নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

কোন প্রাত্যহিক বিবর্ণ সন্ধ্যায়

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ ভোর ৪:১৬

১। সায়েন্স ল্যাবোরেটরীতে এসে বাস থেকে নেমে পড়ে সৈকত। এক ঘন্টার মতো বাসে আটকে ছিলো, পঁচিশ মিনিটের গন্তব্যে পৌঁছাতে। বাস থেকে নেমে যেতেই সে দেখতে পায় রাস্তা ফাঁকা হয়েছে। দ্রুতগতিতে প্রতিটি যানবাহন ছুটে যেতে উদ্যত। এক অলিখিত সর্বনাশা প্রতিযোগিতায় ব্যাপৃত যানবাহনগুলো। যারা সে নিজে বিজয়ী হলে কি হবে সেই সম্ভাব্যতার বিষয়ে অজ্ঞাত।

২। সৈকত মৃদু হাসে। রাস্তা ফাঁকা হবার মাত্র আগে বাস থেকে নেমে পড়ার কারনে দুঃখ অনুভব করতে পারলে ভালো হতো। অনেকদিন হলো অন্য কাউকে অপরাধী ঠাহর করে নিজের দুঃখ অনুভব করার সুখ পাওয়া যায়না। বাসায় নিজের মাকে প্রতিদিন এমনটা করতে দেখে সে। অভাবে, দুঃখে, একাকীত্বে ভদ্রমহিলার সমগ্র সুখ কেবল একটা কাজেই এসে ঠেকেছে। নিজের বহুবিধ দুঃখ, দুর্দশার জন্য কারনে অকারনে স্বামী-সন্তানকে দোষী বলে সাব্যস্ত করা।

৩। সারাটাদিন ধরে শহরব্যাপী ভ্যাপসা গরম। প্রত্যেকেই বিপর্যস্ত ক্লান্ত বীতশ্রদ্ধ। সৈকত বার্ণিশের গন্ধ অনুভব করে। সাথে হাসনাহেনার। বিগত হয়ে যেতে চাওয়া অতীতের সর্বাঙ্গীন মুগ্ধতায় ভরা এক মুহূর্তের কল্পনার আবির্ভাবে গন্ধগুলো তার রুক্ষ কঠিন বাস্তবে সঞ্চারিত হয়।

৪। তার বড় বোন লায়লা একবার কক্সবাজারে গিয়েছিলো। সৈকতের তখন বয়স ছিলো অনেক কম। সাত কি আট হবে। সাথে তাদের বাবা শফিউল হাসানও ছিলেন। লায়লা দশ মিনিট মনোযোগ দিয়ে ঢেউয়ের যাত্রা দেখছিলো। তারপরে শফিউল সাহেব মেয়েকে ধমক দেন। "আর কতক্ষণ ধরে এই জিনিস দেখবি? প্রত্যেকটা ঢেউ তো একইভাবে যায় আর আসে।” লায়লা পিতার সেই বাক্যমালায় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো। প্রায় বিশ বছর আগের ঘটনা হবে। এই তো সেদিন পর্যন্তও পিতার স্থূল স্বভাব ব্যাখ্যায় বহুল ব্যবহৃত উদাহরণে পরিণত বিষাদের হাসি হাসতো সৈকত।

৫। নীলক্ষেতের কাছে এসে পিতার স্থূলতায় নিজের প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো সৈকত। এক বয়স্ক ভদ্রমহিলার সাথে তার জোর ধাক্কা লাগে। সাথে মহিলার স্বামীও উপস্থিত ছিলেন। সৈকত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মহিলার দিকে তাকিয়ে সরি বলে। এমন স্বরে যা সে নিজেও তেমন ভালো করে শোনেনা।

৬। চারপাশটা ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে। দুই বছর আগে আবদুল মান্নান সৈয়দের একটি গল্প পড়েছিলো। ‘মাছ’ নামে। মান্নান সৈয়দের লেখা গল্প পড়লেই সৈকতের মনে হয় যেন তার সমস্ত অনুভূতিকে লেখক কোন এক জাদুতে চুরি করে নিয়ে নিজের নামে ছাপিয়ে গেছেন একের পর এক। বিশেষ করে ‘মাছ’ গল্পটি পড়ে তার ঠিক এরকম অনুভূতি হয়েছিলো। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ঠিক তার মতোই নিঃসঙ্গ, আত্মকেন্দ্রিক, অসামাজিক। সে একুরিয়ামে মাছ পালতো। শেষের শব্দটিতে সৈকতের আজন্মই বিতৃষ্ণা। কেউ কাউকে পালেনা। নিজের কাছে রেখে দেয় বড়জোর। কিন্তু শব্দটির উপযুক্ত কোন প্রতিশব্দ অন্ততপক্ষে অভিধানে আছে বলে সে মনে করেনা।

