নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

পাগলের স্বপক্ষে

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:৫৩

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সামনে যেই লম্বা অংশটুকুতে মানুষরা (রসিকজনে যুগল শব্দটি ব্যবহার করলেও কোন সমস্যা নেই) বসতে পারে এবং বসে তার সামনে দিয়ে প্রায়শই একজন পাগলকে হেঁটে যেতে দেখতাম। এখনো দেখি। দৃষ্টি আর আগের মতো তীক্ষ্ণ নয় নাকি ঔদাসীন্য সেই বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে না পারলেও এখনো এই বিষয়টি আমার কাছে সত্যই রয়ে গেছে যে পাগলটি অন্তত আমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে।

মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ লোকটির সমগ্র অবয়বে এমন কিছু কখনো খুঁজে পাইনি যাতে তার শারীরিক বর্ণনা করবার সময়ে বিশেষ কিছু যুক্ত করা যায়। বলাই বাহূল্য তার সমস্ত শরীর নোংরা থাকে, মাথার চুল দীর্ঘ এবং সঙ্গত কারনেই তা এলোমেলো। বুক ভর্তি লোমে তবে দীর্ঘদিনের গোসল নেই বলেই সম্ভবত সেই লোমরাজি স্পষ্টতায় তেমন প্রগাঢ় নয়। অনার্সের শিক্ষার্থী থাকাকালীন সময়ে প্রায়শই দেখতাম পাগল লোকটি সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সামনে দিয়ে আশেপাশের কাউকে তোয়াক্কা না করে হেঁটে যেতো। সেই সময়ে আমি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম বললে গল্পকে দীর্ঘায়িত করা যাবে, সাথে অগনিত মিথ্যা উপাদান যুক্ত করে গল্পটিকে পাঠকদের জন্য অপেক্ষাকৃত বেশী আকর্ষনীয় করে তোলাও সম্ভবপর হতে পারে, কিন্তু দিনের শেষে তা মিথ্যাই থেকে যাবে যা অন্তত এই গল্পে হোক তা আমি চাইনা। কাজেই স্পষ্ট সত্য বলে নেওয়া ভালো যে অপ্রকৃতিস্থ সেই মানুষের মুখের দিকে আমি কখনোই চেয়ে দেখিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার প্রতি আমি মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়েছি তার গমগমে বলিষ্ঠ কন্ঠের কারনে। সেই প্রথম দেখা থেকে শুরু করে যতোবারই তাকে দেখেছি প্রতিবারই সমগ্র সমাজের প্রতি তার বিষোদগার স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর বসবার জায়গাটুকুর কাছ ঘেঁষে সে হাকিম চত্ত্বর বরাবর রাষ্ট্রের চলমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাতে জানাতে যেতে থাকলে আশেপাশের অনেককেই দেখতাম তার দিকে করুণার দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে। এই কথা পাঠকদের ভালোভাবেই জানা আছে যে আমরা শুধুমাত্র তার প্রতিই করুণা কি সহানুভূতি নামক অন্তঃসারশূন্য এক ধরণের অনুভূতির প্রকাশে পারঙ্গম হয়ে উঠি যেই ব্যক্তিটির পক্ষে কোনভাবেই আমাদের চাইতে উন্নত হয়ে উঠা সম্ভব নয় বলে আমরা মনে করি। সেই কারনে আশেপাশের নানা জায়গায় চলমান অবস্থায় পরস্পরের সাথে আলাপরত কি বসে থাকা কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেওয়ারতদের সেই দৃষ্টিকে আমি কখনো অস্বাভাবিক কিছু বলে মনে করিনি। সত্যিই করিনি।

