নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

যে সময়ে জীবন গল্প হয়ে উঠে

২০ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১:০৩

এই সময়ে রাস্তায় বন্ধুতে – বন্ধুতে মারপিট করলে সমস্যা নেই । গোটা দেশবাসীর মতো গোটা রাস্তাটাও এই সময়ে গভীর নির্জনতায় ডুবে আছে । যেন গাছের একটা পাতা পড়লেও সেই শব্দ যন্ত্রণাকাতর ধর্ষিতার অস্ফূট আর্তনাদের মতো শোনাবে । আশেপাশে কোথাও কেউ নেই । নিজেদের মধ্যে চেঁচামেচি করতে করতে পথ পার হওয়া সঙ্ঘবদ্ধ কুকুরের পালও খুঁজে পাওয়া যায়না ।



সিরাজ আর রইস একে অপরকে কিলিয়ে – ঘুষিয়েই যাচ্ছে । দুজনেই বেহেড মাতাল অবস্থায় আছে । মুখের সাথে সাথে খিস্তিও চলছে দেদারসে । মা – বাপের প্রজাতি থেকে শুরু করে এখন এসেছে অপরের স্ত্রীর সাথে সহবাসের বাসনায় । অথচ কারোরই মনে নেই যে তারা কেউই বিবাহিত নয় । কিন্তু চিরন্তন যেই বিষয় নিয়ে পুরুষে – পুরুষে একে অপরের বিরুদ্ধে কামড়াকামড়ি করে নিজেদের মরদপনা দেখাতে গিয়ে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয় সেই বিষয় নিয়েই তারা লড়াইরত । কোন এক নারীর পাণিপ্রার্থী হবার চিরন্তন অথর্ব লড়াই ।



দুজনের মধ্যে সবার আগে রইসেরই সম্বিত ফেরে । চেতনায় আসবার পর ঠোঁট চাটলে তার বোধ হয় ঠোঁটের উপরের অংশটায় নোনতা নোনতা স্বাদ । হাত দিতেই অল্প একটু রক্ত বের হয়ে গেলো । এখন চেতনা ফিরেছে বলে সিরাজের দিকে নতুনোদ্যমে হাত লাগালোনা । বরং সিরাজের দিকে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলো তার কি অবস্থা ।



সিরাজের অবস্থা রইসের চাইতেও বেশী শোচনীয় । ডান চোখের নীচে কালশিটের মতো হয়ে গেছে । বাম দিকের মাড়ির পাশের নড়বড়ে দাঁতটা আরেকটু মারামারি হলে পড়েই যেতো । দুইজনের মধ্যে সেই বেশী মাতাল ছিলো । মাথাতেও যন্ত্রণা দিচ্ছে সিরাজের । তার মনে হতে থাকে হুজ্জোতটা এই সময়ে তাদের না করলেও চলতো । কামরুন তো আর তাদের কারো থেকেই পালিয়ে যাচ্ছেনা । নিস্তরঙ্গ জীবনে কামরুন ছাড়া আর কার জন্যেই বা তারা মারপিট করতে পারে ?



রইস আর সিরাজ দুইজনেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে একে অপরের দিকে তাকায় । তাকিয়ে পুরনো বন্ধুর মতোই দাঁত বের করে হাসতে থাকে । দেখে কে বলতে পারবে কিছুক্ষণ আগেই দুইজনে উন্মত্ত কুকুরের মতো একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ? তাদের জীবন আসলে এমনই । আজন্মই পথের মানুষ বলে পৃথিবীর বুকে অচেনা , আইন-কানুনের চোখে অনাহূত , সমাজের মানসপটে অস্পৃশ্য । প্রতি ক্ষণে ক্ষণে তাদের জীবনের নানাবিধ রঙ-রুপ পাল্টায় বটে তবে তাদের দৈনন্দিন দিনযাপনের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জুড়ে থাকা জীবনসংগ্রামই কেবল নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । সিরাজ কিংবা রইস কেউই এসব ভারি ভারি জীবনদর্শন নিয়ে কখনো ভাবেনি । ভাবাটা প্রয়োজনীয় সেই অবকাশই তাদের জীবনে আসেনি । ঘন , নির্জন রাতে অস্ফূট সোডিয়াম আলো যেভাবে নিঃসঙ্গ রাস্তায় বাড়ি ফেরা অসহায় পথিকের মনে রেখাপাত করে ঠিক তেমনভাবেই কামরুন রেখাপাত করে সিরাজ আর রইসের মনে । এই উপলব্ধির মাঝে সবই আছে । অনাড়ম্বর ভালোলাগার অনুভূতি থেকে শুরু করে প্রবলভাবেই আধিপত্যশীল দখলদারীর লড়াই । সেটাই কিছু সময়ের জন্য দুইজনকে মাতাল অবস্থায় পেয়ে বসেছিলো ।



