নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রাত্যহিক

১৮ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ১২:৩০

চিরপরিচিত চায়ের দোকান থেকে কখনোই দেখা না হওয়া অপরিচিত কারো কন্ঠ ভেসে আসে ‘আপনে কই যাইবেন?’। সন্ধ্যা পেরিয়ে সবে রাত্রি নেমেছে, শরীর জুড়ে ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ। মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে ইচ্ছা করছেনা। তবুও নিরাসক্ত স্বরে দোকানদারকে বললো ‘পাইকপাড়া।’

সে অবসন্ন পায়ে হাঁটতে থাকে। ডান পায়ের জুতার পেরেকটা শক্ত ঠেকছে। বেশ উঁচু হয়ে উঠেছে কয়েকদিন হলো। বিপত্তিটা আজকে টের পাচ্ছে। পায়ের পাতায় ব্যথাটা চনমনে হয়ে উঠলো। রাস্তাটাকে অনেক অনেকদিন পরে পরিচিত মনে হতে লাগলো।

সময় গেলে নাকি সবকিছুর সাথে সাথে পরিচিত রাস্তাটিও বদলে যায়। এই রাতে, যখন আকাশে চাঁদ উঠেছে নিজেকে প্রকাশ করবার সর্বোচ্চো তাড়না নিয়ে, মৃদু মৃদু বাতাসে আম গাছ থেকে শুরু করে মুখের উপরে এসে পড়ছে রাস্তার কোনা কোনা থেকে উঠে আসা ধুলা, বহু বছর আগে ফেলে আসা কামরাঙ্গার ঘ্রাণ, মানুষের শশব্যস্ত, সন্ত্রস্ত চলাফেরা, টুংটাং বেল বাজিয়ে চোঁখের পলকে রিকশার ছুটে যাওয়া, আশেপাশের মানুষের একে অপরের প্রতি তীব্র সন্দেহ কিংবা সংশয়ের চাহনী সব আগের মতোই নিজেদের স্বকীয়তা নিয়ে বিদ্যমান বলে মনে হচ্ছে তখন চিরচেনা রাস্তাটিকে অপরিচিত মনে হবার কারণ তো থাকতে পারেনা।

পা জোড়া টলমল করছে। তার উপর আরেকটু চাপ প্রয়োগ করলেই যেন চলমান সময়ের সম্পর্কগুলোর মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়বে পা দুটো। গলাটা শুকিয়ে এলো। সাথে সাথেই বেলী ফুলের তীব্র অপাপবিদ্ধ ঘ্রাণ নাকে ভেসে আসলে উন্মুখ হয়ে উঠলো। গন্ধের উৎসমুখের সন্ধানে।

“বেলী ফুলের গন্ধ আমার কি যে ভালো লাগে, তুমি কোনদিন যদি আমারে বেলী ফুল দিছো।” , “আমি দিমু কেমনে, কোনদিন আমারে কইছো বেলী ফুল তোমার সবচেয়ে পছন্দের?” , “মাইকে ঘোষণা করে তোমারে বলতে হবে কেন, আগ্রহ থাকলে নিজেই জেনে নিতা।” এই সময়কে ছাপিয়ে আরেক সময়ের বিগত কথোপকথনের সমগ্র দৃশ্যপট চোঁখের সামনে ভেসে আসলে তৃষ্ণার্ত গলাকে ভেজাতে ভেজাতে তা আরো বেশী শুকিয়ে যেতে থাকে। পরশুদিন সম্ভবত, হ্যা পরশুদিনই কে একজন বলছিলো ঢাকা শহরটা আপাদমস্তক পরাবাস্তব শহর হয়ে উঠেছে। জাদুর শহরও কি? বেলী ফুল সংক্রান্ত অতীতের সুখভাঙ্গা কথোপকথনের আচমকা রোমন্থনে এই সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিতে পারছেনা। এসবে ভেসে যেতে যেতে কখন যে রাস্তার মাঝখানে এসে গিয়েছিলো সচেতন ছিলোনা। শরীরের প্রায় পাশ ঘেঁষে একটা সিএনজি তার চাইতেও বেপরোয়াভাবে চলে গেলে হুঁশ ফেরে।

