নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

কেতাদুরস্ত

১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:২৩

আর কতক্ষণ বাসে বসে থাকতে হবে কে জানে? রিমা বলে দিয়েছিলো ৬টার মধ্যে পৌঁছে যেতে। ৮টার দিকে কোন না কোন গেস্ট আসবে বাড়িতে সেই কারনে এই সময় বেঁধে দেওয়া।

সুজনের মেজাজ চূড়ান্ত খারাপ। একুশদিন পর হলো আজকে রিমার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। তার স্বামী পাঁচ দিনের ট্যুরে আজকে সকালে মালয়েশিয়া গেছে। সারা বাড়ি ফাঁকা। রিমা আগেই সব বন্দোবস্ত করে রেখেছে। হৃদয় উজাড় করে দেওয়া প্রেম-ভালোবাসার আদান-প্রদান শেষে সুজন মৌজ করে আস্ত একটা ব্ল্যাকের বোতল মেরে দেবে তার প্রতি সেই খেয়ালটুকুও রিমা রেখেছে। সুজন সেই সময়ানুযায়ীই মল্লিক ভাইকে ম্যানেজ করে মতিঝিল থেকে বের হয়েছিলো। তারপরে এদিক ওদিক কোথাও না তাকিয়ে সোজা বাস ধরেছিলো। সারা বাড়ি ফাঁকা এরকম পরিস্থিতিতেই রিমার প্রতি প্রেমের উত্তাপ সে সবচেয়ে ভালো করে অনুভব করে। কিন্তু এই বালের বাস নড়ে তো চড়েনা। সেই ৪টার সময়ে বাম দিকের চতুর্থ সিট, জানালার কাছে বসতে পেরে শরীরের পাশাপাশি মন চাঙ্গা হতে শুরু করেছিলো। এখন বাজে সোয়া পাঁচটা, বাস এসে থেমেছে শাহবাগে। থেমেছে তো থেমেছেই, আর নড়ার নামটুকু পর্যন্ত নেই। এদিকে রিমার সাথে দেখা হবে এই বিষয়টা নিশ্চয়তায় পৌঁছালে পাঁচ দিন ধরে পরা শার্টটার উপরে বেশ সেন্ট মেখেছিলো। সেই ঘ্রাণে ফুরফুর যেই ভাব এসেছিলো শরীরে তার কিছুই বাসের যাত্রীদের ঘামের গন্ধের প্রাবল্যের কারনে আর অবশিষ্ট নেই।

হুড়মুড় করে যাত্রীদের চার থেকে পাঁচজন বাস থেকে নেমে হাঁটতে আরম্ভ করলো। এদিকে পিছন থেকে বাসের ড্রাইভারদের উদ্দেশ্যে ক্ষুব্ধ যাত্রীদের খিস্তিখেউড় অবিরাম চলছে। মল্লিক ভাইয়ের সাথে থাকতে হয় বলে সুজনের কাউকে গালিগালাজ করার সুযোগ দূরের কথা উল্টা নিজেরই গালিগালাজের মধ্যে থাকতে হহয়। মল্লিক ভাইয়ের মুখের মাশাল্লাহ কোন ট্যাক্স নাই। নিজে ফিল্ম লাইনের বহু পুরনো ঝানু মাল। সুজনসহ এসিস্টেন্ট যারা যারাই তার অধীনে কাজ করে প্রত্যেককেই পান থেকে চুন খসলেই ‘তোর মায়েরে বাপ’ দিয়ে শুরু করবে, শেষ করবে আক্রান্তদের বউয়ের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হবার বাসনা প্রকাশ করে। পুরান ঢাকার লোক, জন্মের পর থেকেই কুট্টিদের রাস্তাঘাটে খিস্তি করার দৃশ্য দেখে বড় হতে হতে নিজেই আধাকুট্টি হয়ে গেছে।