এদিকে চারপাশে গাছের একটা পাতাও নড়ছেনা । আশেপাশের কোথাও কোন বাড়ীর কোন ঘরে আলো পর্যন্ত জ্বলেনি । কেবল সামনের একটি ডাস্টবিন থেকে পাঁচ গজ পিছন থেকে হঠাৎ একটি বিড়ালকে সতর্ক চোখে তাদের দুইজনের দিকে দৃষ্টি দিতে দেখা গেলো । বিড়াল তাদের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে কি বুঝলো সেই জানে । সেই বিড়াল ছুটে চলে গেলে আবারো রাস্তায় কেবল তারা দুই বন্ধু ।



তারা কে আগে কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছিলোনা । রইস ভাবছিলো সম্ভবত সিরাজই কথোপকথনের সূচনা করবে । সিরাজ ভাবছিলো সে নিজে কথা শুরু করলে রইস মনে করতে পারে সিরাজ বন্ধুর প্রতি করুণাসুলভ বদান্যতা দেখাচ্ছে । অবশেষে নীরবতা ভেঙ্গে রইস খানিকটা কেশে নিয়ে নিজেই শুরু করলো ,



“ কতোবার কইলাম তোরে কামরুনরে লইয়া উল্টাসিধা কথা কইসনা আমার সামনে । তুই শালার জিন্দেগীতে মুখ ভালা করতে পারলিনা । বন্ধুমানুষ হইয়া নিজেরই মিজাজ ঠিক রাখবার পারিনাই তোর উপ্রে , লোকজনে কেমনে রাখবো ? পিটাইয়া তো একদিন শ্যাষ কইরা দিবো তোরে । “



সিরাজ কি বলবে ভেবে পায়না । কারণ সামনে দাঁড়ানো বন্ধুমানুষ যা বললো তার সবই সত্য । খুব বাজে খিস্তি করে বসেছিলো প্রিয় মানুষের সাথে বন্ধুকে জড়িয়ে । কিন্তু কিছু একটা বলে নিজের জায়গা ঠিক রাখতে হবে ভেবে দুর্বল গলাতেই কিছু শক্ত কথা বলে ফেললো “ আমি কেমনে মিজাজ ঠিক রাখুম ? সব জাইনা শুইনা তুই কামরুনরে নিয়া তোর রসের আলাপ পাড়োস আমার সামনে । তুই ই ক আমারে , কুনদিন দেখছোস আমারে তোর সামনে কামরুন রে নিয়া কিছু কইতে ? দুইজনেই কামরুনরে বালোবাসি মাগার বন্ধুরে আঘাত দিয়া কিছু কমু ক্যা ? “



রইস এরকম কঠিণ কোন প্রতিউত্তরের প্রত্যাশা করেনি বন্ধুর কাছ থেকে । সবসময় সিরাজকে বোকা বলেই মনে করে এসেছে । সেই এমন যুক্তিতর্কের কম্পাস মেপে কথা বলতে পারে কখনো কল্পনাও করেনি । প্রসঙ্গটা বদলাবে ভাবলো । কিন্তু অত শত ভেবেও কামরুনের বিষয় থেকে বের হয়ে আসতে পারলোনা । সপ্রশংস গলায় নিজের প্রেমিকার প্রতি অনুরক্ত মানুষটার সামনেই বলতে শুরু করলো ,



“ যতো যাই কস না ক্যান কামরুনে আমারে অনেক ভালা পায় । রিকশা থেইকা নাইমা আমার কাছে আইছে পাঁচ ট্যাকা আছে কিনা জিগাইতে । দিলডা খুশী হইয়া গেলো । সারাদিনে প্যাডে ভালা কিছু পড়েনাই । “ বলেই খুকখুক করে হাসতে থাকে রইস ।



