নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিষাদেরা ফিরে আসে

১৮ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ৮:১৩

পৌষের অন্তিমে এক রৌদ্রছায়াময় দিনের বিকালে উত্তর দিক থেকে অপ্রিয় আগন্তুকের মতো করে একটা জোরালো বাতাস আসছে। সেটা ঠিক সূঁচের মতো গায়ে বিঁধছেনা। অথচ এই শীতে এমনটা বেশ ব্যতিক্রম। খুব তীক্ষ্ণভাবে কেউ বাতাসের ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করলে অনুভব করবে তার আষ্ঠেপৃষ্ঠে একটা আততায়ী গন্ধ জড়িয়ে আছে। পুকুরঘাটের পশ্চীম দিকের যেই নোংরা জায়গাটায় কিছু ঝোপঝাড় জন্মেছে সেখানে নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা কোন অজানা কারণে সতর্ক চোখে দুইটা বেজি চোখের নিমেষে নিজেদের পথ পরিবর্তন করে।

ঝোপঝাড়ের মধ্যেই একটি কালো ব্যাগ কে কবে রেখে গেছে তার দিন তারিখ জানা যায়না। অপ্রাসঙ্গিক কিনা সেটাও আন্দাজ করা যাচ্ছেনা। তবে কথিত আছে গত দশদিন যাবত ব্যাগটির দিকে অনেকেরই চোখ পড়লেও অজ্ঞাত কারণে তার ধারেকাছে কেউ যায়নি। আপাদমস্তক রহস্যাবৃত হয়ে সেই ব্যাগ দশদিনের ধূলার সাথে সহোদরের মতো বাস করছে। কে জানে কোন মনুষ্যপ্রাণী কি উদ্দেশ্যে ব্যাগটি এই জায়গাতেই রেখে চলে গিয়েছে। তার কৌণিক দূরত্বে কিছু পোকায় খাওয়া ধানের শীষকে অসহায়, রুগ্ন শরীরের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। আশ্চর্য ব্যাপার আসলে। চারপাশের কোথাও ধানক্ষেতের ধ পর্যন্ত নেই। সাতাত্তর বছরের পুরনো পুকুরপাড়টার গন্ডি থেকে বেরোলেই মাস দেড়েক আগে ঢালাই করে নেওয়া পিচের লম্বা রাস্তা। সেই রাস্তা বরাবর সোজা টাউন। টাউনে আজকাল কতো কিছু এসেছে। হালকা স্ন্যাকস থেকে শুরু করে আধুনিক নগরের লেটেস্ট ব্র্যান্ডের চিপস পর্যন্ত। পত্রিকায় , টিভিতে দেখায় আজকাল টাউনগুলোও আধুনিক হতে শুরু করেছে। কিন্তু শত সহস্র বছরের যেই করুণ ইতিহাস, চাপা পড়ে থাকা স্তব্ধ জীবনপ্রবাহ, নরম সবুজ ঘাসের আড়ালে আবৃত থাকা হিংসা-দ্বেষের ইতিবৃত্ত, পরশ্রীকাতরতার অস্তিত্বকে স্বযত্নে গোপন রেখে শহুরে মানুষের কাছে ঝাপসা আবেগের পাত্র হয়ে থাকা এই মফস্বল কি শুধু খোলসেই পাল্টেছে? তার অভ্যন্তরে টিম টিম করে জ্বলতে থাকা যেই প্রাগৈতিহাসিক ধাঁচের নিস্তরঙ্গ বয়ে চলা জীবনবায়ু তার ভিতটা কি নিজের আসন্ন ধ্বংসের কথা অনুভব করতে পারে? হালকা ছিপছিপে গড়নের, তীক্ষ্ণ চোখ আর সমাজের সংজ্ঞানুযায়ী অসুন্দরী বলে বিবেচিত মেয়েটি মফস্বলে আছে তিনদিন হলো। নিজেকেই প্রশ্নগুলো করে সে নিজেকেই তার উত্তর শোনায়। না। তার জীবনের প্রায় সিংহভাগই কেটেছে নগরে। একঘেঁয়ে অভ্যস্ততা এবং আজীবন নিজেকে আড়াল রেখে চলা যেখানকার প্রাচীনতম দুইটি অসুখ। আপাত নিস্তরঙ্গ এই মফস্বলী জীবনের গতিপথকে মোটেও তার তীব্র জটিলতার আবর্ত থেকে মুক্ত বলে মনে হয়নি। পরশুদিন প্রথম যখন এই মফস্বলের ধূলিকাঁদা আর পথের সাথে তার প্রথম পরিচয় ঘটেছিলো লক্ষ্য করেছিলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যার চোঁখের ফ্রেমেই সে ধরা পড়ছিলো প্রত্যেকের দৃষ্টিতেই তার প্রতি অকারণ সন্দেহ। সে যে এই স্থানের প্রেক্ষিতে, তাদের জীবনগাঁথার প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণই বহিরাগত এই বার্তাটুকু সম্পূর্ণই অচেনা সেই মানুষেরা তাকে পৌঁছে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি। তারা তো অপরিচিত। সম্পর্কের নামানুসারে যেই মানুষগুলো মেয়েটির আত্মীয় বলে অন্তত অনস্বীকার্য রক্ত আর অনড় অচল স্থবির সমাজের কাছে স্বীকৃত তাদের কাছেও তার নিজস্ব ব্যঞ্জনার কনামাত্র ব্যক্ত হয়নি। তারাই চায়নি তেমনটা হোক। ছুটিছাটা পেলেই যেভাবে গ্রামে কি শৈশবে তাদের বেড়ে উঠবার মফস্বলে যাবার জন্য শহরের মানুষদের প্রাণ আকুলিবিকুলি করে তার মাঝে নিজেদের শৈশব স্থানের সাথে অনতিক্রম্য দূরত্বটাই সম্ভবত স্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত হয়। মেয়েটি আগে কখনো এভাবে ভাবেনি। আর আট দশজন মানুষের মতোই ভেবেছিলো গ্রাম কি মফস্বল যেন শহুরে জীবনের ক্লান্তিতে নিঃস্ব অনুভব করা তাদের প্রত্যেকের জন্য প্রকৃতিপ্রদত্ত শ্যামলছায়ার আঁধার। কিন্তু গতো তিনদিনে এই ভাবনাগুলোকে তার কাছে তীব্র অগভীর বলে প্রতিভাত হচ্ছে। গ্রাম কিংবা মফস্বল সম্পর্কে এখনো তাদের মতো শহরের জীবনে অভ্যস্ত নাগরিকরা যেই কল্পনায় ভোগে তার সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক ততোটাই ক্ষীণ যতোটা ক্ষীণ সম্পর্ক তার সাথে এখানে অবস্থানকারী তার পরিজনদের।

