নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্বজন

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:২৩

স্প্রিং অনেকটাই উঠে গেছে এমন এক সোফায় ছয়জনে গাদাগাদি করে বসতে বসতে সকালে মুসলেম মিয়ার রেস্টুরেন্টে খাওয়া ডাল আর পরোটার ঢেঁকুর উঠে । দুপুর প্রায় পার হয়ে গেছে । এতো তাড়াতাড়িই যদি সকালের নাশতা গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায় তাইলে তো বিপদ । নিশ্চয়ই খাবারে গোলমাল ছিলো । শরীরের আগেই মালেকের মন গোলাতে শুরু করে । সামান্য এক রেস্টুরেন্টওয়ালার কাছে এই ঠগবাজির শিকার হওয়া , ফাজিলের ফাজিল । ঘরে তারই মতো আরো বারোজন চাকরীপ্রার্থী । অশ্রাব্য গালি যেগুলো জানা আছে তার সবই মনে মনে দিয়ে মালেককে সন্তুষ্ট থাকতে হয় । যেই রেস্টুরেন্টওয়ালার উদ্দেশ্যে দেওয়া সে কোন এক উপায়ে জানতে পারলে হয়তো শোকেই অর্ধ দিবস রেস্টুরেন্ট চালিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরতো ।

গলায় আঙ্গুল দিতে যাবে ঠিক এমন সময়ে পাশে বসে থাকা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির শরীরটা নড়ে উঠে । মালেকের অসন্তোষ বাড়ে বই কমেনা । বেশ আগে থেকেই লক্ষ্য করছে মালটা হুদাই নড়াচড়া করে । যেন হিটলারের গ্যাস চেম্বারে জোর করে তাকে কেউ বসিয়ে রেখেছে । আরে বেটা চাকরী খুঁজতে আসছিস তোর এতো তিড়িং বিড়িং কিসের ? মাথা , ঘাড় গুঁজে যতক্ষণ বসে থাকতে হয় বসে থাকবি । একটু আগেও হালকা মতো পা নাচাচ্ছিলো , নবাবের নবাব কোথাকার ।

“ ভাই কয়টা বাজে একটু বলবেন ? “ হালকা নিরীহ গলায় তিড়িং বিড়িং করতে থাকা সেই নবাবের নবাব মালেককে সময় জানতে চেয়ে প্রশ্নটা করলে তার মেজাজ আরো তিরিক্ষি হয়ে যায় । কোন জায়গার আবালস্য আবাল এইসব ইন্টারভিউ দিতে আসছে হাতে ঘড়ি ছাড়া । এর কোন মানে আছে ? মালেক নিজেও তো বাপের মান্ধাতার আমলের ঘড়িটা পরেই এসেছে । উপস্থিত বাকি সবার হাতেও ঘড়ি আছে । অল্প বয়স করে মতো মেয়েটা সেও কি সুন্দর সোনালী রঙের একটা ঘড়ি পরে দিব্য স্মার্টভঙ্গিতে বসে আছে । দেখেই বোঝা যায় তীব্র আত্মবিশ্বাস । আর ইনি এক শাহী আমলের নবাব এসেছেন । অন্যের কাছ থেকে সময় জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন । যত্তসব ।

মালেক নম্র কন্ঠে যেন তার উদ্দেশ্যে করা প্রশ্নটায় সে অত্যন্ত সম্মানিতবোধ করছে এমনভাবে সময় জানিয়ে দেয় । বলার সময়ে স্টাইল করে বা হাতের কবজিটা ঝাঁকিয়ে নেয় । বিনা কারণেই । তার ন্যাংটাকালের বন্ধু আজীজের কাছ থেকে স্টাইলটা শিখে নিয়েছিলো । ভার্সিটিতে পড়বার সময়ে এই স্টাইল করেই মালেকের চোখের সামনে তার একটা প্রেমও হয়ে গিয়েছিলো । আহ , কতো বিচিত্র কিছুতেই না মানুষের প্রেম হয় । আকসার হয় । কেবল তার বেলাতেই লবডংকা ।

