নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শিক্ষকনামা

০৯ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ৩:৪৪

বিছানার শেষ প্রান্ত ঘেঁষা স্থানের সামনে এক চিলতে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াতে পারলে জোৎস্নার আলোকে দেখতে পাওয়া যায়। সেই আলো তার প্রতি উন্মুখ প্রতিটি উৎসুক মুখের প্রতিই সদয়। কিন্তু সময় কই? আকাশে জোৎস্নার দ্যুতি প্রকৃতিপ্রেমিকদের কাছেই শুধুমাত্র নিজেকে প্রস্ফুটিত করে তুলতে পেরেছে। প্রফেসর মিরাজুল হকের চোখে কাম, ক্লান্তি আর প্রকৃতির ত্রিমুখী যুদ্ধ। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেই কি ঘুম আসে? ঈশ্বরও উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে গোস্বা করেন।

কিন্তু আজকের এই ঝলমলে সন্ধ্যার পরে এরকম অবসাদের কি মানে থাকতে পারে? নিতান্তই অর্থহীন। গত তিন সপ্তাহ শরীর আর মনের উপর দিয়ে যা গেছে তারপরে এরকম একটা সন্ধ্যার দেখা পাওয়া যাবে ভেবেছিলো কোন শালায়? অচেনা কারো উদ্দেশ্যে দেওয়া গালিটা নিজের দিকেই ফিরে এসেছে বুঝতে পারলে প্রফেসর মিরাজুল হকের থুথু গিলে নেওয়ার অনুভূতি হয়। দ্রুত তো অস্বস্তিটা কাটাতে হয়। তারপরে ডঃ সাইয়েদুর রহমানের দেওয়া পার্টিতে কাটানো সময়গুলোর কথা মনে না করে পারা যায়?

লোকটা এলেমদার আছে বটে। কোন জায়গায় কি করে কাকে কোন কায়দায় ভজাতে হয় বিলক্ষণ জানে। ভার্সিটিতে বিশেষ কাজের চাপ ছিলোনা। তাই বাইরে কনসাল্টেন্সি কাজের জন্য মিরাজুল হক হন্যে হয়ে ঘুরছিলেন। শেষমেষ ওরিয়েন্টাল গ্লোবের জেন্ডার এমপাওয়ারমেন্ট প্রজেক্টটায় নিজের নাম রেকমেন্ড করবার জন্য মিরাজুল হক বলতে গেলে লোকটার পা ধরতেই বাকি রেখেছেন। তাও প্রায় সাড়ে তিন মাস যাবত। উফ, কি সময়টাই না গিয়েছিলো। বেটা সহজে কনভিন্সড হবারই এলিমেন্ট না। শেষমেষ দামী ব্র্যান্ডের স্কচ বাড়িতে পাঠালেই তবে রাজি হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু লোকটার ম্যানার? লা জওয়াব। যখন কাজের সময় তখন স্ট্রিক্ট প্রফেশনাল, কাজের পর্ব শেষ তো একই মায়ের পেটের আপন ভাই হিসাবে ট্রিট করে কাছে টেনে নাও। এই ব্যস্ত সময়ে নিজের ঘরে পার্টি দিলে নির্দিষ্ট কারো দিকে হোস্ট এতো মনোযোগ দেয়? নাকি দেওয়া উচিত? কিন্তু দেখো সাইয়েদুর রহমানকে। চার পদের মিষ্টি খাওনার পরে পঞ্চম পদেরটা জোর করে প্লেটে তুলে দিতে দিতেও ম্যানার দেখাতে ভোলেনি। ভুলে গেলে সাইয়েদুর রহমানের মতো মানুষদের চলবে কেন?

