নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

কন্ঠ

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:০৯

ঘুম থেকে বেলা করে উঠবেনা বলে গতোরাতে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছিলো। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করাই হয় ভাঙ্গবার জন্য, নিজের কাছে করা শপথের বেলাতেও কথাটি সত্য। ঘুম ভাঙ্গলে প্রথমেই হাতঘড়িতে সময় দেখলে দেখে এগারোটা বেজে গেছে। চোখে পিচুটি, মনে বিরক্তি, মস্তিষ্কে গতোকাল রাতে কি স্বপ্ন দেখেছিলো তার স্মৃতিচারণের নিস্ফল প্রচেষ্টা নিয়ে শহীদ বিছানা ছাড়ে। পুরোপুরি ছাড়তে পারে কি? তার এমনটা মনে হয়না। শরীরের প্রতিটি অংশ আকাঙ্খিত বিলাসের গয়না পরে এখনো যে ম্যাজম্যাজ করছে। সবসময় যে এই মৃদু আলস্যকে প্রশ্রয় দিতে হয় এমন তো কিছু না। বিছানা ছাড়তে ছাড়তে শহীদ গায়ের উপরে রাখা সাদা-কালো ডিজাইনের পাতলা চাদরটিকে ভাঁজ করে রাখে। একেবারে নিঁখুত সেই ভাঁজ। দৃশ্যটি চাক্ষুষ করে শহীদ তৃপ্ত হয়। মনের মাঝে এক ধরণের আত্মবিশ্বাস জন্মে। যাক, সকালটা শুরুই করলো আলস্যকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এবং চাদর নিঁখুতভাবে ভাঁজ করার সাফল্য নিয়ে। সামান্যই অর্জন, তবু দিবসের শুরুর সাপেক্ষে নিতান্তই ফেলনা নয়।

এই ছাত্রদের হলেও সূর্যের উত্তাপ ঠিকই আঁচ করা যায়। গোসলের উদ্দেশ্যে গামছা কাঁধে নিয়ে গোসলখানার দিকে রওনা হতে হতে শহীদ বাইরের দিকে একবার পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায়। শহর থেকে শীত চলেই গেছে বলা যায়। শুধুমাত্র রাতেরবেলা ঘুমাবার সময়েই কেবলমাত্র পাতলা চাদরটা গায়ের উপরে ঘুমাতে হয়। তাছাড়া আর কোথাও শীতের প্রকোপ নেই। তবু আমগাছ থেকে পাতা ঝরে ঝরে নিচে ছোট্ট পানির ফোয়ারার আশেপাশে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সূর্যের খর তাপে আকাশের নীল স্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত না হলেও তাকে বেশ উজ্জ্বলই দেখায় বটে। শহীদ যেই জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নৈসর্গের এই সাধারণ দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করছে তার সাপেক্ষে পশ্চিমে আকাশের উপরে কিছু ক্ষীণ মেঘকে সূর্য আকাশের এই যুগ্ন প্রদর্শনীর মাঝেও সপ্রতিভভাবেই অস্তিত্বশীল দেখায়। আমগাছ থেকে শুধুমাত্র পাতা যে ঝরছে তাই নয় সেটা দুলছেও। অত্যন্ত মৃদুভাবে, তবুও সে দোলে। শহীদ আশ্বস্ত হয় কিনা সেটা তার চাহনী দেখে বোঝা যায়না।

