![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
________________________________________
১. ভূমিকা
ইসলামী আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলন ও দলসমূহ নিজেদেরকে প্রায়শই ন্যায়, সত্য ও শান্তির ধারক হিসেবে উপস্থাপন করে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক, বিনয়ী আচরণ, কোরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক বক্তৃতা এবং আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার আহ্বানের মাধ্যমে তারা জনতার সামনে নিজেদেরকে আল্লাহর নিয়োজিত নেতা হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। তাদের বক্তব্যে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং বামপন্থী মতাদর্শকে শয়তানপ্রসূত অন্যায়ের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই দলগুলো ও তাদের নেতারা কি বাস্তবিক অর্থে নৈতিকভাবে অপরিবর্তনীয়, মানবীয় দুর্বলতামুক্ত সত্তা? ইসলামী শিক্ষার আলোকে দেখা যায়, মানুষের অন্তরে সর্বদাই নফস, রিপু এবং শয়তানের প্ররোচনা সক্রিয়। সেই অর্থে, আল্লাহ নিয়োজিত দাবি করা দল ও নেতারাও তাদের অন্তরের মানবীয় দুর্বলতা থেকে মুক্ত নয়। এই প্রবন্ধে আমরা ইসলামী দলগুলোর ন্যায়ের দাবির পেছনের আদর্শ এবং মানবীয় সীমাবদ্ধতা থেকে উদ্ভূত বৈপরীত্য বিশ্লেষণ করব।
________________________________________
২. ইসলামী দলের আত্ম-উপস্থাপন: ন্যায় ও শান্তির একচ্ছত্র দাবিদার
ইসলামী দলগুলো নিজেদেরকে সমাজে নৈতিকতার একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে। তাদের প্রধান বক্তব্যের দিকগুলো হলো—
• কোরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা: তারা মনে করে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ শয়তানের প্ররোচনায় গঠিত এবং কেবল শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থাই ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
• নেতৃত্বের ঈশ্বরপ্রদত্ত বৈধতা: নেতা ও আলেমদের "আল্লাহ নিয়োজিত" হিসেবে বর্ণনা করা হয়। জনতা তাদের সামনে ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অনুসারী হিসেবে উপস্থাপিত হয়।
• প্রতিপক্ষের অস্বীকৃতি: ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থী আদর্শকে অশুভ এবং অন্যায়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই আত্ম-উপস্থাপন কৌশল মূলত জনগণের মধ্যে নৈতিক উচ্চতর ভাবমূর্তি গঠন এবং আন্দোলনের বৈধতা প্রতিষ্ঠার উপায়।
________________________________________
৩. মানবীয় দুর্বলতা ও বৈপরীত্য: রিপু, নফস ও শয়তানের প্ররোচনা
কোরআন ও হাদিসে মানবসত্তার দুর্বলতা একটি মৌলিক সত্য হিসেবে স্বীকৃত। ইসলামী শিক্ষায় মানুষকে দ্বৈত সত্তা হিসেবে দেখা হয়—
• আল্লাহর পথে সমর্পিত মুসলিম হতে পারে, আবার
• ফাসিক, ফাজির, মুনাফিক, কাফির, মুশরিক, যিন্দিক, মুরতাদ কিংবা মুলহিদ রূপেও পরিগণিত হতে পারে।
অতএব, যে নেতারা নিজেদেরকে আল্লাহ নিয়োজিত দাবি করেন, তারাও মানবীয় দুর্বলতা, নৈতিক বিচ্যুতি কিংবা শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্ত নন। এখানেই বৈপরীত্য—ন্যায় প্রতিষ্ঠার দাবিদার দলের ভেতরেই অন্যায়ের বীজ লুকিয়ে থাকে।
________________________________________
৪. কর্মকাণ্ডের বাস্তবতা: নৈতিকতা বনাম রাজনৈতিক কৌশল
ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহীত কর্মকাণ্ডগুলোও নৈতিকতার সরলরেখায় সীমাবদ্ধ নয়। বরং এগুলো একটি বহুমাত্রিক বর্ণালীতে অবস্থান করে—
