নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

উদ্দেশ্যহীন

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:০৩

সে কি ভুল করে কোন নরকে এসে পড়েছে? নাকি দুঃস্বপ্ন দেখছে? নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখলো। কোন বিস্মৃত হতে চাওয়া ঘোরের মাঝে আছে এমন মনে হলোনা।

একফোঁটা বাতাস নেই। পাঁচ মিনিট পথ হাঁটলেই ভ্যাপসা গরমে সমগ্র পীঠ ভিজে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে এলেও কিছু করার নেই। পানি খেতে হলেও আজকাল রাস্তাঘাটে পনেরো টাকা খরচ করে হাফ লিটারের বোতল কিনে খেতে হবে। সরলরেখা বরাবর লম্বা ফুটপাথটাও এবড়োথেবড়ো। কোনার দিকে বেশ বড় অংশই ভাঙ্গা। সে হাঁটতে গিয়ে দুইবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে সামলে নিয়েছে। রাস্তার অপরপার্শ্বে শুনশান অন্ধকার। মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃপক্ষ সেখানে আলোর কোন প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেনা বলে প্রতি সন্ধ্যাবেলা নিয়ম করে ছিনতাই থেকে শুরু করে চলাচলকারী মেয়েদের শারীরিকভাবে হেনস্থা করা সবই চলছে, বিনা বাধায়। তার পেছনে বেড়া করে হালকা যেই ঝোপের মতো আছে সেখান থেকে গুয়ের গন্ধ পরিষ্কার নাকে আসে। সাড়ে সাত গজ সামনের ডাস্টবিনের কাছ ঘেঁষে দুইটা কুকুর কোন মহৎ গুপ্তধনের সন্ধানে সচেতন চোঁখে এদিক ওদিক চেয়ে দেখছে স্রেফ তারাই বলতে পারে। প্রধান সড়কের ট্রাফিক জ্যামে লোকাল বাসে দমবন্ধ গরমে অতিষ্ঠ ক্লান্ত মুখগুলোর প্রতিটি রেখা-উপরেখাকে তার পরিচিত বলে মনে হয়।

“এই রাস্তা দিয়ে রিকশা গেলে কি সমস্যা? সামান্যই তো পথ”, বাদানুবাদ শুনে মনোযোগ ঘটনাস্থলের দিকে চলে গেলো। দেখতে পেলো রিকশার প্যাসেঞ্জার তরুণীটি ট্রাফিকের সাথে তর্ক জুড়ে দিয়েছে। তার রিকশাটি সম্ভবত রঙ সিগন্যাল দিয়ে আসছিলো। “আপনার রিকশা রঙ সিগন্যাল দিয়া আসবে কেন?” ট্রাফিক সার্জেন্টকে বেশ ঘাড়ত্যাড়া বলে মনে হলো। “সামান্য পথই তো রঙ সিগন্যাল দিয়ে আসছে, একটু সামনেই তো নেমে যাবো। যাইতে দিলে আপনার কি হয়?” সার্জেন্ট প্রশ্নের উত্তরে কিছু না বলে ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে রিকশার পথ ধরে। আশেপাশের প্রত্যেকে সঙ্গত কারণেই বেশ মজা পেয়ে গেছে ঘটনাটায়। প্রত্যেকেই আগ্রহ নিয়ে পরের মুহূর্তে কি ঘটে তার অপেক্ষায় তারিয়ে তারিয়ে ঘটনাটা দেখে। যেন বিশ্বে এই মুহূর্তে এর চাইতে চমকপ্রদ ঘটনা আর কিছু নেই। রিকশার তরুণী প্যাসেঞ্জার এবারে উত্তেজিত হয়ে আশেপাশের সবার জন্য প্রত্যাশিত বিনোদনের যোগান দিলো। “দশটা টাকার জন্যেই এরকম করেন এটা তো বুঝি।” সার্জেন্ট সম্ভবত কোন মেয়েমানুষের কাছ থেকে মুখ ঝামটা খাওয়া পছন্দ করেনা বলেই এবারে মুখ তুললো, “আপনি যা ইচ্ছা মনে করেন।” রিকশাওয়ালা বুঝলো বিশেষ লাভ নেই। সে পথ ঘুরিয়ে তার রিকশা নিতে নিতেই তরুণীর গলা আবারো উচ্চকিত, “শুয়োরের বাচ্চা কোথাকার, চোরের বাচ্চা চোর।” সার্জেন্টের রিফ্লেক্স ততোমধ্যে একেবারে তাৎক্ষণিক, “শুয়োরের বাচ্চা হইলো আপনের মা।” হাত উঁচিয়ে “তোর গলা কাইটা দিবো শুয়োরের বাচ্চা” বলতে বলতে তরুণীটি রিকশা সমেত অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে তার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলো। ফিগারটা বেশ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। গোলগাল মুখের সাথে চশমার ফ্রেমটা ম্যাচ করেছে বলে মনে হচ্ছেনা। ফেসের তুলনায় বেশ সামঞ্জস্যহীন। আজকাল তারা বন্ধুমানুষেরা আড্ডা দিলে কোন না কোন সময়ে মেয়েমানুষের টপিক অনেক বেশীই চলে আসে। আলাপ করবার মতো খুব বেশী কিছু তো নেই। তাদের বেশীরভাগেরই চাকরী হয়নি এখনো। বিয়েশাদীর বালাইও তাই নেই। দুই বন্ধুর আগে প্রেম ছিলো কিন্তু অনন্তকাল ধরে বেকার যুবকের সাথে কেউ প্রেম করেনা বলে তাদের সাথেও আদিরসাত্মক কথাবার্তা বলার পরিবর্তে একটু মন খারাপ মন খারাপ করে থাকতে হয়। তার চাইতে যাকে মাত্রই দেখলো তার কথা পরে সময় করে ভাবা তো যাবে। একবার মেসে পৌঁছে যাক, গোসল করতে স্নানঘরে ঢুকলে তরুণীটিকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় সেই সাহস কার? সেই ছোট্ট স্নানঘরে তখন তো সেই একচ্ছত্র রাজা। তার যেভাবে খুশী সেভাবে সেই নারীশরীরকে সে গড়ে নেবে। যা দেখতে চাইবে তাই সে দেখবে। সেখানে তার উপরে কেউ নেই। একেবারেই কেউ নেই।

