![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রিকশাওয়ালা কৌতূহলী চোঁখ নিয়ে তার দিকে তাকায়। সে ভাবান্তরহীন। শূন্য অভিব্যক্তি দেখে রিকশাওয়ালা নিজেই প্রশ্ন করে “যাবেন”? এই প্রথম রিকশাওয়ালার দিকে সে পূর্ণ চোঁখে তাকায়। সমগ্র রাস্তায় মিটিমিটি আলো জ্বলছে। যানবাহনের চিরাচরিত আওয়াজ, পূজা উপলক্ষ্যে ধুমধাড়াক্কা হিন্দী গান, রাস্তায় চলাচলরত পথচারীরা সন্দেহমাখা দৃষ্টি নিয়ে অপরিসীম নিরাসক্ততায় হেঁটে যাচ্ছে। ক্লান্তিহীন। বিনা অভিযোগে।
সে রিকশাওয়ালাকে শরীরী ভাষাতেই প্রত্যাখ্যান করে। কথা বলাটা অসম্ভব পরিশ্রমের কাজ। এই সাধারণ বৈজ্ঞানিক সত্যটা মানুষজন বুঝতে আগ্রহী হয়না। সময়ে সময়ে সে নিজেও সত্যটা বুঝতে অনিচ্ছুক থাকে। আজকে এমনিতেই সারাদিনে অনেক কথা বলেছে। অফিস থেকে শুরু করে এই যে মুন্নীর সাথে তিন ঘন্টা সময় কাটিয়ে এখন দীর্ঘ পথ হেঁটে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে সেই সময়টুকুতেও সে কম কথা তো বলেনি।
হাঁটতে হাঁটতে অসাবধানী হয়ে গিয়েছিলো। ডান পায়ের স্যান্ডেলটা এবড়োথেবড়ো রাস্তায় আটকালে দেখতে পায় সে এই মুহূর্তে রাস্তার যেই জায়গা দিয়ে হাঁটছে তার গা ঘেঁষে প্রাইভেট কার থেকে শুরু করে লেগুনা, সিএনজি সবই চোঁখের পলকে পেরিয়ে যায়। সেগুলোর কোন কোনটা যে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে তার শরীরের উপর দিয়েই চলে যাবেনা সেই নিশ্চয়তা দুপুরের প্রখর আলোতেও দেওয়া যায়না। এই আলোকজ্জ্বল কোলাহলে পূর্ণ গতানুগতিক যান্ত্রিক রাতে সে নিজেই সড়কের যানবাহনগুলোর কাছ থেকে কোন নিরাপত্তা প্রত্যাশা করেনা।
ক্রমশ নিজের কাছ থেকেই সে প্রত্যাশা করা ছেড়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় কোন মানুষের কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করতে গেলেই দ্বিতীয়বারে সে চিন্তা করে। সেখানে কাউকে তোয়াক্কা না করেই আইনের মতো নিজ গতিতে এগিয়ে যাওয়া যান্ত্রিক যানবাহনের কাছ থেকে প্রত্যাশা? রসিকতাই বটে। সে ফুটপাথে চলে আসে। হাঁটার কায়দায় অভ্যাসে এসে যাওয়া নাগরিক আনুগত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। একটা যাত্রীবোঝাই বাসকে সে পেরিয়ে যায়।
সামনের থেকে ডানে মোড় নিতে হবে। ডান হাতের কবজি একবার ঘুরিয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। অনেক দীর্ঘ সময় হেঁটেছে। অনেকদিন হলো এতোক্ষণ হাঁটেনা। অথচ দ্রুত বাসায় ফিরতে পারলেই সে হাফ ছেঁড়ে বেঁচে যায়। বিদায় নেওয়ার সময়ে মুন্নী অনেকবার করে বলছিলো যেন সে রিকশা করে বাড়ি ফেরে। সে হ্যা কিংবা না কিছুই বলেনি। শেষ সময়ে সেই কথাটুকু পর্যন্তও তার বলতে ইচ্ছা করেনি।
“খানকির পোলারে ধর। আইজকা অর একদিন কি আমাগো একদিন। পিডাইয়া পাছার চামড়া তুইলা ফালামু। চুতমারানী পোলা তোর মায়েরে………ওই তোরা কেউ হালারে বান। ঠিকভাবে বানবি। আমি লাঠি লইয়া আনি।” অপরাধীর শরীরের উপর দিয়ে লাঠির মুহূর্মুহ আক্রমণ বইতে থাকে। অপরাধীর চাপা কন্ঠের আর্তনাদ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চাক্ষুস সিনেমার শ্যুটিং দেখছে এমন ভাব করে থাকা নিষ্পৃহ জনতার কৌতূহলী ফিসফাস সবই তার কানে আসে। “তুমি অনেক বেশী কেয়ারলেস সুমন। এরকম কেয়ারলেস হয়ে অফিসে চাকরী করো কেমনে? আমাকে নিয়ে তুমি কোথাও বের হইলেই আমি আতঙ্কে থাকি। বাস না হয় সিএনজির নিচে কোনদিন দুইজনে চাপা পড়ি। সামান্য রাস্তাটাও এতো রেকলেস পার হয় কেউ তোমাকে না দেখলে জানতামই না। বেটাছেলে বেটাছেলের মতো চলাফেরা করবা কিন্তু না…………” তার প্রতিটি ইন্দ্রিয় চারপাশের চলমান ঘটনাবলী ও সংলাপে সজাগ হতে হতে পুনরায় নিষ্পৃহ হয়ে পড়ে। তবু সে একটু থামে। মনঃস্থির করে ঘটনাস্থলের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। সেদিকে হাঁটতে এগিয়ে গেলে দেখে বেশ ভীড় জমেছে। তাকে ডিঙ্গিয়ে এগোবে সেই শক্তি কি আগ্রহ কোনটাই সে পায়না। অতঃপর একমাত্র সম্বল আশেপাশের কাউকে জিজ্ঞেস করা।
“ভাই কি হইছে? এতো চিলাচিল্লি মাইরপিট হইতেছে ঘটনা কি?”
