নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

একবার অপরাহ্নে

০৫ ই জুন, ২০১৬ ভোর ৪:০০

ইচ্ছা ছিলো সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরোবার । কিন্তু গতোকাল রাতে বিছানায় যেতে যেতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিলো । ছেড়ে চলে যাওয়ার স্ত্রীর জন্য দুঃখ উথলে উঠেছিলো লোকটার গভীর রাতে । বড় দেখতে অধরা আত্মপ্রেমী একটা চাঁদ উঠেছিলো ।জানালার সঙ্কীর্ণ পরিসর থেকে যতোদূর দেখা যায় দেখেছিলো ।দেখে বিষাদে ফেটে যেতে চাইছিলো বুকটা । কিন্তু যতোটা শোকাহত হবার জন্য প্রাণটা উচাটন হয়েছিলো ততোটা হতে পারেনি । নিজের উপরে প্রতিশোধ নিতে উন্মুখ হয়েছিলো মনটা । তাই এক মাস আগে নীলক্ষেত থেকে কেনা লেটেস্ট হট বাংলা ভিডিওটা চালিয়ে দিয়েছিলো । প্রথমবার দেখার সময় পনেরো মিনিট অতিক্রান্ত হতেই পায়জামার ফিতে শিথিল করে দিয়েছিলো । পাঁচ কি সাত মিনিট পরে পায়জামার ভেতরটা সোঁদা , আষ্টে গন্ধে সিক্ত হয়েছিলো । যতোটুকু তরল উপরের নাজুক স্থানটায় লেগে ছিলো তাকে চালান করে দিতে ব্যবহার করেছিলো কিছু প্রাগৈতিহাসিক কাগজের । বিয়ের আগে স্ত্রীর সাথে প্রেমের যেই রিহার্সেলের পর্ব ছিলো সেই সময়ে তার কাছে লেখা আবেগপূর্ণ কিছু চিঠি এখনো লোকটার কাছে রয়ে গেছে । কাগজগুলো ব্যবহার করে জানালা দিয়ে ফেলে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি । তারপরে বারবার ভিডিওটা রিওয়াইন্ড করে দেখেছে । আরো তিনবার পায়জামার ফিতে আলগা করেছে দুই ঘন্টার ভেতরে ।

এভাবে আজকে বিছানা ছাড়তে ছাড়তে দুপুর গড়িয়ে গেলো । লোকটা সন্তর্পণে ওভারব্রিজে উঠে । মনের ভুলে কালো রঙের শার্ট পরেই বেরিয়ে এখন গরমে ভুগতে শুরু করেছে। এমনকি পরনের প্যান্টের রঙও কালো। আজকে পথচারীদের মাথার উপরে সারাদিন ধরে সূর্য যেন বাজ ফেলছে । একসময় খুব কষ্ট পেতো এরকম তেজী রোদে । কিন্তু সময়ের সাথে সাথে গা সওয়া হয়ে গেছে । সে বরাবরই লক্ষ্য করেছে দিনের শেষে যে কোন কিছুই তার গা সওয়া হয়ে যায় । শৈশবে একবার বেধড়ক মার খেয়েছিলো পাড়ার ছেলেপুলেদের কাছে । দোষটা তারই ছিলো । এর নামে তার কাছে মিথ্যা কথা বলা , তার নামে মিথ্যাচার অন্য কারো কাছে । এখনো মনে আছে পাড়ার সবচেয়ে ডাকাবুকো ছেলে রোমেল তার চোয়াল বরাবর প্রকান্ড এক ঘুষি মেরেছিলো । তার মনে হচ্ছিলো যেন আর বুঝি এই পৃথিবীর আলো দেখতে পাবেনা । কখনো আর বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া তার হয়ে উঠবেনা । কিন্তু পরবর্তীতে রোমেলকে দেখে খুব ক্ষণিক সময়ের জন্য বুকের ভেতর একটা চিনচিনে ব্যথা জেগে উঠা ছাড়া আর কোন প্রতিক্রিয়া হতোনা । এমনকি রোমেলের সাথে বন্ধুত্ব পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিলো । একবার তাকে সদরঘাটে নিয়ে গিয়েছিলো মালাই খাওয়াবে বলে । সেই মালাইয়ের স্বাদ জিভে অনেকদিন বসত গেড়েছিলো।

