নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অনুভূতি

৩১ শে মে, ২০১৫ রাত ২:১৫

অগণিত পথচারীর অশ্রুত অগণিত অভিব্যক্তির ধ্বনি কানে আসলে সমগ্র শরীর নড়ে উঠে। একবার সমগ্রটাই নড়ে উঠে স্থানু হয়ে আগের মতো নুয়ে থাকে। কয়েকদিন আগে পড়া এক জার্নালের কথা রিফাতের মগজের ভেতর থেকে সামনে চলে আসে। এমনি এমনি তো আর ঢাকা শহরকে বসবাসের অযোগ্য শহর হিসাবে দুই নাম্বারে রাখেনি বিদেশের নামীদামী জার্নালগুলো। মেক্সিকো সিটি আছে এক নাম্বারে। সেটা কিভাবে ঢাকা শহরকে বিট করে এক নাম্বার হয়? দেখো এই শহরের রাস্তাগুলোর দিকে তাকিয়ে। চারপাশে কেবল পঙ্গপালের মতো মানুষ আর মানুষ গিজগিজ করে। প্রেসক্লাবে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষারত রিফাতের ঘাড় অটোমেটিকালীই চারপাশে নিজেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রদর্শন করে। রাস্তার অপরপাশে সারি সারি করে কয়েকটি খাবারের দোকান, তার সামনে দিয়ে ফুটওভার ব্রিজ যেখানে দুই পেয়ে মানুষ তো মানুষ চার পেয়ে কুত্তাও হাগার জন্য উঠেনা। গরম এবং পঁচা তেলে হালকা বৈকালিক নাস্তা ভাজতে ভাজতে কারিগর লুঙ্গির উপর দিয়েই নিজের উরুসন্ধিতে চুলকাচ্ছে। দুই চোখেই পরিষ্কার দেখতে পাওয়া মানুষজন পথ চলতে চলতে অন্ধের মতো একে অন্যের গায়ের উপরে হামলে পড়ে। একজনের শরীর ও মুখের দুর্গন্ধ অপরজনের শরীরে ট্রান্সফার করে বিগলিত গলায় বলে উঠে “সরি।” অনেকে তাও বলেনা। বেশ লম্বা সময়ই হয়ে গেলো অপরকে ধাক্কা দিয়ে দুঃখিত না হওয়াটা এটিকেটের লেটেস্ট ফ্যাশন হয়ে গেছে। আর এই দিকেও দেখো। তার সাথে আরো বারোজন বাসস্টপে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কখন কাঙ্খিত বাস এলে হুড়মুড় করে উঠে একটা সিট বাগাবে। কার কাছে কথাটা শুনেছিলো রিফাতের ঠিক স্মরণে আসেনা কিন্তু শোনার পরে বড্ড মনে ধরে গিয়েছিলো। “বাসের জন্য দাঁড়াবার সময়ে অনেক ভীড় হইলেই ভালো। উঠবার কাজটাও নিজের করতে হয়না। পিছে দাঁড়িয়ে থাকা প্যাসেঞ্জারেরাই করে দেয়। তাদেরটা করে দেয় তাদের পিছে যারা দাঁড়িয়ে থাকে তারা, তাদেরটা করে......

সকালে কার মুখ দেখে যে উঠেছিলো কে জানে, আজকের সমগ্র দিনটাই মাটি। কথাটা মনে পড়লে রিফাতের মেজাজ আরো খিঁচড়ে যায়। রাতেরবেলায় জেরিনের সাথে কথা বলতে বলতে উল্টো দিকে শুয়ে পড়েছিলো। সেই বরাবর শুলে অতঃপর ঘুম থেকে উঠলেই মুখ বরাবর আয়না। যুতসই উপমা নির্ধারণ করবার অবস্থাতেও এই মুহূর্তে সে নেই এই সত্য হজম করা এতো সহজ নাকি? সারাদিনে তার উপর দিয়ে যা গেছে।