খুব জোরে একটা মাইক্রো ব্রেক কষলে রাজার কল্পনা থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হয়। আরেকটু হলেই পায়ের পাতার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। “ওই মিয়া, চোঁখ কোথায় রাইখা আইছেন?” বলেই ড্রাইভার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সাঁই করে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। উত্তরের জন্যে অধীর আগ্রহে বসে থাকলেও তো ড্রাইভারকে কিছুক্ষণ আগের কল্পিত দৃশ্যাবলীর কথা কিছু বলতে পারতোনা। কলেজের বন্ধু চারুর কথা মনে পড়লো। তাদের মধ্যে সবচেয়ে মুখরা ছিলো। রাস্তার লোক তো রাস্তার লোক শিক্ষকদের সাথেও চোঁখেমুখে কথা বলতো। আফসার স্যারের সাথে তো একবার তুমুল বেঁধে গিয়েছিলো। রেগে গিয়ে আফসার স্যারের মুখ দিয়ে থুথু গড়াচ্ছিলো। “ইউ পম গানা” ধরণের তুমুল উত্তুঙ্গে রাগ। চারুটা এমনই ঘাউড়া ছিলো। এই দৃশ্য দেখেও নির্বিকার। ক্লাস থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে কয়েকটা টান দিয়ে বলে উঠেছিলো “মানুষরে ক্ষেপাইয়া দিয়া মজা আছে, রাগের সময়ে মানুষের চোঁখগুলা যা দেখার মতো হয়না।” আফসার স্যারের রাগত ভঙ্গী হুবহু নকল করে দেখাতে দেখাতে কথাগুলো বললে তারা সবাই হো হো করে হেসে উঠেছিলো। চারু, সেই ড্যাম কেয়ার নির্বিকার নিরাসক্ত চারু ছয় বছরের মাথায় প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নেশা তো ধরলোই নেশার টাকা নিয়মিত যোগাড় করতে দুই বাচ্চার মা এক ভদ্রমহিলার সাথে পরকীয়া করাও শুরু করলো। কাস্টমস অফিসারের কিছুই ভালো লাগেনা গোছের নিষ্পৃহ স্ত্রী যেদিন আসল বিষয়টা জানতে পারলো নিজের সম্মানের কথা কিছুই চিন্তা না করে তাদের সারা শহর প্রায় কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। সেই কেচ্ছা থেকে বহু ঝামেলার পর উদ্ধার পেতে পেতেই একদিন ঢাকা শহরে রাতেরবেলা পুলিশের গুলিতে নিহত চারুর লাশের ছবি পত্রিকায় দেখলো।


