নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শিউলী ফুল এবং অন্যান্য

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৩:০৯

২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখ, বিশেষত্বহীন একটি দিবসে সদরঘাট টার্মিনালের একটি লঞ্চ, যা রাত এগারোটার সময়ে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করবে তার উপরে দাঁড়িয়ে রাত ৮টা বেজে ৩৮ মিনিটে তৌফিক ঠোঁটে সিগারেট ধরায়, নিচে থাকা নিস্তরঙ্গ রাশি রাশি জলের মাঝে সিগারেটের সেই আগুনকে বড্ড বিবর্ণ দেখায়; জলের ছায়ায় তৌফিকের মুখের রেখা-উপরেখাসমূহগুলো বরাবরের মতোই প্রতিক্রিয়াহীন বলে মনে হলেও তৌফিকের মগজের ভেতর প্রবেশ করবার সাধ্য দ্বিতীয় কোন মানবের হলে সে দেখতে পেতো তৌফিকের মুখের রেখাসমূহ বাহ্যিক আবরণে যতোটাই নিষ্পৃহ তার ভেতরটা সম্পূর্ণ বিপরীতভাবেই উচাটন। তৌফিক সিগারেটে গুনে গুনে সাড়ে ৭টি টান দেয়, অতঃপর সিগারেটটি নিচে পানির মাঝে ছুঁড়ে দেয়, অথৈ পানির অস্তিত্বের মাঝে সিগারেটের অবশিষ্টাংশটুকু বিলীন হয়ে যায়, আবার হয়না কেননা সেই সিগারেটের শেষ টানটির মাঝে তৌফিকের মোটা ঠোঁটজোড়ার স্পর্শ ছাড়াও অস্থির, উচাটন, ভেতরে ভেতরে উন্মাতাল মনের মাঝে অবিরাম ঘুরতে থাকা একটি শিউলী ফুলের সুবাসের ঘ্রাণ জড়িয়ে ছিলো; তৌফিক হাতের কড়ে আঙ্গুল গুনে গুনে স্মরণ করতে পারে শিউলী ফুলটির সাথে তার পরিচিয় হয়েছিলো ২০১৪ সালের মে মাসের ১৯ তারিখে, অবিস্মরণীয় সেই মায়াবী বিকালবেলায় মল চত্ত্বরের সামনে দিয়ে একা হাঁটতে হাঁটতে সে ঝগড়ারত এক যুগলের বাক্যালাপ শুনতে পায়, কলহরত নারীটি তার সঙ্গীকে বারবার অনুরোধ জানায় তাকে ভুলে যেতে, কারণ হিসাবে সে দেখায় তার পরিবার বিয়ের জন্য তার উপরে এমনই অনতিক্রম্য এক চাপ সৃষ্টি করেছে যেই বাস্তবতাকে সে কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারেনা। পুরুষসঙ্গীটি সবই শোনে, কিন্তু সদ্যই শ্রবণইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছানো বাক্যমালার কিছুই মেনে নিতে তার ভগ্ন হৃদয় প্রস্তুত থাকেনা, সে প্রথমে নিজের দুর্বল অবস্থার কথা জানিয়ে সঙ্গিনীকে আরেকটিবার তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করে, সেই অনুরোধে কাজ না হলে পুরুষ মানুষটির দুই চোঁখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল পড়তে আরম্ভ করে; তৌফিকসহ উপস্থিত প্রত্যেকেই ঘটনাটি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে হতভম্ব হয়ে যায়; উপস্থিতদের সামনে বিব্রত হয়েছে উপলব্ধিতে আসলে এবারে উপস্থিত প্রত্যেককে সম্পূর্ণ বিপরীত আঙ্গিক থেকে হতম্ভব করে পুরুষসঙ্গীটি তার সদ্যই সাবেক হতে যাওয়া সঙ্গীনীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠে “যা মাগী চুদলাম না তোর ভালোবাসা। এতোদিন ধইরা চ্যাটের