হাঁটতে হাঁটতে ধাক্কা খেয়ে অন্যমনস্ক অবস্থা থেকে বাস্তবে ফেরে লোকটা । চিরুনী , রুমাল এইসব নিয়ে দিব্যি ওভারব্রিজেই বিক্রিবাট্টায় গুছিয়ে বসেছে এক হকার । চিমসানো মুখ , ঠিকভাবে চোখ পরিষ্কার না করার কারনে চোখের নিচে ঘন পিঁচুটি দৃশ্যমান । হকারের হাসিটা বড্ড কুৎসিত ঠেকলো লোকটার । তারেকের হাসিটাও এরকমই ছিলো । কদাকার , দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়তেই মনে হতো একপাল শুয়োর সোল্লাসে খেলা করতে শুরু করেছে । কিন্তু তার স্ত্রী রাবেয়ার কাছে এই হাসিই অন্য কোন অর্থে ধরা দিলো । প্রথম প্রথম স্বামীর ছেলেমানুষী রাগ দেখে হাসতো । বয়স্ক একটা মানুষ বন্ধুর হাসি দেখে এতোটা রাগান্বিত হতে পারে এই দৃশ্য তার কাছে বড়ই উপভোগ্য ছিলো । কিন্তু যতোই দিন গড়িয়েছে সেই নির্মল হাসিকে প্রতিস্থাপন করেছে ক্রুর কটাক্ষ । ‘তোমার নিজের হাসি দেখছো আয়নায়? মানুষের হাসি দেইখা মশকরা করো।’ বউয়ের এই মুখ ঝামটা যে গূঢ় কোন বার্তা বহন করে থাকতে পারে সেই কথা কখনো মাথাতেই আসেনি। তখন তাদের ঘরে ইঁদুরের নিয়মিত উৎপাত ছিলো। সপ্তাহে কমসে কম দুইদিন রাতের খাওয়া শেষ করে সে মহানন্দে ইঁদূর মারতে আরম্ভ করতো। কিন্তু একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলটায় বহুদিন পরে তার কাছে লেখার স্ত্রীর সর্বশেষ চিঠিটি যখন আবিষ্কার করলো সেদিন উপলব্ধি করলো সব ইঁদুরই চোখের সামনে দৃশ্যমান থাকেনা।

ওভারব্রিজ থেকে এবারে লোকটা রাস্তায় নামে। বাম দিকে এলিফেন্ট রোডের পাঞ্জাবীর দোকানগুলো শুরু হয়েছে। আজকে শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। পাঞ্জাবীর দোকানগুলো থেকে শুরু করে চাঁদনীচক পর্যন্ত কুত্তাপাগল ভিড়। এখন সেইদিক ধরে হাঁটবার প্রশ্নই উঠেনা। বরং ঢাকা কলেজের রাস্তাটা ধরে হাঁটা ভালো। এই তো পাশেই কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিংসেন্টার। তার সামনে পরপর তিনটি পান সিগারেটের দোকান। লোকটা ত্রস্ত পায়ে একটি দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। তিনটি গোল্ডলিফ কেনে। একটি ধরিয়ে আরামে টান দিতে দিতে সামনে এগোয়। মাঝেমাঝে রাস্তাটার ধারে দলবেঁধে কাঠেরবিক্রেতারা বসে। লোকটার সৌন্দর্যচেতনা তেমন প্রখর না হলেও তার ইচ্ছা করে কিছু একটা কিনে ফেলতে। ব্যবহার তো কিছু নেই জিনিসগুলোর কিন্তু ডিজাইনগুলো দেখতে ভারি সুন্দর। কিন্তু আজকে তার মানিব্যাগের অবস্থা সঙ্গীন। সিগারেট কেনার খুচরো পয়সা, বাসভাড়া-রিকশাভাড়ার টাকা আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রেমের উপন্যাস কিনবার টাকা ছাড়া হাতে আর কিছু নেই। কাঠেরবিক্রেতাদের অতিক্রম করে লোকটা ঢাকা কলেজের রাস্তা ধরে এগোতে থাকে। সামনে একটা জটলার মতো দেখা যায়। মৃদু জটলা। ঘটনা কি? সামনে গিয়ে দেখে তিনটি তরুণ বয়সী ছেলে এক শার্টবিক্রেতাকে প্রহারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্যত। এই একবার শার্টবিক্রেতার গালে ঠাস করে চড় বসায় তো তিনবার বিক্রেতার মায়ের সাথে যৌনসঙ্গমের ইচ্ছা পোষণ করে। তারা সম্ভবত ঢাকা কলেজেরই ছাত্র হয়ে থাকবে। নাইলে এরকম ব্যস্ত সড়কে জনসমক্ষে এই ঔদ্ধত্যের যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ তো নেই। প্রত্যক্ষদর্শীরা শার্টবিক্রেতার নাজেহাল হবার ঘটনায় বেশ আমোদিত। সকলে মুখভর্তি হাসি নিয়ে মারপিটের দৃশ্যাবলী দেখছে। লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিনিট দুয়েক এই দৃশ্য দেখে। মুখে হাসি ফুটে উঠলে তার মুখের রেখাগুলোকে বিস্তৃত দেখায়। সিগারেটটি ততোক্ষণে ফুরিয়ে আসলে নিশ্চয়ই শার্টবিক্রেতাই কোন তাফালিং করেছে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে লোকটি হৃষ্টচিত্তে স্থানত্যাগ করে।

