নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সেলফি

৩১ শে আগস্ট, ২০১৫ ভোর ৪:৪৪

সে বুঝতে পারলো তার তৃষ্ণা তীব্রতর হয়েছে। বেশ আগে থেকে গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিলো। তখন আমলে না নিলেও এখন আর একে অবহেলা করা যাচ্ছেনা। কালো প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে তার থেকে খুচরা পনেরো টাকা বের করে হাফ লিটারের একটা পানির বোতল কিনলো। টাকা খরচ না করেই মানুষ পানি খেতে পারে সেই সময় বহু আগেই অতিবাহিত হয়েছে। পানিতে গলাটা ভেজালে জিভে বিন্দু বিন্দু স্বাদের অনুভূতি টের পায়। এতোক্ষণ যাবত জিভটা নিমতেতো হয়ে ছিলো। সকালেও যে বেরিয়েছিলো তাও শুকনো কিছু বিস্কিট খেয়ে। ধীরস্থির হয়ে পানিটা পর্যন্তও বাসা থেকে খেয়ে যেতে পারেনি।

সামনের রাস্তাটা একটু দেখেশুনে চলতে হয়। রাস্তার দুই পাশেই বিপদ। একটু আরামসে চলবে কি সে উপায়ও নেই। বামদিকের রাস্তায় অবিরাম খোঁড়াখুড়ি চলছে। চোঁখ দুটো সেদিকে একটু প্রসারিত করতেই দেখলো বাম উরুর দিকে হালকা ছেঁড়া চেক লুঙ্গি, কাঁধ বেয়ে বেয়ে টপটপ করে পড়তে থাকা ঘাম, চাহনীতে তীব্র বিষাক্ততা এবং আধময়লা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরা শ্রমিক তীব্র তপ্ত আকাশের দিকে চেয়ে কি বিড়বিড় করছে। আরেকজন শ্রমিকের সবল কাঁধে গাঁইতি, চোঁখ দুকূল ছাপিয়ে আসা ক্লান্তিতে জরজর। কেউ সামান্য একটুকু ধাক্কা দিলেই যেন সমগ্র শরীর জুড়ে অবিরাম দীর্ঘ ক্লান্তিহীন ঘুম নেমে আসবে। তারও একটু সামনে একটি দোকানের সামনে এই ভরদুপুরে পারিপার্শ্বিক সকল ক্লেদাক্ততাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক গাঢ় সবুজ রঙের শার্টের পকেট থেকে একটি নীল রঙের চিরুনী বের করে পরম যত্নে নিজের দাঁড়ি আঁচড়ায়। গলাটা মাত্রই ভিজিয়েছে, শুকিয়ে কাঠ হয়ে নেই। তবুও তার গা গুলিয়ে উঠলো। জিভটা ফের নিমতেতো মনে হতে লাগলো। এই জায়গাটুকু পেরিয়ে তাকে যেতে হবে ডানদিকে। সেখানেও নিস্তার কোথায়?

পরপর পাশাপাশি প্রায় খুপড়ি ঘরের মতো করে সাজানো ছোট ছোট দুইটি প্রাইমারী স্কুল। ঘন্টার তীব্র শব্দ হলেই জেলখানা থেকে বের হওয়া হচ্ছে এমন স্বস্তিতে বাচ্চাগুলো কাঁধে ভারি ব্যাগের দুঃসহ অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করেই গেট পেরিয়ে যেতে কলকল করে ছুটে আসে। প্রত্যেকেই সবার আগে ছুটে বেরিয়ে যেতে চায় বলে কেউই ঠিকভাবে বেরুতে পারেনা। আজকে শুক্রবার নয় কিন্তু তার দশ গজ সামনেই থাকা ছোট মসজিদটা থেকে ইমাম কি মক্তবের কাঠখোট্টা কর্কশ ধ্বনি নগরের সমগ্র বিরক্তি কি বিদ্বেষকে ধারণ করে ক্লান্তিহীনভাবে হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের থেকে শুরু করে নিরীশ্বরবাদী , বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারীদের চৌদ্ধগুষ্টি উদ্ধার করতে সদাসচেষ্ট। শৈশবে থাকতে যখন শুক্রবার দুপুরে জুম্মার নামাজে যেতো তার স্পষ্ট মনে আছে মসজিদের ইমাম খুতবা চলাকালীন সময়ে প্রায়শই নরকের দীর্ঘ নারকীয় যন্ত্রণাবহুল বর্ণনা দিয়ে উপস্থিত মুসল্লীদের চোঁখে ভয়মিশ্রিত অশ্রু বইয়ে দিতে পারতো। একবার মুসল্লীদের চোঁখে আতঙ্কের সেই দৃশ্য স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ করলে সেই ইমামের বর্ণনা আরো দ্রুততর হয়ে যেতো। পরবর্তী ধাপে থাকতো পৃথিবীতে বসবাসকালীনই মুমিনবান্দারা যেসকল অপরাধসমূহ করে সেই পাপের সম্ভাব্য শাস্তিসমূহের সুদীর্ঘ বর্ণনা। তার বয়ান ব্যাখ্যার সময়ে ইমামের চোঁখে মুখে এক ধরণের দুর্জ্ঞেয়, রহস্যময় ধরণের আমি সব জানি গোছের মিটিমিটি হাসি ফুটে উঠতো। আজ এই সময়ে, এই রাস্তার সমগ্র ব্যস্ততা, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং পঙ্কিলতাকে ধারণ করে থাকা চিত্রটুকুই যেন ইমামের বর্ণিত দোজখের খন্ডিত অংশের মতো।

