![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
১. ভূমিকা
একবিংশ শতাব্দীতে জ্ঞান-গবেষণার আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং নির্ধারণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। গবেষণার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সে অনুযায়ী দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তর্জাতিক র্যাংকিং বৃদ্ধির জন্য বাংলা ভাষার জার্নালগুলোকে ইউজিসি ও অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের উদ্যোগে SCOPUS Indexing করানো এখন সময়ের দাবি।
উল্লেখ্য যে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া মালয় ভাষায় এই ইনডেক্সিং সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। জাপানও তার জাতীয় ভাষায় প্রকাশিত জার্নালগুলোর আন্তর্জাতিক মানের ইনডেক্সিং নিশ্চিত করেছে। এই পদক্ষেপ না নেওয়া হলে দেশের শিক্ষক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে, এবং বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চার গৌরবময় ঐতিহ্য বিশ্ব দরবারে অদৃশ্য থেকে যাবে।
২. প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা একটি সুপ্রতিষ্ঠিত আইনি কাঠামোর ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, যার কেন্দ্রে রয়েছে গতানুগতিক শিক্ষার ধারা। এই ব্যবস্থা মূলত ডিগ্রী প্রদানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির একটি প্রক্রিয়া, যা সমাজে জ্ঞানার্জনের একটি প্রমিতকৃত পথ হিসেবে বিবেচিত। তবে, এই ডিগ্রী অর্জনই যে ব্যক্তিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্ঞানদীপ্ত করে তোলে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
প্রকৃত জ্ঞানদীপ্তির সন্ধান লাভ করতে হলে প্রয়োজন বিশ্ববীক্ষা নিয়ে অবিরাম অধ্যবসায়, গভীর জিজ্ঞাসা ও নিরন্তর জ্ঞানানুশীলন—এসব প্রায়শই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সীমানা অতিক্রম করে যায়। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখা রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য। অন্যদিকে, যারা আত্মজিজ্ঞাসা থেকে উৎসারিত প্রেরণায় প্রকৃত জ্ঞানসাধনায় ব্রতী, তাদের পক্ষে প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই থেকে বিশ্ববীক্ষা নিয়ে সাধনা ও জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থাকাই স্বাভাবিক।
৩. দেশজ জ্ঞান চর্চার চ্যালেঞ্জ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সংকট
এই প্রেক্ষাপটে একটি জ্বলন্ত সমস্যা হিসেবে উদ্ভূত হয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রশ্ন। "আমি বাংলা লিখি, আমার কোনো 'সাইটেশন' নাই, ইমপ্যাক্ট জার্নালে প্রকাশনা নাই। আমাকে পেটভরে 'মূর্খ' বলতে পারেন। কিন্তু তাতে দেশজ শিক্ষা জিজ্ঞাসার নিষ্পত্তি হয়ে যাবে না"—এই মর্মন্তুদ উক্তিটি বাংলা ভাষায় জ্ঞান সৃষ্টি ও প্রকাশের সাথে জড়িত গবেষকদের হতাশা ও হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার অনুভূতিকে তীব্রভাবে তুলে ধরে।
এটি শুধু ব্যক্তিগত আক্ষেপ নয়, এটি দেশীয় ভাষায় গড়ে ওঠা জ্ঞানভাণ্ডারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অদৃশ্য করে রাখার একটি পদ্ধতিগত সমস্যারই ইঙ্গিত। বাংলায় উৎকৃষ্ট গবেষণা সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক সূচকে (যেমন স্কোপাস, ওয়েব অফ সায়েন্স) এর অনুপস্থিতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং এবং গবেষকদের স্বীকৃতি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলস্বরূপ, দেশের শিক্ষক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
৪. বাংলা জার্নাল স্কোপাস ইনডেক্সিংয়ের কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা
অতএব, বাংলাদেশের জন্য জরুরি পদক্ষেপ হলো বাংলা ভাষায় প্রকাশিত গুণগত গবেষণা জার্নালগুলোর স্কোপাস ইনডেক্সিং নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের সমন্বিত ও সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন।
৪.১ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ:
১. মানদণ্ড প্রণয়ন: কোন জার্নালগুলো ইনডেক্সিংয়ের জন্য উপযুক্ত হবে, তার জন্য কঠোর ও স্বচ্ছ বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড (পিয়ার রিভিউ পদ্ধতি, নিয়মিত প্রকাশনা, সম্পাদকীয় বোর্ডের মান, গবেষণার নৈতিকতা ইত্যাদি) স্থির করতে হবে। এর জন্য আন্তর্জাতিক পিয়ার রিভিউ প্রক্রিয়া, সম্পাদকীয় বোর্ডের মান, গবেষণার মৌলিকত্ব ও অবদানের গুরুত্ব বিবেচনা করতে হবে।