পুকুরঘাটের দক্ষিণ দিক বরাবর কিছু মাচা দুর্বলভাবে এখনো ঝুলছে। প্রায় বছর দেড়েক আগে সেগুলো বাঁধা হয়েছিলো। এখন সেই দিকে আগতরা কেউ ফিরেও চায়না। বয়োঃবৃদ্ধ মাচাগুলোর উপরে যেই দোল খাওয়া ঝাউগাছ দেখা যায় তাকে দেখায় চূর্ণবিচূর্ণ মন নিয়ে সান্ত্বনা খুঁজতে থাকা অভিভাবকের মতো।

পুকুরঘাটের অতীতের জেল্লাময় চেহারার অবশিষ্টাংশ দেখলে মনে হবে এর থেকে বুঝি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেলেই সেটা চোখসওয়া হতো। মানুষজনের বসবার জায়গায় একটা হলুদ প্রজাপতি কোত্থেকে এসে পুকুরপাড়টায় যেন আলোর সঞ্চার করতে এলো। স্থানটায় আবছা নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য একটু একটু করে যেন প্রবেশ করছে। ঠান্ডা বাতাসটা এতোক্ষণ গায়ে স্পর্শ করছিলোনা কিন্তু এখন গায়ে মৃদুমন্দ কাঁপুনি দিতে শুরু করেছে।

এদিকে হলুদ প্রজাপতিটা উপস্থিত পাঁচ ফুট সাড়ে চার ইঞ্চি, হালকা ছিপছিপে গড়নের তীক্ষ্ণ চোঁখের অধিকারিনী মেয়েটির বিষণ্ণতা কাটাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যায় নিজের অজান্তেই। কিন্তু পারেনা। মেয়েটি সাথে করে আনা বিশাল বড় লাগেজটি নিজের পায়ের কাছে এনে নামিয়ে রাখলো। আতিপাতি করে কি যেন খুঁজলো ।

বেশ পিছনে অজস্র জিনিসের ভীড়ে লুকিয়ে থাকা ছবিটি খুলে যখন বের করতে পারলো ঠিক সেই সময়ে পুকুরপাড়ের বাইরের রাস্তায় প্রবল হইহুল্লোড়ে কানে শক্ত তালা লেগে যায় এমন অবস্থা। প্রায় জীর্ণ হয়ে যাওয়া ছবিটি বের করে তাতে হেমন্তের আকাশের চাইতেও উজ্জ্বল হয়ে থাকা এক বৃদ্ধাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে দেখতে এতোক্ষণ ধরে পুকুরঘাটে বসে থাকা মেয়েটি কাঁদতে আরম্ভ করলো। হলুদ প্রজাপতিটি এই আকস্মিক কান্নায় যেন স্বীয় ঘূর্ণি বন্ধ করে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো তার দিকে। মনুষ্যপ্রাণীর ভেতরে-বাইরে অনন্তকালের মতো প্রবাহিত হতে থাকা বিচিত্র সব অনুভূতির দ্যোতনার সাথে প্রজাপতির পরিচয় ঘটবে কিভাবে? স্বামী পরিত্যক্তা মৃত জননীর আজন্ম বসবাসস্থানের কাছে বসে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে কাঁদতে থাকা মেয়েটির দিকে হলুদ প্রজাপতি তাই চেয়ে থাকে বিহ্বল। পৌষের আসন্ন একটি সন্ধ্যায় উত্তর দিক হতে আসতে থাকা বাতাস ক্রমশ শীতলতর হতে থাকে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.