নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইডিয়ট

২২ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ২:৩৮

ঘটনাটা যখন ঘটলো তার সেকেন্ডের ভগ্নাংশ আগেও মাহতাব কল্পনা করতে পারেনি এরকম কিছু ঘটতে পারে। তার কল্পনাশক্তির এই ব্যর্থতাকে ক্ষমা করে দেওয়াই যায়। অফিসে মাহতাবের প্রচুর ছুটি পাওনা আছে। সেই ছুটিগুলোর একটা আজকে খরচ করে সকালেই বেরিয়ে পড়েছিলো। অনেক অনেকদিন পরে মর্নিংওয়াকের জন্য সকাল সকাল রমনা পার্কে চলে যাওয়া। চিরচেনা গাছগাছালি, রমনার ঘাস, চাওয়ালা-বাদামওয়ালা-সিগারেটওয়ালাদের সাথে বহুকাল আগে গজিয়ে উঠা পুরনো সখ্যতাকে পুনরায় ঝালাই করে নেওয়ার পরে চাঙ্খারপুলে গরম গরম তেলে ভাজা পরোটার সাথে মাংস গলাধঃকরণ করে নিয়ে অতঃপর কিছু সময় ব্রিটিশ কাউন্সিলে নিরিবিলিতে আর্কিওলজির কিছু বই হাতের কাছে রেখে পড়াশোনা করে প্রোডাকটিভ কাজে অনেক সময় ব্যয় করেছে এবারে একটু রিলাক্সেশন করা যাক মনে করে বসুন্ধরা সিটিতে পা বাড়িয়েছিলো। মার্কেটটাতে সে এসেছে অনেকদিন পরে। কিন্তু এসে এই বিপত্তিতে পড়তে হবে কে জানতো?

সদ্যই লাঞ্চ সেরে ফুডকোর্ট থেকে নেমে তখন লেভেল থ্রিতে এসে নেমেছে। তখনই ঘটনাটা ঘটলো। মুহূর্তের মধ্যে বিনা সংকেতে লোকজন ছোটাছুটি শুরু করে দিলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষজনের দিকে প্রথমে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে মাহতাব বুঝতে চেষ্টা করলো কি হচ্ছে। কিন্তু কিছু বুঝতে পারলোনা। সে শুধু দেখতে পাচ্ছে যে লোকজন ছুটছে। রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে শুরু করেছে। এক ভদ্রলোক ছুটতে ছুটতে উত্তেজনায় তার হাতের প্যাকেটগুলো এবং স্ত্রী পুত্রের হাত ছেড়ে দিয়ে এক্সিডেন্টালী আরেক ভদ্রলোকের গায়ের উপরে হুড়মুড় করে পড়ে গেলে মাহতাব বুঝতে পারলো যে তার আর এক মুহূর্তও দেরী করা উচিত নয়। কিন্তু ঘটনা কি ঘটেছে সেটা না জেনেও স্বস্তির মধ্যে থাকাটা সম্ভব নয় সে বিলক্ষণ জানে। মাহতাব জানে তাকেও রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতে হবে। কিন্তু কেনো তা করতে হবে সেটা তো জানা থাকা দরকার। এক অল্পবয়সী যুগলকে ছুটতে দেখে প্রায় তাদের কাছে দৌড়ে গিয়েই মাহতাব তরুণ ছেলেটির উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো ‘কি হয়েছে ভাই? সবাই দৌড়াচ্ছে কেনো?’ ছেলেটি মাহতাবের প্রশ্নে অত্যন্ত অবাক হলেও দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে ‘লেভেল সিক্সে আগুন লাগছে। যতো তাড়াতাড়ি পারেন এখান থেকে বের হন’ বলতে বলতে প্রেমিকাসহ নিমেষে গায়েব হয়ে গেলো।

বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লেগেছে? মানুষজনের এই প্রাণপণে দৌড়ানো পরিষ্কারই সাজেস্ট করে ঘটনাটা আদপেই মাইল্ড কোন অগ্নিকান্ডের ঘটনা নয়। ঘটনাটা নিঃসন্দেহে সিভিয়ার হতে যাচ্ছে। মাহতাব এবারে নিজে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করলো। এক্সেলারেটর দিয়ে দ্রুত নামা ছাড়া গতি নেই। লিফটগুলো এর মধ্যেই পুরোদস্তুর অকুপাইড। অবশেষে লেভেল ওয়ানে নেমে মার্কেট থেকে বেরিয়ে আসলে মাহতাব বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলো।

অগণিত মানুষ যারা ইতোমধ্যেই নেমে এসেছে তারা সবাই ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করছে। একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা সমগ্র ঘটনার উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরে এনট্রান্স গেটগুলোর একটার একটু সামনেই ফেইন্ট হয়ে পড়ে আছে। তাকে এক হাতে শক্ত করে ধরে আরেক হাতে কেনাকাটার ব্যাগগুলো সামলাতে সামলাতে এক অল্পবয়সী মেয়ে গলায় সমস্ত জোর এনে হেল্প হেল্প বলে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেউই সেই মেয়েটির কথায় কর্ণপাত করছেনা। উল্টাদিকে যেই ফার্নিচারের দোকানগুলো সেখান থেকে লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ঘটছে তা বুঝবার চেষ্টা করছে। বুঝবার পরেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। একেবারে শেষ প্রান্তের এক্সিট গেট, যা দিয়ে বেরিয়ে কাওরানবাজার থেকে ফার্মগেটগামী যে কোন বাসের উদ্দেশ্যে উঠে পড়া যায় গণহারে মানুষজন সেই রুট দিয়ে বেরিয়ে সন্তর্পণে নিজেদের কেনাকাটার ব্যাগগুলো এবং পরিবারপরিজনদের সামলে নিয়ে কাওরানবাজারের চৌরাস্তায় যেই পানির ফোয়ারাটা আছে সেখানে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়াতে শুরু করে। চারপাশে বলতে গেলে এক টোটাল ক্যায়স। বসুন্ধরা সিটির একটু পাশেই যেই দুইটি বিরিয়ানীর দোকান আছে সেখান থেকে লোকজন উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছে যে কি ঘটছে। যখন তারা নিশ্চিত হলো যে সিরিয়াস অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে, ফায়ারসার্ভিসের আগমন সুপ্রত্যাশিত তখন একটি দোকানের ক্যাশে বসা লোকটা ভ্রুকুটি করে ‘ফায়ারসার্ভিস আইতে লাগবো তিন ঘন্টা, মার্কেট এর মইধ্যে পুইড়া ছাই হইয়া যাইবো।’ বলে পুনরায় দোকানের ভিতর নিজের মাথা ঢুকিয়ে দেয়।

এরই মধ্যে বসুন্ধরা সিটির প্রবেশমুখের আগে একেবারে মধ্যবর্তী জায়গাটায় চোঙ্গা হাতে নিয়ে একজন যুবককে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। নিশ্চয়ই কোন টেলিভিশন চ্যানেল থেকে হবে। গতো দশ কি পনেরো বছরে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। কিছুদিন আগে নিজের অফিসেই এই নিয়ে মাহতাব তার সহকর্মীদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠেছিলো। শহরে কাক, কবি এদের সাথে সাথে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও সংখ্যায় নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেছে এমনটাই ছিলো তাদের ভাষ্যমত। কিন্তু আজকের এই বিপদাপন্ন পরিস্থিতিতে কোন প্রকারের হিউমারই মাহতাবকে টানছেনা। তবুও সে উপস্থিত বাকিদের মতো স্রেফ নীরব দর্শক। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোথায় কি হয় দেখছে। হঠাৎ করেই উপস্থিত অন্যান্যদের সহ তাকে হকচকিত করে দিয়ে এক ভদ্রলোককে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে বসুন্ধরা সিটির ভিতরে প্রবেশ করতে দেখলে চোঙ্গা হাতে দাঁড়ানো সাংবাদিক সাথে সাথে সেই লোকটির কাছে ছুটে গেলো। লোকটির পোশাকআশাক একেবারেই আনইম্প্রেসিভ। টোটাল এপিয়ারেন্স অবজার্ভ করে মাহতাব বুঝলো গোটা এলিমেন্টটাই আসলে ইডিয়টের চূড়ান্ত। ‘ভাই আপনি কই যান?’ লোকটির উদ্দেশ্যে সাংবাদিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে মাহতাব যা ধারণা করেছিলো তাকে সঠিক প্রমাণ করে লোকটি মুখভর্তি হাসি নিয়ে সাংবাদিকের উদ্দেশ্যে বলে উঠে ‘আগুন দেখতে যাই।’ সাংবাদিক তৎক্ষণাৎ চোঙ্গা মুখের একেবারে কাছাকাছি নিয়ে কাঠ কাঠ গলায়, যেনো নিজের মায়ের মৃত্যুসংবাদ পাঠ করছে এমন ভঙ্গিমায় বলতে শুরু করে ‘প্রিয় দর্শকবৃন্দ, আপনারা দেখছেন বসুন্ধরা সিটিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। মার্কেটে আসা লোকজন নিজেদের জীবন বাজি রেখে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করেছে। আশেপাশের মানুষজন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কি করবে বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। প্রিয় দর্শকবৃন্দ …………”