এখন গন্তব্যস্থল মানে নীলক্ষেত যাবার পথ দুইটি। হয় ডানদিকে অনেক লম্বা পথ ঘুরে নিউমার্কেট এক নম্বর গেইটের কাছে এসে রাস্তা পার হয়ে নীলক্ষেতে পৌঁছানো। নয়তো সামনের ওভারব্রিজে উঠে বামদিক বরাবর বলাকা সিনেমাহলের সামনে নেমে বাকি পথটুকু লোকজনের শরীরের সাথে সংঘর্ষ বাঁচিয়ে পায়ে হেঁটে নীলক্ষেতে চলে যাওয়া। লোকটা ওভারব্রিজে উঠবে মনঃস্থির করে সিঁড়িতে পা ফেলতে না ফেলতেই বেখেয়াল হয়ে এক দম্পতির সাথে বিশ্রীভাবে ধাক্কা খায়। সেই যুগলকে দেখতে শুনতে শিক্ষিতই মনে হয়। লোকটা দ্রুতই ক্ষমা চাইবার যেই নিজস্ব ভঙ্গিটি আয়ত্ত করেছে তার তড়িৎ ব্যবহার করে দম্পতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে দ্রুত সামনে এগোয়। তার এভাবে দ্রুত পায়ে চলাটা রাবেয়া কখনোই অনুমোদন করতোনা। একবার তো প্রেসক্লাবে তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে রাবেয়ার বাসের চাকার নিচেই পড়ে যাবার উপক্রম হয়েছিলো। সেদিন বাসায় ফিরে বিবাহিত জীবনে প্রথম স্ত্রীকে প্রচন্ড রকম রাগতে দেখেছিলো। সে কি উত্তুঙ্গে রাগ রাবেয়ার!!! কিছুক্ষণ স্বামীর উপরে ক্লান্তিহীন চোটপাট করলো। তারপরেও সাধ না মিটলে জিদে বাসনকোসন ভাঙ্গতে শুরু করলো। দুইটা গ্লাস আর তিনটা খাওয়ার প্লেট ভেঙ্গে তবেই ক্ষান্ত দিয়েছিলো। এরপরে যতোবারই তারা একসাথে ঘুরতে বেরিয়েছে, হোক সেটা সংসদভবনে ফুচকা খেতে কিংবা মতিঝিলের মধুমিতা হলে সিনেমা দেখতে বরাবর স্ত্রীর সাথে তাল মিলিয়েই পা ফেলেছে।

লোকটা নিচে নামলে পায়ের কাছেই বলাকা। প্রদর্শিত সিনেমার পোস্টারগুলা পর্যন্ত এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। পেছনে কি মনে করে একবার ঘাড় ঘুরালে দেখতে পায় সেই যুগলের স্ত্রীলোকটি ভিড়ের মধ্যে স্বামীকে হারিয়ে ফেলে ওভারব্রিজের এক কোনায় জায়গা করে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির দাঁড়াবার ভঙ্গির সাথে রাবেয়ার দাঁড়াবার ভঙ্গির বেশ মিল আছে। মুখের গড়নও উভয়েরই লম্বাটে। শুধু রাবেয়ার বুক দুইটি তুলনামূলকভাবে অনেকটাই অনুদ্ধত। লোকটা উপলব্ধি করে সাধারণ গতানুগতিক অনাড়ম্বর এই অপরাহ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভালোমানুষী বজায় রাখাটা নেহায়েতই অর্থহীন। সুনীলের প্রেমের উপন্যাস তো নীলক্ষেত থেকে পালিয়ে যাচ্ছেনা। ঠিক তখনই চারপাশের সবাইকে সচকিত করে আজানের প্রবল শব্দ সান্ধ্যকালীন নীরবতাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিলে লোকটি বিষণ্ণ মুখে ওভারব্রিজের সিঁড়ির কাছে থমকে যায়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.