নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

আগুন

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:৫৬

“ভাই, আপনারা সামনে দাঁড়াইয়া আছেন ক্যান? সিটে জায়গা থাকতে সবাই আইসা সামনে দাঁড়াইছেন। লোকজনরে বাসে ঢুকতে দিবেননা? যারা দূরে যাইবেন তারা পিছনে গিয়া বসেন। যান পিছে যান।” হেলপারের কন্ঠে পর্যাপ্ত কর্তৃত্ব থাকলেও যাত্রীদের পা জোড়া কনামাত্রও নড়লোনা। এমনকি স্বভাবসুলভ আগেপিছে তাকাবার জন্যেও শরীরের বিভিন্ন অংশের যেই নড়নচড়নের প্রয়োজন হয় তারও কোন হদিস নেই। প্রত্যেকের চোখ সামনে, চিত্ত আগত বর্তমান আর অনাগত ভবিষ্যতের মাঝামাঝি কোন স্থানে। প্রত্যাশিত। গত এক মাসে শহরে কমপক্ষে ষাটজনের মৃত্যু হয়েছে আগুনে পুড়ে। দশ-পনেরো বছর আগেও হরতালে জ্বালানো, পোড়ানো চলতো। বাস ভাঙ্গাভাঙ্গি হতো, প্রাইভেট কারের কাঁচ ভাঙ্গতো। কিন্তু বাসে বোমা মেরে জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়াটা রুটিনওয়ার্কে পরিণত হয়নি। এখন সময় ভিন্ন। বাই হুক অর বাই ক্রুক নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবার খেলার স্ট্র্যাটেজী বদলেছে। ভায়োলেন্সকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাও, পাবলিককে ধারাবাহিক শক দাও, প্যানিক সৃষ্টি করো এবং খেলাটা দীর্ঘায়িত করো। এই সময়ে পেছনের বেশ কিছু জায়গায় জানালার প্রোটেক্টিভ কাঁচ নেই এরকম সিটে যেচে যেচে যাত্রীরা বসবে কি সুখে? কার ঠেকা পড়েছে? এতোকিছু হিসাব করেই তৌফিক মতিঝিলের স্টপেজে পাক্কা পনেরো মিনিট দাঁড়িয়েছিলো। সামনের সিটগুলো ফাঁকা আছে এমন কোন বাস পেলেই অবসন্ন শরীর নিয়ে ঝটপট উঠে পড়বে। কিন্তু সামনে বসেও শান্তি পেলো কোথায়? চারপাশের সবার চোখেমুখের বিবর্ণতায় তার সারাদিনের হতাশা তো বেড়েছেই সাথে ভেতরে কাঁপুনিও বেড়েছে। কাঁধের ব্যাগটিকে মাঝেমধ্যেই শক্ত করে চেপে ধরছে। বিনা কারণে। যেন কাঁধ থেকে হালকা হলেই নিজে নিজে অন্যত্র উড়াল দেবে।



কিন্তু এমন কি হবার কথা ছিলো? গতকালকেও শামসুদ্দিন সাহেবের ফোন পেয়ে কি আনন্দিতই না হয়েছিলো। এই লোককে কতোদিন হলো তৌফিক চেনে, লোকটা এমনি এমনি কাউকে ফোন দেয়না। তাকে যখন দিয়েছে নিশ্চয়ই কোন খবর আছে। এরকম আকাঙ্খিত কোন খবরের জন্য তৌফিক অগণিত জুতার শুকতলা ক্ষয় করেছে তার হিসাবপত্তর কেবল সেই জানে। কিন্তু বাস্তবে কি দাঁড়ালো? ঘোড়েলটা পাক্কা আধাঘন্টা নিজের অফিসে তাকে বসিয়ে রাখলো। শাকচুন্নী রিসেপশনিস্টটা কতক্ষণ পরপরই করুণার পানিতে ভেজা চোখ দিয়ে তাকে নিয়ে খেললো। সেই খেলা শেষ হতে না হতেই ব্রিটিশ আমলের প্লেটে প্রাগৈতিহাসিক আমলের দুটা সিঙ্গারা হাতে ধরিয়ে দিয়ে অবজ্ঞা সমেত ফোর্থ ক্লাস স্টাফ তার সামনে দিয়ে চলে গেলো। তৌফিক তাও বরদাস্ত করতে প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু উপেক্ষার প্রতিটি স্তর পার করে এসেও “সরি, স্যার বলেছেন আজকে দেখা করতে পারবেন না” বাক্যমালা কানে এসে বাজলে আর কি সহ্য করা যায়? কোথাও যদি এতোটুকু শান্তি পায়। এদিকে বাড়িতেও উটকো ঝামেলায় তৌফিকের অবস্থা জেরবার। ছোটবোনটা দিন পনেরোই হলো একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইড এটেম্পট করেছিলো। প্রেমের কেস। বাপের আদরে আদরে এমন আহ্লাদী হয়েছে যে তাকে দুই-চারটা চড়চাপড়ও দেওয়া গেলোনা। তার রেশ বাড়ি থেকে এখনো যায়নি। সপ্তাহখানিক হলো মায়ের সারা শরীরে জ্বালাপোড়া। পরিচিত রহমান ডাক্তারকে দেখিয়েছিলো। কয়েকটা টেস্ট-ফেস্ট করিয়েও বেটা কিছু বলতে পারেনা। কুতকুতে চোখ চারিদিকে ঘুরিয়ে মিনমিনে স্বরে বলে “ব্যাপারটা কি বুঝতে পারছিনা, সামনের দুই-তিনদিন একটু দেখেন। যদি জ্বালাপোড়া না কমে তাইলে আবার নিয়ে আসবেন।” হারামজাদা কোথাকার। সবই বেটার পয়সা কামাবার ফন্দি তৌফিক কি বোঝেনা? স্কাউন্ড্রেলটা কি তাকে দুধের বাচ্চা ভেবেছে নাকি? এইসব দুর্দশা হজম করলে রাতে খাবার টেবিলে চুপচাপ বসে বাপের কাছে বেকারজীবন নিয়ে টিটকিরি শোনা।



