নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সময় ফেরে সময় ফেরেনা

২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ ভোর ৬:৫৮



স্বপ্ন দেখে আফরোজার ঘুম ভাঙ্গলো। কতোদিন পর !!! কতো প্রতীক্ষার পর !!! রাতে হোক কি দুপুরে প্রতিদিন ঘুমাতে যাবার আগে কল্পনা করতেন মনোমুগ্ধকর কোন স্বপ্ন দেখবেন। বছরের পর বছর সেই প্রতীক্ষাতেই কাটিয়ে দিয়েছেন। অবশেষে তার বাসনা পূরণ হলো। এমন কিছু মুহূর্ত দুর্লোভ কোন সুগন্ধীর মতো। সহজে মেলেনা, যখন তার সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হয় তার সৌরভ অনেকদিন স্মৃতিতে থেকে যায়। অমলিন।

আত্মীয়স্বজনে সমগ্র বাড়ী গমগম করছে। বিশাল ডেগচিতে করে মা, খালা, মামীরা পোলাও কোর্মা রাঁধতে ব্যস্ত। রাঁধতে রাঁধতেই নিজেদের মধ্যে অবিরাম খুনসুটি আর তামাশা চলছেই। পুরুষ মানুষেরা নিজেদের প্রাত্যহিক চিন্তাক্লিষ্ট, উদ্বিগ্ন মুখগুলোকে ছুটি দিয়ে খোশ আড্ডায় মেতে উঠেছে। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত থেকে শুরু করে দেশের হালহকিকত, রাজনীতির সাম্প্রতিক হালচাল নিয়ে গালগপ্প। প্রায় সকলের পরনেই ধবধবে ফর্সা পাঞ্জাবী। একেকজনের চেহারায় আনন্দমুখর দিনের উজ্ব্বলতা স্পষ্ট। নিজেদের বাল্যকালের সব স্মৃতির ঝাঁপি খুলে যাচ্ছে। কৈশোরে কি যৌবনে কে কবে গ্রামের কোন সুন্দরী মেয়ের প্রতি হালকা দুর্বল হয়েছিলো তা নিয়ে পরস্পরের সাথে হাসিতামাশা। যাকে নিয়েই ঠাট্টা চলে সে আশেপাশে চোরা চোঁখে বারবার তাকিয়ে দেখে তার স্ত্রী কি ছেলেমেয়েদের কেউ কাছে এসে কিছু শুনে ফেললো কিনা।

তারা, মানে বাড়ির বাচ্চারা আনন্দ খুঁজে নিয়েছে নিজেদের মতো করে। পুকুরে ক্লান্তিহীন দাপাদাপি। কারো ডুবে মরার ভয় নেই। বাড়ির একমাত্র চাকর কুদ্দুসকে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে বাচ্চাদের কাছে কাছে থাকতে। সে খালি গায়ের উপরে লাল রঙের গামছা জড়িয়ে, ঈদ উপলক্ষ্যে পাওয়া পরিষ্কার লুঙ্গি পরে পুকুরঘাটের সামনে বাচ্চাদের পাহারা দেয়। কুদ্দুসের লাজুক অবনত ভঙ্গি নিয়ে বাচ্চাদের হাসাহাসির অন্ত নেই। কিছুক্ষণ পরপরই কেউ না কেউ তার খালি গায়ের উপরে চড়ে বসবার চেষ্টা করছে। কুদ্দুস শুধু “এইরম করেনা” বলে ফের চুপ হয়ে যায়। পুকুরঘাটে দাপাদাপি শেষ হলে বাড়ির সামনের উঠানে অবিরাম ছোটাছুটি। ছোঁয়াছুঁয়ি। যাকে ধরা যাবে তাকেই অন্যদের পিছনে দৌড়াতে হয়। পরবর্তী কাউকে না ধরা পর্যন্ত সেই দৌড়ানোর শেষ নেই। যাকে দৌড়ানোর কাজটুকু করতে হচ্ছে তার শরীরে কি মনে ক্লান্তির কনামাত্র ছাপ দেখা যায়না। আবহাওয়াতেও স্নিগ্ধ বাতাস আর আম গাছের আমপাতার ঘ্রাণ মিলে কি অদ্ভুত এক মৌঁতাত।