সে তার হাঁটার গতি বৃদ্ধি করে। বয়সের তুলনায় তার হাঁটার গতি যথেষ্টই শ্লথ বলে তার মনে হয়। তার অফিসের ম্যানেজার সিদ্দিক সাহেব প্রায়শই তাকে কটাক্ষ করে বলে উঠে “জুয়েল, তোমার থেইকা তো পোয়াতি মহিলারা বেশী জোরে হাঁটে, হে হে হে।” সিদ্দিক সাহেবের হাসির সাথে সাথে তার পান খাওয়া রঙ ধরা দাঁত এবং বিশাল ভুঁড়ির নাচন জুয়েলকে বরাবরই ক্ষিপ্ত করে। “খানকির পোলা, নিজে তো মদ আর মাগীবাজি কইরা টাইম পাওনা। এসিঅলা ঘর থেইকা একদিন বাইরাইয়া এই গরমের মধ্যে পোঁদটারে নাড়াও। বুঝবা তখন কতো ধানে কতো চাল।” সে, উনিশশো তিরাশি সালে জন্ম নিয়ে পিতৃপ্রদত্ত নাম পাওয়া জুয়েলের ইন্দ্রিয় কথাগুলো বলবার জন্য উন্মুখ হয়। যদিও এক ফোঁটা বাতাস নেই কিন্তু ডালিম গাছের নিস্পন্দ পাতাগুলারও তো কান থাকতে পারে নাকি? তাই তার কল্পিত কথাগুলো কোন মাহেন্দ্রক্ষণে বলবে মনঃস্থির করে তার শরীর শিহরিত হয়।

পেছন থেকে একটি রিকশা বিনা সংকেতেই প্রায় তার শরীরের উপরে উঠে পড়বার উপক্রম করে। মাহেন্দ্রক্ষণে চিন্তা ছেড়ে সচকিত হতে হতেই গেটের কাঁছে পৌঁছায়। সেই চিরাচরিত দৃশ্য। ঘাটের মরা সোহরাব মিয়া জিরজিরে দুটো হাত, ক্ষীণ হয়ে আসা চোঁখজোড়া এবং তার চাইতেও করুণ চশমার ফাঁক দিয়ে তাকে দেখতে চেষ্টা করে। পাঁচ কি সাত সেকেন্ড পরে চিনতে পারলে “ও জুয়েল স্যার আপনে” বলে তাকে আগানোর ইঙ্গিত দিলে সে আড়ষ্টবোধ করে। লোকটার বয়স তার স্বর্গত পিতার থেকেও বেশীই হবে। তারপরেও তাকে স্যার স্যার করে বলে। জুয়েল কতোবার ভেবেছে তাকে স্যার ডাকতে নিষেধ করবে। কিন্তু লোকটার স্যার বলার মধ্যে এক ধরণের মাধুর্য আছে। আর তাকে স্যার বলেই বা কে? এভাবেই আর কখনো কথাটা বলা হয়ে উঠেনা।

