নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রজাপতি

২৬ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১:১১

তারা সোজা পথ ধরে হাঁটবে বলে মনঃস্থির করলো। প্রায় আধাঘন্টা হলো এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে অলিগলি হেঁটে তারা সরল পথে নিজেদের গন্তব্য দেখতে চাইছিলো। সেই কারণে তিনজন উৎসাহী রিকশাওয়ালাকে তারা না করে দিয়েছে।

প্রায় আঠারো মিনিটের নিস্তব্ধতা শেষে প্রথমে শফিই মুখ খুলে। হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে শিহাব, সোহেলকে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে “ওই আজকের সকালের পেপার দেখছিলি?”

“না দেখিনাই। খুনখারাবি, ধর্ষণ আর নেতামন্ত্রীগো চাপাবাজি ছাড়া পেপারে কিছু তো থাকেনা। ক্যান, সানী লিওনের লগে তোর বিয়ার খবর ছাপাইছে?” সোহেলের সদাকৌতুকপ্রবণ মন পুনরায় সক্রিয় হয়।

“এতো ভ্যানতারা করোস ক্যান, পেপারে কি আছে ক জলদি।” শিহাব এতো রঙ্গরসিকতার ধার না ধেরেই শফিকে প্রায় আদেশ করলো।

বন্ধুবান্ধবের রঙ্গরসিকতা, ধমকের সুরে মৃদু কিছুই শফিকে স্পর্শ করেনা। সে নিরাসক্তভাবে বলে যায় “আরে গাইবান্ধায় এক মহিলারে পরকীয়ার লাইগা গাছের লগে বাইন্ধা ন্যাংটা কইরা পিটাইছে পাবলিকে। এমন খবর কোনকালে পাইনাই।”

নগ্ন করে পেটানো সেই মহিলার সম্পর্কে আর বেশীদূর তারা যেতে পারেনা। হাঁটতে হাঁটতে তারা রাস্তার যেই বরাবর এসেছে সেখানে পরপর চারটি ভাজাপোড়ার দোকান নিজেদের অস্তিত্বটুকু নিয়ে স্বগর্বে কাস্টমার বাগানোর তালে তাদের বসবার আমন্ত্রণ জানাতে থাকে। নিরন্তর। সেই আমন্ত্রণের মধ্যে আন্তরিকতার সুর স্পষ্টতই এবং সঙ্গত কারণেই অনুপস্থিত। যা কিছু প্রাবল্য আছে তা হলো এই পড়ন্ত বিকালে কিছু কাস্টমার বাগানোর আকুলতার। অনেকক্ষণ হলো তারা তিনবন্ধু নিস্তব্ধ, স্তিমিত, আলস্যে পরিপূর্ণ বিকালে ঘুরতে বেরিয়েছে। হালকা বৈকালিক নাস্তায় তাদের কারোরই কোনকালে অরুচি ছিলোনা। বরং যে কোন বিকালে বাইরে বেরুলে কড়া লিকারের দুধ চায়ের সাথে সিঙ্গারা কি সমুচাকে তাদের পাকস্থলী বরাবরই অভিবাদন জানিয়ে এসেছে। কাজেই তারা চারটি দোকান দেখে নিয়ে যেখানে ভিড় অন্যান্য দোকানগুলোর সাথে তুলনায় কম আছে সেই দোকানটায় গিয়ে বসলো।

চা, সিঙ্গারার অর্ডার দেওয়ার পরে তারা ধাতস্থ হবার পরে শিহাব পুনরায় বিষয়টি তুলে আনে। “গাইবান্ধার মহিলার কথা কি জানি কইতেছিলি?”