ঘড়িতে টং করে একটা শব্দ হলো। বিকাল বেজে ছয়টা হয়েছে। বিশ তিরিশ বছর আগেকার সময় থেকে একধাক্কায় একবিংশ শতাব্দীতে চলে আসলেন। স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভাঙ্গবার পরে মাথাটাও যেন অনেকদিন পরে কেমন হালকা হালকা লাগছে। পালকের মতো। আফরোজা পাশ ফিরলেন। নাহ, আর আলসেমি করার কোন অর্থ হয়না। উঠে বসতে না বসতেই পাশের ঘর থেকে তীব্র আওয়াজ “মা, এতোক্ষণেও উঠোনাই? শরীর খারাপ নাকি?” আফরোজা জবাব দিলেন না। তার ছেলে মুনিম অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিন যন্ত্রের মতো কিছু গৎবাঁধা ধরণের কথা বলে। এই কথাগুলাও সেরকম। রুটিনমাফিক। গলায় কি হৃদয়ে কোথাও উত্তাপের সুর অনুপস্থিত। আফরোজা হতাশা গোপন করেন। মাকে আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলোনা। নাইলে এসব প্রাণহীন মুখস্থ কথাবার্তা নিয়মিত বলে যেতে পারে?



খাওয়ার টেবিলে চুপচাপ বৈকালিক নাস্তা সেরে নিচ্ছেন। পাশেই ছেলে আর ছেলের বউ। তারাও চায়ের সাথে মুড়ি আর পুয়া পিঠা তুলে নিচ্ছে।

“মা জানো, অফিসে আজকে বেলাল চাচা আসছিলো? কিভাবে কিভাবে আমার অফিসের ঠিকানা যোগাড় করছে আল্লাহই জানে। আমি খুব একটা কথাবার্তা বলিনাই।”

আফরোজার চোঁখেমুখে রক্ত জন্মে। খাওয়ার প্লেটের থেকে চোঁখ তুলে সরাসরি ছেলের চোঁখের দিকে তাকান। “তোর বেলাল চাচার সাথে খারাপ ব্যবহার করার দরকার কি ছিলো? তোরও জন্মের আগে যখন তোর বাপের চাকরী-বাকরীর কিছু ঠিক ছিলোনা তখন সে আমাদের কতো সাহায্য করছে তার খবর কিছু জানোস না? কতোবার তোদের দুই ভাইবোনকে তার গল্প বলছি।” শত চেষ্টার পরেও নিজের অসন্তোষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না।

এদিকে মুনিম ততোমধ্যেই ফুল ফর্মে, “এহ, আসছে আমার উনিশশো তিপ্পান্ন সালের সাহায্য নিয়ে। বেলাল চাচার কাহিনী আমি মনে হয় কিছু জানিনা না? দাদার সম্পত্তি নিয়ে দশ দশটা বছর কি ছ্যাচড়ামীটা কইরা গেলো তার মনে হয় কিছুই দেখিনাই আমি? কতোদিন বাবারে এই নিয়ে চিন্তা করতে করতে অসুস্থ থাকতে দেখলাম। আমি এগুলার কিছুই ভুলিনাই।”

“কেউই কিছু ভুলেনা। তোর বাবা নিজে তার মেজো ভাইকে কতো ভালোবাসতো তার খবর তোরা জানোস না কিছু। কেউ জানলে জানি শুধু আমি। লোকটা নিজের বাপের সম্পত্তি নিয়ে নোংরামী করছে যেমন সত্য এইটাও সত্য তার সাহায্য না পাইলে সুমী আর তুই বানের জলে ভেসে যাইতি। আমি কি তোর বাপ কারো সাধ্য ছিলোনা তোদের বাঁচাইয়া রাখার।”