রইসের এই স্বভাবটাই সিরাজের মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয় সবসময় । সিরাজের পিত্তি জ্বালিয়ে দিবে এটা বুঝেও ঠিক সেই ধরণেরই কথাবার্তা বলবে । হাড় হারামজাদার ছেলে একটা । সিরাজের মনে হলো পুনরায় গিয়ে মারামারি বাঁধিয়ে দেয় রইসের সাথে । কিন্তু ডান চোখের নীচে ব্যাথাটা অনুভব করতেই থেমে গেলো ।



তারপরে আবারো দুইজনেই নিশ্চুপ হয়ে গেলো । কে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলোনা । এতো দ্রুতই কিভাবে দুইজনের কথোপকথনের বিষয় ফুরিয়ে যেতে পারে কেউ বুঝে উঠতে পারছিলোনা । তাও আবার কিনা কামরুনকে নিয়ে যেখানে কথা হচ্ছে । এই একজনকে নিয়ে কথা উঠলে সেই আলাপ আর থামতেই চায়না সহজে । অথচ এখন কারো মুখ দিয়ে আর কোন শব্দই বের হচ্ছেনা ।



ঠিক এমন সময়ে দূর থেকে কোন যানবাহনের আওয়াজ শুনে কান খাড়া করে থাকলো রইস আর সিরাজ । রাস্তা জনমানবহীন বলে বেশ দূরত্ব থাকলেও তার শব্দ শোনা গেলো । তারা দেখলো একটি সাদা মাইক্রোবাস তাদের থেকে চল্লিশ গজ দূরত্বে থেমে গেলো । সেকেন্ড পাঁচেক পরে একটা মানবশরীরকে রাস্তার নেড়ি কুকুর জ্ঞান করে মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে ফেলে মুহূর্তের মাঝেই হাওয়া হয়ে গেলো ।



রইস আর সিরাজ নিমেষেই বুঝে গেলো ঘটনা কি । নিশ্চয়ই খুনখারাবির ব্যাপার স্যাপার । মাইক্রোকে আর ধরার কোন উপায় নেই । দুইজনে দ্রুত ছুটে গিয়ে ফেলে যাওয়া মানবসন্তানের কাছে গেলো । দেখলো বছর আঠারো কি কুড়ি বছরের এক তরুণের সারা শরীরের অজস্র কাঁটাছেড়ার দাগ । রক্তে গোটা শার্ট ভিজে গেছে । রইস গিয়ে সেই শরীরের বুকের কাছে কান পাতলো । খুব স্তিমিত নিঃশ্বাস নেওয়ার শব্দের সাথে সাথে সেই শরীরের অস্ফুট কন্ঠে ‘ আমারে কেউ দয়া করে পানি দেন ‘ কথাটা শুনে মাত্র ছয় হাত দূরে থাকা সত্ত্বেও সিরাজকে চিৎকার করে বলে উঠলো “ ওই , অক্ষুনি পানি আনতে দৌড় দে । পুলাডা পানি খাইতে চাইতাছে দেরী করিসনা । দৌড় লাগা । “



অন্য কোন সময় হলে এই কথাগুলো বলার ধরণে সিরাজ মনে করতে পারতো রইস বুঝি বন্ধুর উপরে কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করছে । কিন্তু এখন সেসব ভাবনার কিছুই মাথায় এলোনা তার । কিছুক্ষণ আগেই তারা তাদের প্রণয়িনীর জন্য একে অপরের জান নিয়ে নিতে উতলা হয়ে উঠেছিলো সেই কথাও তার আর মনে রইলোনা । আল্লাহর কাছে কিছু নির্জীব অভিযোগ , গরীব মানুষের ভাগ্যের প্রতি অভিসম্পাত আর দেশের পরিস্থিতিকে উদ্দেশ্য করে কিছু অশ্লীল গালি দিতে দিতে ছুটে গেলো পানির সন্ধানে ।



এদিকে রইস মাটিতে শায়িত শরীরের বুকের দিকে ঝুঁকেই আছে । অত্যন্ত সতর্কভাবে বুঝতে চেষ্টা করছে কোন সময় সেই শরীরের হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে আসে কিনা । এভাবেই এক মিনিট কেটে গেলে রইস দেখতে পেলো কোত্থেকে পানির জগ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সিরাজ দ্রুত তার ছুটে আসছে । তাদের কেউই তখন আর কামরুনকে নিয়ে কনামাত্র ভাবছেনা ।



ঠিক এমনই এক চমৎকার স্বার্থহীন ক্ষণে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে শায়িত মানবসন্তানটি একটু বল পেয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.