ভালোবাসার কথা শুনাইছোস আমারে। দুই বছর হইলো প্রেম করতেছি, একবারও ‘ওইটা’ করতে দেসনাই আমারে। এতো কইরা তোরে অনুরোধ করছি, কইতে গেলে তোর পায়ে পড়ছি কিন্তু তুই কথা শুনোসনাই। জানি তো আকমল ছ্যামড়াটারেই যা দেখানির দেখাইছোস, খুইলা খুইলা সব দেখাইছোস। জানি আমি সবই জানি। আমারে বেকুব পাইছোস? তাও তোর কাছে আইছি। বারবার আইছি। তোরে ভালোবাসি দেইখা। কিন্তু তুই আমার ভালোবাসা বুঝলিনা রে। তুই আমার ভালোবাসা বুঝলিনা। আমারে শিরিন এতো ভালোবাসে। আমি তোরে ভালোবাসি জাইনাও আমারে নিজের ভালোবাসার কথা কেমনভাবে কইতে পারে। তাগো বাসায় গেলে ফাঁকা পাইলেই আমারে কাছে ডাকতে চাইছে। আমি তার কাছে যাইনাই। আইজকাই যামু। এই এখন তোরে লাত্থি দিয়া যদি আমি শিরিনের কাছে না গেছি তাইলে আমার নাম মোসাদ্দেক না।” কথাগুলো বলার সাথে সাথে লম্বা লম্বা পা ফেলে মোসাদ্দেক প্রস্থান করলে তৌফিকসহ উপস্থিত প্রত্যেকে এবারে বিস্ফোরিত হয়; একবিংশ শতাব্দীতে বাস করে এরকম কুরুচিপূর্ণ কথা জনসমক্ষে কেউ বলতে পারে এই বিস্ময়বোধের সাথে পরিচিত হয়ে তারা বিমর্ষবোধ করে নাকি অকপটভাবে নিজের কথা এতোটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে তাদেরকে নিজেদের এই অক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রত্যেকে ক্ষিপ্ত হয় বোঝা যায়না; তৌফিকের আসলে কি অনুভব করা উচিত এই বিষয়ে চিন্তা করতে করতে হঠাৎ সে দেখতে পায় গটগট করে লোকটি প্রস্থান করতে থাকা অবস্থায় তার কালো রঙের প্যান্টের পকেট থেকে একটি আধময়লা শিউলী ফুল গড়িয়ে মল চত্ত্বরের পাকা রাস্তার মধ্যে পড়ে যায়; ততোমধ্যে সকলের সামনে চূড়ান্ত্রমাত্রার বিব্রত হওয়া সেই নারী অপমানিত মুখে ঠিক উল্টাদিকে হাঁটা ধরেছিলো, উপস্থিত বাকি সবাই পুনরায় নিজেদের সঙ্গী/সঙ্গিনীর সাথে নিজেদের প্রাণ কৃত্রিমভাবে কি অকৃত্রিমভাবে মেলাবার কাজে ব্যাপৃত হয়ে পড়েছিলো বলে তাদের কেউই আধময়লা সেই শিউলী ফুলটি লক্ষ্য না করলেও যেহেতু তৌফিক ফুলটিকে মাটিতে পড়ে যেতে লক্ষ্য করেছিলো কাজেই কোন এক অজানা কৌতূহলে কিংবা সেই মুহূর্তে তার ভেতরকার কোন বেদনাবহ নিঃসঙ্গতা কি কোন অচেনা নস্টালজিয়া কি কোন চকিত সময়ের স্মারককে ধরে রাখবার আকুল ইচ্ছায় সে শিউলী ফুলটির দিকে পা বাড়ায়; সেই সময়ে আচমকা সকলকে আতঙ্কগ্রস্ত করে মে মাসের ১৯ তারিখ, যা সেই মুহূর্ত পর্যন্তও একটি বিশেষত্বহীন দিবস বলে বিবেচিত ছিলো সেই সময়ে ভিসির বাড়ীর সামনে গোটা তিনেক ককটেল ফুটে, সেই শব্দ টিএসসি পর্যন্ত অত্যন্ত মৃদু শব্দে পৌঁছালেও সেখানে আড্ডারতরা স্বভাবসুলভ আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে করতে বিচিত্র সব জায়গায় চলে যায়। কেউ সরাসরি টিএসসির ভেতরের টয়লেটে গিয়ে আশ্রয় নেয়, অনেকেই সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সঙ্গী/ সঙ্গীনীসহ গিয়ে