“ভাই ভাড়াটা দ্যান,” হেলপার দ্বিতীয়বার তার কাছে ভাড়া চাইতে এলে তৌফিকের কানের পাশে দপদপ করে। পাছার নিচে কষে দুইটা লাথি মারার ইচ্ছা জাগে। কিন্তু না মারার উদারতা প্রকাশ করে নম্র গলায় “ বাসে উঠতেই তো ভাড়া দিলাম, কয়বার ভাড়া দিবো” বললে হেলপার ভাড়া আদায় করতে ভিড় ঠেলে পেছনের দিকে চলে যায়। ট্রাফিকজ্যাম ঠেলে ঠেলে বাসে ততক্ষণে প্রেসক্লাবে।



“পরশুদিনই তো টক শোতে একজনে আইসা কইলো দেশ নাকি স্বাভাবিক আছে। মিডিয়া নাকি ফুলাইয়া ফাঁপাইয়া সব বড় কইরা দেখতাছে।” কথাটা কে বলেছে তাকে দেখার জন্য তৌফিক ডান দিকে ঘাড় ঘুরালে মাঝখানে বাদুড়ঝোলা হয়ে বাসে দাঁড়িয়ে থাকা বাসযাত্রীদের কারণে বক্তার চেহারা অদৃশ্যমানই থাকে।



“এই টকশোয়ালাগোরে পুন্দাইয়া রাইখা দেওনার কাম।”

“একেবারে ঠিক কথা বলছেন ভাই। আপনার লগে একমত।”

“চরমোনাই পীরেও যদি সামনেরবারে ইলেকশনে খাড়ায় আমি তারেই ভোট দিমু। যার যা বলার ইচ্ছা বলুক গিয়া।” টকশোওয়ালা থেকে রাজনৈতিক আলাপ চরমোনাই পীর পর্যন্ত চলে গেলে তৌফিক কৌতূহলী হয়।



তৌফিকের গলাটা শিরশির করে। বাসে চলমান রাজনৈতিক আলাপে তার কি গলা মেলাতে ইচ্ছা করেনা? কিন্তু সেই সুযোগ কই? বাসে বসে আছে প্রায় আধাঘন্টা হয়ে গেলো। পাশের যাত্রীর সাথেও কোন কথা বলেনি। যাদের চেহারা দেখতে পর্যন্তও পাচ্ছেনা তাদের উদ্দেশ্যে নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ঝাড়লে তাদের কেউ কথা শুনবে? সে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এমনটা তাকে বলা হতেই পারে। তাছাড়া এই রাজনৈতিক জঞ্জালের জন্য কম তো সাফার করছেনা। এই যে গতকাল শামসুদ্দীন নিজে থেকে তাকে ফোন দিয়ে দেখা করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আজকে তার সাথে দেখা করলোনা এর পেছনেও নিশ্চয়ই কোন ঘাপলা আছে। এমিনেন্সের সার্কুলার দিয়েছে। সেই পারপাসেই শামসুদ্দীন তাকে ডেকেছে বলে ভেবেছিলো। অন্য কেউ এর মধ্যেই শামসুদ্দীনকে তার বিষয়ে উদাসীন করে ফেলেছে। নাইলে অফিসে আসতে বলেও তার সাথে দেখা না করবার আর কিই বা কারণ থাকতে পারে? পলিটিক্স, সবই হচ্ছে পলিটিক্স।