মালেকের প্রেম – ভালোবাসা সংক্রান্ত কল্পনায় পুনরায় ছেদ ঘটে । ঘটায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির সেই শরীরটাই । লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের মনেই স্বগতোক্তি করে “ দুপুর পার হয়ে গেলো অথচ ডাকবার নাম গন্ধ পর্যন্ত নাই । খাওয়াটাও আর হলোনা । কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে । “

যেন কিছুই শুনতে পায়নি এমন ভাব করে মালেক প্রেম – ভালোবাসার ভাবনায় আবারো মনোযোগ দিতে যায় । কিন্তু কোন কাজ হয়না । নতুন করে আর সেই তরল বিষয়ে মন দেওয়া যায়না । ধুত্তুরি বলতে গিয়েও গিলে নেয় । খামাখাই অন্যদের কাছে বিরক্তি দেখিয়ে কি লাভ ? ইন্টারভিউটা শেষ হলেই তো আর সহ্য করতে হচ্ছেনা । মালেক কাষ্ঠ একটা হাসি ফিরিয়ে দিয়ে নিজেকে সহজ দেখানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে । খুব একটা সুবিধা হয়নি বলে তার নিজেরই মনে হতে থাকে ।

তবে পাশেরজন কি বুঝে তার সাথে কথা বলতে আরম্ভ করে মালেক তা ঠাহর করতে পারেনা । “ বুঝলেন ভাই , পরিবারের লোক সংখ্যা ছয়জন । বাবা সেই তিন বছর আগে রিটায়ার করলো । মায়ের এই অসুখ তো সেই অসুখ লেগেই আছে । ছোট বোনটা তিনটা টিউশনী করে সংসারের খরচ চালায় কোন রকমে । কিন্তু তার বিয়ে – শাদী হয়ে গেলে কেমনে কি হবে আল্লাহই জানেন । পরিচিত বড় কোন মামা – চাচাও নাই । এই নিয়ে ছয়টা ইন্টারভিউ দিলাম । কোন লাভ হয়নাই । “

শেষের কথাগুলো কানে পৌঁছালে কতক্ষণ আগে যাকে নবাবের নবাব বলে মনে হয়েছিলো তার প্রতি দুর্বল গাঁথুনীর এক ধরণের আর্দ্র মমতা চলে আসে মালেকের । ইশ , মানুষটার কি করুণ অবস্থা । বড় কোন মামা – চাচা নাই অথচ একটার পর একটা ইন্টারভিউ দিয়েই যাচ্ছে । নাহ , এই লোকের সহজেই চাকরী পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই । এই প্রথম লোকটার প্রতি সহমর্মিতায় মনটা ভরে যেতে যেতে নিকটতম অতীত অস্তিত্বহীন হবার উপক্রম করে । নাহ , একে স্ন্যাক্স জাতীয় কিছু একটা অফার করতেই হয় ।

“ আপনাগো মধ্যে কেডা আবদুল মালেক ? তারে ভেতরে ডাকে । “ কর্কশ কন্ঠের পিয়নের মুখে নিজের নামটা শুনে আবারো চোয়াল শক্ত হয়ে আসে মালেকের । মগজের কোষে কোষে ক্রোধ সঞ্চারিত হয় । কি বিশ্রী ভাবেই না তার নামটা উচ্চারণ করলো । চামারের বাচ্চা চামার । সকালবেলায় রেস্টুরেন্ট থেকে এখানে যেই বাসে করে এসেছিলো সেখানকার হেল্পারটার মতোই চাষার গলা । “ এই মতিঝিল , গুলিস্তান , প্রেসক্লাব , শাহবাগ শাহবাগ । আপনেরা জায়গা ছাইড়া দ্যান , সামনে ল্যাডিশ নামবে , ল্যাডিশ । “ উফ , অসহ্য । কপালের উপরাংশে ডান হাতের মাঝখানের তিনটি আঙ্গুল ঘষতে ঘষতে মালেক উঠে দাঁড়ায় । দীর্ঘক্ষণ গাদাগাদি করে বসে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেছে । ডান পা পরপর তিনবার ঘোরালে উপস্থিত বাকিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে । নাহ , এখন এইসবে মনোযোগ দিলে চলবেনা । পায়ে শক্ত হয়ে সেঁটে থাকা পালিশ করা বুটজোড়ার দিকে একবার তাকিয়ে মালেক ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রবেশ করে ।