পাঠকদের অনেকেই হয়তো বিরক্ত হচ্ছেন এই ভেবে যে লেখক ইনিয়ে বিনিয়ে একজন পাগলকে নিয়ে কিসব যাচ্ছেতাই লিখে তাদের পড়তে এক প্রকারে বাধ্য করছেন। অভিযোগটিকে আমি উড়িয়ে দেবোনা। কোনভাবেই না। আসলেই তো। লেখক সর্বশ্রেষ্ঠ কোন সাহিত্য রচনাই করুক কি ভূষিমাল প্রসব করুক পাঠক তা পড়তে এক প্রকারের বাধ্যই হয়ে থাকে বটে। তারপরেও আমি তাদের অভিযোগের প্রতি বিনীত থেকেই লিখে যাচ্ছি কেননা মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোড দিয়ে একদিন রাতেরবেলায় হেঁটে আসতে আসতে পাগলদের নিয়ে এক বন্ধুর সাথে আমি তর্ক জুড়ে দিয়েছিলাম। আমার মতামত ছিলো পাগলরাই প্রকৃতার্থে সুস্থ, কেননা অস্বাস্থ্যকর বিবমিষাকর এই পারিপার্শ্বিকতাকে তারা সহজভাবে মেনে নেয়নি। এই পরোক্ষ বিদ্রোহে তাদের নিজেদের জীবন নিস্ফলতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলেও দিনের শেষে সেই পরিণতিও এক প্রকারের বিদ্রোহেরই ফসল। আমার বন্ধু আমার সাথে স্পষ্ট দ্বিমত পোষণ করে বলে তাদের বিদ্রোহ অনেক বেশী শক্তিশালী হতো যদি না তারা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ঠান্ডা মাথায় চারপাশের সাথে বিদ্রোহ করতো। সেই রাতে পূর্ণিমা ছিলো, আকাশ উজ্জ্বলতর রুপে নিজেকে সকলের জন্য মেলে ধরেছিলো। রাস্তায় যা কিছু ধুলো ছিলো সেগুলোও শরীরে এসে লাগলে তাকে অনুভব করতে ভালো লাগছিলো। নৈসর্গিক সেই সৌন্দর্যের কারনেই হোক কিংবা যুক্তিপ্রদানে আমার অক্ষমতার কারনেই হোক আমি দ্বিতীয় কোন কথা বলিনি। কিন্তু তারপরেও পাগলদের স্বপক্ষেই আমি নিজের অবস্থানকে ধরে রেখেছি। আরো একবার আজকে তার প্রমান পেলাম যখন সন্ধ্যাবেলা দোয়েল চত্ত্বর দিয়ে রিকশা করে শাহবাগে যেতে যেতে এই শীতের মাঝে দৃষ্টি যতোদূর যেতে পারে সেই পর্যন্ত প্রসারিত করতে করতে মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ সেই মানুষটির দিকে চোখ গেলে তার দিকে তাকিয়ে তার বলিষ্ঠ সেই কন্ঠস্বর শুনলাম। কন্ঠ সেই আগের মতোই শক্তিশালী, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভের উদগীরন এতো বছর পরেও এতোটুকু বদলেছে বলে আমার মনে হলোনা। আমি নিজেকেসহ অগনিত চেনা অচেনা মানুষের সমগ্র অস্তিত্বের থেকেও এই পাগলের স্পষ্ট কন্ঠস্বরকে অনেক বেশী প্রয়োজনীয় বলে মনে করি বলে পুনরায় উপলব্ধি করলাম। তার দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকানো আমরা কেউই টিকে থাকিনা। প্রতি বছর আমরা বদলে যাই। আমরা এক জায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হই। নিজেদের অপ্রাসঙ্গিকতাকে সঙ্গী করেই। কখনো কখনো আমাদেরও সেই পাগলের মতো করেই চারপাশের প্রতি তীব্র আক্রোশে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা হয় কিন্তু ততোধিক সংযমের পরিচয় দিয়ে আত্মপ্রতারণার সাথে আরো একটিবার বসত গড়ে তুলবার অথর্ব প্রবণতার কাছে পরাজিত হতে ভালোবাসি বলে তার কাছাকাছি আমাদের আর কখনো যাওয়া হয়না। আমরা যা হতে হতেও হতে পারিনা তা হলো পাগল। আমরা যা হতে চেয়েও পারিনি বলে নানাভাবে নিজের অস্তিত্বকে সার্থক প্রমান করার চেষ্টায় নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রবোধ দিয়ে চলি তাকেও মাত্র একটি শব্দ ব্যবহার করেই স্পষ্টভাবে বুঝানো যায়, পাগল। আমরা সহানুভূতির পসরা সাজিয়ে বসে প্রকৃত প্রস্তাবে নতমস্তকেই পাগলদের কাছে নিজেদের অধঃনস্ততাকে মেনে নেই, নিঃশর্তে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:০৩

আহনাফ নীল বলেছেন: সত্যিই তো, কখনো এভাবে নিজেকে তুলে ধরতে পারিনি।

২| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৫৩

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: এটাকে গল্প বলা কতটুকু উচিৎ জানি না। আমার কাছে কেন জানি মনে হয়, গল্প তো গল্পই। শুধু বাক্য আর শব্দের সমাহার নয়।
যাই হোক, পড়তে ভাল লাগছিল। আগেই বলেছিলাম, শহিদুল জহিরের স্বাদ পাওয়া যায় আপনার লেখায়। যেটা বলিনি সেটা হলো, শহিদুল জহিরের মতো লিখতে গিয়ে তার কার্বন কপি হয়ে যাচ্ছেন না তো?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.