নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

জারুল অথবা ঈর্ষার গল্প

২০ শে এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪০

ডান চোখের পাতা বন্ধ করলে হালকা গোছের শিরশিরে এক ব্যাথায় সেঁজুতি আবছা কঁকিয়ে উঠে, গলা থেকে কোন আওয়াজ প্রকাশিত হতে অনিচ্ছুক বলে মুখমন্ডলের রেখাসমূহে আড়াই সেকেন্ডের জন্য মৃদু একটুকু পরিবর্তন ব্যতীত আর কোন প্রতিক্রিয়া হয়না। আধ খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির পানির ছাঁচ যে একটু একটু টেবিলে আসতে শুরু করেছে সেটা চোখে পড়লেও বিছানা ছেড়ে উঠে জানালাগুলো লাগিয়ে দিতে ইচ্ছা করছেনা। অথচ টেবিলে গুচ্ছের গুরুত্বপূর্ণ সব কাগজ, পলিটিকাল সায়েন্স কোর্সের মাহবুব স্যারের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নেওয়া নোটসমূহ। সেঁজুতি একটু একটু করে পড়তে শুরু করলে অনায়াসেই এই কোর্স উৎরে যাবে। আর তাদের কে না জানে একেবারে শেষ বর্ষে এসে এই একটা কোর্স উৎরে যাওয়া মানেই নিশ্চিন্ত। অনার্সের ডিগ্রিটা মোটামুটি বিনা ঝঞ্ঝাটেই শেষ করা যাবে। ভাবতে ভাবতে ডান চোখের শিরশিরে ব্যাথা নিয়েই সেঁজুতি ডান পাশে কাত হতে হতে হাসে। হাসবেনা ? নোটগুলো সংগ্রহ করবার আগে সেঁজুতি কতোবার মাহবুব স্যারের সাথে কথা বলবার রিহার্সেল দিয়েছে। নিজে নিজে দেওয়ার পরেও যখন খুঁতখুঁতে ভাবটা যায়নি তখন সামনে আফরিনকে রেখে আরো তিনবার রিহার্সেল দিয়েছে। আফরিনের ভুঁরুতে প্রথমে একটু ভাঁজ পড়েছিলো। পরক্ষণেই সপ্রতিভ,

“বাব্বা, দেখে তো মনে হইতেছে মাহ-বুবসের কাছে নোট নিতে না বাসরঘরে ঢুকবার রিহার্সেল দিচ্ছিস।”

কুইক রিফ্লেক্সের জন্য সেঁজুতির খ্যাতি গোটা বিশ্ববিদ্যালয় জোড়া। তাই তড়িৎ জবাব ঠোঁটের আগাতেই সুড়সুড় করে চলে আসে,

“তুই থাকতে কার ঘাড়ে কয়টা মাথা তার সাথে বাসরঘরে ঢুকবার রিহার্সেল দেয়?”

এসবের পরে আর বিশেষ দেয়ালা করার সুযোগ হয়নি। ওড়নাটা একটু নিচের দিকে নামিয়ে আনা ছাড়া সেঁজুতির বাকি সবেতেই আফরিনের ওকে ছিলো। শালী আস্ত......বাকিটুকু তখন মনে মনেও আর উচ্চারণ করেনি। এই আফরিনের স্ট্র্যাটেজীই একটা। স্যারদের কাছ থেকে মিস করা ক্লাসগুলোর নোট কালেক্ট করতে যাও মানেই ওড়নাটা নিচের দিকে নামাতে হবে। নিজেরটা তো নামাবেই বান্ধবীদের কেউ নিতে গেলেও নিস্তার নেই। তবে সেঁজুতি অস্বীকার করে কি করে আজকে এই গতানুগতিক স্ট্র্যাটেজীটাই তার জন্য দুর্দান্ত কাজে লেগে যাবে? চোখ দিয়ে বিশ সেকেন্ডের মতো তার সমগ্রটা গিলে নিয়ে তবেই না আজিজুদ্দীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিকাল সায়েন্সের মাননীয় লেকচারার মোঃ মাহবুব কামরান গদগদ গলায় “ সেঁজুতি তুমি এতো লেট করলা নোটগুলো কালেক্ট করতে? আরেকটু হইলেই তো আর পাইতানা। চার বছরে এসেও তুমি কেয়ারলেসই থেকে গেলা।” এতো লম্বা সময় ধরে কথাগুলো বললো তবু সেঁজুতির বুকের দিকে দৃষ্টিটা ঠিকই কেয়ারফুল্লীই রাখতে পেরেছে। সে নিজে নোট কালেক্ট করতে গেছে। ঠেকা তো তার নিজেরই। সেভাবে নিজেকে প্রিপেয়ারও করে নিয়েছিলো। এই নিয়ে অভিযোগ করার আছেটা কি?

