নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অর্থনীতিবিদ

অর্থনীতিবিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সৃষ্টিশীলতাঃ বাস্তবতা আর কিছু প্রত্যাশা

০১ লা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ২:২৭


স্কুলে থাকতে সনেট এবং জাহিদ পর্যায়ক্রমে ছিলো আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। তারা ছিলো অনেক মেধাবী। প্রতিটা বিষয়ে তারা চমকপ্রদ নাম্বার পেতো। আমি আবার ছিলাম মোটামুটি মানের ছাত্র। মানে কোনোমতে টেনেটুনে পাশ করতাম আরকি। সনেট যেখানে অঙ্কে 100 এর মধ্যে 98 পেয়ে মন খারাপ করতো (100 তে 100 কেন হলো না তাই), আমি সেখানে 33 পেলে খুশিতে নিজেকে কলম্বাস জাতীয় কিছু একটা ভাবতাম যে কিনা ইন্ডিয়া আবিষ্কার করার পরিবর্তে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আবিষ্কার করে ফেলেছিলো। স্কুলের শিক্ষকরা সনেট, জাহিদের মেধা দেখে বিস্মিত হতেন। তারা সবাই নিশ্চিত যে এই দুই ছেলে বড় হয়ে নিশ্চয়ই অনেক বড় কিছু করে ফেলবে, অনেক বড় কিছু হবে। সনেট, জাহিদ স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে নটরডেমে পড়লো, বুয়েটে পড়লো, ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বের হলো, ভালো চাকরী পেলো, বিয়ে করলো, বাচ্চাকাচ্চা হলো অর্থাৎ এমন একটা জীবন তারা পেলো যে জীবন স্কুলের সুরুজ্জামান, আনোয়ার, জামিল, জানে আলম, তরিকুল, আহমদ, নিপু, গাফফার, জুয়েল স্কুলে কোনো চমকপ্রদ রেজাল্ট না করেই অতিবাহিত করছে। অর্থাৎ সবার জীবন এখন এক ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়? কে মেধাবী? দিনশেষে তো সবই এক হয়ে গেলো। আমরা কি পেলাম সেই সনেট আর জাহিদদের কাছ থেকে?

পাওয়া বলতে কী বুঝাচ্ছি সেটা একটু ব্যাখ্যা করি। ধরুন, আপনি এখন মারা গেলেন। তারপর কতজন মানুষ আপনাকে পরবর্তীতে মনে রাখবে? আপনাকে স্মরণ করবে? আপনার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ছেলেমেয়ে, পাড়া-প্রতিবেশী এরাই তো আপনাকে মনে রাখবে। সংখ্যাটা বড়জোর এক-দেড়শো হবে। আর বছর হবে বড়জোর দশ-বিশ বছর। তারপর আপনার নাম হারিয়ে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে চিরকালের মতো। কিন্তু আপনি এখন ঢাকায় থাকেন, দিনাজপুরের কেউ কোনোদিন আপনাকে চিনবে না, চট্টগ্রামের কেউ কোনোদিন আপনার নামও জানবে না। এমনকি আপনার নিজ জেলার অধিকাংশ মানুষই কিন্তু আপনাকে চিনবে না কোনোদিন। কিন্তু আপনি যদি এমন কিছু একটা করে যান যার ফলে মানুষ আপনাকে যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে, আপনার কথা স্মরণ করবে তাহলে সেটাই হলো প্রকৃত পাওয়া। পৃথিবীর বুকে এমন কিছু একটা সৃষ্টি করে যাওয়া যে কারণে আপনাকে মানুষ যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমরা রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি, আমরা কাজী নজরুলকে স্মরণ করি, আমরা নিউটন, আইনস্টাইন, লিওনার্দো, সেক্সপিয়ারকে স্মরণ করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্কুলের পাঠ সমাপ্ত করেননি। তিনি অঙ্কে 100 তে 90 পাননি কোনোদিন। তারপরও তিনি মেধাবী। তার মৃত্যুর 77 বছর পরও আমরা প্রতিনিয়ত তাকে স্মরণ করছি। স্কুল, কলেজে তার লেখা গল্প, কবিতা পড়ানো হয়। কাজী নজরুল ইসলাম তো মাধ্যমিক পাশও করেননি। তারপরও তিনি আমাদের জাতীয় কবি। যতদিন বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশী জাতি থাকবে, ততদিন এই দুই মহান মানুষকে স্মরণ করা হবে সহস্র বছর ধরে।

