নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাদা এবং কালো

১৭ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ৩:০৩

“সময় আর আগের মতো নাই রে পাগলা। মানুষ বদলাইছে, সময়ও বদলাইবো।”

সেই কবে শুনেছিলো কথাগুলো। অন্ততপক্ষে বছর পঁচিশ তো হবেই। তার বড় মামার কাছে। লোকটা বড্ড আমুদে ছিলো। স্বভাবে নিষ্কর্মাও ছিলো। তাই বয়স্ক অন্যান্য আত্মীয়স্বজনেরা গুরুত্ব দিতোনা লোকটাকে। যখনই তার প্রসঙ্গ উঠতো প্রত্যেকের ঠোঁটের কিনারায় তাচ্ছিল্যের একটা রেখা সেই শিশু বয়সেও পরিষ্কার বুঝতে পারতো সে। অন্যান্য শিশুরাও। গোটা পরিবারে শিশুদের বাইরে সবচাইতে অনুল্লেখ্য মানুষ ছিলো তার বড় মামা। ভারিক্কি সব কথা কিন্তু মজার ভঙ্গিতে বলে নিজের শিশু পরিজনদের যে মুগ্ধ করে রাখতো। অনেকদিন পরে লেক সার্কাস রোডের মোড়ে খাটো করে দেখতে, উশকোখুশকো চুলের মানুষটাকে পথচারীদের সামনে নির্বিকারভাবে অন্ডকোষ বরাবর চুলকাতে দেখে আচমকাই প্রাগৈতিহাসিককালে বড় মামার কাছ থেকে শোনা কথাটা মনে পড়লে জুলাই মাসের এই দুপুরে, যেদিন সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে এমন অবস্থাতে লোকটা শিউরে উঠে।

প্রায় তিন মাস হয়ে গেছে কুষ্টিয়া ছেড়ে ঢাকায় এসেছে। এই তিন মাসে একদিনের জন্যেও সাদা রঙের কোন জামা পরেনি। নিয়মিত শেভ করেছে। গাবদা গাবদা পাগুলোর উপরে প্যান্ট গলানোর পরে মন দিয়ে লক্ষ্য করেছে প্যান্ট গোড়ালীর উপরে উঠে গেছে কিনা। এবং এরকম আরো বহুবিধ প্রস্তুতি। শুধুমাত্র শ্যামলীতে নিজের এক ঘুপসি ঘর থেকে বাইরে বেরুবে এই কারনে। এসকল প্রস্তুতির কোন ব্যতিক্রম হয়নি এই নব্বই দিনে। লোকটা রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে একটা পান কেনে। দোকানদারের দিকে স্পষ্ট চোখ তুলে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করে যে তার দিকে দোকানদারের চাহনীটা কি রকম। নাহ, সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে বলে তো মনে হলোনা। পান মুখে দিতে দিতে লোকটা রাস্তা পার হয়। রোড ডিভাইডারটাতে কাঁদা জমে গেছে। সাথে স্লিপারিও। লোকটা চটিজোড়াকে সাবধানে, যেনো দাঁতের ডাক্তারের কাছে দাঁত তুলতে এসেছে এমন সন্তর্পণে ডিভাইডারের মাঝে দাঁড়য়। একটু স্লিপ কাটলেই সর্বনাশ। সোজা সাত নাম্বার বাস কিংবা প্রাইভেট কারের নিচে পড়লে আর দেখতে হবেনা। পরেরদিন স্টুপিডের মতো নিথর মুখ নিয়ে পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হোক এমনটা সে কোনভাবেই চায়না। তার মুখখানা এমনিতেই থোবড়ানো। দেখতে দাগী আসামীর মতো মনে হয়। কুষ্টিয়াতে যখন প্রথম গিয়েছিলো কতোদিন যে অপরিচিতজনেরা যেমন বাসযাত্রী, স্টেশনে অপেক্ষারত অন্যান্য সহযাত্রী এমনকি অফিসের কলিগদের সাথে যখন হৃদ্যতাপূর্ণ কোন সম্পর্ক গড়ে উঠেনি তারা পর্যন্ত অস্বস্তিভরা চোখ নিয়ে তার সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরেই তফাতে চলে যেতো।