“আরে মিরাজ, এতো লজ্জা কেন করেন? প্রতিদিন তো আর হরেক পদের মিষ্টি খেতে পারেন না। আজকে এই অধমের বাড়িতে আসলেন, নিঃসংকোচে খাওয়াদাওয়া করেন। অল ওয়ার্ক এন্ড নো ইটিং উইল মেইক মিরাজ এ ডাল প্রফেসর, হা হা হা হা।”

হাসি একটা আছে বটে লোকটার বিশাল সাইজের ভুড়ির উপরে থাকা গলার ভেতরে। সময়ে সময়ে বোমা পড়ার শব্দের মতো করে বেরিয়ে আসে। তবে কথায় কথায় নিজের বেলাতে অধম শব্দটা ব্যবহার করার সেই মুহূর্তে মিরাজুল হকের চোখে চলে গিয়েছিলো বাদামী রঙের দেয়ালে। একটু দূর থেকেও সালভাদর দালীর আঁকা পেইন্টিংটা ঠিকই দৃশ্যমান হয়। শেষবার কথায় কথায় সাইয়েদুর রহমান বলেছিলেন যে পেইন্টিংটা স্পেন থেকে আনিয়েছেন। এই যদি হয় অধমের অবস্থা তাহলে উত্তমের সংজ্ঞা কি? এসব অদ্ভুতুড়ে ভাবনা মনে হলেই কি আর জিজ্ঞেস করা যায়? কেউ কেউ অবশ্য সূক্ষ্ণ হিউমার ব্যবহার করে অন্যভাবে প্রশ্নটা করতেই পারতো। কিন্তু মিরাজুল হকের কি ঠেকা পড়েছে এই বর্ণিল, মাদকতাময় সন্ধ্যায় নিজের উইটের লেভেল পরীক্ষা করবার? দিব্যি তো পঞ্চম পদের মিষ্টিটা পেটে চলেই গিয়েছে।

মিষ্টির কথা ভাবতে ভাবতে বেশ জোরে হুঁইসেলের শব্দে কানে তালা লেগে গেলে মিরাজুল হকের সামনে নিরেট বাস্তব। প্রায় কম দিন তো হয়নি সেগুনবাগিচায় আছেন। বাঁশির তীব্র শব্দে রাতে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় বলতে গেলে ঋদ্ধ হয়ে গেছেন। চোখের তলাতে আবছা আবছা ঘুম এখনো ঠিকরে বেরুচ্ছে। এবারে রিগোরাস একটা এটেম্পট নেবেন কিনা ঘুমের জন্য তা ভাবতে ভাবতে শান্তিনগরে প্রফেসর সাইয়েদুর রহমানের পার্টির খন্ড খন্ড স্মৃতি পুনরায় এসে ভিড় করলে সেই রিগোরাস এটেম্পট বাষ্প হয়ে উবে যায়।

“মিরাজ ভাই, আপনি আনম্যারিড লোক সেটা আমরা জানি তাই বলে আপনার ভাইয়ের পার্টিতে এসেও এরকম স্টিফ থাকলে তো হবেনা।” পলি ভাবি এসে স্বভাবসুলভ রসিকতা করতে ছাড়েনি। কালোর উপরে কমলা রঙের শাড়ি পরিহিতা কর্ত্রীর রসিকতায় ব্যক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট। আটত্রিশ বছরের মিরাজুল হকের রিফ্লেক্স ধারালো ছিলোই বা কবে যে এই কথার যুৎসই রিপ্লাই দেবেন? নিজেকে সপ্রতিভ করতে তাই তাকে অন্য পথের আশ্রয় নিতেই হয়। “সাইয়েদুর ভাই এতো খাওয়াইলো যে কি বলবো ভাবি, সাগর আর সুমাইয়াকে দেখছিনা যে।” দেখছিনা শব্দটি উচ্চারণ করতে কি কষ্ট হয়েছিলো তার খবর ঈশ্বর আর মিরাজুল হক বাদে পলি ভাবি সম্ভবত একটু আঁচ করতে পারেন। মুখ ফসকে ‘খাওয়াইলো’ উচ্চারণ করে ফেলার পরেই পলি ভাবির চোখ কুঁচকে গিয়েছিলো।

“ওরা এই সামনেই আছে, বন্ধুবান্ধব এসেছে কিছু তাদের এন্টারটেইন করছে। তাদের মিরাজ আঙ্কেল কি উপহার এনেছে সেই নিয়ে কতক্ষণ আমার সাথে চেঁচামেচি করলো। আমি বলেছি যে পার্টি শেষ হবার আগ পর্যন্ত উপহার সম্পর্কে কিছু বলা হবেনা।” পলি ভাবির সাথে সাথে সাইয়েদূর ভাইও অর্থহীন হাসি হাসলে মিরাজুল হক আর কিই বা করতে পারেন?