“না কি আর কমু। কইলাম যে কোন মহিলারে ন্যাংটা কইরা পিডাইয়া মাইরা ফালাইছে এমন খবর আগে পত্রিকায় দেখিনাই।” শফি গলায় বিস্ময় তুলে আনার প্রাণপণ চেষ্টা করে। সম্ভবত বিস্মিত ভঙ্গির ওভারডোজ হয়ে গিয়েছিলো তাই সেই অভিব্যক্তি চেহারায় তেমন সবল হতে পারলোনা।

“বেডির সেই অবস্থার ছবি ছাপাইছে কিনা সেইডা ক। তাইলে বাড়িত গিয়া লগে লগে পেপার নিয়া বসুম।” সোহেল সুযোগ পাওয়া মাত্রই পুনরায় কৌতুকপ্রবণ হলে এবারে তারা তিনবন্ধুই চারপাশের প্রত্যেককে সচকিত করে সজোরে হেসে উঠে।

ততোমধ্যে গরম গরম চায়ের সাথে সিঙ্গারা, সমুচা চলে এসেছে। আরাম করে খেতে খেতে তারা নিমেষেই প্রসঙ্গ বদলে ফেলে। এবারে তাদের বিষয়বস্তু অনেকটাই বৈষয়িক। দৃষ্টিভঙ্গীও সচেতন।

“ওই, ইসলাম চাচার বইয়ের দোকান কেমন চলতেছে রে? দুই মাস হইয়া গেলো দোকান দিছে। খবরটবর তো কিছু নিতে পারলাম না।” শিহাবের বাক্যমালার পরতে পরতে নিজের প্রতি বিরক্তি ঝরে ঝরে পড়ে।

“আমি গেছিলাম দশ কি বারোদিন আগে হইবো। ইসলাম চাচারে চিনি তো বহুদিন হইয়া গেলো। বুড়ায় এই ব্যবসায় নতুন হইলে কি হইবো ঠিকই জমাইয়া ফালাইছে। আমি দোকানে যাওনের পরে খাতির কইরা বসাইলো।” শফি বলার পরে কি ভেবে একটু থামতেই সোহেলের খোঁচা “হ, বুঝছি ইসলাম চাচায় তোমার লগে তার মাইয়া তানিয়ার বিয়া দেওনের খোয়াব দেখে। এইবারে শ্বশুরআব্বার ব্যবসার কথা কও।”

এই কটাক্ষের প্রত্যুত্তরে চাইলেই কি সাথে সাথে কিছু বলা যায়? একে তো বন্ধুমানুষের সুতীক্ষ্ণ খোঁচা তার উপরে তানিয়ার মুখ চোঁখের সামনে ভেসে আসলে কি বলা উচিত শফি তার কোন কূলকিনারা খুঁজে পায়না। এই মেয়ে জীবনের নাগালে চলে আসা মানে একমাত্র এই মানবজীবনটাই আজীবন সুরক্ষিত। তানিয়ার অবয়ব যতো বেশী না মনে রেখাপাত করে তার চাইতে বইয়ের দোকানের ব্যবসাটা সে তরতর করে বাড়িয়ে তুলছে এই স্বপ্নই শফির সমগ্র আন্দোলিত করে। কিন্তু এই কথা কারো কাছে প্রকাশ করা যায়না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথেও না। তাই শফিকে অর্ধেক কথাই বলতে হয়, “আরে রঙ্গতামাশা রাখ। ইসলাম চাচায় যেমনে ব্যবসা বাড়াইতেছে দেইখা আমি টাস্কি। আরে মায়রে বাপ কি বুদ্ধি হালার। কলকাতার লেখক গো বই বাজারে ভালো চলতাছে। ধর ঐ সুনীল আর নিমাই কি জানি নাম আছে না? এগো নাম তো শুনছোসই। কোত্থেইকা কোত্থেইকা কি কি বইপত্তর আছে অল্প দামে ছাপাইয়া সুনীল আর নিমাইয়ের নাম উপরে লিখা দিয়া বিক্রি করে। মানুষের আর অতোশত বুঝে কই? গাঁটের ট্যাকা খরচ কইরা সেই বই কেনে। এই কইরা কইরাই ইসলাম চাচায় দুই মাসের মধ্যে বইয়ের ব্যবসা জমাইয়া ফালাইছে। চিন্তা করবার পারোস?”

