নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

নির্বোধ কড়চা

০১ লা মার্চ, ২০১৬ রাত ৯:৫০

আমার প্রায়ই ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়। সত্যি বললে ক্ষমার অযোগ্য পর্যায়ের দেরী হয়। সেই বাস্তবতায় মেজাজ থাকে খিটখিটে। তখন রাস্তায় বের হলে প্রতিদিনকার মতোই প্রচুর মানুষ দেখি। কিন্তু কারো দিকে আলাদা করে মনোযোগ দিয়ে দেখতে ইচ্ছা করেনা। নিজেকে নির্বোধ নির্বোধ মনে হয়। অন্য যে কোন স্বাভাবিক সময়ে যে নিজের নির্বুদ্ধিতার বিষয়ে আমি অসচেতন থাকি এমন নয়। কিন্তু নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ এই সময়গুলাতে নিজের অস্তিত্ব সংকটে তীব্রভাগে ভুগি। সেই সময়ে সহজে না পারি অন্য কারো সঙ্গ সহ্য করতে, না পারি নিজেকে একেবারে নিঃসঙ্গ অবস্থায় সহনীয় দৃষ্টিতে দেখতে।

তারপরেও আমি ঘর থেকে বের হই। নিজের ঘরের বাথরুমের নীল-সাদা দেয়াল থেকে শুরু করে উজ্জ্বল মেঝে কিছুতেই তখন আমার মন বসেনা। বাইরেও যে বিশেষ একটা আনন্দ পাই তেমন নয়। উপরে তো বলেছিই যে রাস্তায় চলাচলকারীদের কারো দিকেই আগ্রহ নিয়ে তখন তাকাতে ইচ্ছা করেনা। তাদের প্রত্যেকেরই একটা অবয়ব আছে এটুকু স্রেফ দেখতে পাই। দেখে নিশ্চিন্ত হই। কিন্তু যেহেতু বাইরে বের হওয়া মানেই একগাদা বিপদের মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা মাথায় রেখেই বের হওয়া তাই বাইরে বের হলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এটা সেই দমবন্ধকর সময়ের সাপেক্ষে আমার জন্য ভালো বলেই মনে করি। কোন প্রকারের বিপদের আশঙ্কা নেই এরকম কোন সম্ভবপরতা স্বেচ্ছাচারীতা>অথর্বতা>অর্থহীনতা এই সমীকরনের বাইরে যেতে পারেনা। আধুনিক বিজ্ঞান মানুষের অমরত্ব আবিষ্কার করা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। পত্রিকা খুলে বিজ্ঞানের খবরাখবর দেখতে গেলেই বিজ্ঞানীদের এই প্রবণতা চোখে পড়ে। মানুষ কখনো অমরত্ব লাভ করলে বিজ্ঞান নিয়ে যে তাদের আর কোন আগ্রহ অবশিষ্ট থাকবেনা এই বিষয়টি কি বিজ্ঞানীরা অনুধাবণ করে? তাদের কথাবার্তা শুনে আমার তেমনটা মনে হয়না। মানুষ অমরত্ব লাভ করলে সবার আগে যাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবার সম্ভাবনা থাকে তাদের মধ্যে বিজ্ঞানীরা উপরের সারিতেই অবস্থান করবে।