কলেজে আজ স্বাভাবিক কর্মদিবস। বামদিকের বড় অংশটায় দিন পনেরো হলো ভাঙ্গাভাঙ্গি শুরু হয়েছে। খেলাধুলার জন্য নতুন রুম করবে না কি করবে কে জানে কিন্তু তার আশেপাশে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার উপায় নেই। বালু, কয়েকদিনের বৃষ্টির জমে থাকা কাঁদা আর অফুরন্ত ধুলার সংমিশ্রণে জায়গাটা কিম্ভূতকিমাকার হয়ে রয়েছে। ডানদিক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই হিসাববিজ্ঞানের পুরনো শিক্ষক বিমল বাবুকে দেখা গেলো। “কি খবর জুয়েল, কতোদিন পরে তোমারে দেখলাম। এদিকে আসোনা-টাসোনা তেমন একটা, এরপরে আসলে আমারে একটু খবর দিও।” জুয়েল প্রত্যুত্তরে বিনীতভাবে “হ্যা স্যার আপনাকে জানাবো” বলে শুকনোভাবে হাসতে চেষ্টা করে। হাসিতে ঝরে পড়া বিনয় কতোটা রাখতে পারলো কে জানে। ঠিকভাবে বলতে পারলে মনে হয় নতুন একটি কি দুইটি স্কিমের কথা বলে দেখতে পারতো। মনে মনে ঠিক করে নিলো এরপরে যেদিনই এখানে আসবে সবার আগে বিমল বাবুকেই টার্গেট করে রাখবে। লোকটার কানেকশন শুধু ভালো না বেশ ভালো। তাকে গোটা দুয়েক নতুন স্কিম ধরিয়ে দিতে পারলে কমিশনের অঙ্কটা মোটাই আসবার কথা।

“না তুই সর তুই সর, তোর জন্যে আমারে দেখা যায়না।” সামনেই একাধিক তরুণীর কন্ঠস্বর কখন তাকে আচমকা বিহ্বল করে ফেলতে পারে বুঝতেই পারেনি। দেখতে পেলো উজ্জ্বল পোশাকের তিনজন তরুণী একটি মোবাইল লোফালুফি করতে চেষ্টা করছে। নিজেদের ছবি নিজেরাই তুলবে। জুয়েল রাস্তাঘাটে অনেককেই এমনটা করতে দেখে। পত্রিকায় পড়েছিলো এটাকে নাকি সেলফি বলে। কি উজ্জ্বল প্রশান্ত মুখ তরুণীগুলোর। কেমন নির্ভার। তাদের প্রত্যেকের দিকে আলাদা করে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করলো। প্রত্যেকেই বেশ স্বাস্থ্যবতী। সেলফিতে সম্ভবত সে নিজের অজান্তেই প্রবেশ করে ফেলেছে। তাই দেখলো সুকৌশলে তার থেকে একটু দুরত্বে সরে গিয়ে, যেন সে বুঝতে না পারে এমন কায়দায় তরুণীগুলো চারপাশে থেকে সহজাতভাবেই নিজেদের বিযুক্ত করে নিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় সেলফি তুললো। সেই পর্ব শেষ হলে তাদের প্রতিক্রিয়া হয় দেখবার মতো। ভেতরকার আপাত সব সাধ-আহ্লাদ যেন তার মধ্যেই পূরণ হয়ে গেছে।

কলেজের প্রধানশিক্ষকের কাছে দেখা করতে এসেছিলো। মনে হয়না আজকে আর দেখা হবে। এতোক্ষণেই সেই ঘরে তার ডাক পড়বার কথা। প্রধানশিক্ষকের পিয়ন বেলাল এসে তো কিছু বললোনা। সে অনুভব করলো তার পায়ে ক্লান্তি চেপে বসেছে। বেঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতেই সাদা রঙের পরিষ্কার শার্ট, নীল ফেডেড জিন্স, দেখতে শুনতে ভদ্রঘরেরই মনে হচ্ছে ছেলেটাকে, বয়সে তার থেকে কমসে কম পাঁচ বছরের ছোট হবে একজন বেঞ্চে বসে মনোযোগ দিয়ে কি সব কাগজপত্র দেখছে।