৩২ নাম্বার জাদুঘরের সামনে একটা বিশাল জটলা দেখা যাচ্ছে। হইহল্লা, গালাগালির আওয়াজ স্পষ্ট। পানটা বেশ ভালো বানিয়েছে। মুখের ভেতরে যেনো গলে গলে যাচ্ছে। লোকটা রাস্তার কিনারা ঘেঁষে হাঁটে। যেখানে বাদামওয়ালা, চানাচুরওয়ালারা বিরস মুখে বসে আছে যদি কোন গবেট এই সময়ে তাদের ডাকে সাড়া দেয় এই অলীক আকাঙ্খায়। কিন্তু কাউকেই তাদের কাছে এসে চানাচুর কিংবা বাদাম কিনতে দেখা যায়না। সম্ভবত শহুরে মানুষরা আগের চাইতেও অনেক বেশী স্মার্ট হয়েছে। এরকম কিম্ভুতকিমাকার সময়ে বাদাম চানাচুর এইসব খেলে রাস্তার লোকজন তাদের আবুলের বেশী গুরুত্ব দিয়ে দেখবেনা এটুকু বোঝে। মানুষের বদল দেখো একবার। যেই লোকটা লিখতে পড়তে জানেনা সেও পর্যন্ত শার্টের বুক পকেটে আর কলম রাখেনা। শহুরে মানুষের এই কেতাদুরস্ত পরিবর্তন নিয়ে ভাবতে ভাবতে লোকটা একবার ভাবে যেখান থেকে হইহল্লার আওয়াজ আসছে সেখানে গিয়ে অন্যান্যদের সাথে মিলে দাঁড়াবে। মজা দেখবে। সার্কাস যাত্রা এসব তো উঠেই গেছে দেশ থেকে। এখন মুফত সার্কাস দেখা যায়। যারা দেখায় তাদের ধরে ধরে যে পয়সা দিতে হয় এমনও নয়। কে কখন কোথায় সার্কাস দেখাতে আরম্ভ করে বলা মুশকিল। যেমন লেক সার্কাস রোডে অন্ডকোষ চুলকাতে চুলকাতে যেই বদখত চেহারার লোকটা ইতিউতি তাকাচ্ছিলো সেও তো সার্কাসই দেখাচ্ছিলো। মানুষজন কেমন ঘুরে ঘুরে তার দিকে চেয়ে ছিলো। এদিকে হইহল্লার শব্দ আরো প্রগাঢ় হয়েছে। এবারে গালাগাল স্পষ্টতই শুনতে পাচ্ছে সকলে।

“খানকির পোলা বল আমার টাকা কি করছোস?”

“কসম আল্লাহর, আমি জানিনা।”

“মিথ্যা কথা চোদাস? আমার সাথে মিথ্যা কথা চোদাস? জানোস আমি কে?”

“ভাই বিশ্বাস করেন আপনার ট্যাকার কথা আমি কিচ্ছু জানিনা।”