বৃষ্টির ফোঁটা এবারে সাড়ম্বরে আকাশ বেয়ে বেয়ে চারপাশে পড়তে শুরু করলে শারীরিক কলাকৌশলের বিষয়ক ভাবনা ছেড়ে সেঁজুতিকে বিছানা থেকে উঠতেই হয়। নারিকেল গাছের পাতার ডগায় উপরে কোত্থেকে একটা জারুল ফুল এসে স্থির হয়ে আছে। এই বৃষ্টিতেও নড়েনি। জানালা বন্ধ করতে করতে নিচের দিকে চোখ যায়। চার-পাঁচজন বন্ধু্র সাথে মিলে টঙের দোকানের শেডের নিচে বুলবুল রঙ্গতামাশা করছে। বেশ রাস্টি ধরণের ছেলে। সেঁজুতি কলেজে থাকতে তার উপরে কতো ট্রাই নিয়েছিলো। সেঁজুতি পাত্তা দেবে এরকম লোফার ধরণের ছেলেকে? প্রশ্নই আসেনা, একদিন নিজেই এপ্রোচ করেছিলো বুলবুলকে।

“আপনি সারাটাজীবন আমার পথে দাঁড়িয়ে থাকলেও কোন লাভ হবেনা। আমি আপনার প্রস্তাবে সাড়া দেবোনা।” সেঁজুতি সেইবারেই প্রথম বুঝেছিলো ‘দাঁড়িয়ে’, ‘দেবো’ শব্দাবলী উচ্চারণ করাটা কতো কষ্টের। মুখ থেকে সহজে বেরুতেই চায়না। এরজন্যেও রিহার্সেলের দরকার হয়। ইন্সট্যান্টলী মুখ থেকে বের হয়না।

হকচকিয়ে যাওয়া বুলবুল তখন কি বলবে? অন্যসময়ে বাইরে যতোই রাজাউজির মারুক প্রণয়িনীর এরকম অকস্মাৎ চন্ডালমূর্তির সাবলীল মোকাবেলা করাটা অন্তত তার ব্যাপ্তির বাইরে। তাই পরবর্তী চার মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ড যাবত সেঁজুতির গর্জন সহ্য করে সেই যে চোখ নামিয়েছিলো আর কোনদিনই তোলেনি। এখনো তাদের হোস্টেলের সামনে দিয়ে গেলে চোখে চোখ পড়লে সেঁজুতির মাথা নামাতে হয়না। অপরপ্রান্ত থেকেই আপনাআপনি মাথা নুয়ে আসে। লজ্জায় কি ভয়ে সেঁজুতি তার খোঁজ রাখবার কোন প্রয়োজনবোধ করেনি। এরকম রাফ এন্ড টাফ কাউকে নুয়ে থাকতে দেখলে চাপা এক ধরণের গর্ব হয় এই সত্য সে নিজের কাছে লুকায় কিভাবে?

বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশটা এতো ঝকঝকে দেখাচ্ছে! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবার মতো। কিন্তু সেঁজুতির ভাগ্যে প্রকৃতিপ্রেমের সুযোগ কই? দেখতে দেখতেই অপর পাশের বিছানায় মুমু হাতের ব্যাগ ফেলে ধপ করে বসে পড়লে সেঁজুতির কপালে ভাঁজ পড়ে। দুই বছর হলো মুমুকে দেখছে, কখনো তো এরকম আপসেট দেখেনি। কৌতূহলী চোখে সে প্রশ্ন করবে কোথায় মুমু নিজে থেকেই বলতে আরম্ভ করে।