বাসে উঠে পড়া একজনের মুখ অনেকের ভিড়েও পরিচিত পরিচিত লাগলো সুজনের। জগন্নাথ না? হ্যা, এইবারে মুখ স্পষ্ট দেখতে পাওয়ায় অনেকক্ষণ পরে এই প্রথম তার মুখের রেখাসমূহ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। জগন্নাথ ছেলেটা তারই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। ছেলেটা বোকা বোকা ধরণের, মিনমিন করে কথা বলে। ক্লাস করতো, ক্লাস শেষেই সোজা হলে চলে যেতো। সহপাঠীদের কারো সাথেই বিশেষ একটা মিশেছে বলে সুজন মনে করতে পারেনা। ক্লাস করার সময়তে সুজন কোনদিনও দেখেনি শার্টের একটা বোতামও খোলা রেখেছে ছেলেটা। একেবারে উপরের বোতামটাও কখনো খুলে রাখতোনা। তারা বন্ধুবান্ধবেরা ছেলেটাকে নিয়ে সময়সুযোগ পেলেই খোঁচাখুচি করে বেজায় আনন্দ পেতো। জগন্নাথ কখনো পাল্টা জবাবও দেয়নি। যাক ভালোই হয়েছে ছেলেটাকে পেয়ে। বাসে আর যেই সময়টুকু অবশিষ্ট আছে এর সাথে দিব্যি গালগপ্পো করে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

সুজন ডাক দেয় “জগন্নাথ”, জগন্নাথ শুনতে পেয়ে তার দিকে তাকায়। মৃদুমন্দ একটা হাসি ঝুলে উঠে তার মুখে। সাথে সাথেই সুজনের পাশের সিট ফাঁকা দেখে নির্দ্বিধায় পাছা এলিয়ে বসে যায়। মোহাম্মদপুরে যাবে। পাশেরজনকে আজীবনই সে রামছাগল ভেবে এসেছে সত্য তাই বলে এতোটা দীর্ঘ পথ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাবার কোন মানে হয়না। সে চিরাচরিত মিনমিনে কন্ঠে সুজনের উদ্দেশ্যে বলে উঠে “কি খবর তোমার? দিনকাল কেমন চলে?”

সুজনের মুখের রেখা-উপরেখাসমূহ আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠে। বহুদিন হলো বন্ধুবান্ধবদের কাউকে কাছে পেয়ে আড্ডা দিতে পারেনা যে একটু খোশগল্প করতে পারে। তার কতো কি যে বলার আছে বন্ধুদের। হোক দূরের কি কাছের। ভেতরে ভেতরে আনন্দে আটখানা হয়েও সুজন তাই রেডিমেইড দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে “খবর আর কি বলবো কও? বন্ধু মানুষ হইলা কিন্তু কোন খোঁজখবর তো রাখলানা। তাই চলতেছে কোন রকমে। আল্লাহ যেমন রাখছে।”

জগন্নাথের মুখে থুথু জন্মে। তারপরেই সাথে সাথে আয়ত্ত্ব করা কৌশলে সেটা গিলেও নেয়। শালার ঢ্যামনা, নাটক-সিনেমার কাজের সাথে থাকতে থাকতে নিজেও নাটক করা শিখে গেছে। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই সভ্য মানুষ, মনের কথা মুখ দিয়ে বলে ফেললে আর সভ্য থাকতে পারবে কি করে? কথা বলারও তো একটা আর্ট আছে, যেনতেনভাবে কিছু বলে দিলেই তো হলোনা। তাই সে প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে প্রশ্ন করে “তা কই যাও? আমি মোহাম্মদপুরে বোনের বাসায় যাইতেছি।”

অনেকদিন পরে কোন বন্ধুর সাথে দেখা হলো বলে যেই কথাগুলো সামনের জনকে শোনানোর জন্য সুজনের জিভ সুড়সুড় করছিলো সেই কথাগুলো বলার সুযোগ এই হাবাগোবা জগন্নাথ নিজে থেকেই বলার সুযোগ করে দিলো বলে তাকে গলা জড়িয়ে একটা চুমু খাওয়ার ইচ্ছা হলো। সুজন নন্সটপ শুরু হয়ে যায়,