কাঙ্খিত মিডওয়ে বাস সারাদিনের ইতিবৃত্তান্ত পুনরায় স্মরণ করবার বিড়ম্বনার মাঝে রিফাতকে অবগাহন করতে না দিলে সারাদিনে আল্লাহ এই প্রথম বুঝি তার দিকে একটু মুখ তুলে তাকিয়েছে ভেবে রিফাতের বুকে অদৃশ্যমান বৃষ্টি জন্মে। পাদানিতে পা জোড়া সহি সালামতে একবার রেখে অতঃপর বাসের বাঁদিকের থেকে তিন নম্বর রোয়ের জানালার পাশের সিটটা পেলে তার বুকে বৃষ্টির পরিমাণ আরেকটু বেড়ে যায়। সব দিন তো আর মানুষের সমান যায়না, আজকে অন্তত বাস ঠিকঠাক তো বসতে পেরেছে। কিন্তু পাশেরজন বসতে বসতে বাসের পুনরায় যাত্রা শুরুর দুলুনীতে প্রায় রিফাতের শরীরের উপরে পড়বার উপক্রম করলে রিফাত সামনে সাপ দেখেছে এমন ভাব করে চমকে উঠে। ভদ্রলোক সরি বলে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলে কি হবে ততমধ্যে রিফাতের মনের গতিপ্রকৃতি আরেকদফা শিফটেড হলো। কি এক কপাল তার!!

অফিসে সকালে এসেই কানাঘুঁষা শুনতে পেয়েছিলো যে প্রত্যাশিত প্রমোশনটা নাকি তার নাও হতে পারে। কবির সাহেবের কাছে এই রিউমারের সম্ভাব্যতার কথা শুনেই বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠেছিলো। এটা কিভাবে হয়? এই প্রমোশনের জন্য মনে মনে কম ছক এঁটে রেখেছিলো সে? কতো প্ল্যান, কতো হোমওয়ার্ক, সাথে আরো এক্সট্রা কতো হিসাবনিকাশ। তার প্রমোশন হবেনা বললেই হলো? কিন্তু এই প্রশ্ন নিজে ছাড়া আর কারো কাছে তো রাখা যায়না। খচ্চর কবির সাহেবের কাছে তো আরো নয়। শালা সামনে যতোই মিষ্টি মিষ্টি কথা শোনাক রিফাতের পিছনে তাকে নিয়ে কি কি নোংরা কথা বলে সে তার খোঁজ রাখেনা নাকি? এমনকি ছয় মাস হলো অফিসে জয়েন করলো সেই জয়িতার সাথে তার প্রফেশনাল কেমিস্ট্রি নিয়েও অন্যান্য কলিগদের কাছে রসালো গসিপ করেনি কবির লোকটা? শালা আস্ত ভন্ড। তা রিফাত তো বসে বসে আঙ্গুল চুষবার মতো নপুংসক নয়। সোনিয়ার সাথে কবিরের ঘষাঘষির কথা সেও কলিগদের কাছে রসিয়ে রসিয়ে বলতে ছাড়েনি। আরেকটু হলে এ কান ও কান হয়ে কবিরের বউয়ের কাছেই পৌঁছে যাচ্ছিলো বিষয়টা। চিন্তা করে মনে উদারতার বাতাস আনতে চেষ্টা করতে করতে রিফাত বাইরের আকাশ দেখে। সূর্যের তেজের সাথে জয়িতার আচরণের সামঞ্জস্য কি পাওয়া যায়না? ফ্লার্ট করার একরত্তি স্পেস তাকে দেয়না খানকি কোথাকার। কে বলবে এই মেয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা?

“স্যার, ভাড়াটা”, হেলপার কর্কশ গলায় ভাড়া চাইলে জয়িতাকেন্দ্রিক হতাশা থেকে নিজের মনকে ডাইভার্ট করে রিফাত বাস্তবে ফেরে। দশ টাকার একটা আধাময়লা নোট পকেট থেকে বের করে পুনরায় আকাশ দেখায় মনোনিবেশ করবে এমন সময়ে স্টপেজে এসে বাস থামে। এক বয়োঃবৃদ্ধকে ডান হাতে পুরনো ধরণের একটা হ্যান্ডব্যাগ, চোখের নড়বড় করা চশমা ঠিক করে লাগাতে লাগাতে বাসে উঠতে দেখা যায়। দেখে মনে হচ্ছে বুড়ো ভালো রকমের জেদী আছে। হেলপার দেখে নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। সেই আহ্বান গ্রহণ না করেই বুড়ো দিব্যি নিজের মতো করে বাসে উঠেও পড়লো, ফাঁকা জায়গা পেয়ে ডাঁটসে বসেও পড়লো।

