![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
১. ভূমিকা
আধুনিক বিশ্বে ধর্মীয় রাজনীতি বহুমাত্রিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। বিশেষত ইসলামী আদর্শভিত্তিক আন্দোলনগুলো একদিকে শান্তিপূর্ণ দাওয়াহ, সামাজিক সংস্কার ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে অগ্রসর হচ্ছে; অন্যদিকে, সহিংস প্রতিরোধ, আত্মঘাতী হামলা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের রূপ নিয়েছে। এ দুই ধারা একে অপরের পরিপূরক না হলেও, উভয়ের ভিতেই নিহিত রয়েছে ইসলামী রাজনৈতিক তত্ত্ব, শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা এবং উম্মাহর পুনর্গঠনের আদর্শ।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের আন্দোলনগুলো বহুবিধ মাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে। মৃদু আচরণ—যেমন সমালোচনা, ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা, মিছিল-মিটিং—থেকে শুরু করে তীব্রতম কর্মকাণ্ড—যেমন আত্মঘাতী বোমা হামলা ও সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদ—সবই ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অংশ হিসেবে বিবেচিত। এই প্রবন্ধে আমরা (১) এসব কর্মকাণ্ডের আদর্শগত ভিত্তি, (২) গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীর শ্রেণিবিন্যাস এবং (৩) সহিংসতার মাত্রা ও রাজনৈতিক কৌশলগত দিক বিশ্লেষণ করব।
________________________________________
২. আদর্শগত ভিত্তি: ইসলামী রাজনৈতিক তত্ত্ব ও আন্দোলনের প্রেরণা
ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মকাণ্ড মূলত কয়েকটি ধর্মতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে আছে।
1. তাওহীদ ও উম্মাহর ঐক্য
ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ধারণা হলো—মুসলিম সমাজকে একটি ঐক্যবদ্ধ দেহ (Ummah) হিসেবে দেখা। এখানে ভৌগোলিক জাতিরাষ্ট্রের সীমারেখা গৌণ; প্রাথমিক লক্ষ্য হলো মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পুনর্গঠন।
2. শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা
ইসলামী আন্দোলনের অধিকাংশ দলই মনে করে, আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা ইসলামের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। সুতরাং রাষ্ট্রীয় আইনব্যবস্থায় কোরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক শরিয়াহ প্রয়োগ করা অপরিহার্য।
3. জাহেলিয়াত প্রত্যাখ্যান
সাইয়্যেদ কুতুবের ভাষায়, আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতা ‘জাহেলিয়াত’-এর নতুন রূপ। তাই ইসলামী আন্দোলন পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত এক বিকল্প সভ্যতা নির্মাণকে লক্ষ্য করে।
4. জিহাদ ও প্রতিরোধ
ইসলামী রাজনৈতিক তত্ত্বে জিহাদকে শুধুমাত্র যুদ্ধ হিসেবে নয়, বরং অত্যাচার প্রতিরোধ, ইসলাম রক্ষা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হিসেবে দেখা হয়। চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো জিহাদকে আক্রমণাত্মক রূপে প্রয়োগ করে।
5. শহীদ ও আত্মত্যাগের মহিমা
আত্মঘাতী হামলাকারীদের কর্মকাণ্ড ইসলামী আন্দোলনের এক চরম রূপ, যা তারা পরকালীন মুক্তি ও নৈতিক গৌরব অর্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখে।
________________________________________
৩. কর্মকাণ্ডের মাত্রা: মৃদু থেকে তীব্র রূপ
ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে কর্মকাণ্ড একটি ধারাবাহিক বর্ণালীতে অবস্থান করে:
৩.১. মৃদু রূপ (Soft Approaches)
• দাওয়াহ ও প্রচার: তাবলিগ জামাতের মতো গোষ্ঠী সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধ বিস্তারে মনোযোগী।
• রাজনৈতিক সমালোচনা: পশ্চিমা সভ্যতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও দুর্নীতিপরায়ণ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বক্তৃতা, বই, এবং মিডিয়া প্রচারণা।
৩.২. মধ্যম রূপ (Moderate Political Mobilization)
• দলীয় রাজনীতি: জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
• আন্দোলন: মিছিল, ধর্মঘট, অবরোধের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ।