৭। সর্বত্রই সে অসামাজিক বলে বিবেচিত। সৈকত নিজে আপাতদৃষ্টিতে সঠিক এই জাজমেন্টের সাথে একমত নয়। অসামাজিক হতে পারাকে সে এক ধরণের প্রিভিলেজ বলে মনে করে। যেই প্রিভিলেজ অন্ততপক্ষে আর যারই থাকুক মানুষের নেই।

৮। সৈকতের বুকের ভেতরে সর্বক্ষণই ভাষা জ্বলজ্বল থাকে। অব্যক্ত সেই ভাষা। যেই বাক্যমালা প্রিয়-অপ্রিয় সবাইকেই কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। কিন্তু কেউ বুঝতে পারছেনা। সৈকত নিজেও বোঝাতে পারছেনা ঠিক ঠিক। একেবারেই সহ্য করতে পারেনা এমন কেউও যদি সেই ভাষা বুঝতে পারতো তাহলেও বুঝি সৈকতের ভালো লাগতো। সেই অসহ্যকর মানুষটিকে ভালোবাসতো কিছু সময়ের জন্য।

৯। আজকাল পিতার স্থূলতায় সৈকত কৌতুকের চাইতেও যা বেশী কিছু খুঁজে পায় তার নাম ট্র্যাজেডী। তার ধারণা জীবন মানুষকে একাধিক সুযোগ দিয়ে থাকে। শুধুমাত্র তাকে সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য হলেও অপর একজন মানুষের প্রয়োজন হয়। নয়তো যেই শব্দটি সেই মানুষের সাথে চিরকালের জন্য জুড়ে যায় তার নাম ট্র্যাজেডী।

১০। নীলক্ষেতের তেহারীর দোকানগুলোর সামনে এসে সৈকত থমকে দাঁড়ায়। পকেট থেকে কার্ডটি বের করে দোকানের নাম দেখে নেয়। হ্যা ঠিকই আছে। সৈকত তেহারীর দোকানগুলো পেরিয়ে বাম দিক বরাবর ঢুকে যায়।

১১। সৈকত ব্যাগ থেকে একগুচ্ছ কাগজ বের করে। তারপরে দোকানীর হাতে এগিয়ে দিতে দিতে তাকে নির্দেশ দেয় প্রতিটার এক কপি করে ফটোকপি করার জন্য। ছাপাখানায় কাজ আরম্ভ হয়ে যায়।

১২। সৈকত অনতিক্রম্য ক্লান্তিকর প্রাত্যহিকতায় কৌতূহলহীন নিরাসক্ত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যাপন করা বর্তমানের প্রতিটি মুহূর্ত কখন অতীত বলে বিবেচিত হবে তার অপেক্ষায়।

১৩। ছাপাখানায় অবিরাম কিছু কাগজ নিজেদের ভাঙ্গতে থাকে, গড়তে থাকে। কারো কাছে অর্থহীন বলে প্রতিভাত হবে সেই অনিবার্যতাকে মেনে নিয়ে।

১৪। আরিফ স্যারের কথা মনে পড়ে যায় সৈকতের। ক্লাউনের চূড়ান্ত। কোচিঙে আদিরসাত্মক ছ্যাবলা কথাবার্তায় ছাত্রছাত্রীদের জোর করে হাসায়। অনেকেই হাসে। কারনে, অকারনে। স্থূলতায়, অসহায়ত্বে।

১৫। আজকাল এ কথা ভাবলেই সৈকত পায়ের নিচে মাটির পরিবর্তে তরলের অস্তিত্ব পায় যে সমগ্র পৃথিবী নির্বুদ্ধিতা দ্বারা আচ্ছাদিত। প্রভাবিত। পরিচালিত। নিয়ন্ত্রিত।