এখন হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে। পা জোড়াকে মনে হচ্ছে রিচার্জড মোবাইলের মতো। সে গলিটা পাল্টে নেয়। এই গলিটা বরাবরের মতোই ডেনজারাস। পনেরো বছর আগে এক বর্ষার রাতে এই রাস্তা থেকেই তার পিতা ছিনতাইকারীদের হাত থেকে কিভাবে দুই লাখ টাকা এবং নিজের মহামূল্যবান জান নিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন সেই গল্প ভদ্রলোক আমৃত্যু করে গিয়েছিলেন। সে নিজেই কম করে হলেও বিশ কি পঁচিশবার গল্পটা শুনে তিরিশবারের মতো মুগ্ধ হবার ভান করে গেছে। সময় মানেই প্রেমিক, সময় মানেই হন্তারক। কফিনে মোড়ানো পিতার লাশের স্মৃতির সাথে আজকে, নিজেকে খুঁজে ফেরার এই সুতীব্র সুপ্রাচীন মুহূর্তগুলোকে মেলাতে মেলাতে কথাটি এক লহমায় মনে পড়েই মিলিয়ে গেলো।

এইতো, এইতো রাস্তার সর্বডানে সেই চেনা দৃশ্যাবলী। এই আঁধো আলোতে, আঁধো অন্ধকারেও দেয়াল বেয়ে বেয়ে হালকা সবুজ শ্যাওলার ছবি দেখা যাচ্ছে। তার ধারেই পাশাপাশি অগণিত মাছের বিক্রেতারা। কই, কিছু তো বদলেছে বলে মনে হয়না। প্রায় সন্ধ্যাতেই বাসায় ফেরার পথে দেখতো শ্যাওলা দেয়াল বেয়ে ঝরে ঝরে নর্দমার দিকে চলে যাচ্ছে। ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায়। তার আশেপাশে অগণিত মানুষ পথ চলছে। দৃশ্যটি দেখে, দৃশ্যটি থেকে চোঁখ এড়িয়ে। আজ এতো এতো সময় পরেও তার চোঁখকে শ্যাওলার আস্তরণে পরিপূর্ণ রঙ উঠা দেয়ালটা চুম্বকের মতো টানছে। পাশের গেট পেরুলেই তো সেই ............... একসময় যার ছায়ায় সমগ্র জীবন পল্লবিত হতো। যার আবর্তে একসময় নিজেকে আপাদমস্তক দেখে নেওয়ার উন্মুখতায় অবগাহন করে কাটিয়ে দেওয়া যেতো একেকটি নীলকন্ঠি সন্ধ্যা। সে ধীরে ধীরে নিজের চোঁখ নামিয়ে নেয়। আজ এতো কাল পরে চিরকালের নিষ্পাপ রয়ে যাওয়া এই অপার্থিব দৃশ্যাবলীর দিকে নির্ণিমেষ তাকিয়ে থাকবার মতো জীবন কি তার আর অবশিষ্ট আছে?

গেট পেরুতেই দেখলো পাড়ার যেদিকেই চোঁখ যায় সেদিকেই প্রতিটি বাসার একটা কি দুইটা ঘরে আলো জ্বলছে। দেয়াল হালকা সবুজ রঙের ডিস্টেম্পারে সুশোভিত। তাদের সময়তেও হালকা সবুজ রঙের ডিস্টেম্পারের দেয়ালকে কি তীব্র অস্তিত্বসম্পন্ন দেখাতো!! যান্ত্রিক এই শহরের যান্ত্রিকতা থেকে যা যোজন যোজন দূরে অবস্থিত। ডালিম গাছের ঘন সান্নিধ্যে এখনো সমগ্র পাড়ার মানুষেরা নিজেদের একাত্মতা জানাচ্ছে। যেদিকেই চোঁখ যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মধ্যবয়স্ক নারী-পুরুষ প্রত্যেকে পাড়াময় হেঁটে বেড়াচ্ছে। এই জায়গার চিরাচরিত সান্ধ্যকালীন হাঁটতে বেড়ানো। “আমি আর তোর বাবা নিচে হাঁটতে যাই, তোরা কেউ ঘর থেকে বেরুবিনা। কেউ যদি আসে তাইলে বলে দিবি যে বাসায় কেউ নাই।” , “মা আমরাও তোমার আর আব্বুর সাথে যাবো।”, “না, এইসব বললে হবেনা। সারাবিকাল মাঠে খেলে এসেছিস। এখন তোদের পড়াশোনা করার টাইম। কালকে স্কুলের যা হোমওয়ার্ক আছে সব সেরে ফেলতে হবে।” চারপাশের কলকাকলী তীব্র হয়ে উঠলে ঘোর, শৈশবের অমলিন স্মৃতির পানিতে স্নাত অতীতের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারলো।