“তুমি আর কথা বইলোনা। স্বামী আর ভাসুরের প্রতি দরদ উথলাইয়া উথলাইয়া পড়তেছে।” মুনিমের কন্ঠ তখন বিস্ফোরক। এতো ভালোবাসা নিয়াও তো স্বামীরে যদি.........মায়ের প্রতি আক্রোশে মুনিম কথা শেষও করতে পারলোনা। তার স্ত্রী শিউলী যথেষ্টই বিবেচক মেয়ে। পরিস্থিতি সামলাতে সে ততোমধ্যেই আন্তরিক হয়ে পড়েছে। “তুমি কি বলোতো? এইভাবে মাকে......তাদের একমাত্র সন্তান রাব্বি তখন কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে তারস্বরে কাঁদতে শুরু করেছে। আফরোজা বধির। বিমূঢ়। চারপাশে এতো এতো তীব্র শব্দ। তবু তার কানে শত বছরের নীরবতা এসে আঘাত করতে শুরু করেছে। ইয়া আল্লাহ, এখনই যদি আমাকে পৃথিবী থেকে তুলে নিতে!!! চেয়ার থেকে উঠতে গেলেন। পারলেন না। পা জোড়া অসাড় হয়ে গেছে।




মাথার তীব্র ব্যথায় সমগ্র চারপাশ যেন আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। ঘরের বাতি নেভানো। জানালাটা যা একটু খোলা আছে বাতাস তাই দিয়ে যতোটুকু প্রবেশ করতে পারে করছে। হালকা সবুজ বাতিটা টিমটিম করে জ্বলছে। রাতেরবেলায় যদি বাথরুমে যাবার প্রয়োজন পড়ে তখন যেন সহজে যেতে পারেন। আজকাল দেয়ালে ভর দিয়ে তবেই বিছানা থেকে রাতেরবেলায় বাথরুমে যেতে হয়।

আজকে বিকালে যা ঘটলো সেটা এই প্রথম নয়। আফরোজা বিলক্ষণ জানেন শুধুমাত্র তার সন্তানেরাই নয় আত্মীয়স্বজনের প্রায় সবাই তার স্বামীর আত্মহত্যার জন্য তাকেই দায়ী করে এসেছে। এখনো, বিশ বছর পরে এসেও তাকেই দায়ী করে। একমাত্র তাকে। যেন কেউ আত্মহত্যা করলে সমগ্র দায়ভার তার স্বামী কি স্ত্রীর। মিথ্যা, কি নিদারুণ মিথ্যার বেড়াজালে মানুষ আজীবন বসবাস করে। আফরোজা নিজের জীবন দিয়ে এই রুঢ় , কঠোর সত্যকে বুঝে নিয়েছেন। যেদিন স্কুল থেকে দুপুরবেলাতে ফিরে এসে সিলিংফ্যানের সাথে স্বামীর ঝুলন্ত লাশকে আবিষ্কার করলেন সেদিন থেকে পারিপার্শ্বিকতা তাকে চোঁখে আঙ্গুল দিয়ে সত্যটিকে প্রতিনিয়ত দেখিয়ে দিয়েছে। আজ, এই এতো সময় পরেও দেখাচ্ছে। ক্ষমাহীনভাবে।

