নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঈশ্বরের সমীপে

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ভোর ৬:৪৭

ঈশ্বর,

কখনো চিন্তা করিনি আপনার সমীপে কিছু লিখবার পরিস্থিতি আসবে। এই অদম্য বাস্তবতার চিত্রটুকু আমার জন্য তেমন সুখকর নয়। আশা করি আপনি বিব্রত হচ্ছেন না। হবার কথাও না। আপনি মহানের চাইতেও মহান। নির্দিষ্ট কাউকে নিয়ে বিচলিত হয়ে সমগ্র জগত, যার পরিচালনার বিপুল দায়ভার আপনার অদৃশ্যমান কাঁধে ন্যস্ত তাকে আপনি এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশতম সময়ের জন্যেও নিঃসঙ্গ ছেড়ে আসতে পারেন না। যদিও আমি, পাঁচ ফুট সাড়ে ছয় ইঞ্চি, বাসে উঠে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে কিংবা বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফিরবার সময়ে যাকে সবাই চোঁখ দিয়ে গিলে খায় সেই ঋজু নিটোল শরীরের এই আমি বরাবরই নিঃসঙ্গ থেকে গেছি। জানিনা আপনার এই প্রশ্নাতীত কারসাজিতে অন্য কারো নিঃসঙ্গতা দূর হয়েছে কিনা। আমি এও জানিনা আমার প্রতি আপনার এই বিবেচনায় অন্য কোন মনুষ্যপ্রাণী উপকৃত হয়েছে কিনা। আমি এসবের কিছুই জানিনা। আমি এই মুহূর্তে, এই ঘোর লাগা এবং একই সাথে নিজেকে বিদীর্ণ করে দেওয়া মুহূর্তে শুধু এটুকু বলতে পারি আপনার উদ্দেশ্যে লিখতে গিয়ে আমার ডান হাতের প্রতিটি রেখা-উপরেখা কেঁপে উঠছে। আমি মাঝেমাঝেই অপলক চোঁখেই চেয়ে আছি ফ্যানের ব্লেডগুলোর দিকে। গতো পরশুদিন নিজে সেগুলোকে পরিষ্কার করেছিলাম। আজকে সেই সাদা ব্লেডগুলোকে কি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে !!! সাথে অচেনাও মনে হচ্ছে। ব্লেডগুলোকে আমি নোংরা দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। অভ্যস্ততার সাথে এই বিচ্ছেদে নিজেকে কেমন যেন মনে হচ্ছে। যেন ব্লেডগুলোর কাছেও আমি অপাংক্তেয় হয়ে উঠেছিলাম ।

অথচ নিজেকে পারিপার্শ্বিকতার থেকে এমন বিচ্ছিন্ন হিসাবে আবিষ্কার করার কথা ভাবতেই পারতাম না বিস্মৃত হওয়া সুদূর অতীতে। তখন জীবনে নিরবচ্ছিন্ন উদ্বেগ ছিলোনা। ক্রোধ এবং অক্ষমতার দোলাচলে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার আত্মপ্রতারণা ছিলোনা। সন্ধ্যা হলে সবার চোঁখ এড়িয়ে সামান্য একটা আমড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তার সাথে কথা বলার আকুলতা ছিলো। ইঁচড়ে পাকা ছিলাম বরাবরই। বয়সেরও তুলনায় অনেক বড়দের উপন্যাস পড়ে কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে একাকার করে দিতাম। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলাম। অংক করতে অসম্ভব ভালো লাগতো। তখন ইচ্ছা হয়েছিলো বড় হয়ে বিজ্ঞানী হবো। স্বপ্ন স্রেফ দেখা মাত্রই। দিগন্তে আর চোঁখ প্রসারিত হয় কোথায়? এই বঞ্চনার দুঃসহ ভার আরো অনেকে বয়ে বেড়ায় নিত্যদিন এতেই সান্ত্বনা খুঁজে নিয়ে নিজেকে সামলে রাখতে হতো। কি নিদারুণ পরিণতি আপনার সৃষ্ট সেরা জীবের। চিনিনা জানিনা এমন অনেক মানুষের বঞ্চনার কথা ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিতে হতো। অদেখা যাদের কথা বলছি তারাও নিশ্চয়ই এমন করেই ভাবে। আমি তাই মনে করি। আমি বিশ্বাস করি আপনারই সৃষ্ট জীবেরা পরস্পরের গ্লানির মধ্যে নিজেদের সন্তুষ্টি খুঁজে নেয় তার সমগ্র অপমান কেবল আপনারই। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বহন করারর জন্যেও আলাদা একটা নার্ভ তৈরী করতে হয়। একসময় সেই নার্ভেও চিড় ধরতে শুরু করে। যখন উপলব্ধি করলাম তখনই লিখতে বসলাম। আপনার উদ্দেশ্যে। আপনার কাছে যা অর্থহীন। আমার কাছে যা জীবনের সম্পূর্ণ অর্থহীনতাকে প্রকাশ করবার সর্বশেষ অর্থপূর্ণতা।