হাঁটতে হাঁটতে আমি মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের সামনে চলে আসি। তখন মনে হয় মতিঝিলগামী বাসে করে মতিঝিলের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। উদ্দেশ্য আর কিছুই না, শাপলা চত্ত্বরের সামনে মানুষজনের যাওয়া-আসা দেখবো। ২০১৩ সালের পর থেকেই দেখেছি বেশীরভাগ মানুষজন শাপলা চত্ত্বরের সাথে হেফাজতের ইসলামীকে সমার্থক করে ফেলে। সাম্প্রদায়িকতার চাষ করে বেড়ানো মানুষজন থেকে শুরু করে প্রেসক্লাব-শাহবাগগামী প্রগতিশীলদের অনেককেও শাপলা চত্ত্বর নামটি উচ্চারণ করতেও তোতলাতে দেখেছি। যা বোধগম্য হয়েছে তা হলো নিকৃষ্ট রাজনীতির প্রতি ঘৃণা পোষণ করা প্রতিটি মানুষই তার দ্বারা আক্রান্ত। করুণভাবেই আক্রান্ত। ব্যাপারটি অসচেতন এরকম কোন বেনিফিট অব দা ডাউট দেওয়ার সুযোগ নিজেকেসহ অন্যদের আর পাইনা। সমগ্র শহরবাসীই তো বর্তমানে সচেতনভাবে অসচেতন থাকতে ভালোবাসে। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকেসহ সবাইকেই split পারসোনালিটি ধরে নিয়ে গদগদ হয়ে অথর্ব আত্ম্রতৃপ্তিতে নিরন্তর ভুগে যাওয়া? ক্লান্তিকরই বটে। আমার আর মোহাম্মদপুর থেকে কোন বাসে উঠে মতিঝিল যাওয়া হয়না। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সাথে পড়তো। এখন একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে শাঁসালো চাকরী করে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারপাশে হরেক রকমের আলো। সেই আলোতে আমি দেখি আমার বন্ধুর মুখ তেলতেলে। সেটা অবশ্যই শুধুমাত্র সারাদিনকার পরিশ্রমের তৈলাক্ততা নয়। তার চাইতেও বেশী কিছু। বন্ধুর পেটের দিকে চোখ গেলে যেই তৃপ্ত ভুঁড়িখানা আমার মুখোমুখি হয়ে মুচকি মুচকি হাসে তার সাথে আমার বন্ধুর মুখের তৈলাক্ততার প্রবল সখ্যতা। এই সময়ে আমার এই গর্বিত বন্ধুর সঙ্গ আমার খুব একটা কাম্য ছিলোনা। কিন্তু তার সাথে এই মুহূর্তে যদি সময় না কাটাই তবে সে মনে আঘাত পাবে। সেই আঘাত তাকে আঘাত দেওয়ার পেছনে কোন যুক্তি খুঁজে পাইনা। সারাদিন প্রচুর খাটে বেচারা। অফিস শেষে দেখা হয়ে যাওয়া কোন বন্ধুকে নিজের পেশাগত কৃতিত্বের কথা গদগদ হয়ে যদি বলতে নাই পারে তাহলে কি অর্থ থাকে এই জীবনের? ওকে তো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই চিনি। নিজেকে নিয়ে বেশ হীনমন্যতায় ভোগে। তুচ্ছ, ক্লান্তিকর বিষয়গুলোতে নিজের ব্যর্থতা যে আনন্দময় হয়ে উঠতে পারে এই বোধটুকু পর্যন্ত নেই। তাই আমি তাকে নিজের গর্বিত চেহারাটি প্রদর্শন করতে সাহায্য করি। সে সামান্য ইঙ্গিত দেওয়া মাত্রই একসাথে হাঁটতে হাঁটতে কাছাকাছি কোন একটা রেস্টুরেন্টে বসি।