বসুন্ধরা সিটি থেকে মাহতাব পান্থপথে হাঁটতে হাঁটতেই এসে পড়েছে। স্কোয়ার হাসপাতালের সামনে। ঘটনাটা আমূল নাড়িয়ে দেওয়ার মতো এমন কিছু নয়। এরকম অগ্নিকান্ডের ঘটনা তো বটেই এর চাইতেও ভয়াবহ অনেক ঘটনাই সে এনকাউন্টার করেছে। কিন্তু একটা দৃশ্য সে কোনভাবেই ভুলতে পারছেনা। চোঙ্গা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সেই আনইম্প্রেসিভ এপিয়ারেন্সের ইডিয়টটার হাস্যজ্জ্বল মুখ।

মুখভর্তি হাসি নিয়ে, এরকম শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতেও কিভাবে কারো সাথে হাসিমুখে কথা বলা যায়? কোন দোর্দন্ড আত্মবিশ্বাসে? নাকি পরম নির্বুদ্ধিতায়? লোকটা নির্বোধ তো বটেই। আগুন লেগেছে। মানুষজন মার্কেট থেকে পারলে উড়াল দিয়ে নিচে নেমে এসে নিজেদের জীবন বাঁচানোটা সুনিশ্চিত করে আর সে কিনা স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে আগুন দেখতে যায়? মাহতাবের স্পষ্ট মনে আছে উত্তর দেওয়ার সময়ে লোকটির স্ত্রী-পুত্রও আনন্দিত মুখেই স্বামী-পিতার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। এর অর্থ দাঁড়ায় তারাও আগুন দেখতে উৎসাহী ছিলো। এরকম বড় বিপদের সময়ে অনেক মানুষের মাথাই ঠিকভাবে কাজ করেনা এটা মাহতাব ভালো করেই জানে। মানুষের এই উজবুকি নিয়ে কম সংখ্যক গল্প সে শোনেনি। কিন্তু সেই আনস্মার্ট লোকটা এবং তার স্ত্রী-পুত্রের এই সামষ্টিক নির্বুদ্ধিতাকে কি এতোটা সরলভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? নাহ, বিপদের সময়ে মানুষের মাথা কাজ করেনা এই হাইপোথিসিস দিয়ে এই ঘটনাটিকে বিচার করতে নিজের কাছেই বাধো বাধো ঠেকছে। বড্ড নাইভ ব্যাখ্যা। তবে অল্টারনেটিভ আর কোন হাইপোথিসিস দাঁড় করানো যায়? মানুষ আজকাল বড্ড বেশী স্যাডিস্ট হয়ে পড়ছে। অন্যদের দুঃখ-কষ্ট তার আনন্দের বিষয়। কিন্তু এই ইস্যুতে তো সেই ব্যাখ্যাও খাটছেনা। একটা মানুষ তার স্ত্রী-পুত্র সহ আগুন লেগে যাওয়া জায়গাটি দেখতে যাচ্ছে এর অত্যন্ত সোজাসরল অর্থ আছে। তা হলো লোকটা এই বাসনা পূরণ করতে গিয়ে প্রয়োজনে নিজের, নিজের পরিবারের লোকজনদের জীবন বিপন্ন করতেও দ্বিতীয়বার ভাবতে আগ্রহী নয়। মানুষজনের রুদ্ধশ্বাসে ছোটাছুটি দেখে এই বিষয়টা সহজেই ধরে নেওয়া যায় যে আগুন দেখতে যাওয়া দূর কি বাত মার্কেটের ভেতরে প্রবেশ করলেও জীবন বিপদের মুখে পড়ে যেতে পারে। তবে কোন অভূতপূর্ব নেশায় আক্রান্ত হয়ে এরকম চূড়ান্ত সুইসাইডাল কোন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়? লোকটা কথাবার্তায়, পোশাকেআশাকে চূড়ান্ত লেভেলের ইডিয়ট সেই নিয়ে সন্দেহ সামান্যই। কিন্তু ইডিয়টেরও তো প্রাণীসত্তা থাকে। বেসিক ইন্সটিঙ্কট। খাওয়া, ঘুম, সঙ্গম ইত্যাদির মতো নিজের জীবনকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করার তাড়নাটাও তো মানুষের সহজাত। সেই তাড়না তো বুদ্ধিমান-নির্বোধ , সৎ-অসৎ ইত্যাদি বিচার করেনা।