পৃথিবীর সব বুড়োই এরকম হয় কিনা কে জানে। রিফাত ততক্ষণে পৃথিবীর সমস্ত বুড়োদের নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হলো। তার নিজের বাসাতেই তো এরকম একটা স্যাম্পল আছে। দুই হাজার পনেরো সাল হয়ে গেছে তাকে দেখলে, তার সাথে কথাবার্তা বললে সেটা বোঝে সাধ্য কার? সেই আশির দশকের টিপিকাল মধ্যবিত্ত বাপের জেরক্স কপি। বুড়ো আসলেই ওয়ান পিস কারিগর একটা। নিজের বাপ, এভাবে গালমন্দ করতে আছে? রিফাতের মন নিজেকেই শাসন করবার চেষ্টা করে। কিন্তু পেরে উঠেনা সবসময়ে ওৎ পেতে রাখা জিভটাকে একটু বের করে ঠোঁটের উপর নিচ চেটে নেয়। কিন্তু পিউরিটার্ন বাপটার কথা একবার মনে পড়লে এতো সহজে কি ভোলা সম্ভব? এই যে রিফাতের প্রত্যাশিত প্রমোশনটা আজকে হবেনা হবেনা এমন এক সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে এর পিছনেও লোকতার পরোক্ষ হাত আছে, আলবত আছে। গতো তিন মাসে কমপক্ষে দশদিন রিফাতের অফিসে আসতে লেট হয়েছে। তাদের পাংচুয়াল এবং স্ট্রিক্ট বসের সেটা চোখে পড়েছে নিশ্চয়ই। বেটা নির্ঘাত সেটা মগজে রেখে দিয়েছে। যখন আসল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তখনই মগজের খাপ থেকে বের করে তাকে ব্রহ্মাস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে রিফাতের ন্যায্য পদন্নোতি আটকে দিচ্ছে। হতে পারেনা এমন? অবশ্যই হতে পারে। পুত্রের এইসকল বেদনার খবর লোকটা রাখবে কিভাবে? তাহলে তো রিফাতের হয়েই গিয়েছিলো। আর কতক্ষণ পরে বাড়িতে পৌঁছালেই তো সেই চিরাচরিত দৃশ্য দেখে রিফাতের মেজাজ আরেকটু তিরিক্ষে হবে। চোখে ভালো করে দেখেনা বলে বাড়ির কাজের লোকটা জোরে জোরে খবরের কাগজের শিরোনাম পড়ে বুড়োকে শোনাচ্ছে। আর বুড়ো এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা হয়ে যাচ্ছে এমন ভাব করে আমোদে সব শুনতে থাকবে।

বৃদ্ধ পিতার প্রতি রিফাতের রাগের পারদ ক্রমশ চড়া হতে হতে প্রায় অনিয়ন্ত্রিত এক অবস্থায় এসে উপনীত হয়। পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক বোধহয় তার অস্থিরতা বুঝতে পারে। বিনীত কন্ঠে “আপনি কি অসুস্থ ভাই?” জিজ্ঞেস করলে রিফাত প্লাস্টিক হাসি ছাড়া আর কি প্রতিক্রিয়াই বা দেখাতে পারে? কি যে তার কপাল দেখো, নিজের ভাগ্যের প্রতি সারাদিনে সপ্তমবারের মতো বিষোদগার করতে করতে এবারে পুনরায় রিফাতের জন্মদাতা তার নীরব আক্রোশের শিকার হয়। এই লোকটা আসলেই একটা কালপ্রিট, বাবা হয়েছে তো কি হয়েছে? তাদের দুই ভাই তো বটেই মা যতোদিন বেঁচে ছিলো তাকেও একদন্ড স্বস্তি দেয়নি লোকটা। রিফাতের মনে পড়ে বেঁচে থাকতে থাকতে তাদের মা প্রায়ই রান্নাঘরে রান্না করতে করতে স্বামীর নামে শাপশাপান্ত করতো। আশেপাশে কেউ যেন শুনে না ফেলে এমন গলায় বলতো “আমার জীবনটা জ্বালিয়ে শেষ করলো।” এখন রিফাত মায়ের অসন্তোষের মানে বোঝেনা? ঠিক বোঝে। কাছে যখনই যাও মনে হবে সাক্ষাত স্বর্গ থেকে বুদ্ধ নেমে এসেছে। আহা কি সব ঐশী বাণী, সৎ পথে উপার্জন করো, জীবনে কখনো কোন জায়গাতে শর্টকাট নিয়োনা। মনে রাখবা একবার শর্টকাট নিলেই সেটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাবে ব্লা ব্লা ব্লা। যেন সাক্ষাত দেবদূত। সরকারী অফিসের দুই পয়সার কেরাণী মফিজুর রহমান এই সময়ের দুনিয়াদারীর দেখেছে কি? হাহ, যত্তসব!!!

