নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শিরোনামহীন

৩০ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ২:০০

দুপুর বেজে হয়েছে সাড়ে তিনটার মতো। কিছুক্ষণ পরেই সময়ানুযায়ী বিকাল শুরু হবে। কিন্তু সূর্যের প্রখর তেজ, চারপাশের নাগরিক ব্যস্ততা, অগণিত অপরিচিতদের সাথে প্রাণপণ প্রতিযোগিতা করে কোন বাহনে উঠে একটু শরীর এলিয়ে দিয়ে স্বস্তি অনুভব করা এসবের কিছুই বদলাবেনা। বাস্তবতার এতোসব প্রাত্যহিক রুপ প্রতিদিন জনজীবনে আসে, অনাহূতের বেশে। তবু সে অনিবার্য। অবিচ্ছেদ্য।

কাকরাইলে প্রায় বিশ মিনিটের মতো অপেক্ষা করবার পরেই সাথে থাকা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বাস পেয়ে প্রায় পঁচিশজনের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে যখন শিরিন বাসে উঠতে পারলো তারপরে আর কোনভাবেই নিজেকে সুস্থ-স্বাভাবিক রাখা যায়না। প্রতিদিনই এই বাস্তবতা তার মতো অগণিতজনের দিকে ধেয়ে আসে। সমগ্র চেতনা যতোই বিষিয়ে উঠুক না কেন এই জড়, নিশ্চল অনিবার্যতা থেকে মুক্তি কোথায়? বাসে উঠেও যদি এতোটুকু স্বস্তি মেলে। কোন ফাঁকা সিট পেয়ে বসা দূরের কথা দাঁড়িয়েও যে যাবে তার জন্যেও পা মেলে দাঁড়িয়ে থাকাটাও দায় হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিটি ফাঁকা স্থানেই প্যাসেঞ্জার উঠানোর অনাবশ্যক বদান্যতার জন্য ঠিকভাবে দাঁড়াবার জায়গাটুকুও অবশিষ্ট নেই। এক হাতে নিজের হ্যান্ডব্যাগ, অপর হাতে ক্লাস ওয়ানে পড়া পুত্র বৃত্তের বইখাতায় পরিপূর্ণ ব্যাগ সামলাতে সামলাতে শিরিনের মুখ বরাবর রক্ত জমে। কপাল থেকে শুরু করে মুখের সর্বত্র ঘামে ভিজে উঠতে উঠতে ছেলের প্রতি অকারণ বিরক্তিতেই সে খেঁকিয়ে উঠে “এই, একদম বিরক্ত করবানা। পিছনে যাও, সেখানে গিয়ে দাঁড়াও।”

টানা কয়েকদিনের অঝোর বৃষ্টির পরে আজকে সূর্য নিজের চিরাচরিত ফর্মে ফিরেছে। তার প্রখরতার কাছে বাসে বসে থাকা কি দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেক যাত্রীই বিপর্যস্ত। বাস ততোমধ্যে কাকরাইল থেকে নয়াপল্টনের দিকে পৌঁছালে মাইকের তীব্র আওয়াজে তারা আরো বেশী অধৈর্য হয়ে উঠে।

“ওই হালা বাসড্রাইভার, বারবার বাস থামাস ক্যান? চালা শিগগির।”

“ওই হেলপার মাদারচোত, ড্রাইভাররে ক জলদি বাস চালাইতে। হাউয়ার পোলা বাস চালায় না গরুর গাড়ি?”

“শুয়োরের বাচ্চা সব। কান বরাবর বয়রা দুই তিনটা না খাইলে কথা কানে যাইবোনা।” অতি উৎসাহী দুইজন ড্রাইভার বরাবর এগিয়ে যেতে গিয়েও বসে পড়তে বাধ্য হয়। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে ড্রাইভারকে বন চটকনা দেওয়ার পরিণামে নিজেদের মূল্যবান সিট হারিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হবার বোকামী করে কি হবে?

