নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ \nআধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের আলোকে জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের সম্ভাবনা

২৫ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৬


বাঙ্গালী জাতির প্রচলিত ইতিহাসের একটি সমস্যা হলো এই যে, এই ইতিহাসে বাঙ্গালী জাতির গর্ব ও ঐশ্বর্যের ইতিহাসটি সঠিকভাবে লিপিবদ্ধায়িত হয়নি। এর প্রধান কারণ হলো ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাঙ্গালা সালতানাতের চূড়ান্ত পতনের পর, বাঙ্গালী জাতির কোনো জাতীয় ইতিহাস রচনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এর প্রধান কারণ হলো, ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ— এই চার শতাব্দীকালব্যাপী মুঘল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী শাসনামলে বাঙ্গালী জাতির কোনো ইতিহাস নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি বরং এই তিনটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বাঙ্গালী জাতির অতীত ইতিহাসকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এই সময়ে বাঙ্গালার বহু শিলালেখ, দলিলপত্র ও গ্রন্থ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ পর্যায়ে উল্লেখ্য যে, কোনো রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে, সেই রাজনৈতিক শক্তি পূর্ববর্তী রাজত্বকালের ঐশ্বর্যগুলোকে গোপন করতে বা মুছে দিতে প্রয়াসী হয়। জাপান ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটি মেইজি বিপ্লবের পর, মেইজি সম্রাট তাঁর পূর্ববর্তী তকুগাওয়া রাজত্বকালের অতীত অর্জনগুলো মুছে দিতে প্রয়াসী হয়। তকুগাওয়া শাসনমলের প্রতি তাঁরা এতোটাই বৈরী ছিলো যে, তাঁরা তকুগাওয়া রাজত্বকালের নামই বদলে দেয়। সেজন্য তকুগাওয়া শাসনামলের নাম বদলে তাঁরা এদো শাসনামল রাখে। এদো ছিলো মূলত: তকুগা্ওয়া রাজত্বের রাজধানী শহর। অথচ তকুগাওয়া রাজবংশ প্রায় আড়াই শত (১৬০৩-১৮৬৮ খ্রি.) বছর জাপান শাসন করে। সে সময় তাঁরা জাপানকে একীভূত করে একটি জাতিতে পরিণত করে এবং জাপানকে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এগিয়ে নেয়।

আমরা জানি যে, বাঙ্গালী জাতির সৃষ্টি হয়েছে প্রায় হাজার বছর আগে, অথচ প্রচলিত ইতিহাসে বাংলাদেশের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়ে থাকে ২৬ মার্চ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এভাবে জাতির অতীতকে চেতনায় ধারণ না করে সর্বশেষ একটি মুক্তিযুদ্ধকে মাইলফলক ঘটনা হিসেবে নিয়ে যে রাজনৈতিক ইতিহাস নির্মাণ করা হয়েছে, তা জাতির অতীত সভ্যতা ও ঐতিহ্যের আংশিক বর্ণনা বিশেষ। তা সত্ত্বেও সংক্ষিপ্ত কালব্যপ্তির মধ্যে এই ইতিহাস নির্মাণ করার কারণ হলো ইতিহাস বিস্মৃতি। বাঙ্গালী জাতির এই ইতিহাস বিস্মৃতি ঘটেছে, ভিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কবলে নিপতিত হওয়ার কারণে। বস্তত: বাঙ্গালী ইতিপূর্বে মোটামুটি চার শতাব্দীকালে ধরে মুঘল সাম্রাজ্য (১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রি.) ও দুই শতাব্দীকাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের (১৭৫৭-১৯৫৭ খ্রি.) শাসনাধীনে নিপতিত ছিলো। এই দু’টি বহিরাগত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিনষ্ট করতে বাঙ্গালী জাতির সভ্যতা ও ঐতিহ্যকে মুছে দিতে প্রয়াসী হয়। তারা নিজেদের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসকে কালক্রমে বিকৃত করতে প্রয়াসী হয় এবং বাঙ্গালী জাতির স্মারক বিভিন্ন নিদর্শন, যেমন- রাজধানী গৌড়কে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। বিস্ময়ের বিষয় হলো এই যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের পর, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভারতও সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে, নতুন ধারার ইতিহাস নির্মাণ শুরু করে। কিন্তু বাঙ্গালার একাংশ বাংলাদেশ নামে স্বাধীন হলেও, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের প্রয়োজনীতার প্রতি বিদ্বজনের মধ্যে কোনো স্পৃহা জন্মায়নি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে নতুন করে ইতিহাস লেখার উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। উল্লেখ্য যে, চীনের হান জাতি দীর্ঘ কাল মোঙ্গল সাম্রাজ্য (১২৭১-১৩৬৮ খ্রি.) ও মাঞ্চু সাম্রাজ্যের (১৬৬৬-১৯১২ খ্র.) অধীনে নিপতিত ছিলো। তবে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পর তাঁরা খ্রিষ্টপূর্ব কালকে প্রারম্ভ বছর ধরে তাঁদের ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণ করে। হান জাতির ইতিহাস পুনর্নির্মাণের নজিরটিকে সামনে নিয়ে বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস পুনর্নির্মাণ করা উচিত। উল্লেখ্য যে, একটি জাতির ইতিহাসকে পূর্ণাঙ্গভাবে বিবৃত করতে হলে, জাতির অতীত অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঘটনা প্রবাহকে কালানুক্রমিকভাবে তুলে ধরতে হয়। বাঙ্গালী জাতির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নির্মাণ করতে হলে প্রথম রাষ্ট্রব্যবস্থা পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার বছর ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দকে প্রারিম্ভিক কাল ধরে অতীত কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ইতিহাসকে পুনর্লিখন করা প্রয়োজন।