এবারে শিউলী ফুলের কাছে ফেরার সময় সমাগত। তার সমগ্র শরীর এই ব্যস্ত দিবসেও কেমন চনমনে হয়ে উঠেছে। অভিঘাতে সিক্ত এই শহর, যাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়াটাই প্রাত্যহিক বাস্তবতা সেই শহরে এমন সময় সৌরভের মতো সুবাস নিয়ে আসে। অনেক অনেক সময় ধরে সকল প্রকারের প্রাগৈতিহাসিক প্রবৃত্তি, আদিমতম বাসনায় উন্মুখতার বলয়ের বাইরে যার গন্ধ নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় আমৃত্যু। চারপাশে কেমন গা ছমছম করা নিস্তব্ধতা। কাছে আসতেই শিউলী গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঠিকরে বের হতে থাকা চাঁদের ভাস্বর আলো, পাশের ছোট্ট পুকুরের টলমলে পানিতে নড়ে উঠলো। নিচে পড়ে থাকা থোকা থোকা শিউলীর দিকে হাত বাড়ালো। “ওই শুয়োরের বাচ্চারা এইখানে কি? এই রাইতে কিয়ের লাইগা আইছোস? বাইর হ , বাইর হ এইখান থেইকা। মাদারচোতের জাত, সাহস তো কম না।” সে এই অন্তহীন পরাবাস্তব শহরে নিজের নিষ্পাপ অতীতের কাছে এসে এতো সময় লক্ষ্য করেনি পশ্চিম পাশে, আশি থেকে একশো গজ দূরত্বের একদা ফাঁকা জায়গাটায় এখন কালো পোশাক পরে সারা শহর দাঁপিয়ে বেড়ানো জাদুকরদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সম্বিত ফিরে পাওয়ার সাথে সাথে দ্রুত স্থানত্যাগ করতে উদগ্রীব হলো। হাতের তালুতে তখনো কিছু শিউলী ফুলের সুবাস লেগে আছে।

নিজের দৈনন্দিন গন্তব্যের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তার মুখাবয়বের কোন রেখাই স্পষ্ট বোঝা যায়না। নিষ্পৃহ ভঙ্গিতে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুললো। শুনশান অন্ধকার ঘর, কোথাও চাঁদের আলো দূরে থাক গভীর রাতে টলমল করতে থাকা পুকুরের পানির জ্বলজ্বলে অস্তিত্বের লেশমাত্রও নেই। আলো জ্বালাতেই পালিয়ে যাবার চেষ্টা করা ছোট কোন বিড়ালছানাও নেই। পোশাক না পাল্টেই বিছানায় নিজের শরীর এলিয়ে দিলো। ঘুমে সমগ্র সত্তা ডুবিয়ে দেওয়ার বেশ কিছু সময় পরে দেখতে শুরু করলো রঙ উঠা অপাপবিদ্ধ এক দেয়ালে হালকা সবুজ শ্যাওলার আস্তর ক্রমশ নর্দমার দিকে নামছে তো নামছে। আনন্দে চিৎকার করে উঠতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। পরাবাস্তব এই শহরের কালো জাদুকরদের তীব্র চোঁখ রাঙ্গানীর দৃশ্য সেই চিৎকারের সবটুকু গ্রাস করে নিলো।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১০:১২

আহমেদ জী এস বলেছেন: আল - বিরুনী প্রমিথ ,



সময় মানেই প্রেমিক, সময় মানেই হন্তারক।

সময় গেলে সবকিছুর সাথে সাথে পরিচিত আরও অনেককিছুই বদলে বদলে যায়।
এ এক প্রাত্যহিকতার রোজনামচা ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.