যার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি করা সে বেশ বিরক্ত হলো। কিন্তু পরক্ষণেই জবাব দেয়,
“মোবাইল চুরি করতে গেছিলো। ওইখানে যেই মহিলারে দাঁড়াইয়া আছে দেখতেছেন তার মোবাইল চুরি কইরা দৌড় দিতে নিছিলো। কিন্তু পালাইবার পারেনাই। পাবলিকে ধইরা ধাতানি দিতেছে। পাবলিকরে তো চিনেনাই। আজকে অরে পিটাইয়া তক্তা বানাইয়া ফালাইবো।”
এতো দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় শার্টটা ঘামে বেশ ভিজে গেছে। অনুভব করলো বুক বেশ স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। হার্টবিটের বিশেষ কোন উঠানামা নেই। ডান হাত দিয়ে একবার চুলগুলো কপালের বাম দিকে সরালো।
মাটিতে শায়িত ভিকটিমকে হালকা আলোতে আবছা দেখতে পেলো। অচেতন। ফোলা চোঁখ-মুখ এবং প্রায় নড়চড়বিহীন মধ্যম দৈর্ঘ্যের শরীরটিকে দেখলে তার আর বেশীক্ষণ নিঃশ্বাস নেওয়ার সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্যে হবেনা এই ভবিষ্যতবাণী করলে তা সঠিক হবার সম্ভাবনা অনেক।
সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। আবেগহীন। আক্রান্তের প্রতি কোন প্রকারের আবেগ অনুভব করছেনা তারপরেও।
তার প্যান্টের পকেটকে সচকিত করে মোবাইল বাজতে আরম্ভ করে।
কল রিসিভ করে মৃদু কন্ঠে একবার হ্যালো বলে।
অপরপ্রান্তই কথা যা বলার অবিরাম বলতে থাকে। কথোপকথন শেষ হলে সে অনুভব করে সামনে এগিয়ে চলার রসদ সে ফোনকলটি থেকে পেয়ে গেছে। এখন আর এই কুৎসিত দৃশ্যটি অবলোকন করার কোন অর্থ তার কাছে ধরা দেয়না।
চলে যেতে যেতে আরো একবার শায়িত দেহটির দিকে তার চোঁখ পড়ে যায়।
চিমসানো কালো খর্ব আকৃতির চোঁখজোড়ার রুগ্ন শরীরটি ঘামে ভেজা শার্ট, তীক্ষ্ণ চোঁখ-মুখ অথচ এলোমেলো চুলের ক্লান্ত একটি শরীর দ্বারা সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময়ের জন্য প্রতিস্থাপিত হয়। সেই বিভ্রম কেটে গেলে সে অনুভব করে আচমকাই বাতাসকে উপভোগ করা যাচ্ছে। সন্তুষ্ট চিত্তে সে শার্টের প্রথম বোতামটি খুলে দেয়। আহ, কি ফুরফুরে বাতাস বুকের ভেতরে প্রবেশ করছে !!!
প্যান্টের পকেট থেকে সে মোবাইল ফোনটি বের করে নেয়। ছোট্ট একটি এসএমএস করবে। “I love you”। তার মুখের হাসি বিস্তৃত হয়।
এদিকে পেছনে ফেলে যাওয়া উন্মত্ত ক্রোধান্বিত শহরের একটুকরো চিত্র ক্রমশ আরো উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে।
©somewhere in net ltd.
১|
০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:৫৭
আরণ্যক রাখাল বলেছেন: ভাল