ইতিহাস নির্মাণের উক্ত ধারণাগত প্রেক্ষাপটে, বাঙ্গালার ইতিহাসটি নিম্নরূপভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। চতুর্থ শতাব্দীতে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর দেশ জুড়ে রাজনৈতিক শুন্যতা চলতে থাকলে, এক পর্যায়ে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে বরেন্দ্রের ভূমিপুত্র গোপাল গৌড়ে রাজধানী স্থাপন করে পাল সাম্রাজ্য (৭৫০-১১৬১খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই সাম্রাজ্যের সম্রাটগণ উত্তর-পশ্চিমে গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্য (৭৩০-১০৩৬খ্রি.), দাক্ষিণাত্যে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য (৭৫৩-৯৮২ খ্রি.) ও পশ্চিমে চালুক্য সাম্রাজ্য (৯৭৫-১১৮৪খ্রি.) এবং পূর্বাঞ্চলে বাগান সাম্রাজ্যের (৮৪৯-১২৯৭খ্রি.) বিরুদ্ধে যুজে ১১৬১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন। তৎপরবর্তীতে সেন সাম্রাজ্য (১০৭০-১২৩০) সহ কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য স্বাধীনতা বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলো বটে, কিন্তু মধ্য এশিয়া থেকে নতুন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চিন্তা ও দর্শন নিয়ে আগত মুসলমানগণ বাঙ্গালাকে শাসনে ব্যপৃত হয়। সারা ভারতবর্ষ যখন মুসলমান শাসকদের শাসনাধীনে নিপতিত হতে থাকে, তখন শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৪৮৭খ্রি.) নামক এক মুসলিম নেতা পাল সাম্রাজ্যস্থ জনগণের পক্ষে ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন বাঙ্গালা সালাতানাত (১৩৫২-১৫৭৩ খ্রি.) নামক নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করেন। এই সালতানাত ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লী সালতানাত, দাক্ষিণাত্য ও বার্মার আধিপত্য থেকে বাঙ্গালার স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হন। এই বাঙ্গালা সালতানাতের নাম থেকে এই দেশ, জাতি ও ভাষা যথাক্রমে বাঙ্গালা দেশ, বাঙ্গালী জাতি ও বাঙ্গালা ভাষা অভিধা লাভ করে। ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীস্থ মুঘল সাম্রাজ্যের হাতে এই স্বাধীন বাঙ্গালা দেশের রাজধানী গৌড়ের পতন ঘটলে, প্রথমে মুঘল সাম্রাজ্যের (১৫৭৩-১৭৫৭ খ্রি.) অধীনে এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের (১৭৫৭-১৯৪৭খ্রি.) শাসনাধীনে নিপতিত হয়। মুঘল শাসনাধীনে নিপতিত হওয়ার প্রাক্কালে বারো ভূঁইয়াদের সমর্থনে ঈশা খাঁন (১৫৩৬-১৫৯৯খ্রি.) পরাধীন বাঙ্গালা দেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে ব্যপৃত ছিলেন। কিন্তু তিনি স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। তৎপরবর্তীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনে নিপতিত হলে এ দেশের মানুষ ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ), সাঁতাল হুল (১৮৫৫ খ্রি.), সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭খ্রি.) ও নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯খ্রি) ইত্যাদি আন্দোলনের মাধ্যমে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, ফজলুল হক, শরৎ বসু, কিরণ শংকর রায় (১৮৯১-১৯৪৯), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হোসেন প্রমূখ নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ শাসনাধীন ব্রিটিশ বেঙ্গল থেকে স্বাধীন বাঙ্গালা গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপধ্যায়, খাজা নাজিমউদ্দীন, জ্যোতি বসু ও আবুল হাশিম প্রমুখের বিরোধিতায় বাঙ্গালা দেশ স্বাধীন হতে পারেনি বরং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সৃষ্ট ভারত (১৯৪৭-বর্তমান কাল পর্যন্ত) ও পাকিস্তানের (১৯৪৭-১৯৭১) শাসনাধীনে নিপতিত হয়। অত:পর ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙ্গালাবর্তের একটি অংশের জনগণ স্বাধীনতার জন্য গণআন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রামে ব্যাপৃত হয়। অত:পর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ নামে স্বাধীনতা লাভ করে।

উক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, বাঙ্গালী জাতির প্রথম রাষ্ট্রব্যবস্থা (৭৫০-১১৬১ খ্রি.), দ্বিতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা (১৩৫২-১৫৭৬ খ্রি.) ও তৃতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা (১৯৭১- ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো যথাক্রমে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে, ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে ও ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে, যেগুলোর প্রতিষ্ঠাতাগণ ছিলেন যথাক্রমে মহামতি গোপল, শাহ-ই-বাঙ্গালা সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বর্তমানে যেহেতু বাঙ্গালীদের জন্য ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে একটি নাগরিক রাষ্ট্র অর্জিত হয়েছে এবং বাঙ্গালী সমসত্ত্ব জাতি হিসেবে সুগঠিত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে, সেজন্য এই জাতির জন্য একটি জাতিরাষ্ট্র নির্মাণ করার মতো ঐতিহাসিক ও আদর্শিক ভিত্তি বিদ্যমান রয়েছে। কাজেই এখন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আদর্শের অনুসরণে চতুর্থ রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণ করার উপযুক্ত সময়। কাজেই বাঙ্গালী জাতির জন্য একটি জাতিরাষ্ট্র নির্মাণে সহায়ক রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মসূচী প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.