শিরিনের সমগ্র দপদপ করে উঠে। ছেলেকে নিয়ে বাসায় গিয়েও একটু যদি শান্তি মেলে। জুরাইনের স্যাঁতস্যাঁতে আধাময়লা সেই বাড়িতে পৌঁছালেই তো ঘড়ি ধরে পঁচাশি বছর বয়সের রোগাক্রান্ত শ্বাশুড়ীকে ওষুধ খাওয়াও, কলেজে পড়া দেবরের এটা ওটা কি লাগবে তদারকি করো, বিকালের নাস্তা বানাও। তারপরে একটু চোঁখ বুঁজে আসলে বিছানায় শোবে ভাবতে ভাবতেই বৃত্তের বাপ হাঁক ডাকিয়ে অফিস থেকে বাসায় আসবে। অফিস তো নয় যেন সাম্রাজ্য সামলে তবেই বাড়ি ফেরে। বাসায় ঢুকেই দুদন্ড কোথায় বসে জামাকাপড় বদলাতে বদলাতে নিজে একটু জিরোবে কি, তাকে তটস্থ করে আধমরা করে রেখে দেয়।

কোনভাবে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ছেলে আবারো তার দিকেই ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছে দেখলে পুত্রের মুখে স্বামীর অবয়ব বসা কল্পনা করে শিরিন এবারে চোঁখ পাকিয়ে ছেলেকে ধমকায়, “তোমারে বলছিনা বিরক্ত করবানা? যাও পিছে গিয়া দাঁড়াও, ফাজিল ছেলে।”

কিন্তু ছেলে শুনলে তো? তার কিছু স্কুলবন্ধুও নিজেদের মায়ের সাথে এই বাসেই উঠেছে। তাদের নাগালে গিয়ে কাউকে চিমটি কেটে আসবে সেই সুযোগও বৃত্ত পাচ্ছে কই? আজকে স্কুলে যাওয়ার পরে তার সাথে কেউ খেলেনি। স্কুল ছুটি হলে মাকে দাঁড়িয়ে সবে ঘটনাটা একটু কি বলেছে তারপরেই বাসে উঠবার জন্য হুড়াহুড়ি করে উঠতে হলো। তার বন্ধুগুলোর মধ্যে সাবিতটাই সবচেয়ে বেশী বদ। তাকে চিমটির পরিবর্তে ঘাড়ের পিছনে একটা কি দুইটা বসিয়ে দেওয়ার প্রাণপণ ইচ্ছাটা বৃত্তের দমন করে রাখতে হয়। তাদের থেকে অনেক সামনে ফাঁকা সিট পেয়েই মাকে সাথে নিয়ে বসে গেছে। বৃত্ত সামনে এগিয়ে গিয়ে যে ঘাড়ের পিছনে একটা কনুই মারবে সেই সুযোগও নেই। আর সেটা দিলেও আরেক বিপদ। সাথে সাথেই কাঁদতে কাঁদতে তার মাকে দিবে নালিশ। সেই নালিশ শুনে বৃত্ত নিজের মায়ের কাছে খাবে মার।

দাঁড়াবার জায়গাটার পেছনেই দুই থেকে তিনজনের মতো নেমে যেতে চাইলে ছেলেকে নিয়ে সিটে বসবার সুযোগটা শিরিন হাতছাড়া করেনা। সিটের পাশে লাগোয়া জানালাটিও কি কারণে যেন নেই। সূর্যের প্রখরতা তাদেরকে তাই বাসের ভেতরেও ছেড়ে যায়না। পুত্রকে নিয়ে একটু বসতে বসতেই পুত্রের বন্ধুর মার প্রশ্নবাণ শুরু হয়ে যায়।

“কি গরম দেখছেন ভাবি?”

