নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সময় আমাকে ক্ষমা করো

০৫ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ১:৩৫

উত্তাল বাতাসটা পেরিয়ে চারপাশ থমথমে হয়ে গেছে। সন্ধ্যা থেকেই কি চমৎকার বাতাস দিচ্ছিলো। শরীর-মন সম্পূর্ণই ফুরফুরে হয়ে উঠেছিলো। এখন আবার সেই আগের মতো। সবসময়েই যেমনটা দেখে এসেছে। আগে তীব্র যন্ত্রণা হতো ভেতরে ভেতরে। এখন সেটাও অনেক কমে এসেছে। মনে হয় সমগ্র বোধশক্তিই ভোঁতা হয়ে গেছে। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফেরার পরে আগে কি ক্ষিধা পেতো। সেই ক্ষিধাও মরে গেছে। হৃদয়ে লালন করে যাওয়া সমস্ত স্বপ্নগুলোর মতো।

ঘরে বাতি জ্বলছে নিভু নিভু। ডিমলাইট। কৈশোরে থাকতে এই মৃদু আলোকে কি যে ভালোবাসতো!! তারপরে কি হলো কিভাবে হলো বলতে পারেনা গাঢ় হতাশা অনুভব না করলে ঘরে সেই বাতি জ্বালাতোনা। অনেকদিন পর আজকে তীব্র হতাশা অনুভব করছে। রেফায়ার সাথে যদি রাস্তায় আচমকা দেখা না হয়ে যেতো!!

একসময় কি তীব্র আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করতো। বিকালবেলা ক্লাব থেকে বেরুবার পরেই ঘন্টা দুয়েক সেই গোল মুখের দেখা না পেলে সমস্ত দিনটাই মাটি হয়ে গেছে বলে মনে হতো। মানুষ কি স্বপ্ন দেখতে দেখতেই একাধিক দুর্ঘটনার চিত্র এঁকে ফেলে? উত্তরটা তখন পেয়ে গেলেও বেশ ভালো হতো। তারই সাথে যুগপৎ স্বপ্নের চারা বুনতে বুনতে কোন অবিশ্বাস্য ঘুর্ণিপাকে তারই ক্লাবের প্রেসিডেন্টের অপদার্থ ছেলেটার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে রেফায়া নিজের ভবিষ্যত দেখে নিয়েছিলো? “কি হইছে আমারে স্পষ্ট খুইলা বলো।”, “তোমারে আর কি বলতে হবে? আমি তো বললামই যে তোমার সাথে আমার পোষাইতেছেনা।” শফিকের বুকে অবমাননার সুর নতুন করে গুনগুন করে। সেদিনকার বাতাসটাও এখনকার মতোই প্রাণহীন ছিলোনা? এতো আন্তরিকভাবে সে কখনো কারো সাথে কথা বলেছে কিনা কখনো বলতে পারেনা।

কোলবালিশটাকে নিজের সাথে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। চারপাশ এতোটাই নিস্তব্ধ যে দরজার ওপাশে ক্লান্ত, অবসন্ন এক জোড়া পায়ের হেঁটে যাওয়ার শব্দ কানে আসে। সেই ক্লান্ত পা জোড়া তার চাইতেও ক্লান্ত হাতের সাহায্যে বাথরুমের কল খোলে। কল থেকে পানি পড়ার অবিরাম শব্দ কানে বাজতেই থাকে তো বাজতেই থাকে। তার বাষট্টি বছরের পিতা ছাড়া আর কেউ হতেই পারেনা। ঘুষের মিথ্যা মামলায় কর্মস্থল কর্তৃক অভিযুক্ত, অসত্যের অযুত-নিযুত বেড়াজালে সমাজ কর্তৃক অনানুষ্ঠানিকভাবে নির্বাসিত মোঃ সোবহান রাত বাজে প্রায় দুইটা হবে এই সময়ে ক্লান্ত হাতে পানির কল খুলছেন। সেই পানির কল থেকে তার অভিশপ্ত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মতো অঝোর ধারায় পানি পড়েই চলেছে। “ সিদ্দিকা বিশ্বাস করো, আমি একটা টাকাও ঘুষ নেইনাই। আমারে মিথ্যা ফাঁসাইছে সবাই মিলে।” , “শফিক ও শফিক বাপ আমি একটা পয়সাও ঘুষ নেয়নাই। তোর বাপ ঘুষের পয়সায় কখনো তোদের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করেনাই।” অনেক অনেকদিন পরে পরাজিত বাপের প্রতি শফিকের আর্দ্র হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। সম্ভব হলে যদি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, চোঁখে-মুখে অপরিসীম অসহায়ত্বের ছাপ বয়ে বেড়িয়ে চলা মানুষটার ভেতর লীন হয়ে যেতে পারতো। কখনো এমন ইচ্ছা হয়নি। এই মুহূর্তে, যখন পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ কি উল্লাসের কিছুমাত্র তার কাছে ধরা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, চরাচরের সমগ্র বেদনার দুঃসহ ব্যঞ্জনা তার দিকে ধেয়ে আসছে অপ্রত্যাশিত সাইক্লোনের মতো করে এমন সময়ে নিজেকে সামলানো বড্ড দায়। পারছে কই?

