নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সুরঞ্জিৎ

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ২:০১

স্টেশন থেকে বেরিয়ে সুরঞ্জিৎ আনমনা হয়ে পড়লো।

যখন সচেতন সজাগ ছিলো তখনো সে অন্তর্গত তন্ময়তা থেকে বেরুতে পারেনি।

ঘোর সবার কাছে ধরা দেয়না। যাদের কাছে ধরা দেয় তাদের সঙ্গ ছাড়তে চায়না। সুরঞ্জিৎ ছয় বছর হয়ে গেলো হলে বসবাস করছে। পড়াশোনা কি চাকরী-বাকরীর জন্য ছোটাছুটির সময়টুকু ব্যতীত যে সময়টুকু তার হাতে অবশিষ্ট থাকে সে চিন্তা করে। তার দিগন্ত হলের সামনে থাকা পুকুরঘাট থেকে শুরু করে তন্ময়তার স্বরুপ পর্যন্ত বিস্তৃত।

আজ পর্যন্ত এই দার্শনিকসুলভ মগ্নতা সুরঞ্জিৎকে জীবনের অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাধ-আহ্লাদ- সুখ-সন্তুষ্টি-আনন্দ-রং-রুপ থেকে বঞ্চিত করেছে। সুরঞ্জিৎ এই সত্যের সাথে কোন প্রকারের দ্বন্দ্বে কি সংঘাতে যায়না। কখনোই না। এই সত্য সেই সত্য- যার সাথে শরীরের জোরে সংঘাতে যাওয়াটা মূঢ়তা, মনের সাথে ফাঁকি দেওয়াটাই যার চূড়ান্ত গন্তব্য।

সুরঞ্জিৎ ছুটিতে বাড়িতে ছিলো। বারোদিন বাড়িতে কাটিয়ে ফিরতি ট্রেনে আজ শহরে ফিরেছে। বাড়িতে যাওয়ার সময়ে সে গৃহে নতুন কিছু ঘটবে এমন প্রত্যাশা করে যায়নি। গতানুগতিক কিছু অভ্যাস, কিছু প্রবাহমান মুহূর্তের পরম্পরা, নিশ্চিন্তে কিছু সুখদায়ক নিঃশ্বাস ফেলা; বাড়িতে যখনই গেছে এর চাইতে বেশী কিছু সুরঞ্জিৎ কখনো চায়নি। চাইলে পাবেনা এই বাস্তবতার সাথে শৈশব থেকে যুঝতে যুঝতে প্রাপ্যতার এই সীমাবদ্ধতাকেই সুরঞ্জিৎ আপন করে নিয়েছে।

“মামা কই যাইবেন?” রিকশাচালকের প্রশ্নে সুরঞ্জিতের ঘোর সাময়িকের জন্য কেটে যায়। সামনে একটা ছোটোখাটো ভিড়ের দিকে তার চোখ পড়ে। আজকে জাতীয় ছুটির দিবস। সন্ধ্যাবেলাতে মতিঝিলে, বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের সামনে এরকম অনেক ভিড় সে দেখতে পায়। সেই দিকে মনোযোগ না দিয়ে সুরঞ্জিৎ রিকশাচালককে স্তিমিত গলায়; যেনো জোরে বললে একান্তই গোপন কোন কথা চারপাশের মানুষেরা জেনে যাবে এমনভাবে বললো “টিএসসি যাবো।”

রিকশাচালকের কাছে এই গন্তব্য প্রত্যাশিত ছিলোনা। সুরঞ্জিতের কাছ থেকে গন্তব্যস্থানের কথা শুনে সে সাথে সাথে নিজের অমত প্রকাশ করলে সুরঞ্জিৎ ব্যাগ নিয়ে সামনে হাঁটতে থাকে।

রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় কাঁদা জমে আছে। পিচ্ছিল, একটু জোরে হাঁটতে গেলেই আছাড় খাওয়ার বেজায় সম্ভাবনা আছে। সম্ভবত আজকে একটা লম্বা সময় ধরে বৃষ্টি হয়েছে। সুরঞ্জিৎ সন্তর্পণে পা বাড়ায়। বাড়িতে থাকবার সময়ে বাজার থেকে নতুন একটা প্যান্ট কিনেছে। কালো রঙের। প্যান্টের ডিজাইনটা দেখে সুরঞ্জিৎ অনেক অনেক দিন পরে নিতান্তই স্থূল কিছুর প্রতি এতো তীব্রভাবে আকৃষ্ট হয়েছে। তাকে নিজের হিসাবে পেতে চেয়েছে। সেই আকাঙ্খিত পোশাকটি কাঁদার স্থূলতায় নিজেকে আরো স্থূলভাবে আবিষ্কার করুক এটা সুরঞ্জিতের মনোঃপুত নয়।