রুমের পর্দাগুলো প্রচন্ড ফর্সা দেখাচ্ছে । যেন গতকালকেই ধুয়ে শুকানোর সাথে সাথেই টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে । তবুও দুপুরের কড়া রোদের চোখ ধাঁধানো আলো একটু একটু ঘরে ঢুকেছে । বোর্ডের মধ্যখানে যিনি বসে আছেন তার মাথার সাদা চুলে এবং মুখে উজ্জ্বল হলদেটে আলো ঝিলিক মারছে । টাইলসের মেঝেতে হাঁটতে হাঁটতে বুটজোড়াকে গলার ফাঁসের মতো মনে হলে ভেতরকার দাবিয়ে রাখা অস্বস্তিটা বেশ বেড়ে যেতে যেতে মালেক সামনের কালো চেয়ারটাতে বসে । ব্র্যান্ড নিউজ চেয়ার । দেখেই বোঝা যায় মালয়েশিয়ার । মালেক সাথে সাথে চিনেছে ।

“ তা , আপনার নাম আবদুল মালেক ? “ মাঝখানের ডান পাশের জন যার কানে এবং নাকে অস্বাভাবিক পরিমাণে লোমের আতিশায্য তার গম্ভীর মুখে প্রশ্নটা শুনে মালেকের মনে হয় এই নামের অধিকারী হবার কারণেই বুঝি তার এখানে আর চাকরীটা হবেনা । আটষট্টি বছরের প্রাক্তন ফোর্থ ক্লাস কেরাণী বাপের কথা মনে হলে দুপুরের না খাওয়া মুখটা যেন একটু কষা হয়ে যায় । ইশ , লোকটা কি গ্রাম্য , কি গ্রাম্য !!! তাদের দুই ভাইয়ের নাম মিলিয়ে রেখেছিলো সালেক আর মালেক । বড় ভাই প্রায়ই নাম নিয়ে অভিযোগ করতে গেলে পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বলতো “ তরা এই নামের কি বুঝবি রে ? নামের মধ্যে কি বরকত আছে বুঝলে আমিই তোদের পোলা হইতাম । “ হ্যা , নামের বরকত কি সেটা তো চোখের সামনেই দেখতেছি । চাকরীটা হবার সামান্য যা সুযোগ আছে তাও বুঝি পানিতে চলে গেলো ।

প্রশ্নকর্তারা নাম থেকে সরাসরি সম্রাট আকবরের জীবনীতে চলে গেলে মালেকের পক্ষে সহজ হওয়া সম্ভব হয় । মোঘল সম্রাটদের সম্পর্কে যা যা জানার আছে তার সবই সরকারী পরীক্ষার জন্য পড়ে নিয়েছিলো । তবে তার আগের জনদেরকেও এই একই প্রশ্ন করা হতে পারে বিষয়টা মালেকের মাথায় ধরেনা । গলা যতোটা সম্ভব সংযত রেখে প্রশ্নগুলোর যথাযথ উত্তর দিলে পুনরায় তার চোখ স্থির হয়ে যায় । মাঝখানে বসে থাকা মধ্যবয়ষ্ক ভদ্রলোক পুরু চশমায় তার গলার টাইটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন । নির্ণিমেষ ।