পাশ ফিরে শুলো। বাতাস যেন আরো অনেক বেশী ভারি ঠেকছে। বুকের ভেতরে গুড়ো গুড়ো হয়ে প্রতিটি সেকেন্ড নিজেদেরকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। হাতটা একটু বাড়াতেই হালকা, মিহি এক টুকরা কাপড় আঙ্গুলের নাগালে চলে আসে। চোঁখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় তার জননীর কান্ড। ছেলের মঙ্গলকামনায় তার বিছানার এক কোনে তাবিজ রেখে দিয়েছে। ছেলের হাতে বেঁধে দিতে চাইলে সে হেসেই উড়িয়ে দেবে এই জন্য। তাই ছেলে যখন বাড়ি ছিলোনা তখন চুপিচুপি তার বিছানার এক কোনে রেখে দিয়ে নিজে ঘরের সমস্ত কাজকর্ম সেরে শুয়ে পড়েছে। শুয়ে পড়লেই কি ঘুম আসে? তার মায়ের কখনো আসেনি। কতোদিন রাতে খাবারের খোঁজে ঘর থেকে বেরুলেই দেখেছে ভবিষ্যতের হাজারটা অনিশ্চিত বাস্তবতার নিশ্চয়তাকে বুকে চেপে রেখে মেহমানদের ঘরে একাকী নিঃসঙ্গ নিজের অশ্রুকে পাখির মতো করে মেলে দিয়েছে। শফিকের সমগ্র সত্তাটাই বিদীর্ণ হয়ে যেতো সেই দৃশ্য দেখলে। কিন্তু সেই অবস্থায় কখনোই সে মায়ের কাছে যেতে পারেনি। আসলে যায়নি। কেবল একবারই মায়ের কাছে গিয়েছিলো। ছুটে গিয়েছিলো। ভোর হতেই চারপাশটা কি রকম শুভ্রতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করেছিলো। বাইরের বাতাসে কুয়াশার গোলাপী গোলাপী আভা, ইলেকট্রিক তারে সেই হলদে পাখিটার বসবার সময় হয়েছে মাত্র। আগের রাতে সম্পূর্ণই নির্ঘুম শফিক পানি খেতে ঘর থেকে বেরিয়েছে মাত্র। তার গর্ভধারিণী, নিজের রিক্ত জীবনের মাঝেও স্বামী আর পুত্র নামক দুই পুরুষকে জড়িয়ে রাখা দৃঢ়চিত্তের সিদ্দিকা বেগম গলায় র‍্যাটম ঢেলে নিজেকে চিরতরে বিলীন করবার কাজে ব্যাপৃত। শফিকের হাতের ধাক্কায় র‍্যাটমের কনাংশও তার গলায় যেতে পারেনি। সেই ঘটনাটি ঘটবার মুহূর্তে কল্পনাতীত বিহ্বলতা তাদের দুইজনকে ঘিরে ধরেছিলো। সেই প্রথম। সেই শেষ। সেই ঘটনা নিয়ে মাতা পুত্রের মাঝে একটি বাক্যও বিনিময় হয়নি। যেন সমগ্র ঘটনাটিই অস্তিত্বহীন ছিলো।

গালে একবার হাত বুলিয়ে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির অস্তিত্বে অস্বস্তিবোধ করলো। মৃদু আলোতে সময় দেখে নিলো। খুব বেশী রাত তো হয়নি। আড়াইটা বাজে মাত্র। আগামীকাল সারাদিন ছুটি। কেবল বিকালবেলাতে টিউশনিটায় যাবে। গতো এক সপ্তাহ হলো কামাই দিয়েছে। বাথরুমে উঠে আয়নায় নিজেকে দেখলো। নিজেকেই প্রশ্ন করে “তুমি কি শফিক?” উত্তর দিতে গিয়ে দেখে গলা মুহূর্মুহ কেঁপে উঠছে। আয়নায় নিজের চোঁখের দিকে স্পষ্ট তাকাতে চাইলো। দেখলো এতোদিন যাবত বয়ে বেড়িয়ে চলা জীবনের সমগ্র অস্পষ্টতাকে ধারণ করে সেই চোঁখ ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে এসেছে। ক্লিষ্ট কোন বৃদ্ধের মতো স্বপ্নহীন এক জোড়া চোঁখ। যা আগামীকালকে নিমন্ত্রণ জানায় অর্থহীন এক প্রাত্যহিকতায়। রেজর আর শেভিংফোমের ঠিক পাশেই সদ্যই কেনা একটি ব্লেড জ্বলজ্বল করছে। শফিকের ডান হাতটা সেদিকে চলে যায়। সমগ্র পাড়াই তখন নিস্তব্ধ। একটা কুকুর নিজের নিঃসঙ্গতা জানান দিতে একবার ডেকেই চুপ করে গেলো।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.