৪.১. মৃদু রূপ (Soft Approaches)
• দাওয়াহ, দিকনির্দেশনা, সমাজ সংস্কার।
• রাজনৈতিক বক্তৃতা ও মিডিয়া প্রচারণা।
৪.২. মধ্যম রূপ (Moderate Political Mobilization)
• নির্বাচনে অংশগ্রহণ, মিছিল, অবরোধ।
• প্রতিপক্ষের উপর সামাজিক চাপ ও ভীতি প্রদর্শন।
৪.৩. তীব্র রূপ (Radical & Violent Approaches)
• সশস্ত্র প্রতিরোধ, হত্যা, অপহরণ।
• আত্মঘাতী হামলা ও আন্তর্জাতিক জিহাদি তৎপরতা।
এখানেই মূল সংকট: যারা নিজেদের ন্যায় ও সত্যের ধারক বলে মনে করে, তারাই একইসাথে রাজনৈতিক স্বার্থে সহিংস কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়।
________________________________________
৫. বৈপরীত্যের ধর্মতাত্ত্বিক তাৎপর্য
এই বৈপরীত্য ইসলামী চিন্তায় নতুন কিছু নয়। কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
"হে মুমিনগণ! তোমরা কেন এমন কথা বল যে কাজ তোমরা কর না? আল্লাহর কাছে অত্যন্ত নিন্দনীয় যে তোমরা এমন কথা বল যা তোমরা কর না।" (সূরা আস-সাফ, ৬১:২–৩)
অতএব, ইসলামী আন্দোলনের নেতাদেরও আত্মসমালোচনা প্রয়োজন, কারণ ন্যায় প্রতিষ্ঠার আহ্বান মানবীয় দুর্বলতা ও ক্ষমতার লালসা দ্বারা প্রভাবিত হলে তা ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে বিকৃত করে।
________________________________________
৬. রাজনৈতিক প্রভাব: ন্যায়ের দাবি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
ন্যায় প্রতিষ্ঠার আহ্বান প্রায়শই রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের সাথে জড়িয়ে যায়।
• ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থী প্রতিপক্ষকে দমন: তাদেরকে "শয়তানের হাতিয়ার" হিসেবে চিহ্নিত করে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ধর্মীয় নৈতিকতার আড়ালে বৈধ করা হয়।
• ক্ষমতার পবিত্রকরণ: নিজেদের শাসনকে আল্লাহর বিধান হিসেবে বৈধতা দেওয়া হয়, যা আসলে মানবিক নেতৃত্বের সমালোচনার বাইরে যেতে চায়।
________________________________________
৭. উপসংহার
ইসলামী দলগুলো নিজেদেরকে ন্যায় ও সত্যের একচ্ছত্র ধারক হিসেবে উপস্থাপন করলেও বাস্তবিক অর্থে তারা মানবীয় দুর্বলতা, নৈতিক বিচ্যুতি এবং শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্ত নয়। ন্যায় প্রতিষ্ঠার এই দাবি তাই গভীর বৈপরীত্যপূর্ণ।
এ প্রবন্ধের আলোচনায় স্পষ্ট—ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী আদর্শের আহ্বান গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এর বাস্তবায়নে মানবসৃষ্ট সীমাবদ্ধতা ও রাজনৈতিক স্বার্থের মিশ্রণ অনিবার্য। অতএব, ইসলামী আন্দোলনকে টেকসই ও বিশ্বাসযোগ্য করতে হলে নৈতিক আত্মসমালোচনা, অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি এবং আদর্শিক-রাজনৈতিক বৈপরীত্য মোকাবিলা অপরিহার্য।
________________________________________
তথ্যসূত্র (নমুনা)
1. Esposito, J. L. (1999). The Islamic Threat: Myth or Reality? Oxford University Press.
2. Qutb, S. (1964). Milestones. Damascus: Dar al-Ilm.
3. Riaz, A. (2016). Political Islam and Governance in Bangladesh. Routledge.
4. Roy, O. (2004). Globalized Islam: The Search for a New Ummah. Columbia University Press.
5. Kepel, G. (2002). Jihad: The Trail of Political Islam. Harvard University Press.
©somewhere in net ltd.