• দলবদ্ধ ভীতি প্রদর্শন: প্রতিপক্ষের ওপর সামাজিক বয়কট, ভাংচুর বা মারপিট।
৩.৩. তীব্র রূপ (Radical & Violent Approaches)
• সশস্ত্র প্রতিরোধ: জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মতো গোষ্ঠী বোমা হামলা, হত্যা, অপহরণের মতো কর্মকাণ্ড চালায়।
• আন্তর্জাতিক জিহাদ: আল-কায়েদা, আইএস-এর মতো সংগঠন বৈশ্বিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মঘাতী হামলাসহ চরম সহিংস পন্থা গ্রহণ করে।
________________________________________
৪. দল, উপদল ও গোষ্ঠীর শ্রেণিবিন্যাস
৪.১. প্রধানধারার রাজনৈতিক দল
• বাংলাদেশে: জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
• লক্ষ্য: শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
৪.২. দাওয়াহ ও সংস্কারমূলক গোষ্ঠী
• তাবলিগ জামাত: সম্পূর্ণ অহিংস পদ্ধতিতে ইসলামী জীবনধারা প্রচার।
• দাওয়াহ প্রচার সংস্থা: মসজিদভিত্তিক শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কার।
৪.৩. চরমপন্থী জিহাদি গোষ্ঠী
• আন্তর্জাতিক: আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট (আইএস)।
• বাংলাদেশে: জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসারুল্লাহ বাংলা টিম।
• লক্ষ্য: সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠা ও বৈশ্বিক উম্মাহর পুনর্গঠন।
৪.৪. উপগোষ্ঠী ও বিচ্ছিন্ন দল
• বড় সংগঠনগুলো ভেঙে ছোট ছোট উপগোষ্ঠীতে পরিণত হয়, যারা স্থানীয় প্রেক্ষাপটে অভিযোজিত কৌশল গ্রহণ করে।
________________________________________
৫. আদর্শ ও কৌশলের আন্তঃসম্পর্ক
ইসলামী আন্দোলনের আদর্শ ও কৌশল পরস্পর গভীরভাবে জড়িত।
• ইবনে তাইমিয়াহ ও সাইয়্যেদ কুতুবের তত্ত্ব চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে ধর্মীয় বৈধতা দেয়।
• সালাফি-জিহাদি মতবাদ সহিংস জিহাদকে বৈধ প্রতিরোধ হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
• মুসলিম ব্রাদারহুড মডেল রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে চায়।
________________________________________
৬. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতি ঐতিহাসিকভাবে ঔপনিবেশিকতা, পাকিস্তানি সামরিক শাসন ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে বেড়ে উঠেছে।
• ৭০–৮০-এর দশক: জামায়াতে ইসলামী পুনর্গঠিত হয়ে সাংবিধানিক রাজনীতিতে প্রবেশ করে।
• ৯০-এর দশক: তাবলিগ জামাতের প্রভাব বিস্তার।
• ২০০০-এর পর: জেএমবি ও অন্যান্য জিহাদি গোষ্ঠীর উত্থান এবং আত্মঘাতী হামলা।
________________________________________
৭. নৈতিকতা, বৈধতা ও বৈশ্বিক বিতর্ক
ইসলামী আন্দোলনের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্বে দ্বিমুখী বিতর্ক রয়েছে।
• একদিকে: এসব আন্দোলনকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ধর্মীয় অধিকারের দাবিদার হিসেবে দেখা হয়।
• অন্যদিকে: আত্মঘাতী হামলা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত।
________________________________________
৮. উপসংহার
ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত কর্মকাণ্ডগুলোকে একমাত্রিকভাবে দেখা যায় না। এগুলো শান্তিপূর্ণ দাওয়াহ থেকে সহিংস জিহাদ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি ধারাবাহিকতার অংশ। এর পেছনে নিহিত আছে গভীর আদর্শ—শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও উম্মাহর পুনর্গঠন। ফলে এই আন্দোলনগুলোকে বোঝার জন্য কেবল নিরাপত্তা-ভিত্তিক দৃষ্টিকোণ যথেষ্ট নয়; বরং ধর্মতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে একসাথে বিশ্লেষণ করতে হবে।
________________________________________
তথ্যসূত্র
(উদাহরণস্বরূপ)
1. Qutb, S. (1964). Milestones. Damascus: Dar al-Ilm.
2. Esposito, J. L. (1999). The Islamic Threat: Myth or Reality? New York: Oxford University Press.
3. Roy, O. (2004). Globalized Islam: The Search for a New Ummah. New York: Columbia University Press.
4. Riaz, A. (2016). Political Islam and Governance in Bangladesh. London: Routledge.
5. Kepel, G. (2002). Jihad: The Trail of Political Islam. Cambridge: Harvard University Press.
©somewhere in net ltd.