রেস্টুরেন্টে আমরা গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে মানুষের জীবনের মৌলিক সব বিষয়ে নিতান্তই ফালতু কথাবার্তা বলি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষায় তোতলা বাখোয়াজি। আমার বন্ধুকেই কাজটিতে বেশী সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। আমি নিজেই তাকে সেই সুযোগ করে দেই। ইদানিং নিজের বাখোয়াজির বিষয়টা সহ্য করতে নিজের কাছেই কষ্টকর ঠেকে। তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার কর্মস্থলের কথা জিজ্ঞেস করি। ইচ্ছা করেই করি। জানি প্রশ্নটা করলে কতো কষ্টকর একটা স্থানে সে নিজেকে টিকিয়ে রেখে পেশাগত জীবনে কৃতিত্ব লাভ করছে, পরিবারের সকলের চোখের মণি হয়ে উঠেছে, নিজেকেসহ পরিচিত সকলের গর্ব হয়ে উঠেছে এইসব ইডিয়টিক বর্ণনা নির্বোধের মতো দিয়ে যাবে। কৃতি বন্ধুকে নিখাদ নির্বোধ হিসাবে আবিষ্কার করতে পারার আনন্দ অনেক। আমি কৃতি কেউ নই লোভ থেকে উৎসরিত নিজস্ব এই হীনমন্যতাও কি সেই সময়ে আড়াল হয়ে যায়না? তাই আমি ধৈর্য্য ধরে আমার বন্ধুর দীর্ঘ, জীবনকে একরৈখিকভাবে দেখবার সেই একঘেঁয়ে বর্ণনা শুনে যাই। সম্বিত ফিরে পেলে আমার বন্ধু আবিষ্কার করে যে সে একাই শুধুমাত্র কথা বলে যাচ্ছে। পেশাগত জীবনের বহুবিধ হিসাবনিকাশে শেখা লজ্জাবোধ তাকে অবশেষে থামিয়ে দেয়। সে আমার কাছে জানতে চায় আমি বর্তমানে কি করছি। আমার প্রথমে ইচ্ছা করে রাসকলনিভের মতো জবাব দেই যে আমি চিন্তা করছি। এটাও একটা কাজই বটে। পরে মনে হয় কথাটাকে সে ঠেস হিসাবে নেবে। তাছাড়া এই মুহূর্তে, যখন চারপাশের সবকিছুর কৃত্রিমতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তখন এরকম গূঢ় দার্শনিক কথার কোনই গুরুত্ব থাকেনা। তাই আমি মনে মনে বন্ধুকে খুশী করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাকে বলি যে চাকরীবাকরী খুঁজছি কিন্তু কিছু পাচ্ছিনা। তীব্রভাবে আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছি। আমি জানতাম এই টোপে কাজ দিবে। দিলোও বটে। সাথে সাথে আমার বন্ধু জাতির না হলেও এককালীন বন্ধুর বিবেক হয়ে আমাকে আশ্বাস দিতে শুরু করে। আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছি এমন ভঙ্গিতে বন্ধুর সেই অভয়বাণী মন দিয়ে শুনি।

রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া, আনুষ্ঠানিকতা বজায় রেখে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্কের একজনের সাথে কথাবার্তা বিনিময়ের পরে আমার বন্ধু ইঙ্গিতবাহী ভঙ্গিতে ঘড়িতে সময় দেখে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি। তার সাথে দেখা হয়ে যাবার পর থেকেই যে আমি মনে মনে এই ভঙ্গিতে সময় গুণে যাচ্ছি সেই কথাটা বন্ধুকে বলতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু অনেক অক্ষমতার মতো এই কথাটুকু বলতে না পারার অক্ষমতাকে সঙ্গী করে বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নেই। বন্ধু তার প্রাত্যহিক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রিকশা নেয়। তার চাকরীর বেতন প্রায় এক লাখের কাছাকাছি। রেস্টুরেন্টে বসেই যেন পাদ্রির কাছে কনফেশনে বসেছে এমন ভঙ্গিমায় আমাকে জানিয়েছে। তবু পঞ্চাশ টাকার ভাড়াকে পয়ত্রিশ টাকা করে তোলার তার আপ্রাণ চেষ্টা আগ্রহ ও কৌতুক নিয়ে দেখলাম। রিকশাওয়ালা বেশ বৃদ্ধ। তার গন্তব্যস্থলও সম্ভবত একই। তাই সে বিরসমুখে পয়ত্রিশ টাকায় যেতে রাজি হয়ে যায়। বন্ধুকে বিদায় দিতে দিতে রিকশার পেছনের লেখা পড়ি। বড় বড় করে লেখা ‘মায়ের দোয়া’। সচরাচর আগেরকার সময়ের বেবিট্যাক্সি, এই সময়কার সিএনজি ড্রাইভার, আর ফার্নিচারের দোকানদারদেরই অতিমাত্রায় মাতৃভক্ত হিসাবে আবিষ্কার করে এসেছি। মাতৃভক্ত কোন রিকশাওয়ালাকে এই প্রথম দেখলাম। দেখে ভালোই লাগলো। রিকশার যাত্রীর কারনে আলাদা করে ‘ই’ প্রত্যয়টুকু যুক্ত করতে হলো। নয়তো আরো ভালো লাগতে পারতো।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা মার্চ, ২০১৬ রাত ১:২০

তোফায়েল তালহা বলেছেন: বাহ। বেশ লেখেন আপনি! ভালো লাগলো।

২| ০২ রা মার্চ, ২০১৬ রাত ১:২২

তোফায়েল তালহা বলেছেন: কমেন্ট এডিট করা যায় না। করা গেলে 'ভালো লাগলো' কেটে লিখতাম 'চমৎকার লাগলো' : )

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.