এখন ভ্যাপসা গরমটা একটু কম অনুভূত হচ্ছে। কারণ কি কে জানে। শার্টের দ্বিতীয় বোতামটা লাগিয়ে নিলো। আজকের ইন্টারভিউয়ের সময়ে কে বোকামিটাই না করে বসেছিলো। অপেক্ষা করতে করতে গরমে একেবারে উপরের বোতামটা খুলে দিয়েছিলো। ইন্টারভিউ রুমে যাবার সময়ে যে লাগিয়ে নেবে সেটাই ভুলে গিয়েছিলো। সেই যে তার দিকে উপস্থিত বাকিদের ভ্র কুঁচকে তাকানো সেটা আর শিথিল হলোনা। “আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম চুক্তির নাম কি”, “পিপিপি এর সম্পূর্ণ মানে কি”, “জিমি কার্টার কতো সালে নোবেল পদক লাভ করেন” ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্নগুলোর উত্তর সে জানেনা সেটা বলতেও প্রচুর কষ্ট হলো। শালার পুরাটাই বানোয়াট। তাকে নেবেনা, সে তার চৌদ্দবাপের জন্মেও এই চাকরী পাবেনা এটা উপরের আল্লাহ থেকে শুরু করে কর্তারা পর্যন্ত সবাই জানে। তাও খামাখাই ইন্টারভিউ নেওয়ার ন্যাকামী। একদলা থুথু ফেলতে চাইলো। সেটাও মাটিতে পড়লো যেন নিতান্তই অনিচ্ছায়। ‘ল্যাওড়া’, জোরে উচ্চারণ করলেও কেউ তার দিকে তাকালোনা পর্যন্ত ।

মেসের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে। এই দিকে রাস্তা বেশ নির্জন হয়। অবশ্য তার আছেই কি যা হারাবার ভয় থাকতে পারে? আড়াই বছর ধরে ঘুরে ঘুরে গোটা তিনেক স্যান্ডেল ক্ষয়েও তো চাকরী জুটলোনা কোন। তাই সে নির্বিকার চিত্তে হাঁটতে লাগলো। যানবাহনের উৎপাত দেখা যাচ্ছেনা। একবার রাস্তার বায়ে তো একবার ডানে নেচে নেচে বেড়াতে ইচ্ছা করলো। দুইবার সেটা করলোও। ডান দিকের স্যান্ডেলটা ফট করে ছিঁড়ে যেতে নিচ্ছিলো আরেকটু হলেই। কিন্তু ছিঁড়লোনা। ল্যাম্পপোস্টটার কাছে হালকা আলোতে এক জোড়া যুগলকে ঝগড়া করতে করতে রিকশা দিয়ে যেতে দেখলো। তার ইচ্ছা করলো চিৎকার করে যুগলের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়, “জনসংখ্যা আজ দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। টেলিভিশনের টক শোতে দেখবেন সুযোগ পেলেই যে কেউ এসে কথাটা বলবে। সভা-সেমিনারেও মানুষজন বলবে। বিদেশ থেকে এনজিওর মোটা টাকার ফান্ড আসবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে। আবাসিক-অনাবাসিক হোটেল থেকে পুলিশ প্রায়শই প্রেমিক-প্রেমিকাকে গ্রেফতার করে আনে তাও সম্ভবত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নিজেদের শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে। কাজেই ভাইয়েরা তোমার, বোনেরা আমার আপনারা প্রত্যেকেই একে অপরকে ভাই-বোন বলে মনে করুন। দেশের তাবৎ স্বামী-স্ত্রীরা বিছানায় একে অপরকে ভাই-বোন মনে করে দূরত্ব বজায় রেখে শান্তিতে ঘুমাতে যান। ঝগড়া করবেন না, কলহ করবেন না। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নিজেদের ভূমিকা পালন করে আদর্শ নাগরিকের পরিচয় দিন।” জাতিকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলেছে ভাবতে ভাবতেই তার চিরপরিচিত মেসের স্নানঘর এবং গোলগাল চেহারার চশমা পরিহিতা এক তরূণীর সমগ্র শরীরের ছবি ভেসে আসলে নিজের মধ্যে আলোড়ন টের পেলো। ল্যাম্পপোস্টের কাছে সাধারণত পেশাব করে কুকুরে। সে তাদের থেকে এমন ব্যতিক্রমই বা কি? তার কাছে আগাতে আগাতে জিপারে হাত দিয়ে একবার আশেপাশে তাকিয়ে সে হো হো করে হাসতে শুরু করলো। উজ্জ্বল আলোকিত শহরকে একটু ফ্যাকাশে বিবর্ণ দেখালো কি? সেটা বোঝা গেলোনা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.