“ভাইসব, এই খানকির পোলাটারে প্রশ্ন করলাম। মিছা কথা বইলা গেলো। আর না, এইবারে মুখে কিছু হইবোনা। যা হইবো হাতেই”………একটা সামষ্টিক আনন্দচিৎকারের শব্দ লোকটার কানের আরো নিকটে চলে আসে। লোকটা এবারে দেখতে পায় যেই ছিঁচকে চোরটিকে মারতে আশেপাশের জনতা উদ্যত হয়ে উঠেছে তার পরনে শতচ্ছিন্ন সাদা রঙের পোশাক। লোকটার শরীর আবারো শিরশির করে উঠে। ঢাকায় আসবার পর থেকে সাদা রঙের কিছু পরা দূরে থাক সাদা রঙ দেখলেই তার আতঙ্কের মতো লাগে। লোকটার ফের মনে পড়ে যায় বহু বছর আগে নরসিংদীতে, যখন পরিবারে বাবা বেঁচে ছিলো, মা বেঁচে ছিলো, বড় বোন দুইটির তখনো বিয়ে হয়নি, ছোট ভাইটা তখনো বিছানাতেই পেচ্ছাপ করে দাঁত বের করে আধো আধো হাসি হাসতো সেই বিস্মৃতকালের এক রাত্রিতে সে এডভেঞ্চার করবে বলে মনঃস্থির করলো। কি সেই এডভেঞ্চার? বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরের রাস্তাটা নির্জন। কাকপক্ষী পর্যন্ত সেই রাস্তায় রাতেরবেলায় যেতে ভয় পাবে এমন অবস্থা। রাতেরবেলায় জানালা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সেই রাস্তায় চলে যাবে। পথে যাদেরকেই দেখবে ভয় দেখিয়ে আসবে। এলাকায় গাছের সংখ্যা অনেক। মানুষজন চলাফেরা করতে প্রচুর গাছের মুখোমুখি হবে। গাছের গুঁড়ির পেছন থেকে দাঁড়িয়ে নাকি সুরে ডাকলেই বাপ বাপ করে পালাবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। লোকটা জানালা দিয়ে ঘর টপকালো। টপকে খেয়াল করলো তার পরনের জামাটা ধবধবে সাদা। মানুষকে ভয় দেখাতে সুবিধা হবে। এরকম ঘোর কৃষ্ণবর্ণের রাতে ধবধবে সাদা পোশাকের একজন নাকি সুরে ডাকাডাকি করছে, সেই বান্দা আর যাই হোক সাধারণ মানুষ তো হতে পারেনা। এবারে সোজা রাস্তা বরাবর নির্জন সেই রাস্তা ধরে চলে যাবে। সামনেই একটা কুল গাছ কেবল সাবধানে পার হতে হবে। বেশ পিচ্ছিল আছে জায়গাটা, আছাড় খেলে ফ্র্যাকচার নিশ্চিত। পা টিপে টিপে কুল গাছ পার হচ্ছে। “জালাল ভাই, তুমি এইরকম কইরোনা। আল্লাহর দোহাই লাগে। আব্বা জানলে আমারে গলা টিপে মেরে ফেলবে।” এ কি কান্ড!!! মানুষজনকে ভয় দেখাতে বেরিয়ে এখন তো নিজেরই ভয় খাওয়ার যোগাড়। তার বড় বুবু জালাল ভাইয়ের সাথে এতো রাতে কিসের কথা বলে? আধা ঘন্টা আগেই তো বুবুকে সে বুবুর ঘরে পায়চারি করতে দেখেছে। আর সেই বুবুই কিনা, তার লক্ষী স্বভাবের, সাত চড়ে রা করেনা বুবু জালাল ভাইয়ের মতো একটা আস্ত হারামজাদার সাথে এতোদিনএভাবে রাতবিরাতে টাংকি মেরে যাচ্ছে? তারা কেউ কিছু জানলোনা? সে বুবু বলে একটা আর্তচিৎকার দিয়েই দাঁত কপাটি দিয়ে কুল গাছের সামনেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। গুলশানের হত্যাকান্ডটা ঘটে যাওয়ার পর পুলিশও নাকি বিভিন্ন জায়গায় সাদা পোশাকে নেমে পড়েছে। যাকে খুশী তাকেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কারো কিচ্ছু বলার নেই। এবারে যখন ঢাকায় আসবে তখন লোকটার স্ত্রী পইপই করে তাকে বলে দিয়েছিলো যেনো সাদা রঙের কিছু না পরে। নিয়মিত যেনো ক্লিন শেভ করে। মুখে দাঁড়ি থাকলেই নাকি তাকে পুলিশ সন্দেহ করবে। সাদা, এই স্নিগ্ধ কোমল একটা রঙই তাকে তিন মাস বন্দী করে রেখেছে। কি ঘরে, কি বাইরে। লোকটা ততোমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ধানমন্ডি সাতাশ নাম্বারে চলে এসেছে। সামনে আবারো একটু জটলা দেখতে পেলো। এবারে আতঙ্ক সাদা রঙে নয়। কালো রঙে। দুই দুইটা র‌্যাবের অফিসার সাম্পান নামক রেস্টুরেন্টের পাশে যেই চিপা জায়গাটা আছে সেখান থেকে ফেনসিডিলসহ তিন যুবককে গ্রেফতার করে খোলা রাস্তাতেই মানুষ জমিয়ে দিব্যি আসর বসিয়ে দিয়েছে। তাকাবেনা তাকাবেনা করেও লোকটা র‌্যাবের অফিসারগুলোর দিকে তাকিয়ে ফেললো। এবারে অফিসার দুইজনের একজনের চোখ স্পষ্ট লোকটার চোখ বরাবর। তাকে কি নিরীক্ষা করছে এতো? একবার যে তাকিয়েছে চোখ নামানোর কোন লক্ষনই নেই অফিসারটার। তিন মাস যাবত লোকটা, কোন অপরাধ না করেও সাদা রঙের কোন জামা পরেনি, নিয়মিত ক্লিন শেভ করেছে, গোড়ালীর উপরে উঠে যায় এমন সব প্যান্ট ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে, তারপরেও কি রক্ষা হবেনা? ‘বউ, আমার বুদ্ধিমতি বউ তুমি আমারে খালি সাদা রঙের ভয় দেখাইলা ক্যান? কালো রঙের কথা তোমার মনে ছিলোনা? এই দেখো আমার দিকে যেই লোকটা চোখ তেড়া করে তাকায়ে আছে সে সাদা রঙের কিছু পরেনাই। পরছে কালো রঙের। চোখে চশমা, সেইটাও ঘুটঘুইটা কালো। বউ, তুমি আমারে ক্যান কালো রঙের কথা বইলা দিলানা।” পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি, পয়ষট্টি কেজির এভারেজ স্বাস্থ্যটি ধানমন্ডি সাতাশ নাম্বার রোডে, সাম্পান নামক রেস্টুরেন্টটির সামনে, জুলাই মাসের এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে ঝুপ করে পড়ে যেতে যেতে আবিষ্কার করে সমগ্র শহরে মাত্র দুইটি রঙ দেখা যাচ্ছে। সাদা এবং কালো।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১৩

লেভিয়াথান বলেছেন: বুঝে উঠতে উঠতে থেমে যাই কিন্ত ঘোর লেগে থাকে।

ভালো গল্প। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.