মিরাজুল হকের চোখের তলানির ঘুম একটু কি কাটতে শুরু করেছে? শীতের সকালের কুয়াশা যেভাবে ধীরে ধীরে কাটতে থাকে সেভাবে? তার সম্পর্কে অবহিত হতে রাত বাজে দুইটা আট মিনিটে তার ভালো লাগে কিভাবে? পার্টিতে আজকে তার পরিচিত মানুষ কম এসেছিলো নাকি?

অনার্সে পড়বার সময়ে তার প্রিয় ছাত্রদের একজন ছিলো রাতুল। বলতে গেলে একেবারে উপরের দিকেরই ফেভারিট স্টুডেন্ট। বরাবরই এম্বিশাস আর শার্প। সাথে স্মার্টনেসটাও দেখবার মতো। প্রাক্তন স্যারের এনিভার্সারীর পার্টিতে এসেছে নিঁখুত এটায়ারে। শার্ট, স্যুট আর টাইয়ের কম্বিনেশন দেখে মুগ্ধ হতে হয়। বড় এক মাল্টিন্যাশনালে সিক্সটি থাউজেন্ড স্যালারী। বছর দুয়েক পরে হাইয়ার স্টাডিজের জন্য কানাডায় যাবে বউসহ। অতীতের প্রিয় শিক্ষকের সাথে এতোদিন পরে দেখা হলে আলাপচারীতা না জমে পারে? দিব্যি জমে গিয়েছিলো রাতুল আর তার বউয়ের সাথে। মিরাজুল হক ছাত্রের বউকে এই প্রথম দেখেন।

“আপনার কথা রাতুলের কাছে অনেক শুনেছি। ছয় বছর হলো পাস করে গেছে এখনো নিয়মিতই আপনার কথা বলে।” রাতুলের স্ত্রী নুসাইবার গলায় প্রশংসার সাথে সাথে আরো কিছু আছে কিনা জানবার বড্ড সাধ হয়। স্টুডেন্টদের মুক্ত প্রশংসার ঝর্ণায় ভিজে যেতে বরাবরই মিরাজুল হকের সমগ্র শরীর শিরশির করেছে। কিন্তু সেই সুযোগ তো বর্তমানে খুব বেশী মেলেনা। কিন্তু এরকম র কোন প্রশ্ন করবার বয়স পার করে এসেছেন বলে জ্বলজ্বল করতে থাকা কৌতূহলকে নিজের কাছেই মাটিচাঁপা দিয়ে রাখা ব্যতীত তার ভিন্ন কিছু করা হয়ে উঠেনা।

“স্যার, নুসাইবার কথা কিন্তু একটুও মিথ্যা না। স্টুডেন্ট থাকার সময়ে আপনি যেই হেল্প করেছিলেন সেটা আমি সবসময়েই মনে রেখেছি। ইনফ্যাক্ট আমার কানাডা যাবার নিউজটা কনফার্মড হবার পর আমি প্রথম ফোন কলটাই আপনাকে করেছিলাম।” আধাঘন্টার মধ্যে এই একই কথা তিন তিনজন এক্স স্যারকে বলার পরেও রাতুলের গলায় প্রথমবাবের মতো বলা সপ্রতিভতাটুকু পুরোদমে রয়ে যায়।

ঘরে একটু একটু করে গরম বাড়তে আরম্ভ করেছে। রাত বেজে হয়েছে আড়াইটার মতো। জোৎস্নার আলো কমেছে এই কথা অবিশ্বাস্য পর্যায়ের মিথ্যুক পর্যন্ত বলতে পারেনা। কিন্তু মিরাজুল হক, প্রফেসর অব ইউনিভার্সিটি অব ঢাকার প্রবল অস্থিরতা কাটাবে কে? এই যে এতো এতো প্রশংসার জলে ভিজে আসলেন, এতো এতো পুরনো স্টুডেন্টরা পুরনো স্যারকে দেখে উচ্ছসিত হয়ে উঠলো তারপরেও কি যেন নেই কি যেন নেই ধরণের একটা বিশ্রী অনুভূতি। এর কোন মানে হয়?