“পুরুষমানুষগুলা এরকম হয় কেন রে? এত্তো হার্ড হার্টেড, মায়ের পেট থেকে জন্মেই পাষাণ হতে শুরু করে।” শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে মুমুর কখনো আড়ষ্টতার অনুভূতি হয়না। ঝরঝরে সেই বাংলা শুনে সেঁজুতির বুকে ঈর্ষার একটা মৃতু ধাক্কা লাগে। কিন্তু পুরুষমানুষ নিয়ে জম্পেশ তর্ক-বিতর্ক হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এসব সুপ্ত ঈর্ষাকে এখন গর্তে রেখে না দিলে আর কখন দেবে? উত্তেজনায় সেঁজুতির ডান চোখের শিরশিরে ব্যাথাটাও তাই চলে যাবার উপক্রম।

“কি রে কি হইছে? আজকে এতো পুরুষমানুষের উপরে ক্ষেপলি ক্যান, তমাল ভাই তমাল ভাই করে দুই বছর ধরে অজ্ঞান দেখলাম। আজকে হঠাৎ কি হইলো?”

মুমুর চোখের পাতা কাঁপে। কাঁপতেই থাকে অনবরত কিন্তু মুখ থেকে কোন শব্দ সরেনা। এই অবস্থায় সেঁজুতি রসিকতা করে কিভাবে? তাই মুমুর কাঁধ ধরে হালকা চাপ দিতেই মুমুর মুখ নিজেকে খুলতে শুরু করে,

“আজকে অফিস শেষে দেখা করতে বলেছিলো বুঝলি?” সেঁজুতি বুঝেছে কিনা তার ব্যাপারে সম্পূর্ণ অনাগ্রহী হয়েই মুমু ফের বলতে শুরু করে। “জানিনা কেন আজকে তমালের ফোন পেয়েই কেমন যেন দারুণ লাগলো। আমি তো অফিসে বলতে গেলে ছুটির আগে বেরই হইনা। আজকে হলাম। হাতে তেমন কাজও ছিলোনা তাই বের হতে সমস্যা হলোনা। দেখা করলাম সংসদ ভবনের দিকে। আমি তমালকে এতো করে বুঝানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু কে শোনে কার কথা।” ফোঁপানীর মধ্যে কথাগুলির শেষের অংশ সেঁজুতি আধা আধা শোনে। তমাল ভাইকে মুমু কি বোঝাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে সেটা জানতে না চেয়েই সেঁজুতির মুখ বোকা বোকা শোনায়। “এতো চিন্তার কি আছে? তমাল ভাইয়ের সাথে পরে আবার কথা বইলা নে। সমস্যা তো নাই।”

“নাহ, কোন সমস্যা নাই। একটা ফোন দিলেই তোর তমাল ভাই সুড়সুড় করে আমাকে নির্ভার করবে।” মুমুর কন্ঠে হতাশা এবং ব্যাঙ্গের মিশেলে এক অদ্ভুতুড়ে প্রতিক্রিয়া। তার হাতের আঙ্গুলগুলো প্রবলভাবে কাঁপে। মুখমন্ডল জুড়ে ‘সব শেষ হয়ে গেছে’ ধরণের ছাপ ক্রমশ পরিষ্কার হতে শুরু করলে সেঁজুতি নিজের কাছেই নিজেকে ব্যাখ্যা করতে পারেনা। মনে হচ্ছে যে বেশ সিরিয়াস কিছুই। বেশ হয়েছে। দুই বছর ধরে দেখছে। দিনের মধ্যে হাজারবার করে তমাল আর তমাল। এতোবার আল্লাহ-রাসুলের নাম নিলেও তো বছর দশেকের সোয়াব নগদে পেয়ে যেতো। হাহ, সেঁজুতির মনে সহানুভূতির লেশমাত্রও দেখা যায়না। হোস্টেলের অন্যরাও কি কম রসিকতা করেছে মুমুকে নিয়ে? বিথী তো বিশ্রিভাবেই বলতো “তোর তো বাথরুমে গেলেও তমাল ভাইয়ের নাম না নিলে হয়না।” মুখ খারাপ করে কথা বলায় বিথীর কাছে সেঁজুতি তো শিশু। কিন্তু মহারানী মুমু এসবেও কোনকালে দমেনি। ঘাড় গোঁজ করে বলেছে “তোরা যাই বলিস তমালকে আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। ও আর আট-দশটা ছেলের মতো না।” এহ, আর আট-দশটা ছেলের মতো না। এখন তো তার জন্যেই কেঁদে বিছানা ভাসিয়ে দিচ্ছিস হারামজাদী।