মালেকের মনে হতে থাকে যেন টাইয়ের ফাঁসটা শুধু গলায় না তার শরীরের সর্বত্র হাতির মতো চেপে বসেছে । ধুরো বাল , মাকে বলেছিলো এই কটা সবুজ রঙের টাইটা বের করে না দিতে । তার কথা যদি বাড়ির কেউ শুনেছে কখনো । আহ , কবেকার কোন বিশ্রী এক টাই পরে সে সং সেজে চলে এসেছে ইন্টারভিউ বোর্ড ফেস করতে । তার মায়ের আজও কোন বুদ্ধিশুদ্ধি হলোনা । অথচ দেখো দেওয়ার সময়ে কি গদগদ কথা “ বাবা এই সবুজ রঙের টাইটা পইরা ইন্টারবিউ না কি কয় সেইটা দিতে যা । তরে খুব মানাইবো দেখিস । সকাল সকাল বাড়িত থেইকা বাইর হবি । লোকজনে তর দিকে চাইয়া থাকবো দেখিস । নাইলে বাড়ি ফিরা আমারে আইসা কইস । “ হ্যা , সবাই তার দিকে চেয়েই আছে বটে ! কি এক বদখত টাই পরে এসে তার এই চাকরীটার গোড়াতেও না পানি ঢালে সামনের মানুষগুলা । তার মতো হাজার হাজার মানুষ চরে এরা করে খায় । ক্যান্ডিডেটের পরনের টাইয়ের রঙ ভালো লাগেনাই , ব্যাস চাকরী দেবেনা এরকম খামখেয়ালী করতেই পারে । তার কি ক্ষমতা আছে প্রতিবাদ করবে ? ইশ , এরকম মূর্খ জন্মদাত্রী ঘরে থাকলে বাইরের বিপদের আর দরকার নাই । মালেকের মনে হয় কিছুক্ষণ কপাল চাপড়াতে পারলে বুঝি কিছু শান্তি হতো ।

চাকরীর জন্য সঙ্গে কার সুপারিশ এই প্রশ্নে মালেক সম্বিত ফিরে পায় । আছে আছে , তারও শক্ত সুপারিশ আছে । মুখে একটুকু হাসি বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলসে উঠে । আসলে কোন পরিশ্রমই বিফলে যায়না । বন্ধু আজীজের উশৃঙ্খল কাজিনটাকে পড়িয়েছিলো বছর তিনেক । পাজির পা ঝাড়া ছিলো । মালেক ছয় মাসের মধ্যে সিধা করে ছেড়েছিলো । ক্লাশ টেনের টেস্ট পরীক্ষায় ছাত্রের প্রতিটা সাবজেক্টে আশির উপরে নাম্বার ছিলো । সিমেন্টের ব্যবসা করে কোটিপতি হওয়া ছাত্রের বাপ মালেককে ভোলেনি । এখানে ইন্টারভিউ দেবে এই কথা তাকে জানালে উদার গলায় নিজের রেফারেন্সের কথা বলেছিলো । অভিজ্ঞ চোখ তো , ঠিকই বুঝে কাকে দিয়ে কি হবে । নয়তো কি সেধে সেধে তাকে নিজের কথা .........আসলেই পুরানো চাল ভাতে বাড়ে ।

চাকরীর নিশ্চয়তার অলিখিত সার্টিফিকেট সঙ্গে করে মালেক ইন্টারভিউ রুম থেকে বেরিয়ে আসলে স্প্রিং উঠে যাওয়া সোফায় তার পাশে বসে অনবরত বকবক করা সেই মুখটি উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় । অব্যক্ত সেই প্রশ্নাতুর মুখে দিকে একবার তাকিয়েই মালেক চোখ নামিয়ে নেয় । এমনকি তাকে সঙ্গে করে নিচে কোথাও খেয়ে নেবে এই ইচ্ছাও তার আর স্মরণে থাকেনা । আহ কি শান্তি , চাকরীর প্রথম বেতনে বাপ – মাকে কি দেবে ভাবতে ভাবতে মালেক লিফটের বদলে সিঁড়ি দিয়েই তরতর করে নামতে থাকে । মা – বাপের দোয়ার উপর কিছু আছে নাকি ?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.