“আমি যাবো ধরো এই জিগাতলা। জিগাতলার গাবতলা মসজিদ চিনো তো? ওই যে জিগাতলা কাঁচাবাজারের সামনে যে।” জগন্নাথ মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো “তা তোমার বাজার করতে বাসে করে জিগাতলা যাওয়া লাগবে কেন?” শালার পাছায় যদি কষে দুইটা লাথি দিতে পারতো! সুজনের গাদাগাদি করে রাখা পাজোড়া শক্ত হয়ে যায়। কিন্তু মুখের হাসি ধরে রেখেই সে বলে “আরে পুরা কথা তো আগে শুনবা তুমি। আগেই যদি সব বইলা দাও তাইলে আমি আর কি বলবো?” জগন্নাথ উৎসুক হয় “আচ্ছা আচ্ছা বলো তুমি।” সুজনের রাগ গলে নিমেষেই পানি হয়ে উঠে। “আরে জিগাতলায় এক বিখ্যাত পরিচালক থাকে। ওই যে বৈশাখী টিভিতে নাটক-সিনেমা বানায়। রেদওয়ানুল হাসান। নাম নিশ্চয়ই শুনছো?” এই মালটা কে? আজকাল তো কবিদের থেকেও এইসব পরিচালকদের সংখ্যা অনেক বেশী। ঈদের সময় নিজের বিশ মিনিটের নাটকের জন্য চল্লিশ মিনিটের বিজ্ঞাপন দেখাতে রাজি হয়ে যাওয়া, নায়িকাদের দিয়ে নাকি নাকি সুরে সংলাপ বলানো কোন তালেবর নাকি? জগন্নাথ টেলিভিশন তেমন দেখেনা বলে এদের ব্যাপারে বিশেষ একটা আপডেটেড থাকতে পারেনা। তারপরেও বন্ধুকে আসন্ন বাগাড়ম্বর করার সুযোগ দিতে সে ইতিবাচকভাবে উত্তর দেয় “হ্যা হ্যা চিনি তো। বেশ কয়েকটা ভালো নাটক বানাইছে। আমি দেখছি তার দুই একটা নাটক।”

সুজনের এবারে আর নিজের আনন্দ রাখবার জায়গা হয়না। যাক, গাধাটা টোপ গিলেছে। এবারে সে মনে মনে গুছিয়ে রাখা কথাবার্তাগুলোকে সম্প্রসারিত করতে শুরু করে “হ্যা ঠিক চিনছো। তার কাছেই যাইতেছি। সে পরশুদিন আমারে ফোন দিছিলো। নাম্বার কোত্থেকে পাইছে আল্লাহই জানে। আমি তো ফোন পাইয়া অবাক। কেমনে কি? এরকম হোমরাচোমরা আমার মতো চুনোপুটির নাম্বার পাইলো কেমনে। তারপরে তার সাথে কথাবার্তা হইলে আমারে আজকে তার বাসায় আসতে বললো। সেই জন্যেই মতিঝিল থেকে বাসে উঠছি। ও, আমার কার্ড রাখো একটা।” সুজন কার্ডের জন্য পকেটে হাত দিলো। ধুর বাল, রেখেছে তো পাছার সাথে লাগোয়া পকেটে। বেশ কসরৎ করে পাছার দিকে হাত বাড়িয়ে কার্ড বের করে জগন্নাথের উদ্দেশ্যে সেটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বললো “দেখো তো জগন্নাথ, আমারে সে বলে দিছে যে ছয়টার মধ্যে তার বাড়ি পৌঁছাইতে। কিন্তু এই শালার বাসের যন্ত্রণার জন্য আমার দেরী না হইয়া যায়। তুমি কি বলো? বাস থেকে নাইমা রিকশা ধরুম?”