রাস্তা অনেকাংশেই ফাঁকা। চারপাশে এখন মানুষজন তেমন দেখা যায়না। নির্জন নীরব রাস্তা। কিন্তু এই শব্দহীনতায় কোন স্বস্তি নেই। না অনুভব করা যায় কোন মুগ্ধতা। সুরঞ্জিৎ এমন অসংখ্য নীরব নির্জন কোলাহলহীন সন্ধ্যায় কি রাতে শহরে ঘুরে দেখেছে। প্রথম প্রথম তার অন্যরকম অনুভূতি হতো। শৈশবে ঘুড়ি উড়ানো শেষে বাড়ি ফেরার সময়ে যেই নিস্তব্ধ এক অনুভূতি তাকে আবিষ্ট করে রাখতো সেই অনুভূতির গন্ধ পেতো। কিন্তু শহরের সাথে তার তিক্ত পরিচয় যতোই দিনের হিসাবে বেড়েছে, মাসের হিসাবে প্রগাঢ় হয়েছে, বছরের হিসাবে তরতর করে এগিয়েছে ততোই সুরঞ্জিৎ বুঝেছে যে অনুভূতির মাঝেও নানাবিধ ফাঁকি থাকে। অনুভূতির প্রতিটি মুহূর্ত সত্যতায় কেটে গেলেও তার মাঝে ফাঁকি কিংবা বিচ্যুতি থেকে যায়। দিনে দিনে সেগুলো অনেক বেশী স্পষ্টতর হয়ে উঠে। একসময় আবিষ্কার করা হয় যে অনেক মুহূর্ত কি প্রহর, অনুভূতির সর্বোচ্চো অপাপবিদ্ধতা নিয়ে কেটে গেলেও তার ভেতরকার অন্ধত্ব ধীরে ধীরে একসময় উন্মোচিত হয়। একটি চোখ থেকে দুইটি চোখে সমগ্রতাকে দেখা হয়। দুই থেকে চার, চার থেকে আট, এভাবে চোখের সংখ্যা ক্রমশই বাড়তে থাকে। বয়সের জাবেদা খাতায়, অভিজ্ঞতার ভারে। স্মৃতি, যার যাপনে সংশ্লিষ্ট অনুভূতিকে চূড়ান্ত কি শাশ্বত মনে করবার ভ্রান্তিতে মন ডুবে যায় রোমন্থনের সময়ে সেই অনুভূতির কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকেনা। স্মৃতি থাকে, থাকে তার রোমন্থন। কিন্তু যাপনের সিড়ি ততোমধ্যে সম্পূর্ণ বদলে যায়।

সুরঞ্জিৎ অতীতমুখী। বরাবরই। নিজের যাপিত বিভিন্ন স্মৃতি কি অভিজ্ঞতাকে সে সবসময়ে নাড়াচাড়া করে দেখে। অভ্যাসটা তার জিনগতো বলেই সে মনে করে। তার পিতারও এই স্বভাব আছে তা শৈশব থেকে টের পেয়ে এসেছে সুরঞ্জিৎ। পোস্টমাস্টারের মতো একটি সদাব্যস্ত কষ্টদায়ক চাকরীতে থেকেও কিভাবে এই স্বভাবকে অন্তর্গত করে রাখা যায় এই প্রশ্ন জন্মদাতাকে করবে করবে করেও সুরঞ্জিৎ কখনো করতে পারলোনা। বহুবিধ পারিবারিক ঝুটঝামেলায় বিপর্যস্ত সুরঞ্জিতের মা সন্ধ্যারাণী, সুরঞ্জিতের পিতার উনতিরিশ বছরের সঙ্গী দুঃখ বিপদ অপমান ক্লেদ যন্ত্রণার সাথে যুঝতে যুঝতে কখনো সম্পূর্ণই ভেঙ্গে পড়লে সুরঞ্জিতের পিতার এই অতীতমুখীনতা নিয়ে কটাক্ষ করতে পারতপক্ষে কোন ভুল করেনা। সুরঞ্জিৎ লক্ষ্য করেছে তার মায়ের সেই কটাক্ষ করার সময়তে তার পিতার চোখে এক অদ্ভুত হাসি এসে জুড়ে বসে। কিন্তু সেই চোখে কোন শূন্যতা ধরা পড়েনা। অতীতমুখীনতা কিভাবে এতোটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারে যার কাছে চোখের সামনে ঘটে চলা অপমান অবজ্ঞা ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ কটাক্ষ অবহেলা সবই তুচ্ছতায় পর্যবসিত হয়ে যায়?

হাঁটতে হাঁটতে সুরঞ্জিৎ টিএসসির কাছাকাছি চলে এসেছে। হাতে করে বয়ে বেড়ানো ব্যাগটিকে যতোটা ভারি মনে করেছিলো এখন আর তেমন দুঃসহ লাগছেনা। এতোক্ষণ যাবর রাস্তায় কোন সড়কবাতি জ্বলতে দেখেনি সে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কাছাকাছি চলে আসতেই বিপুল তীব্র উজ্জ্বল আলোতে তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এতোটা তার কাছে প্রত্যাশিত ছিলোনা। কাম্যও ছিলোনা। সুরঞ্জিৎ স্টেশন থেকে নেমেই ভেবেছিলো আজ সারাটা পথ সে বুঝি বিপুল নৈঃশব্দ্য, অনিবার্য অন্ধকারের মাঝেই গন্তব্যে পৌঁছাবে। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে তা আর হয়ে উঠলোনা। সুরঞ্জিতের পায়ের কাছে কি যেনো এসে ঠেকে। সুরঞ্জিৎ পা সরাতে গিয়ে আলোর মাঝে স্পষ্ট দেখতে পেলো ফুটপাথের কোনায় শুয়ে থাকা একটা গর্ভবতী বিড়ালের শরীরে সে আঘাত দিয়ে ফেলেছে। আরেকটু জোরে আঘাত হলেই সুরঞ্জিৎ দুইটি প্রাণের হত্যাকারী হয়ে যেতে পারতো।

বিড়ালটিকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে সুরঞ্জিতের মনে হলো হত্যাকারী হিসাবে নিজেকে আবিষ্কার করলে সে হয়তো বেঁচে যেতে পারতো।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.