মেধা কী? এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে মেধাকে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে আর যাই হোক, স্কুল-কলেজের ভালো ফলাফল কোনোক্রমেই মেধার পরিচায়ক নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। তবে সেটাকে একমাত্র মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করা অযৌক্তিক। আজ যখন একটা ছাত্রকে দেখি ভালো ফলাফল করতে, পিতামাতাকে তা নিয়ে গর্ব করতে দেখি তখন মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। তুমি তো মেধাবী নও, তুমি রেকর্ড করার যন্ত্র। তুমি সব কিছু ভালো করে রেকর্ড করতে পারো, আর তাই তুমি ভালো ফলাফল করতে পারো। আমার স্কুল জীবনের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখন হাসি পায়। সনেট, জাহিদ তোমরা ভালো ছাত্র ছিলে, কিন্তু তোমরা মেধাবী ছিলে না। তোমরা ছিলে একটা ভালো টেপ রেকর্ডার আর প্রিন্টারের মতো একটা যন্ত্র। আমরা সবাই তাই ছিলাম। কিন্তু তোমরা ভালো রেকর্ড করতে পারতে আর পরীক্ষার খাতায় ভালো প্রিন্ট করতে পারতে। আর তাই তোমরা ছিলে ভালো ছাত্র। আমরা যারা মোটামুটি পারতাম আমরা মধ্যম মানের ছাত্র। আর যারা কম পারতো তারা দুর্বল ছাত্র। কিন্তু এই তকমা জীবনের গতিপথকে পরিবর্তন করে না। তাই দিনশেষে এখন আমরা সবাই এক পথেই হাঁটছি।

তাহলে মেধা কী সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। মেধার একটা পরিচয় হলো সৃষ্টিশীলতা। সৃষ্টিশীল কাজকর্মের মাধ্যমে যারা পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন তারাই আসলে প্রকৃত মেধাবী। তাদের কর্মের জন্য আমরা প্রতিনিয়ত তাদের স্মরণ করি। স্টিফেন হকিং কথা বলতে পারতেন না। তারপরও তিনি পৃথিবীকে যা দিয়ে গেছেন তার জন্য আমরা তাকে যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবো।

আপনার সন্তান শিশু থাকা অবস্থায় সিডি আর আটার দলা দিয়ে শনি গ্রহ তৈরি করলে আপনি দেখে খুশি হন। মনে মনে ভাবেন এই ছেলে তো একদিন অনেক বড় হবে। আপনি শপথ নেন যে এই ছেলেকে বড় করতেই হবে। বড় তাকে করেনও। কিন্তু কিভাবে? সে যখন বড় হতে থাকে, তখন তাকে ‘একদিন তাকে বড় হতে হবে’ করার চেষ্টায় আপনাদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। আদা-জল খেয়ে লাগেন তার পিছনে। স্কুলে ক্লাস, একগাদা স্কুলের বই, হোমওয়ার্ক, হাউজ টিউটর দিয়ে তাকে এত ব্যস্ত রাখা হয় যে তার মেধাটা শুধুমাত্র স্কুলে ভালো ফলাফল করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। ছেলে ভালো রেজাল্ট করে, আর বাবা মা পরিতৃপ্তির হাসি হাসে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে তারা বলে, দেখো আমাদের ছেলে কত মেধাবী। শিশুকাল থেকেই তো আমরা সেটা বুঝেছিলাম। তারপর তারা ফেসবুকে ছেলেকে নিয়ে স্টাটাস দেয়। আমরা দেখে চমৎকৃত হই আর লাইক, কমেন্টের বন্যা বইয়ে দেই। ছেলে বড় হয়, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে, ভালো চাকরী করে, অনেক টাকা বেতন পায়, একটা ভালো বিয়ে করে আর তারপর আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করে শেষে একদিন পৃথিবী থেকে চলে যায়। হায়! কোথায় তার সেই শিশুবেলার সৃষ্টিশীলতা? সেই শনি গ্রহ? হায় বাবামা! আপনারা নিজের অজান্তেই আপনাদের সন্তানকে একটি টেপ রেকর্ডার হিসেবে তৈরি করছেন। অথচ সে হতে পারতো একজন নিউটন, একজন আইনস্টাইন, একজন ইবনে সিনা, একজন নজরুল বা একজন রবীন্দ্রনাথ। তাই সন্তানকে টেপ রেকর্ডার নয়, একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে তৈরি করুন। আমাদের সমাজে এখন সৃষ্টিশীল মানুষের বড়ই অভাব। আপনারা চারিদিকে তাকান। কোথাও মেধার চর্চা নেই। সর্বত্র শুধু ভালো রেজাল্টের চর্চা। আর তাইতো এতো প্রশ্ন ফাঁস, নকল আর পরীক্ষায় দুর্নীতি।