শালা, ঢপবাজির অভ্যাস এখনো গেলোনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় থেকেই এইসব দেখে আসছে জগন্নাথ। একটা জায়গায় যদি সত্য কথা বলে হারামজাদার যেন জাত চলে যাবে। জগন্নাথ বিলক্ষণ বুঝতে পারে বেটা নিশ্চয়ই কোন না কোন আকাম করতে জিগাতলা যাচ্ছে। নাটকের পরিচালক বাসায় ডেকেছে অল বোগাস। কম সময় হলো মালটাকে সে চেনে? ইশ, যদি কথাগুলা সরাসরি মুখের উপরে বলে দিতে পারতো। কিন্তু সে প্রয়োজনের থেকেও বেশী বিনয়ী হয়ে উঠে “না বাস থেকে নামার কি দরকার? জ্যাম তো ছেড়েই দিলো। সায়েন্স ল্যাব পার হয়ে আসছে কথা বলতে বলতে মনে হয় খেয়াল করোনাই। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে চলে আসবে। আর তুমি তো সেলিব্রেটি হয়ে গেছো, পরে আর কখনো তোমার সাথে বাসে চড়তে পারি কিনা কে জানে।”

পৃথিবীতে আল্লাহ এখনো সরলসোজা মানুষজন পাঠায়। তাদের একজন যে তারই হোক যতোই দূরের বন্ধু পুনরায় উপলব্ধি করে সুজন ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠে। বাস তার গন্তব্যস্থলে দ্রুতই চলে আসায় জগন্নাথের সাথে কথোপকথন আর বেশীদূর গড়ালোনা।

সুজন দরজায় কড়া নাড়তেই একবার ভেতর থেকে সজোরে শব্দ শোনে ‘আসি’। তারপরে আবারো দীর্ঘসময়ের নিস্তব্ধতা। ছয়টাও বাজেনি অথচ চারপাশে কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাড়ির বাইরের একটি বাতিও কেউ জ্বালায়নি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সুজন দুইবার প্রায় আছাড় খেতে নিয়েছিলো।

রিমা নিজেই দরজা খোলে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে “গোসল করতে বাথরুমে ঢুকতে যাবো মাত্র তুমি এসে দরজায় ধাক্কা দিলা। বসো একটু। আমি গোসলটা সেরেই আসতেছি।” রিমার ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দেখতে দেখতে সুজন হৃষ্টচিত্তে সোফায় এসে বসে। পত্রিকাগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখবে নাকি? বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ফেলার পর থেকেই পাঠসংক্রান্ত যাবতীয় কর্ম থেকে সে বলতে গেলে অবসর গ্রহণ করেছে। চাকরীবাকরী সংশ্লিষ্ট ঝামেলা থাকলেও না হয় বিসিএসের গাইড নিয়ে বসতে হতো। পুরনো পত্রিকাগুলো হাত থেকে নামিয়ে রাখতে রাখতেই দেয়ালের দিকে সুজনের চোখ চলে গেলো। আজিব দৃশ্য। ফিরোজা রঙের দেয়ালে বেশ উপরের দিকে, ধুলোর আস্তর জমে জালের মতো হয়ে গেছে সেখানে দুইটি টিকটিকি পরস্পর সঙ্গমরত। সুজন এই দৃশ্য তার চৌদ্দজন্মেও আগে কখনো দেখেনি। টিকটিকি দুইটার একাগ্রতা দেখার মতো। নিজ নিজ জায়গায় স্থানু নিশ্চল হয়ে রয়েছে। অথচ তাদের কি প্রাণময় দেখাচ্ছে। এদিকে বাথরুমের ছিটকিনি খোলার শব্দ হলো। সুজন সেই শব্দ শুনে একটু নড়েচড়ে বসে। ব্ল্যাকের বোতলটা এই মুহূর্তে হাতের কাছে থাকলে ভালো হতো।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪৩

সজিব হাওলাদার বলেছেন: তারপর কি হল?

২| ১২ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:০৮

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন: পরের ঘটনাটা কন! জানার ইচ্ছা জাগছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.