আকাশে হালকা শরীরের মেঘেরা দিব্যি নিজেদের মনে বিচরণ করে। ঘরে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা নীলাভ আলোতে সেই বিচরণের তল তো দূরের কথা সামান্য অগ্রভাগ পর্যন্তও অনুভব করা যায়না। এদিকে ডঃ সাইয়েদুর রহমানের পার্টির স্মৃতিগুচ্ছ যা ছিলো তার সবই তো মোটামুটি রোমন্থন করা শেষ। বিয়েটা পর্যন্ত করলেন না যে আজকের সন্ধ্যার অভিজ্ঞতাগুলো রসিয়ে রসিয়ে স্ত্রীর কাছে বলতে পারবেন। এই যে এরকম একটা মস্ত বড় লোকের পার্টিতে তাকে স্বয়ং হোস্ট যেই খাতিরদারি করলো, এতো এতো পুরনো স্টুডেন্ট তার সাথে দেখা করে প্রশংসায় তাকে দেবতার আসনে উঠিয়ে দিলো এইসব গল্প কি নিজের কাছেই রেখে দেওয়া যায়? কতো রকমের কষ্ট থেকে যায়। শুধু শারীরিকই তো না মানসিকও। ময়মনসিঙে তাদের বাড়িরই কাছাকাছি বাড়ি পরিচিত কুদ্দুস মাস্টারের মেয়ে রিনার সাথে তার বিয়ে নিয়ে ভাইরা কতো চেষ্টা করলো, জেদের বশে সেই বিয়ের প্রস্তাবকে না করে দিয়েছিলেন। এই নিঃসঙ্গ মুহূর্তে নিজের জেদের উপরেই মিরাজুল হকের জেদ হয়। রিনা মেয়েটার চেহারাসুরত বলতে গেলে জাতেরই না তো কি হয়েছে? এই সময়ে সমাজে স্বামীর বিদ্যমান প্রভাব-প্রতিপত্তির অতিরঞ্জিত বর্ণনা শুনতে ঠিকই রাজি হয়ে যেতো। মেয়ে বাপের মতোই সরল চরিত্রের, তিনি যাই বলতেন সেটাই বিশ্বাস করতে দ্বিতীয়বার দ্বিধা করতোনা।

কিন্তু এসব তো গেলো কল্পনার কথা, খাস বাংলায় বললে ভাবের কথা। বাস্তবে সেই সুখ তার কপালে জুটলো কই? এদিকে কিছু সময় বিরতি দিয়ে আবারো বাঁশি বেজে উঠলো। এইবারে তীব্র স্বরে। সম্ভবত আশেপাশে কোন চোর ধরা পড়েছে। সচরাচর ছিঁচকা চোর কি ছিনতাইকারী ধরা পড়বার পরেই পুলিশ কি গার্ডে থাকা দারোয়ান প্রায় আকাশের সমান উচ্চতায় ঘুমিয়ে থাকা সমাজের প্রভাবশালী তস্করদের তীব্র শব্দে বাঁশি বাজিয়ে আশ্বস্ত করে। মনোটনি কাটাতে টেলিভিশন চালু করতে করতেই শরীরে আচমকা তুমুল ভাংচুর। আজকে সকালে এইচবিও চ্যানেলে মুভি দেখেছিলেন। ছবি শেষ হলে সেভাবেই বন্ধ করে দিয়ে চলে যাবার পর এই পৌনে তিনটায় টিভি অন করতেই হার্ডকোর থ্রিএক্স দৃশ্যে আজকের বর্ণিল সন্ধ্যা, কুদ্দুস মাস্টারের মেয়ে রিনাকে স্ত্রী করতে রাজি না হবার মূঢ়তায় মিরাজুল হকের আহাজারী সব চলে যেতে উদ্যত হলে জোৎস্নার আলোর কিছু করবার থাকে?

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ১২:৫১

কলমের কালি শেষ বলেছেন: গল্পে ভাল লাগলো । মিরাজুল মাস্টারের স্মৃতি মন্থন আর পাওয়া না পাওয়া দীর্ঘশ্বাস । সুন্দর করে সাজিয়েছেন ।

২| ১১ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ২:০৭

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
ধারাবর্ণনা ভাল লাগলো ৷ আটসাঁট ৷

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.