তারা তিন বন্ধুই অতঃপর কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে যায়। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবার এতো এতো অভিনব সব কায়দাকানুনের কিছুই বর্তমানে তাদের নাগালের মধ্যে নেই ভেবে তারা ব্যথিত হয়। এই তীব্র বেদনার উৎস যেই জটিল আবর্তের গর্ভে সঞ্চারিত তার বেড়াজাল নিয়ে তারা তিন বন্ধু নিজেদের মতো করে একটু ভাবার ফুরসত পেলোনা। তাদেরসহ হোটেলওয়ালাদের সচকিত করে দিয়ে আশেপাশের কোত্থেকে যেন তীব্র হইহুল্লোড়ের শব্দ তাদের কানে আসলে তাদের কেউই আর নির্লিপ্ত বসে থাকতে পারেনা। সম্বিত ফিরে পেতেই তারা লক্ষ্য করে হোটেলের ক্যাশে বসে থাকা ম্যানেজার থেকে শুরু করে পনেরো কি ষোল বছর বয়সী কিশোর ওয়েটার পর্যন্ত গামছা কাঁধে রেখেই ঘটনাস্থলের দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে। সেখানে চোঁখ রাখলে দেখা যায় ঘটনা খুব অভিনব কিছু নয়। রাস্তার অপরপার্শ্বে যেই ফুটপাথ সেখানে লাইন করে করে হকারেরা নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে বসেছে। সেই ভীড়ের সুযোগেই কার যেন পকেটমারী হয়েছে। কিন্তু পকেটমার আনাড়ি ছিলো বলে সাফল্যের সাথে সাফাই করার কাজটি করতে পারেনি। তারা তিনজন যতক্ষণে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে তার আগেই মারমুখী ‘বীর’ জনতা ততোমধ্যে পকেটমারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার থেকে শুরু করে গোটা পাঁচেকবার পকেটমারের মায়ের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হবার বাসনা, পকেটমারের পশ্চাৎদেশে নানাবিধ যন্ত্রপাতি প্রবিষ্ট করাবার অভিলাষ উদাত্ত কন্ঠে ব্যক্ত করেছে। মার খেয়ে ডান চোঁখের নিচে কালশিটে পড়ে যাওয়া, হাঁটুর নিচে রক্ত জমে যাওয়া, বাম হাতের কব্জির একটু নিচেই কালো হয়ে যাওয়া পকেটমার সেই সময়ে পৃথিবীর রঙ-রুপ, রস শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে এমন কোন ঘোরের জালে নিজেকে সমর্পণ করেছে। তারা তিনবন্ধু দেখতে পেলো আশেপাশের জনতা একটু যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এরকম পড়িমড়ি করে ছুটে এসে যদি দেখে পরিস্থিতি স্তিমিত হয়ে পড়েছে তাহলে কিভাবে কি? অতএব তারা তিনজনেই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে এবারে নিজেরাই পকেটমারকে শায়েস্তা করতে উৎসাহী হয়।

তাদের তিনজনের মধ্যে সোহেলই প্রথম দ্রুত পদক্ষেপে পকেটমারের দিকে এগুতে থাকে। কিছু পেছনে পড়ে থাকায় শিহাব এবং শফি দেখতে পায় এগুতে থাকা সোহেলের নাক বরাবর একটি কালো প্রজাপতি উপস্থিত সকলকে অতিক্রম করে স্থানত্যাগ করে।

হতবিহ্বল পকেটমারের প্রতি অক্ষম মমতা নাকি জনতার প্রতি তীব্র ঘৃণা বুকে নিয়ে সেই প্রজাপতি তৎক্ষণাৎ স্থানত্যাগ করেছিলো সেই গল্প কারো জানা হয়ে উঠেনা ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.