
৩) এই দুই জেলায় কোনও বাংলা ভাষা মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে না।
তাহলে কী ঐ দুই জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে 'ক' ও 'খ' দেশের এই শর্তগুলো মেনে নেওয়া যায়? সবাই অথবা অধিকাংশই সম্ভবতঃ উত্তর দিবেন যে, অর্থনৈতিক সুবিধা বিবেচনায় বাংলাদেশে বিদেশি ভাষা চাপিয়ে দেয়া সঠিক হবে না। অথচ বাংলাদেশে সম্ভাব্য রাজনৈতিক কুফলের বিষয়টিকে বিবেচনায় না নিয়ে, অর্থনৈতিক লাভালাভের কথা চিন্তা ইংরেজি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ শক্তি দেশে ইংরেজি ভাষাকে মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠিত করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে। ফলশ্রুতিতে দেশের মানুষের ভাষিক মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়েছ, যা বিবাঙ্গালীআয়ন প্রক্রিয়া কার্যকর করার শর্ত তৈরি করেছে।
৩. ভাষিক সাম্রাজ্যবাদ ও বিবাঙ্গালীআয়ন প্রক্রিয়া
বিবাঙ্গালীআয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, মূলত বাঙ্গলায় নওয়াবী শাসনের পতন ও ব্রিটিশ শাসনের উত্থান কালে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিবাঙ্গালীআয়ন প্রক্রিয়াটি ইংরেজি ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের কবলে, দেশব্যাপী সর্বাত্মক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে বাঙ্গলায় নওয়াবী শাসনের পতনে বিবাঙ্গালীআয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। বাঙ্গলার রাজধানীর পতন, বাঙ্গলা ভাগ ও হিন্দি ও উর্দু ভাষার ভাষিক আধিপত্যবাদের কবলে অনুবর্তন—এই সমস্ত কারণে বিংশ শতাব্দী থেকে বাংলা ভাষার অবনমনের সূচনা হয়। বাংলা ভাষার অবনমনের সূত্রপাত হয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়। সে সময় আন্দোলনটির চরিত্র ছিলো একাধারে সাম্প্রদায়িক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যদিও ভাষা আন্দোলন ছিলো না, এই আন্দোলনটিই পরবর্তীকালে নানান রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রনোদণা যোগায়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের বিরক্তি থেকে ইংরেজগণ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ার রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করে। ফলে হিন্দুস্থানী বুলির উন্নয়নে হাওয়া লাগে। এতোদিন হিন্দুস্থানী ভাষা বাংলা ভাষার সমান তালে ছিলো। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা ছাড়া এতোদিন যে হিন্দুস্থানী ভাষা ছিলো অপাংক্তেয়, তা নতুন রাজধানীর কল্যাণে সমৃদ্ধ হতে থাকে। দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয় উর্দুর ভগ্নী ভাষা হিন্দি ভাষা। সেই হিন্দি ভাষার পালে যে হাওয়া লেগেছে, সে হাওয়ায় গতিপ্রাপ্ত হয়ে হিন্দি বর্তমানে সর্বভারতীয় ভাষায় রূপ নিচ্ছে। বর্তমানে হিন্দি একটি আধিপত্যবাদী ভাষায় পরিণত হয়ে, অপরাপর ভাষার উপর মর্যাদা ও কার্যকারিতায় প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া ভেঙ্গে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক শক্তি উর্দু ভাষাকে মর্যাদা ও কার্যকারিতায় প্রতিষ্ঠায় ব্যপৃত হলে, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আদর্শের অনুসারীরা বাংলা ভাষা অধিকার আন্দোলনে ব্যপৃত হয়। ফলে উর্দু ভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয় বটে, কিন্ত প্রায়োগিকতায় পিছিয়ে থাকে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বেগবান হলে, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলা ভাষাকে মর্যাদা ও প্রায়োগিকতায় প্রতিষ্ঠিত করার একটি প্রয়াস ছিলো। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের এক দশকের মধ্যে দেশের মূল ধারার রাজনৈতিক শক্তিগুলো জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আদর্শ বিচ্যুত হয়ে পড়ে এবং দেশে একটি সর্বাত্মক ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও ইংরেজি ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত এই ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থাধীনে শিক্ষা লাভের ফলে, বাঙ্গালী জাতি জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছে এবং বিবাঙ্গালীআয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
৪. বিবাঙ্গালীআয়ন প্রক্রিয়া ও ধ্রুপদী ভাষা চর্চার প্রতি অনীহা
বাঙ্গালীত্বের ভিত নির্মাণ করতে হলে ধ্রুপদী ভাষা চর্চা অবকাঠামো নির্মাণ প্রয়োজন। কিন্তু মূল ধারার রাজনৈতিক শক্তিগুলোর নিকট ধ্রুপদী চর্চার গুরুত্ব স্পষ্ট নয়। সেজন্য তাঁদের কাছে জাতীয় ইতিহাস নির্মাণে সহায়ক ধ্রুপদী জ্ঞান চর্চায় কোনরূপ উদ্যোগ নেই। আর ধ্রুপদী চর্চা ব্যহত হওয়ার কারণে সংস্কৃত, প্রাকৃত ও পালি— এ ভাষাগুলোর চর্চায় অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ এগুলো আমাদের দেশে হাজার বছর ধরে জ্ঞান চর্চার ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এসব ভাষায় আমাদের অতীত ইতিহাস লিপিবদ্ধায়িত রয়েছে। কাজেই এ সব ভাষা চর্চার সুযোগ না থাকলে আমাদের অতীত বিস্মৃত হবে। অথচ আমাদের দেশে ধ্রুপদী চর্চা নেই এবং এর জন্য কোনও অবকাঠামো নেই। সেজন্য বাঙ্গালী জাতির অতীত অনুসন্ধান ব্যহত হচ্ছে। একই কারণে জাতীয় ইতিহাস নির্মাণ ব্যহত হচ্ছে। কিন্তু কোনও জাতি নির্মাণে ধ্রপদী চর্চার বিকল্প নেই।
৫. ইংরেজি শিক্ষা ও জাতিসত্ত্বার সঙ্কট
ইংরেজি শিক্ষা ও সমাজ জীবনে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারের বিস্তৃতির ফলে যে বিবাঙ্গালীআয়ন প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছে, তার ফলশ্রুতিতে বাঙ্গালী জাতির জাতিসত্ত্বা সঙ্কটে নিপতিত হয়েছে। কারণ দেশের কয়েক দশক ধরে ইংরেজি ভাষা দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রধান নিয়ামক হিসাবে অবির্ভূত হয়েছে। কারণ ইংরজি ভাষায় সামাজিকীকরণ ঘটছে এবং এই ভাষার ছাঁচে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর সাস্কৃতিক আচার আচরণ ঢালাইকৃত হচ্ছে, যা বাঙ্গালী সমাজে বিবাঙ্গালীআয়ন প্রক্রিয়া ত্বরাণিত করছে। যে কারণে বাঙ্গালী জাতি নিজেদের অজান্তেই ইংরেজি শিক্ষা মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়ায় জাতিসত্ত্বা বিনাশের ঝুঁকিতে রয়েছে। যা ভবিষ্যতে জাতিসত্বার সঙ্কটরূপে বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।
৬. উপসংহার
উপরের আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, ভাষা যথাক্রমে আত্তীকরণ ও সামাজিকীকরণের নিয়ামক, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বাহন, জাতীয়তাবাদের প্রতীক এবং অন্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য মারণাস্ত্রের মতোই কার্যকরী একটি অস্ত্র। কাজেই ভাষাকে কেবলই সংজ্ঞাপনিক মাধ্যম ভেবে ইংরেজি ভাষাকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের জাতীয় ভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে এবং ধ্রুপদী ভাষা চর্চাকে উপেক্ষা করেআ হচ্ছে। আর ইংরেজি ভাষাকে এমন অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেনো বাঙ্গালী জাতির জাতিসত্ত্বা বিনষ্ট হয়।
©somewhere in net ltd.