“আহা, কি যে হয়ে গেলো ভাবীর জীবনে। এরকম একটা ঘটনা ঘটলে কিই বা করতে পারে মানুষ।”, “আল্লাহর খেলা আমরা কবেই বা বুঝতে পারছি? বুঝলা আজাব পড়ছে ওদের উপরে।”, “ এখন সুমী আর মুনিমের কি হবে? ওদের দেখাশোনা করবে কে?”, “আর কি, ঠেলে সব আমাদের উপর দিয়ে যাবে। স্বামী মরছে, ছেলেমেয়েদের এর ওর ঘাড়ে ঠেলতে হবেনা? আফরোজা ভাবী দেইখা নিও তাই করবে। আমাদের এর ওর ঘাড়ে নিজের ছেলেমেয়েগুলারে তুইলা দেওয়ার চেষ্টা করবে।”, “রফিক ভাই আত্মহত্যা কইরা কি যে বিপদে ফালাইলো আমাদের সবাইরে।”, “আরে ধুর, আত্মহত্যা কি কেউ সাধে করে নাকি? ভাবীর যন্ত্রণায় টিকতে না পাইরা কইরা ফেলছে। ভাবীরে আমরা সবাই চিনি। মানুষ না ডাইনী, সংসার করতে হইলে মেয়েমানুষের কতো রকমের মানাইয়া গুনাইয়া নিতে হয়। সে তো সবসময়েই চলছে উল্টাদিকে। রফিক ভাইয়ের ব্যবসাটা আবার জমজমাট হইলো। ভাবী চাকরীটা ছাইড়া দিলেই পারতো। কিন্তু জেদ দেখো মহিলার। সামান্য দুই পয়সার স্কুলমাস্টারীর চাকরী, ছাড়লোইনা। এখন নিজে বুঝো।” ........................

আত্মীয়স্বজনের কটুবাক্যের তীব্র শ্লেষ তার পিছু ছাড়লোনা আজঅবধি। এই অন্তহীন বাক্যবাণে প্রতিনিয়ত ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ হয়েছেন। তবু কদাপি নিজের ভেতরটা কাউকে বুঝতে দেননি। সমস্ত অবজ্ঞা আর অপমান নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে সন্তানদুটাকে তার সামান্য আঁচও লাগতে দেননি। এতোকিছুর পরেও ছেলেমেয়েদের কাছেও খলনায়কই থেকে গেলেন। মেয়েটা ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে উঠতেই পালিয়ে সেই যে বিয়ে করে ফেললো আজ পর্যন্ত এই বাড়িতে পা দেয়নি। কেমন আছে, কি করছে, ছেলেমেয়ে আছে কি নেই খবর জানেন না কিছু।

মফস্বল বলে চারপাশের সমগ্র নিস্তব্ধতায় পরিপূর্ণ। আফরোজা সমগ্র পরিমন্ডল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার তীব্র চেষ্টায় আকুল। কিন্তু পারছেন কই? পাশের ঘর থেকে ঠাস করে চড় দেওয়ার শব্দ শুনতে পেলেন। বিয়ে হয়েছে ছয় বছর হলো। বাচ্চাও হয়ে গেলো তিন বছরের। এতো সময় পরেও বউকে না পেটালে তার ছেলে মুনিমের হাতের সুখ মিটেনা। অফিসের বড় কর্তা, ছেলের বাপ, সমাজের গন্যমান্য একজন মুনিম খান, তারই গর্ভজাত সন্তান রাতের নির্জনে নিজ ঘরে বউকে মারধোর করছে। পাশের ঘরে চিৎকার, চেঁচামেচি ক্রমশ বাড়তেই থাকে। জানালা দিয়ে কোথা থেকে যেন হাসনাহেনার গন্ধ ভেসে আসে। সেই গন্ধের কারণেই কিনা কে জানে আফরোজা বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইলেন। পাশের ঘরে গিয়ে আজকেই হেস্তনেস্ত কিছু একটা করবেন। উঠে দাঁড়াতেই মাথার তীব্র ব্যথা তার সমগ্র চেতনাকে বিদীর্ণ করে উঠলে এই আঁধো আলোয়, হাসনাহেনার গন্ধে সুরভিত চারপাশকে অতিক্রম করে সিলিংফ্যানে ঝুলন্ত একটি ক্ষতবিক্ষত পরাজিত মুখের ছবি তার চোঁখের সামনে ভেসে আসলে আফরোজা আত্মগোপনের জন্য তীব্রভাবে উন্মুখ হলেন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.