মুখে তো এরকম কতো কথাই চলে আসে। কার না আসে? কিন্তু সব কথা এভাবে চাইলেই বলা যায় নাকি? তাও এরকম সময়ে? এদিকে কাঁদতে কাঁদতে ততক্ষণে মুমু বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়লে কথাবার্তা আর এগোয়না। শিউলীর আসবার সময় হয়ে আসলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দোকানে যাবার কথা মনে পড়লে বিলম্ব না করেই সেঁজুতি বের হয়। শিউলীটা শ্যাম্পুর কথা বলছিলো বেশ কয়েকদিন ধরে। আজকে রাতেও যদি না দেখে তাইলে নিশ্চিত বিরক্ত হবে। মুমুকে একলা রেখেই তাই সেঁজুতির বেরুতে হয়।

হোস্টেলের গেট পেরুলে মন্তাজ মিয়ার দোকান তেমন দূরে নয়। বন্ধুবান্ধব নিয়ে বুলবুলের আড্ডাস্থান টঙের দোকানটা বরাবর সরু রাস্তা ধরে দুই একটা নতুন গজিয়ে উঠা ছোট গোছের প্রাইভেট অফিস, একটা হলুদবাড়ি , আর লাইটপোস্ট পেরুলেই কাস্টমার বিশেষ করে তাদের হোস্টেলের মেয়েদের জন্য মন্তাজ মিয়াকে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। মাঝেমাঝে এই চিপা রাস্তায় শুকনা মুখের এক ক্যানভাসারকেও দেখা যায়। আজকে বৃষ্টিবাদলার দিন ছিলো। আজকে সম্ভবত এদিকে আসবেনা। অভ্যাসের মতো করে প্রয়োজনীয় বাজার সেরে আসতে আসতে সেঁজুতির চোখজোড়া ঘোলাটের মতো হয়ে আসে। ডান হাতে বাজারের ব্যাগ, একটু বেসামাল হলেই জিনিসপত্র সব এই প্যাচপ্যাচে কাঁদায় ছিটকে পড়বে। তাকেও তো সাবধানেই পথ চলতে হচ্ছে। কিন্তু সেঁজুতির হাঁটবার গতি আরো শ্লথ হয়ে আসে। শরীরটা আচমকাই বেশ দুর্বল হয়ে পড়লো মনে হয়। গত বছরের মাঝামাঝি মুমুটার ডেঙ্গু জ্বর হলে তমাল ভাই কি যত্নটাই না করেছিলো। হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ হবার পরেও ঘড়ি ধরে ধরে ফোন দিয়ে ওষুধ খাওয়ানোর কথা মনে করিয়ে দেওয়া থেকে শুতে যাওয়া অবধি সম্পূর্ণ টেক কেয়ার করা সবই করেছে। এর মধ্যেই শিউলী হোস্টেলে ফিরে এসেছে। রুবায়েত ভাইয়ের সাথে চুটিয়ে প্রেম করে এসে কতক্ষণ জিরিয়ে নিয়েই আরাম করে গোসলঘরে ঢুকে চুলে শ্যাম্পু করবে আর গুনগুন করে গান গাইবে। মুমুও যতোই রাগারাগি করুক নিশ্চয়ই এর মধ্যে তমাল ভাইয়ের সাথে মিটমাট করে নিয়েছে। আর সে? ঘোলাটে চোখে, অবসন্ন শরীরে নিঃসঙ্গ হাঁটতে হাঁটতে টঙের দোকান বরাবর সেঁজুতি চলে আসলে, কাঁদাপানির মধ্যেই পড়ে থাকা কিছু জারুল ফুলে বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি করা এক রাফ এন্ড টাফ ছেলের মুখ বিনা সংকেতেই ভেসে আসলে তার কি দোষ?


মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ৮:৪৮

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: মোটেও দোষ নাই। একাকি থাকতে কে চায়?

ভাল্লাগল।

২| ২১ শে এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৭

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
প্রবাহমান জীবন ৷

৩| ২১ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১১:১৫

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: অসাধারন লিখেছেন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.