“সালাম শহীদ ভাই।” নিসর্গের থেকে শহীদ স্পষ্ট সকালের বাস্তবতায় ফিরে আসে। নিজের ঘর থেকে মাত্রই বুঝি বের হলো প্রশান্ত। শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। অতি বিনয়ের সাথে তার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া সালামের সম্ভাষণে শহীদ প্রশান্তর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। ছোঁড়াটা তাকে কি মনে করে? সে কিছুই বোঝেনা? দুই কি তিনদিন হবে টিএসসিতে রাশেদের সাথে শহীদকে আড্ডা দিতে দেখেছিলো প্রশান্ত। রাশেদ সূর্যসেন হলের অবিসংবাদিত ছাত্রনেতা। হলের সমস্ত ছাত্ররা যদি একটিমাত্র বিষয়েও সহমত পোষণ করে থাকে কি সহমত পোষণ করতে বাধ্য হয় তা হলো এই হলের একমাত্র নেতা রাশেদ। প্রশান্ত ছেলেটা ভেবেছে শহীদকে নিয়মিত তোয়াজ করে চললে যদি রাশেদের ঘনিষ্ঠ হওয়া তার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠে। প্রশান্ত তাকে এর মধ্যেই বেশ খানিকটা অতিক্রম করে গেছে। শহীদ প্রয়োজনের চাইতেও বেশী তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে উঠে,

“প্রশান্ত শুনো।”

প্রশান্ত এগিয়ে আসে। মুখে স্মিত হাসি ধরে রেখে। তার কতোটা প্রাণবন্ত সেটা সে নিজেই বলতে পারে।

“আজকে শাহবাগে আসবানা? আমি গোসলটা পাঁচ মিনিটে সাইরা নেই। তারপরে চলো একসাথে যাই।”

প্রশান্তের মুখে ঘন ছায়া জন্মে। হলের বড় ভাইকে যেই কথাগুলো বলা দরকার তা বলে ফেলবে কিনা ভাবতে ভাবতে তার অবয়ব আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠে।

“কি হইলো? শাহবাগে এতো এতো মানুষ আসছে। কতো জায়গা থেকে মানুষজন আসছে। রাজাকারদের ফাঁসী চায় বলে এই রোদের মধ্যেও ঘেমে শ্লোগান দিতেছে। তোমার-আমার যাওয়া উচিত না?”

শাহবাগে যাওয়ার ঔচিত্যবোধ নিয়ে প্রশান্ত কোন সন্দেহ প্রকাশ করেছে নাকি? তার এই হলের বড়ভাই সবসময়ে দুই ইঞ্চি কথা বেশী বুঝে। প্রশান্ত অনেকবারই বিষয়টা লক্ষ্য করে দেখেছে। অবশেষে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে সে অগ্রজের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

“আসলে শহীদ ভাই আজকে শায়লার সাথে দেখা করার কথা ছিলো। এই কয়েকদিন পরীক্ষার জন্য তার সাথে দেখা করা হয়ে উঠেনাই। এখন তার সাথে দেখা করতে বের হইলাম।”

এরকম অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও ব্যক্তিগত প্রেমের সম্পর্কই মুখ্য হয়ে উঠে এমন কারো সাথে কথোপকথন চালিয়ে যেতে শহীদ আর আগ্রহবোধ করলোনা। তার আরো মনে পড়ে গেলো বর্তমানে তার কোন প্রেমিকা নেই। শারমিনের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটেছে তাও দুই বছর হয়ে গেলো। সে প্রশান্তর উদ্দেশ্যে মুখে হালকা একটু হাসি, যেই অভিব্যক্তিতে প্রকাশ্যের চাইতে গোপনতাই বেশী স্পষ্ট হয় ঝুলিয়ে গলায় শ্লেষ মাখিয়ে বললো “যাও তাইলে। দেখা করাটা যখন এতো ইম্পর্ট্যান্ট।”

