![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পহেলা বৈশাখ আমাদের বাঙ্গালীদের অভাবনীয় আনন্দের একটা দিন। সাড়ে চারশত বছর আগে সম্রাট আকবর তার রাজস্ব কর্মকর্তা আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীর পরামর্শে ১৫৫৬ সালের এই দিন খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে প্রথম বাংলা সন চালু করেন। ১৬১০ সালে যখন ঢাকাকে সর্বপ্রথম রাজধানী হিসেব গড়ে তোলা হয় তখন রাজস্ব আদায় আর ব্যবসা- বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য পহেলা বৈশাখকে সম্রাট আকবরের অনুকরনে সুবেদার ইসলাম খান চিশতি তার বাসবভনের সামনে সব প্রজার শুভ কামনা করে মিষ্টি বিতরণ এবং বৈশাখী উৎসব পালন করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় এই পহেলা বৈশাখ আজো আমাদের কাছে আতুলনীয় আনন্দের একটা দিন।
চিরায়ত বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল “হালখাতা”। এই দিনে রঙ্গীন কাগজে সাঁজানো হয় দোকান-পাট আর ব্যবসায়ীরা মিষ্টি মুখ করায় খরিদ্দারদের। দেনা-পাওনা মিটিয়ে হাসি ফুটে ক্রেতা-বিক্রেতার মুখে।
নদী-মাতৃক এই দেশে দরিদ্র গ্রামবাংলার মানুষ খাবার হিসেবে নিতেন ডাল-ভাত আর নদী পুকুরের সহজ লভ্য মাছ। পান্তা ভাত আলুভর্তা, পোড়া মরিচ ইত্যাদি ছিলো তাদের কোন রকম বেঁচে থাকার জন্য সকালের খাবার। বৈশাখ উপলক্ষে তারই ধারাবাহিকতায় ইলিশ মাছের সাথে পান্তাভাত আর পেয়াজ মরিচের মিলবন্ধনে ভিন্নস্বাধে ভরে উঠতো গ্রামবাংলার বৈশাখী সকাল। ১২ রকমের তরকারী আরা তাজা মাছ দিয়ে তৃপ্তিসহ খাবার খাওয়া ছিলো আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য একটা আনন্দঘন ব্যপার।
রং-বেরংয়ের পিঠা-পায়েশের আয়োজন দেখা যেত বাড়িতে-বাড়িতে। আনন্দের মাত্রা ছাড়িয়ে যেত সবার হৃদয়ের মনিকোঠায় একে অন্যের আতিথীয়তায়। আমাদের ইতিহাস- ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এমন সাড়ে চারশত বছরের বৈশাখ।
বদলে গেছে সময়, বদলে গেছে উদযাপন, বদলে গেছে আনন্দের ধরন। তাই চাইনিজ অথবা থাই রেস্টুরেন্টে হাজার টাকার পান্তা-ইলিশ দিয়ে শুরু হয় বৈশাখ। বাঙ্গালীর প্রিয় ঈলিশের হালি তাই বৈশাখে হয়ে যায় ৪০ হাজার টাকা, মধ্যবিত্ত সমাজে তাই বামন রাজ্যের চাঁদ হয়ে যায় রূপালী ইলিশ। নববর্ষ উদযাপনের নাম করে একদিনের বাঙালী সেজে কি আমরা গ্রামবাংলার দরিদ্র মানুষের জীবনযাপনকে উপহাস করছি না?
আমাদের কাছে বৈশাখ মানেই এখন “পান্তা ইলিশ” আর “মঙ্গল শোভাযাত্রা” যদিও তার কোনটাতেই আমার কোন আপত্তি নেই ততক্ষন পর্যন্ত যতক্ষন পর্যন্ত তা শান্তিপূর্ণ ও অসম্প্রদায়িক। ধর্মনিরপেক্ষতার দৃষ্টিভংগি তে এই মঙ্গল শোভা যাত্রা যদি প্রার্থনা হয় তবে আর তা অসম্প্রদায়িক হয়ে কি করে? শত বছরের মৌলিক সংস্কৃতি মিশে গেছে ভিন্ন উৎসবের মিশ্রনে। শত কোটি টাকার খরচ বেড়েছে তাতে কি যায় আসে? কে কত বড় করে শোভাযাত্রা করতে পারলো? প্রতিযোগীতা তো সেখানে। অথচ মঙ্গল শোভাযাত্রাটি কে বৈশাখী উৎসবের সাথে যুক্ত করেছি ২৬ বছর আগে ১৯৮৯ সাল থেকে।
সাড়ে চারশত বছরের ইতিহাসে শুরু হলো বিবর্তন। স্বকীয়তা হারাতে থাকলো আমাদের বৈশাখ ভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রনে। তাহলে আমরা কি সুখী নই আমাদরে স্বতন্ত্র সংস্কৃতিতে? অনুকরণ করতেই হয় বিদেশী সংস্কৃতিকে?