সারাটাদিন বেশ উষ্ণ ছিলো। এখন আবহাওয়া মেঘলা। সম্ভবত বিকালে একচোট বৃষ্টি হবে। পান্থপথ থেকে হাঁটতে হাঁটতে ততোমধ্যে মাহতাব এসে পড়েছে ৩২ নাম্বার রোডে জাদুঘরের সামনে। তিরিশ কি চল্লিশ টাকা রিকশাভাড়ায় সোজা বাড়ি ফিরে যাবে। হাঁটতে হাঁটতেও মাহতাব চারপাশে মানুষজনের কথোপকথন মন দিয়ে শুনেছে। প্রত্যেকেই অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি নিয়ে চিন্তিত। কেউ কেউ ইতোমধ্যেই কনস্পিরেসী থিওরী ব্যবহার করে মূল কালপ্রিট নির্ণয় করে পরবর্তী বড় কোন ডিজাস্টারের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করে দিয়েছে এমনটাই মাহতাবের অনুমান। বরাবর যেমনটা হয়ে থাকে আর কি। কথা থাকে, সন্দেহ থাকে। সবকিছুর সামেশন পরবর্তী বড় কোন বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা। রিকশায় উঠতে উঠতে মাহতাবের মোবাইল ফোন বেজে উঠে। অপর প্রান্তে নিজের অফিস থেকে তার বউ নুশাইবার উদ্বিগ্ন কন্ঠ। মাহতাব কিছুই জানেনা এমনটা অনুমান করে তাকে কিছু বলতে না দিয়ে নুশাইবা বসুন্ধরা সিটির অগ্নিকান্ডের ঘটনাটা হড়বড় করে বলতে আরম্ভ করলো। বলতে বলতে নুশাইবার গলা ধরে আসলে মাহতাব তাকে চমকে দিয়ে আগুন দেখতে যাওয়া মানুষটার অনুকরণে মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলে উঠে ‘আরে তুমি চিন্তা করোনা। আমি এতোক্ষণ পান্থপথেই ছিলাম। মানুষের ছোটাছুটি আর আগুন ধরে যাওয়া দেখে এখন বাসায় ফিরছি। তুমিও তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসোনা। গতোকাল রাতে কথা দিয়েছিলে কিন্তু কথা রাখোনি। অপর পাশে মুখ করে শুয়ে পড়েছিলে। বিকালে আমার কথা রাখতে হবে বলে দিলাম।’

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.