১৬। ফটোস্ট্যাটের দোকানদার নিরাসক্ত ভঙ্গিতে গান ছেড়ে দেয়। সনু নিগামের পুরনো গান। একসময় বহুল জনপ্রিয় ছিলো।

১৭। এই অসহনীয় গরমের চাইতেও অসহ্যকর আরেকটি জিনিস আছে বলে সৈকতের অনুভূত হয়। সেটা হলো যাপন করা প্রতিটি সেকেন্ড। এগুলোর সমষ্টিকেই তার সময় বলে আখ্যায়িত করতে হবে, মেনে নিতে হবে প্রহর বলে এই বাস্তবতাকে গ্রহণ করার যাতনা অন্য কাউকে বলে বোঝানো যায়না। এমনকি সেই মানুষেরও যদি একই অনুভূতি হয় তাহলেও না।

১৮। সৈকত শ্বাস বন্ধ করে থাকতে চায়।

১৯। সৈকত প্রাণহীনতাকে আলিঙ্গন করে অপেক্ষা করে।

২০। তার অপেক্ষার পর্ব শেষ হয়।

২১। দোকানদার জানায় যে সবমিলিয়ে হয়েছে তিনশো ছয় টাকা। কিছু পৃষ্ঠা নষ্ট হয়েছে। সৈকত অনেকগুলো কাগজ দিয়েছিলো কিনা সেই কারনেই হবে হয়তো।

২২। সৈকত কোন দ্বিরুক্তি করেনা। পাঁচশো টাকার একটি নোট মানিব্যাগ থেকে বের করে দোকানদারকে দেয়।

২৩। তখনো সনু নিগামের পুরনো গানগুলো চলছেই। একটি শেষ হতেই আরেকটি। সৈকতের শুনতে খারাপ লাগছেনা। আজকাল ভালো লাগার দুষ্প্রাপ্যতা এতোটাই যে কোনকিছুতে খারাপ না লাগলে তাকেই ইতিবাচক বলে মনে হয়।

২৪। দোকানদার জীর্ণ দুইটি একশো টাকার নোট সৈকতের হাতে ধরিয়ে দেয়। সৈকতের মুখে টুকরো হাসি এসে পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়।

২৫। মানিব্যাগের টাকা গুণতে গুণতে সৈকত নীলক্ষেতের খোলা রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। ভিড় অনেকটাই পাতলা হয়েছে এখন। চোখ একটু উপরে তুললেই চাঁদের অস্তিত্ব। আকাশ ছুঁইছুঁই করছে। কিন্তু আকাশের কোন বিন্দুতে তা স্থির হয়ে আছে সেটা কেউ বলতে পারেনা।

২৬। সৈকতের তীব্র ইচ্ছা জাগে। আত্মঅস্বীকৃতির। কিন্তু আগে সমগ্রতাকে অস্বীকার করার সফলতা অর্জিত হলেই নিজেকে স্বীকৃতি না দেওয়ার আনন্দটুকু পাওয়া যেতে পারে। তার আগে নয়। সৈকত অনেকবার চেষ্টা করে দেখেছে। কিছু হয়নি।

২৭। নীলক্ষেতের চাঁদ তখন প্রাণবন্ত বাতাসের সান্নিধ্যে আরো বেশী করে স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। তাকে খালি চোখে দেখা যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু নিজের বলে ভাবা যাচ্ছেনা। এক ধরণের অস্পৃশ্যতা ঘিরে আছে যা ঠিক চাঁদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়।

২৮। সৈকতের পকেটে মোবাইল ফোন বেজে উঠে। কলারের নাম লেখা, ‘আব্বু।’

২৯। ‘হ্যা আব্বু, মাত্রই ফটোকপি করলাম। আর একঘন্টার মধ্যে বাসায় ফিরবো।”

৩০। সৈকত যেদিনই বাড়ি থেকে বের হয় কোনদিনই আসলে সেখানে ফিরে যায়না। যেতে পারেনা। কখনো নিজের পিতাকে সে বুঝিয়ে বলবে বলে মনঃস্থির করেছে। চৌরাস্তার সামনে যেই নতুন তোরণটি নির্মিত হয়েছে তাকে অতিক্রম করে সোডিয়াম আলোর মাঝে নিজেকে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দিয়ে সৈকত ফুটপাথ ঘেঁষে হাঁটতে থাকে।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৭:২১

রেইড ইন স্কাই বলেছেন: অসাধারন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.