গোসল থেকে বের হয়ে অতঃপর প্রস্তুত হয়ে শাহবাগের উদ্দেশ্যে ডাকসুর সামনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পৌনে বারোটা বেজে গেলো শহীদের। আজকেও ক্যাম্পাসের দৃশ্যাবলী অন্যান্য দিনের মতোই। কারেন্ট এফেয়ার্সসহ নানাবিধ বই নিয়ে এক ভ্রাম্যমান দোকানী অপেক্ষারত কবে কখন কোন উৎসুক এসে তার কাছ থেকে বই কিনবে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সামনে খাবারের যেই দোকান আছে সেখানে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন ভিড় এই মুহূর্তেও দৃশ্যমান। বাতাসের ধুলো উড়তে উড়তে শহীদসহ সেখানে উপস্থিত প্রত্যেকের মুখেই পড়ে। নির্বিকারভাবে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর ভেতরে চাকরীর জন্য পড়াশোনা করতে উদ্গ্রীব অগণিত শিক্ষার্থীকে শহীদ স্পষ্ট দেখে। বাঁ দিকে ঘেঁষে শাহবাগের উদ্দেশে এগোতে এগোতে ক্যাম্পাসের সেই চেনা পরিচিত পাগলকে আরো একবার নিজের আক্রোশ জানাতে জানাতে লাইব্রেরী থেকে হাকিম চত্ত্বর বরাবর ছুটে যেতে দেখা যায়। চেনা পরিচিত সমগ্র পথটিই শহীদ মনোযোগের সাথে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে এগোয়।

মসজিদ পেরিয়ে শাহবাগের রাস্তায় প্রবেশ করতেই তুমুল জনস্রোত তাকে আলিঙ্গন করে নেয়। সে আগ্রহ নিয়ে প্রতিটি অংশকে আগপাশতলা পরখ করতে শুরু করে। বয়স, শ্রেণী, পেশা নির্বিশেষে সবাই রাজাকারের ফাঁসীর দাবীতে চারপাশকে মুখরিত করে তোলে। যেন প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে সরকারকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছে। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয় হাজার হাজার কন্ঠের শ্লোগানে শ্লোগানে। চারুকলা বরাবর ঘেঁষে হেঁটে সামনে এগোলে শহীদ দেখে একটি তৃষ্ণার্ত কুকুর পানির জন্য নিজের শুকনো ঠোঁট বারবার চাটছে। তার পাশেই শ্লোগানরত একজোড়া যুবক ছেলে দৃশ্যটি দেখতে পেলে একজন তার নিজের পানির বোতল বের করে কুকুরটির তৃষ্ণা মেটালো।

আরো সামনে পেরিয়ে শহীদ তার বিভাগের শিক্ষক ও বন্ধুবান্ধবসহ পরিচিত অনেককেই দেখে। রোদ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে তারা একটা নিরাপদ জায়গা বেছে নিয়েছে। ‘রাজাকারের ফাঁসী চাই’ এই দাবীতে একটি সবুজ রঙের ব্যানার এক হাতের কোনায় শক্ত করে ধরে বাদল শ্লোগান দেয় “ফাঁসী ফাঁসী ফাঁসী চাই, রাজাকারের ফাঁসী চাই।” রাজাকারদের স্বপক্ষের শিক্ষক বলেই যাকে শহীদসহ অনেকেই চেনে সেই আলতাফ হোসেনকে সে মুখে স্মিত হাসিসহ চারপাশে অনেক পরিচিত মানুষজন সমেত আবিষ্কার করে। “আরে মামা এতো লেট করলি ক্যান?” , “আসেন ভাই, আমাদের সাথে বসেন।” শহীদকে উদ্দেশ্য করে একগাদা বাক্য বর্ষিত হয়। আলতাফ স্যার তার দিকে রাকিয়ে মুখের হাসি বিস্তৃত করেন, “কি খবর শহীদ কেমন আছো? আসো, আমাদের সাথে শ্লোগান ধরো।” শহীদ মুখে শ্লোগান ধরে। “ফাঁসী ফাঁসী ফাঁসী চাই, রাজাকারের ফাঁসী চাই।” কন্ঠটা বড্ড বেশী টলমল করে। কোন জায়গায় দৃঢ় শক্ত সংকল্পে স্থির হয়না।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৩৪

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: অসাধারণ গল্প।
ঐ উত্তাল সময়টা নিয়ে খুব কম গল্প রচিত হয়েছে, যাও বা হয়েছে, তাও বড়ো তেলতেলে।
এই গল্পটা শুধু যে সেই আন্দোলনকেই তুলে ধরেছে তা না, টেনে এনেছে একজন তরুণের মনের ভেতরের কিছু চিত্র, নিরপেক্ষদের ছেনালি।
খুব সুন্দর

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.