“বাসড্রাইভার দেখি সব জায়গাতেই প্যাসেঞ্জার উঠাইতেছে ভাবি। এইটা কি কথা? কতক্ষণে বাসায় পৌঁছাবো আল্লাহই জানে।”

নিজেকে ধাতস্থ করাটাই এতো মুশকিলের হয়ে উঠেছে। তার পরেও প্রশ্নগুলোর সন্তোষজনক সব উত্তর দিলো। কিন্তু বেটির এইসব কি ন্যাকা প্রশ্ন। যেন ঢাকা শহর না এতোদিন নিউইয়র্কে ছিলো। বয়স বাইশ কি তেইশ হয়নাই, পোলাপান পয়দা করে বসে আছিস তিনটা। প্রশ্ন শুনলে মনে হয় গাঁওগেরামের কিশোরী প্রথম আসছে ঢাকা শহরে। খান... গালিটা সম্পূর্ণ না করে বরং নিজের পুত্রের দিকে মনোযোগ দিলে ভালো। ইশ, রোদে মুখটা কি রকম লাল হয়ে একাকার অবস্থা। আবার শিরিন যে নিজে জানালার ধারের সিটে গিয়ে বসবে সেই উপায়ও নেই। তাইলে ভেতরের গরমে ছেলে আরো বেশী হাঁসফাঁস করবে। তাদের সিট বেয়ে বেয়ে সূর্যের সমগ্র ত্যাড়া আলো সরাসরি পড়ছে। চারপাশের যাত্রীদের থেকে চোঁখ পাশে নিতেই বৃত্তের সমগ্র মুখ বরাবর অভিমানের স্পষ্ট ছাপ দেখলে শিরিনের মাতৃমূর্তি কৌতূহলী হয়।

“কি হইলো, এরকম মুখ করে আছো ক্যান?”

“কথা বলতেছোনা দেখি। মন খারাপ হইছে? কেন?”

এতো এতো প্রশ্ন, এখন মাকে সব কথা বলাই যায়। এতোক্ষণ বাইরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মাকে স্কুলে সারাদিনের ঘটনাবলি জানাতে বৃত্ত উন্মুখ হয়ে উঠে।

“মা, আজকে স্কুলে আমার সাথে বন্ধুরা কেউ খেলেনাই। তুমি তাও সাবিতের সাথে কথা বললা কেন?”

পুত্র পুনরায় অভিমানে জর্জরিত হলে শিরিনের সমগ্র কেঁপে উঠে। প্রাত্যহিক ক্লান্তি, নিত্যনৈমিত্তিক স্বপ্নভঙ্গের অশ্রুত বেদনা, দৈনন্দিন গতানুগতিক জীবনের অদৃশ্যমান নানাবিধ পরাজয়ের ভিড়ে জীবনের যাপন কাকে বলে প্রায় ভুলেই গেছে। এতো এতো সব গ্লানি, যার সবটুকুই সে একাকীই বহন করে চলে প্রতিনিয়ত এসবের ভিড়ে এমন অপার্থিব মুহূর্ত কিভাবে জাদুর মতো কাছে চলে আসে? তাকে বিহ্বল করে নতুন করে বাতাসকে অনুভব করতে শেখায়। আকাশের নীল রঙের নানা অর্থ জানিয়ে দিয়ে যায়। অসহনীয় গরমের মাঝেও শিরিন যতোটা সম্ভব পুত্রের ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে। কৌণিক দূরত্বে এবারে সূর্যের আলো তার সমগ্র মুখের উপরে পড়তে থাকলে শিরিনের সমগ্র মুখ লাল হয়ে আসে। তবু সূর্যের আলোকেই শিরিনের নতুন করে জাগ্রত হওয়া প্রাণশক্তির কাছে ম্লান হয়।

তখন নাগরিক ক্লান্তি, গ্রীষ্মের উত্তপ্ততা, মানুষের অন্তর্গত অস্থিরতা মা এবং পুত্রের কাছ থেকে রিক্ত মুখে ফিরে যায়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.