গাঁজার উৎকট গন্ধের মাঝে নিরাপত্তা খুঁজে ফেরে, আবার অনেকেই দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘটনাস্থল সোজা ভিসি চত্ত্বরের সামনেই চলে আসে, সেখানে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকা অপ্রস্তুত পুলিশ বাহিনী এদের কাউকে কাউকে দেখে, কিন্তু তারা ছাত্রছাত্রী বলে তাদের সেখানে উপস্থিত হওয়াটা পছন্দের না হওয়া সত্ত্বেও পুলিশবাহিনী স্বভাববিরুদ্ধভাবে আপাত মোলায়েম কন্ঠে তাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠে “আপনারা এইখানে আইছেন ক্যান? মাত্রই ককটেল ফুটছে। যান যান তাড়াতাড়ি অন্যদিকে যান।” কিন্তু সেদিন ২০১৪ সালের মে মাসের ১৯ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সাপেক্ষে ঘটে যাওয়া এইসব সাধারণ ঘটনাবলী সম্পর্কে সেদিন তৌফিক কিছু জানতে পারেনা। ভিসির বাড়ির সামনে যেই মুহূর্তে ককটেল ফুটেছিলো সেই সময়ে তার হাতে থাকা আধময়লা সেই শিউলী ফুল নিয়ে সে দৌড়ে সোজা চলে গিয়েছিলো শাহবাগ, মিনিট দশেক দৌড়াতে হয় বলে তার ক্রমশই স্ফীত হতে থাকা ভুঁড়ি থরথর করে কাঁপে, মিনিট পাঁচেক ধরে সে কেবলই হাঁপাতে থাকে; স্ফীত ভুঁড়ি সমেত তার হাঁপানোর দৃশ্য দেখে সেই মুহূর্তে শাহবাগ থেকে রিকশা করে কার্জন হলের উদ্দেশ্যে যেতে যেতে ছয় বছর বয়সী এক বাচ্চা মেয়ে ফিকফিক করে হেসে ফেলে; সেই হাসিতে তার সাদা ঝকঝকে দাঁত সমেত তার অন্তর্গত হৃদয়ের সমগ্র নির্মলতা স্পষ্ট দেখা যায়; ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৪ তারিখে নতুন করে তৌফিকের সব মনে পড়ে যায়, মল চত্ত্বরে নিজের চোঁখে দেখা সেই যুগলের ঝগড়ারত দৃশ্য, প্রস্থানরত পুরুষ সঙ্গীটির পকেট থেকে পড়ে যাওয়া আধময়লা শিউলী ফুল, ভিসির বাড়ীর সামনে ককটেল ফুটলে মুহূর্তের মাঝে চারপাশে আতঙ্কের সৃষ্টি হওয়া, তৌফিকের এক দৌড়ে শাহবাগ চলে গিয়ে কম্পমান ভুঁড়িসমেত মিনিট পাঁচেক হাঁপাতে থাকা দৃশ্যাবলীর সবই তাকে নিজের অজান্তেই মনে করিয়ে দেয় তৌফিকের প্রতি ইরার নিষ্পৃহ কন্ঠ; ইরা যেন কোন নিষ্ঠাবান প্রাবন্ধিক কাঠ কাঠ নিরেট গদ্যে তার ছাত্রছাত্রীদের উনিশ শতকের বাংলার তথাকথিত নবজাগরণ কি কি কারণে অতিকথনের ভিড়ে একটি অন্তঃসারশূন্য ফাঁপা ধারণা ছিলো মাত্র এমন নির্মোহভাবে তৌফিককে জানিয়ে দেয় তার প্রেমের প্রস্তাবে ইরা সাড়া দিতে অপারগ; কথাগুলো নির্মোহভাবে বলার সময়তেও ইরার চোঁখের কোমলতা তৌফিকের নজর এড়ায়না, তার মনে পড়ে যায় মল চত্ত্বরের সেই প্রেমিক পুরুষটির মতো কর্কশ কি গ্রাম্য ভঙ্গিতে না হলেও নিজের আয়ত্তাধীন চৌকস ভঙ্গীতে যদি ইরার সিদ্ধান্তকে সে পুনর্বিবেচনার দিকে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু তৌফিককে কোন সুযোগ না দিয়েই তাকে হকচকিত করে ইরা ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হলে তার ব্যাগের