পলিটিক্সের প্রতি বিতৃষ্ণায় তৌফিকের মুখে থুথু জমে। সেটা বাইরে ফেলতে হলেও জানালার কাঁচ সরাতে হবে।কাঁচটা বেশ শক্ত। একবার খুললে লাগাতে একটু সময় লাগবে। করতে গেলেই পাশের আর পিছনের যাত্রীরা হইহই করে উঠবে এই বিষয়ে তৌফিক নিঃসন্দেহ। এমন অবস্থায় মনে মনে ‘বাল’ বলে থুথু সমেত শব্দটি গিলে নেওয়া ছাড়া তৌফিক আর কিছু করতে পারেনা। তার আজকের সারাটা দিনই মাটি।



গন্তব্যে চলে আসলে কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে তৌফিক নামতে উদ্যত হয়। বাসে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধের সাথে সংঘর্ষ হলে তৌফিক প্রায় লাফ দিয়ে বাস থেকে নেমে যায়। তার উদ্দেশ্যে ভিকটিম কি অভিশম্পাত করে তা শোনা থেকে বাঁচতে। বৃদ্ধের দাঁড়াবার ভঙ্গিটির সাথে সে পরিচিত। এই যে রাত বেজেছে এখন পৌনে নয়টা, দশটার সময়ে টেবিলে বসবার আগে তার সাথে চোখাচোখি হবার সময়ে তৌফিক আবারো এই দাঁড়াবার ভঙ্গিটি দেখতে পাবে।



“এই রিকশা, যাইবা?” কোথায় যেতে হবে সেটা জেনে নিয়ে রিকশাওয়ালা তার সাথে গন্তব্যে সফর করতে রাজি হলে দশ টাকা বেশী ভাড়া দিতে হবে জেনেও উঠে যায়। এইদিকের রাস্তা রাতেরবেলায় বেশ বিপদজনক। গত মাসেই ছিনতাইকারীর হাতে তিনজনে মরেছে। বাস থেকে নেমে গেছে। তারপরেও মুক্ত বাতাস তৌফিকের কাছে বদ্ধ ঠেকে। গলার কাছে সামান্য একটুকু জায়গা লাল হয়ে গেছে। সেখানে হাত বুলাতে বুলাতে। পোড়া গন্ধ নাকে ভেসে আসলে দেখে ডানদিকের ফুটপাতে স্তুপ করে রাখা জঞ্জাল আগুনে আত্মাহুতি দিচ্ছে। পারিবারিক বিপর্যয়, নিস্ফল একটি দিনের প্রতিক্রিয়ায় আগুন অচল কাগজপত্র, চিপসের প্যাকেট থেকে তৌফিকের ভেতরেও সঞ্চারিত হয়। রিকশাওয়ালা দ্রুতবেগে রিকশা চালানোয় জাগ্রত আগুন নিয়ে তৌফিক বাড়ির কাছাকাছি চলে আসলে গেটের সামনে উৎসুক অচেনা মানুষজন দেখে। ভাড়া মিটিয়ে “কি ব্যাপার” জিজ্ঞেস করলে ফ্যাসফ্যাস গলায় গেটের দারোয়ান বলে “স্যার, চাইর ঘন্টা হইবো হারুন রাস্তা পার হইতে গিয়া সামনের হাসপাতালের কাছে এক্সিডেন কইরা মারা গেছে।” তৌফিকের ভেতরকার উত্তেজনা একটু থিতিয়ে মৃত হারুনের দিকে ঝুঁকে আসে। হারুনের বয়স তার থেকেও কম ছিলো, সামনের এপার্টমেন্টের দারোয়ান ছিলো। ভাবতে ভাবতে “ খাটিয়ার মাথা সামনের দিকে রাখ, তুলতে সুবিধা হইবো” বাক্যমালা তার কানে ভেসে আসতে আসতে ততক্ষণে আগুন তৌফিকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অচল কাগজপত্র , চিপসের প্যাকেটের কাছে নিজেকে পুরাদমে সমর্পণ করেছে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:১৬

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: অসাধারণ গল্প সমসাময়িক বাস্তবতা নিয়ে| অনুসরণ করছি

২| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৯:১৮

বৃতি বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.