“ভাই, আপনি কি এই কলেজের?”
“জ্বি না, কেন বলুন তো?”
“না আসলে আমি আসছি সিটি ব্যাঙ্ক থেকে। আমাদের ব্যাঙ্ক থেকে ফ্রিতে একাউন্ট খোলা, তারপরে ধরেন ফ্রিতে ডেবিট কার্ড আর ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হয়। আপনার সাথে কি দুইটা মিনিট কথা বলা যায়?”
“সরি কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে ঠিক চাচ্ছিনা......”
“না না ঠিক আছে। আপনি কিছু মনে কইরেন না আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম।”

এখানে আর খামাখাই প্রধানশিক্ষকের জন্য বসে থাকবার কোন অর্থ হয়না। গরমটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ভ্যাপসা গরমটা আর কোনভাবেই সহ্য করা যাচ্ছেনা। ক্লান্ত পা জোড়া নিয়ে সে গেট থেকে বের হবার উদ্দেশ্যে এগোতে শুরু করলো। ভেবেছিলো আজকে একটা কি দুইটা নতুন স্কিম কাউকে ধরিয়ে দিতে পারবে। মাসের প্রায় শেষে এসে গোটা তিনেক কি চারেক ক্লায়েন্ট ধরতে পারলে শেষের দিকে আর বিশেষ টেনশন থাকেনা। বোনটার হালকা হাতখরচ আর নিজের চা-বিড়ির খরচ নিয়ে কোন চিন্তা থাকেনা। সামনের মাসে টাকাপয়সা ভালোই খসবে। এক তারিখেই বিথীর সাথে একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া। সেখানে যেতেই হবে। শেষবার সবটা হয়ে যাওয়ার পরে এতো করে সে বলেছিলো যেন পিল খেয়ে নেয়। শুনলোই না। এখন সেই নাদানীর ফল ভোগো। টাকা যা যাবে তার হাতের উপরে দিয়েই তো যাবে। কষে ক-বর্গীয় কি চ-বর্গীয় গালি দিতে গিয়েও দিলোনা। তাকে আর গালমন্দ কি করবে? মা-বাপ নাই এতিম মেয়ে, মামার কাছে থেকে মানুষ। নিজেও বহু কষ্টে আছে। সকাল-বিকাল কান্নাকাটির উপরেই থাকে। না সে পারে ঠিকমতো সময়টা দিতে। হাসপাতালে যেদিন গিয়ে ব্যাপারটা খালাশ করে আসবে সেদিন আরো লম্বা সময় মেয়েটার সাথে থাকতে হবে।

গেট থেকে বের হতেই সোজা ডান বরাবর আহমদিয়া রেস্টুরেন্ট। সারাদিন দানাপানি বিশেষ কিছু পেটে পড়েনি। যেই কাজের জন্য এসেছিলো তারও তো কিছু হলোনা। পকেট থেকে রুমাল বের করে সমগ্র মুখ একবার মুছলো। রুমাল ভর্তি বালিতে কিচকিচ করছে। রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতেই দেখলো একগাদা মানুষজন হঠাৎ করেই বেরিয়ে যেতে রেস্টুরেন্ট অনেকটাই ফাঁকা লাগতে লাগলো। মোবাইল বের করে সময়টা দেখে নিলো। হাতে আরো এক ঘন্টার মতো আছে। বেয়ারাকে ভাজি পরোটার অর্ডার দিয়ে হাত ধুতে গেলে দেখলো আয়নাটা ভাঙ্গা। যেন সে হাত ধুতে ধুতে নিজেকে একটিবার পরিষ্কারভাবে দেখবে তাতেও আয়নাটার আপত্তি। হাত ধুতে ধুতে তার মনে হতে লাগলো সমগ্র পারিপার্শ্বিকতার নিজস্ব সেলফি থেকে তার পৌনে ছয় ফুট শরীরের লম্বা রেখা -উপরেখাগুলো ক্রমশই দূরে সরে সরে যাচ্ছে। ভাবনাটা একবার মাথায় চলে এলে সে ভাঙ্গা আয়নায় দিকে তাকিয়ে আশেপাশের প্রত্যেককে বিস্মিত করে খলখল হেসে উঠে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:৩৬

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: অসাধারণ| গতি খুব শ্লথ গল্পে যদিও কিন্তু আপনার বলার ভঙ্গি আর বাক্যবিন্যাস মুগ্ধ করার মত

২| ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:০৪

অন্তু নীল বলেছেন: সুন্দর।। খুব সুন্দর শব্দ চয়ন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.