একদিনের জন্য নিজেকে বাঙ্গালী বানিয়ে, মুখে রং কালি মেখে, ফ্যশানের ধরন বদলে দিলেই যে বাঙালী হওয়া যায় না তা ভুলে গিয়ে জোর গলায় বলে উঠি “এসো এসো, হে বৈশাখ, এসো এসো”। রবীন্দ্র-নজরুল আর বাঙ্গালীয়ানার পরিচয় নিয়ে সকালটা বৈশাখী আমেজে শুরু হলেও শেষ হবে কেন বিজাতীয় সঙ্গীত দিয়ে? তা আমার বোধগম্য নয়। আনন্দের জোয়ারে ভাসতে গিয়ে আমাদের এখন আর বাংলা গানে মনে হয় নৃত্যটা জমে উঠে না। তাই বড়-বড় কান ফাটানো স্পিকারে বাজে বিজাতীয় সঙ্গীত “মুন্নির বদনাম” অথবা “বেবী ডল”। উচ্ছাসিত তরুনেদের কেউ কেউ বেছে নেন ট্রাক অথবা ভ্যান, যেখানে তারা ঘুরে বেড়াবেন সারা শহর আর তাদের তীব্রতর শব্দে স্পিকার গুলো নির্দ্বীধায় হিন্দি আর ইংরেজী গানে কান ফাটিয়ে যাবে আশে-পাশের মানুষ গুলোর। উদ্ভট এই আনন্দের নামে মেয়েদের উত্যক্ত করা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, কোন অংশেই আমাদের বৈশাখী উৎসবের অংশ হতে পারে না।
আমাদের অপসংস্কৃতির মিশ্রনে হারাচ্ছি বৈশাখের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা। হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃত্য বন্ধনের মিলন মেলা হয়ে যাচ্ছে বিচ্ছেদের কারণ। অপসংস্কৃতি, নগ্নতা, বেহায়পনা আর উশৃখলতাকে পরিহার করতে গিয়ে বৈশাখী আনন্দকে বর্জন করছেন অনেক্ই, অথচ এই অতিরঞ্জন ১৯৮৯ সালের আগে কোন কালেই বৈশাখী বর্ষবরণের অংশ ছিলো না।
আমরা আসক্ত হয়ে গেছি দলাদলি, মারামারি আর হিংসার মত ঘৃন্য কর্মকান্ডে কারণ আমরা ভুলে গেছি আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই সম্প্রীতি-ভালোবাসা। আমাদের মত করে বদলে দিয়েছি আমাদের সোনালী ইতিহাস । তাই এখন বৈশাখ মানেই কৃত্তিম পান্তা ভাতে ফরমালিন ইলিশ, বৈশাখ মানেই রং বেরংয়ের সাজ, বৈশাখ মানেই পার্টি ডান্স, বৈশাখ মানেই উশৃঙ্খলতা, ইভটিজিং আর নিরাপত্তাহীনতায় নারী সমাজ। এই যদি হয় আমাদের বর্ষবরণ তবে কি আর রইলো সোনালী ইতিহাসের পাতায়। শত বছরের ইতিহাস তাই মলিন করে দিচ্ছি আমরা। আমাদের সমৃদ্ধ স্বতন্ত্র সংস্কৃতির মধ্যে জোর করে মিশিয়ে দিচ্ছি বিজাতীয় সংস্কৃতি। তবে কি শিখবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের কাছে? আসুন না ফিরিয়ে আনি আমাদের নিজেদের ঐতিহ্য কে, কারো ধার করা সংস্কৃতি দিয়ে নয় নিজেদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতিতে, সেই স্নেহ-ভালবাসাময় ভ্রাতৃত্বীতের মিলবন্ধনে। তাহলেই ভালো থাকবো আমরা, আমাদের প্রজন্ম, সংস্কৃতি আর সোনালী অতীত।
©somewhere in net ltd.