আমরা নাকি জাতিগতভাবেই গল্পবাজ। আমার বাবা বেঁচে থাকতে প্রায়ই রসিকতা করতেন এই বলে যে দশজন জন বাঙ্গালী যদি স্বচক্ষে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে দেখে তবে তাদেরকে আলাদা আলাদা করে জিজ্ঞেস করলে দশ রকমের বর্ণনা শোনার অভিজ্ঞতা হবে। আমার বাবা স্বপ্নালু চরিত্রের মানুষ ছিলেন। নাইলে আগেই বুঝতে পারতেন ঘুষের মিথ্যা মামলায় চাকরী চলে যাবার পরে একদিন ভোরে যখন তাকে তার স্ত্রী, সন্তানেরা সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত আবিষ্কার করবে তারপর থেকে সমাজের চোঁখে তারা প্রত্যেকেই ঘুষখোরের সন্তান বলে পরিচিত হবে। আপনি বিব্রত হচ্ছেন কি? দয়া করে তা হবেননা। আমার বাবার অনতিক্রম্য সেই ট্র্যাজেডী নিয়ে আমার বিশেষ কোন অভিযোগ নেই। না অভিযোগ আছে আমার চিরকালের শক্ত মা স্বামীর আত্মহত্যার বেদনায় লীন হবার দুই বছরের মাথায় নিজেও প্যারালাইজড হয়ে পড়েন সেই নিয়ে। আমি আজকে শুধু আমার নিজস্ব বেদনার কথা বলতে চাই। হোক নিজের মা কি বাবা অন্য কারো বেদনা নিয়ে অনুযোগ করবার মতো মহত্ব আমার মাঝে আর অবশিষ্ট নেই। এই বাস্তবতাকে নিজের মাঝে ধারণ করে সামান্য একটু রক্তক্ষরণও যদি আপনার হয় তার প্রতি সবিনয়ে প্রণাম জানাবো। আমার চাহিদা এই অবিমৃষ্যকারী বর্তমানে এতোটাই নীম্নমুখী।

বিয়ে করেছিলাম। এই চূড়ান্ত সময়ে এসে ভালোবাসা শব্দটি উচ্চারণ করার আস্পর্ধা দেখাতে চাইনা। বিয়েটা ছিলো শুধুমাত্র হিসাবের। সকল জৈবিকতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার তাড়নাজাত হয়ে। আমড়া গাছের নিচে সকলের চোঁখ এড়িয়ে গাছের সাথে একা একা কথা বলার সেই অপাপবিদ্ধ ইচ্ছাকে কবেই ফেলে এসেছি। একজনকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম। সকল স্বপ্নই মিথ্যা। সে কখনো বোঝেনি। আমি জেনে এসেছি। প্রথম দিন থেকেই। তাকে নিদারুণ বাস্তবতার মাটিতে আছড়ে ফেলার পরে তীব্র আনন্দ হয়েছিলো। পাশবিক আনন্দ। আমিও কাউকে হতাশায় ডুবিয়ে দিতে পারি। কারো জীবনের গতিপ্রকৃতি চিরকালের জন্য বদলে দিতে পারি। আমিও কিছু পারি। কি ব্যাখ্যাতীত অসহায়ত্ব সমগ্র সত্তাকে গ্রাস করে নিলে মানুষ বিনা রক্তপাতে এতোটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। আমি হয়ে উঠেছিলাম। প্রতিনিয়ত নিজেকে রক্তাক্ত করে। কাউকে জানাতে পারিনি কারণ জানাতে না পারার এই শাস্তিই আমার জন্য শিরোধার্য এই সত্যকে মেনে নিয়েছিলাম।