একটি দিক খোলা ছিলো বিধায় সেখান থেকে পাঁচ টাকার একটি খুচরা নোট, গোটা দুয়েক টিস্যু পেপার এবং তৌফিককে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে একটি আধময়লা শিউলী ফুল শাহাবুদ্দীন মামার চায়ের দোকানের নিচে যেই এবড়ো থেবড়ো মাটি আছে তার মাঝে পড়ে আরো বেশী ময়লা হয়ে যায়। বিহ্বল তৌফিকের তখন মনে পড়ে যায়, মে মাসের ১৯ তারিখে যেই আধময়লা শিউলী ফুলটি সে কুড়িয়ে নিয়েছিলো সেই দিনকার পরিহিত প্যান্ট লন্ড্রিতে দেওয়ার সময়ে পকেট থেকে ফুলটি সে তুলে নিতে ভুলে গিয়েছিলো; তৌফিকের মনে হয়েছিলো ইরা এবং আধময়লা শিউলী ফুলের এই কাহিনী বুঝি আর কখনো তার জীবনে প্রত্যাবর্তন করবেনা। কিন্তু ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখ, বিশেষত্বহীন সেই দিবসে সদরঘাট টার্মিনালে এক বন্ধুকে পৌঁছে দিতে এলে তার সাধ হয় এখনই ছেড়ে দেবেনা এমন একটি লঞ্চের উপরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিচে প্রবাহিত হওয়া জলরাশি দেখতে দেখতে সে একটি সিগারেট টানবে। রাত ৮টা বেজে ৩৮ মিনিটে সে সিগারেট ধরালে তার এক মিনিটের ভেতরে বারো গজ দূরত্বে পেছনে সম্ভবত তার মতো কৌতূহলী হয়েই এক মা এবং তার আট বছর বয়সী একটি ছেলে রাত এগারোটার সময়ে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চটির উপরে উঠে দাঁড়ায়। বাচ্চা ছেলেটি তৌফিক, দুই চোঁখ সামনে ছড়ালে প্রবাহিত হওয়া নিস্তরঙ্গ, নিষ্পৃহ উদাসীন জলরাশি, সদরঘাটে চলাচলরত প্রতিটি সরল, আধা সরল, ধূর্ত , টাউট চরিত্রের কাউকেই তোয়াক্কা না করে বলে উঠে “আম্মা এই দেখো, বাসে পায়ের পিছে কিছু শিউলী ফুল পাইছিলাম। সেগুলারে এই আলোয় কি উজ্জ্বল দেহায় !” তৌফিক সিগারেটে গুনে গুনে সাড়ে ৭টি টান দেয়, অতঃপর সিগারেটটি নিচে পানির মাঝে ছুঁড়ে দেয়, অথৈ পানির অস্তিত্বের মাঝে সিগারেটের অবশিষ্টাংশটুকু বিলীন হয়ে যায়, আবার হয়না কেননা সেই সিগারেটের শেষ টানটির মাঝে তৌফিকের মোটা ঠোঁটজোড়ার স্পর্শ ছাড়াও অস্থির, উচাটন, ভেতরে ভেতরে উন্মাতাল মনের মাঝে অবিরাম ঘুরতে থাকা একটি শিউলী ফুলের সুবাসের ঘ্রাণ জড়িয়ে ছিলো; তৌফিক হাতের কড়ে আঙ্গুল গুনে গুনে স্মরণ করতে পারে শিউলী ফুলটির সাথে তার পরিচয় হয়েছিলো ২০১৪ সালের মে মাসের ১৯ তারিখে।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:১৩

ফ্লাইং সসার বলেছেন: জটিল বাক্যে রচিত গল্প খানা ভালই লাগল।

২| ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৯:২৩

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: মনে হল, শহীদুল জহিরের কোন গল্প পড়লাম

৩| ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৯:২৪

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: গল্পটা ভাল লেগেছে

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.