২. জার্নাল নির্বাচন ও উন্নয়ন: প্রণীত মানদণ্ডের ভিত্তিতে বাংলা জার্নালগুলোকে যাচাই-বাছাই করে স্কোপাসে অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রস্তুত করতে হবে। প্রয়োজনে জার্নাল সম্পাদক ও প্রকাশকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নিয়মিত প্রকাশনা, সময়মতো প্রকাশ এবং ডিজিটাল অ্যাক্সেসিবিলিটি নিশ্চিত করতে হবে।
৩. প্রক্রিয়ায় সহায়তা: স্কোপাসের মতো ডাটাবেসে ইনডেক্সিংয়ের জটিল প্রক্রিয়ায় জার্নালগুলোকে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। আন্তর্জাতিক গবেষকদের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৪. অর্থায়ন ও নীতিগত সমর্থন: এই উদ্যোগের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ এবং জাতীয় গবেষণা নীতিতে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত স্কোপাস-ইনডেক্সড গবেষণার স্বীকৃতি ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা: জাপান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সাফল্য
এই সংকটের একটি কার্যকর ও প্রমাণিত সমাধানের পথ দেখিয়েছে জাপান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ। জাপান তার জাপানি ভাষার জার্নালগুলোর জন্য শক্তিশালী ইনডেক্সিং সিস্টেম গড়ে তুলেছে, যার অনেকগুলোই আন্তর্জাতিক ডাটাবেসে স্থান পেয়েছে। জাপানের এই সাফল্য প্রমাণ করে যে মাতৃভাষায় উৎকৃষ্ট গবেষণা পরিচালনা করেও বিশ্বমানের স্বীকৃতি অর্জন করা সম্ভব।
একইভাবে, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া তাদের জাতীয় ভাষা (মালয়/ইন্দোনেশীয়)-তে প্রকাশিত গবেষণাকে স্কোপাসের মতো বিশ্বমানের ইনডেক্সে অন্তর্ভুক্ত করতে সফল হয়েছে। এই সাফল্য প্রমাণ করে যে মাতৃভাষায় উৎকৃষ্ট গবেষণা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিদার এবং তা অর্জনও সম্ভব।
এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হলো যে, নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গবেষণা পরিচালনা করেও আন্তর্জাতিক মানের জার্নাল প্রকাশ সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, যথাযথ বিনিয়োগ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা।
৬. উপসংহার: দেশজ জ্ঞানকাণ্ডের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার আইনি কাঠামো ও এর সীমাবদ্ধতা বাস্তবতা। তবে, এই কাঠামোর মধ্য থেকেই বাংলা ভাষায় যে মূল্যবান জ্ঞানসৃষ্টি ও গবেষণা চলছে, তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারে পরিণত হওয়া উচিত।
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও জাপানের মডেল অনুসরণ করে ইউজিসি ও অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের নেতৃত্বে বাংলা জার্নালগুলোর স্কোপাস ইনডেক্সিং নিশ্চিত করা গেলেই কেবল দেশের গবেষকদের শ্রম সার্থক হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তর্জাতিক র্যাংকিং বৃদ্ধি পাবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চার গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য বিশ্ব দরবারে তার প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করবে।
এটি শুধু 'সাইটেশন' বা 'ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর'-এর প্রশ্ন নয়, এটি দেশীয় জ্ঞানকাণ্ডের মর্যাদা ও আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য পদক্ষেপ। বাংলা ভাষার জার্নাল ইনডেক্সিং শুধুমাত্র একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজন নয়, বরং এটি দেশজ জ্ঞান চর্চার নবজাগরণের সূচনা করতে পারে।
এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের গবেষকদের মাতৃভাষায় চিন্তা ও গবেষণা করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ তৈরি করবে। দেশের শিক্ষক ও গবেষকরা তাদের দেশজ জ্ঞান, সংস্কৃতি ও চিন্তাধারাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করানোর সুযোগ পাবেন। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তর্জাতিক র্যাংকিং উন্নতি ঘটবে, যা জাতীয় গৌরবের বিষয় হয়ে উঠবে।
সময় এসেছে আমাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে জ্ঞান চর্চাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার। বাংলা ভাষার জার্নাল ইনডেক্সিং এই লক্ষ্য অর্জনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে।
©somewhere in net ltd.