সকল প্রকারের পার্থিব হিসাব নিকাশ সেরে যাকে বিয়ে করেছি সে সাত সকালেই কর্মস্থল নামক ছোটখাটো সেই চিরস্থায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে গেছে। সানন্দেই গেছে। নিঁখুত আঙ্কিক জীবনের ছক কি কেবল আমিই কষে চলি? মোটেও নয়। সেই মানুষটাও ভিন্ন কিছু করেনি। আমার সৌন্দর্য, খোদ আমি নিজে তার সবদিক থেকে সফল জীবনে একটি ট্রফি মাত্র। যাকে কোনকালেই ঝাড়পোছ করার প্রয়োজন পড়েনা। আমি আপনাকে চিঠিটি লিখতে না বসলে আরো কতোকাল এই নীরব কিন্তু সুতীব্র মিথ্যার বেসাতির মাঝে বাস করতে হতো কে বলতে পারে। বাড়ি থেকে টুকটাক কিছু জিনিস কিনতে বেরিয়েছিলাম। কেনাকাটা শেষে প্রধান সড়ক পেরিয়ে পরিচিত একটি গলি চোঁখে পড়লো। এই শহরে এমন রাস্তা থাকাটাই আশ্চর্যের। দুই পাশে কেবল গাছ আর গাছ। এমন সময়েই ঘটনাটি ঘটলো। আমি এতোক্ষণ কি তীক্ষ্ণ চোঁখে সবকিছু দেখছিলাম কিন্তু সেই দৃষ্টি ঝাপসা হতে দেরী হলোনা। একদিন যাকে অবিরাম মিথ্যা সব স্বপ্নের মাঝে দমবন্ধ করা পাখির মতো রেখে দিয়েছিলাম, যার অজস্র ছটফট করা রাতের কারণ ছিলাম সে রিকশায় আমারই সমবয়সী হবে একজনের সাথে হাসতে হাসতে রিকশা করে যাচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই তার সেই সঙ্গিনী কোন দিক থেকেই আমার ধারেকাছেও আসেনা। কিভাবে কিভাবে যেন তার চোঁখ আমার দিকে পড়লো। আমি ক্ষণিকের মধ্যেই দেখে নিলাম সেই দৃষ্টিতে অভিমান কি রাগের পাতলা তরল ছায়াটুকুও ছিলোনা। সেই দৃষ্টির সমগ্রতায় শুধুমাত্র নির্লিপ্ততা। বিদ্রুপে উদ্ভাসিত হওয়া নিষ্পৃহতা। আমি এই দৃষ্টির সম্পূর্ণটুকু চিনি। নিজের শরীরের প্রতিটি তিলকে যেভাবে চিনি।

বাসায় ফেরার পরে আয়নায় কতক্ষণ যে নিজের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছি। নিজেকে ঘৃণা করে বাঁচতে চেয়েছি কতো দীর্ঘ সময় হলো। আয়নায় নিজেকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখতে দেখতে একটি আমড়া গাছের জন্য প্রবল তৃষ্ণা হলো। একটি আমড়া গাছ, সন্ধ্যাবেলা বাবা ফিরে আসলে তার কর্মস্থলে ঘটে যাওয়া মজার মজার সব ঘটনা আগ্রহ নিয়ে শোনা, রাতেরবেলা সমগ্র শহর ঘুমিয়ে পড়লে নিজের বুকের ভেতরে অস্পষ্ট আবছা কিছু স্বপ্নের দ্রিমদ্রিম শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠা, এর সব আমার সকল চৈতন্যকে গ্রাস করে নিলো। যখন উপলব্ধি করলাম অনিবার্য সত্যকে চুলের কাঁটাকে চোঁখের সামনে রেখেছিলাম। একটি আঁচড়ও বসাতে পারিনি।

চুলের কাটা দিয়ে পারিনি বলে আমার অক্ষমতা নিয়ে কটাক্ষ করবেন না। একগাদা ঘুমের ওষুধ আনিয়ে নিয়েছি। আজকাল ফার্মেসীগুলাতে সহজে ঘুমের ওষুধ দিতেই চায়না। শুরুতেই সন্দেহের চোঁখে তাকায়। পরনের বেশ একটু আলুথালু করে নিতে আর গলায় মাদকতা আনতেই অবশ্য কাজ হয়ে গেছে। শেষ কিছু মুহূর্ত, এখনো অভিনয় ছাড়া আমাকে কেউ গ্রহণ করতে চাইলোনা। এক জোড়া নির্লিপ্ত নিষ্পৃহ চোঁখ পর্যন্ত আমাকে তুমুলভাবে হারিয়ে দিয়ে গেলো।

আপনার কাছে বলার আর তেমন কিছু রইলোনা। কিছু ঘন্টা পরেই আমার আঙ্কিকজীবনের অংশীদার বাড়ি ফিরে এক জোড়া নিষ্পলক চোঁখ আর একটি নিথর শরীরকে আবিষ্কার করবে। তাকে বিশেষ ঝামেলা পোহাতে হবেনা। সুন্দর একটা সুইসাইড নোট লিখে দিয়ে যাবো। ছয় মাস কি এক বছরের মাথায় নিশ্চয়ই কেউ না কেউ আমার স্থলাভিষিক্ত হবে। হবেই। তা নিয়ে মন খারাপের কিছু দেখিনা। বরং ভালোই হবে। আমি এর চাইতে আর কিই বা প্রত্যাশা করতে পারি?

আপনার কাছে শেষ একটা কথা। চুলের কাঁটাটা চোঁখের সামনে রাখবার সময় একটু কেঁদেছিলাম। আপনার ইচ্ছা হলে কাউকে জানাবেন।

বিনীতা

নামহীন পরিচয়হীন জীবনহীন

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.