তবে আপনার সন্তানকে নয় সবার আগে আপনি আপনার নিজের ভিতরে তাকান। মানুষ তার নিজের সম্পর্কেই সবচেয়ে কম জানে। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে অসীম মেধা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আপনি হয়তো স্কুলে চমকপ্রদ রেজাল্ট তৈরি করতে পারেননি, কিন্তু নিজের মেধা দিয়ে নিজেকে ও অন্যকে আলোকিত করার ক্ষমতা আপনার আছে। এটা হলো একটা মোমবাতি দিয়ে লক্ষ মোমবাতি জ্বালানোর মতো। নিজেকে সেই উচ্চতায় নিয়ে যান। যেন মানুষ হাজার বছর ধরে আপনাকে মনে রাখে। আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ২:৪৫

চাঁদগাজী বলেছেন:


ঘোলাটে, কিছুই পরিস্কার হয়নি

০১ লা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৩:০৩

অর্থনীতিবিদ বলেছেন: স্কুলের ভালো রেজাল্ট মেধার একমাত্র মাপকাঠি নয়। কিন্তু আমাদের দেশে এটাকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়। শিশুর সৃষ্টিশীলতা বিকাশের তেমন কোনো সুযোগ নেই। এমনকি মানুষ নিজের ভিতরের গুণগুলোর ব্যাপারেও তেমন সচেতন নয়। এই ব্যাপারগুলোই মূলত বুঝাতে চেয়েছি।

২| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৮ ভোর ৬:১৪

কালীদাস বলেছেন: আমার মনে হয় কি জানেন? প্রতিটা মানুষ সেইম ট্যালেন্ট নিয়েই পৃথিবীতে আসে। কিন্তু সবাই প্রোপার ফিল্ডে সেটার প্রয়োগটা করে যেতে পারে না; নিজের স্পেশালিটি কি সেটা মানুষ সবসময় খুঁজেও পায় না।

আমাদের দেশে পরীক্ষার রেজাল্টে নিয়ে এক বিকৃত চর্চা চলছে। সে সাথে উচ্চশিক্ষাকে বানানো হয়েছে সামাজিক স্ট্যাটাসের বিষয় যেটা বছরের পর বছর বেকারত্বের হার বাড়িয়েছে। নিজের ব্যর্থতা/লিমিটেশন মেটানোর জন্য এক্সপেক্টেশনের লোড চাপানো হয় পরের জেনারেশনের উপর।

এই লুপ চলছে তো চলছেই, কনভার্জ আর করে না। এর পর আর সুপ্ত-মেধা থাকে কিভাবে? :((

০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:৩২

অর্থনীতিবিদ বলেছেন: আপনি ঠিকই বলেছেন। নিজের বিশেষত্বটা কেউই খুঁজে দেখে না। অথচ প্রতিটা মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে।

৩| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৭:৫৯

নিকোলাস- রাহাদ বলেছেন: ভালোই বলেছনে
আরেকটু পরিষ্কার করে লিখলে আরেকটু ভালো হতো

০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:৩৩

অর্থনীতিবিদ বলেছেন: ধন্যবাদ। এর পরের বার আরো ভালো করার চেষ্টা করবো।

৪| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:৫৫

বিএম বরকতউল্লাহ বলেছেন: অনেক মেধা এমনি করে
অকালে যায় ঝরে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারনা করেছেন।
ধন্যবাদ।

০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:৫৭

অর্থনীতিবিদ বলেছেন: ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

৫| ০৬ ই মে, ২০১৮ রাত ৩:২২

কাওসার চৌধুরী বলেছেন: বাহ!! চমৎকার সুন্দর একটি লেখা। এতো দিন চোখে পড়েনি। আপনার লেখার স্টাইল খুব সুন্দর। শুভ কামনা আপনার জন্য।

০৬ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৪০

অর্থনীতিবিদ বলেছেন: ধন্যবাদ। আপনার জন্যও শুভকামনা রইল।

৬| ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:০৯

আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: চমৎকার লেখা...
প্রিয়তে

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৩:৫২

অর্থনীতিবিদ বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.