আজকে পেশাগত দুর্ভোগ যতো যাই হোক তার বাড়ি ফেরত অভিজ্ঞতা অন্যান্য দিনের সাথে তুলনা করলে বেশ ভালোই বলতে হবে। নাইলে মাত্র পঁচিশ মিনিটের মাথায় প্রেসক্লাব থেকে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছানো সম্ভব? রিফাত নিজের ভাগ্যকেই বিশ্বাস করেনা। বাস থেকে নেমে আশেপাশে অন্যদের চোখ এড়িয়ে বাম হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে ডান হাতের কবজিতে চিমটি কাটে। একটু বেশীই জোরে হয়ে গিয়েছিলো। একবার আলতো করে বাম হাতের তর্জনী দিয়ে চিমটির স্থান ডলে নিলো। বাস থেকে নামার পরে অভ্যাসবশত পকেটে হাত দেওয়ার সাথে সাথে পকেটে মোবাইলের নাচ শুরু হতেই “ধুরো শালা, এখন আবার কে ফোন দিলো” ভাবতে ভাবতে রিফাত ফোন বের করে। কলারের নাম দেখে হাঁটতে হাঁটতে জুতা দেখতে ঢুকছে এমন ভাব করে শোরুমে ঢুকে “হ্যালো, স্লামালিকুম স্যার। .........” এভাবে আরো পাঁচ মিনিটে গোটা আষ্টেকবার দোকানের কর্মচারীরা রিফাতকে স্যার শব্দটি উচ্চারণ করতে শোনে।

আকাশটা বেশ তো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে এখন। ধীরে ধীরে জেরিনের প্রতি প্রথম সময়কার ভালোবাসার মতো করে মেঘমালা ভীড় করতে শুরু করেছে আকাশের চারপাশে। গাবতলা মসজিদের কাছে কাঁচাবাজারটায় যা একটু বিশ্রী চেঁচামেঁচি হবে এখন। কিচ্ছু শুনছেনা এমন ভাব করে জায়গাটা পেরুলেই হবে। রিফাত ব্যাগ হাতে সাবধানে কাঁচাবাজার পেরোয়। সামনে এগোলেই কিছু শিউলী ফুলকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলো। রিফাত এই জায়গাটায় সেই কবে থেকে আছে, রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে শিউলী ফুল দেখাটা তার নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাবধানে খুলতে গিয়েও ক্যাঁচ করে বেশ অবসন্ন সুরে দরজাটা আওয়াজ করে উঠে। নিজের অপটু হাতের কাজের জন্য রিফাত নিজেই নিজেকে নিঃশব্দে শাসন করে। বিকাল বাজে পৌঁনে ছয়টা। বুড়ো মানুষটা হয়তো একটু জিরোচ্ছে। সারাটাজীবন মানুষটা কম তো পরিশ্রম করলোনা। তাদের দুই ভাইকে মানুষ করলো। বড় ছেলেটা তো সুযোগ পাওয়া মাত্রই দূরে সটকে পড়লো। কথা বলার ছিলো এক স্ত্রী, সেও বছর পাঁচেক আগে মরে গেলে বুড়োর একা না হয়ে উপায় কি? কাজের লোকের কাছে পত্রিকার শিরোনাম শুনে তো আর একাকীত্ব কাটেনা। সেও বাপকে সময় দিতে পারে কই? নাহ, বাপটাকে কম তো অবহেলা সে করলোনা। আর না। আফটার অল প্রমোশনটা যেহেতু হয়েই গেলো কাজেই পরশুদিন ছুটিতে বুড়োর জন্য দেখেশুনে ভালো কিছু কাপড়চোপড় কেনা, ছোট ছেলে হিসাবে খুব বেশী কিছু তো নয়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.