নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেজা-ভু

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:২০

এই ভরদুপুরে; মাথার উপরে ছাতা নেই, ভ্যাপসা গরমের অনুপেক্ষনীয় দুঃসহ চ্যাটচ্যাটে ঘামে শরীর যখন পুরোদস্তুর ছেড়ে দিয়েছে, কলাভবন প্রবেশের মুখে অবস্থিত ছাউনীর বিপরীত দিকের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হালকা কালো স্ট্র্যাপের ব্যাগটা সামান্য একটুতেই ছিঁড়ে গেলে মাসুদের যখন মনে হয় অতীতেও ঠিক একইরকমভাবে তার একটা কালো স্ট্র্যাপের ব্যাগ ছিঁড়ে গিয়েছিলো তখন ভাবনাটা তাকে ঘোরলাগা বাস্তবে নিয়ে যায়। মাসুদ যতোদূর স্মরণ করতে পারে এরকম কোন অনুভূতির মুখোমুখি সে আগে কখনো হয়নি। কখনো হয়নি বলে কখনো হবেনা এতোটা মূঢ় মাসুদ নয়। কিন্তু এই যে হয়ে গেলো; এরকম একটি অভূতপূর্ব আপাত তাৎপর্য্যহীন ঘটনায় সে কিছু মুহূর্তে নিজেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেললো, মানসিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার চোরপুলিশ খেলাটাতো এতোটা সহজ নয়। ঝপাং করে জুলাই মাসের এক ভরদুপুরে মাসুদকে ফেলে দিলো বোধহীনতার নীরব নির্জন কুয়াতে। মাসুদ কিভাবে একা একা নিজেকে উদ্ধার করে?

আনইম্প্রেসিভ দেখতে, কথাবার্তাতেও মাঝেমাঝে পিতৃবাড়ী নোয়াখালীর প্রভাব মাসুদের উপর পড়ে বলে প এর পরিবর্তে ফ উচ্চারণ করে ফেলে। তবুও এইসকল সীমাবদ্ধতা তার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। জীবনের প্রতি মাসুদের এটিচিউড মিডিওকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হবার জন্য দশ বছর আগে যেদিন মহসিন হলে পা দিয়েছিলো সেদিন সন্ধ্যাতেই মাসুদ উপলব্ধি করেছিলো তার স্বপ্নগুলোও মিডিওকারই থেকে যাবে আজীবন। শুধুমাত্র একটা কাজে মিডিওকার হবার সামান্যতম সম্ভাবনাও তার কাছে অনুমোদিত ছিলোনা। সেটা হলো তাকে ক্লাসে টপ করতে হবে। শিক্ষকদের সুনজরে থাকতে হবে। এখানে কোন প্রকারের মিডিওক্রিটি এলাউড নয়। মাসুদের বাবা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপ্রভাবশালী কর্মচারী ছিলেন। পুত্রের প্রতি তাই তার অনুক্ত মেসেজটা ছিলো খুবই সহজ; তুমি জীবনে যা কিছুই অর্জন করতে চাও তোমাকে তা নিজে অর্জন করে নিতে হবে। অক্ষম পিতার সেই মেসেজ মাসুদের কান এড়ায়নি। ফলশ্রুতিতে সরলরৈখিকভাবে বছরের পর বছর ক্লাসে দুর্দান্ত ফলাফল করে, ফ্যাকাল্টির প্রতিটি শিক্ষকের সাথেই প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক নিঁখুতভাবে বজায় রেখে, লেকচারারের পদটি বিনাপ্রশ্নে বাগিয়ে অতঃপর ফুলার রোডে একটি কোয়ার্টারের ব্যবস্থা করে অবসরপ্রাপ্ত পিতা, বহুবিধ অসুখের ভারে কাবু মাতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোট বোনটিকে নিজের কাছে এনে রাখতে তার কোন বেগ পোহাতে হয়নি।

বাড়ি ফেরার পর খাওয়াদাওয়া সেরে অতঃপর দীর্ঘ একটা ঘুম দেওয়ার পরে উঠে বিকালবেলায় সে বারান্দায় বসে ভাবতে শুরু করে। এরকম কোন অনুভূতির মুখোমুখি অতীতে মাসুদ কখনো হয়নি। সে অন্তত মনে করতে পারেনা। অথচ ব্যাগটার চেইন যখন দুম করে ছিঁড়ে গেলো তার কিছু মুহূর্ত পরেই মাসুদের মনে হচ্ছিলো সদ্য অভিজ্ঞতার ঘটনাটি তার এই প্রথম নয়। প্রথমবারেও যখন ঘটেছিলো হুবহু একইরকম ঘটেছিলো। মাসুদ ক্লাস নেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে সকাল সকাল বেরিয়েছিলো। তার মেজাজ ছিলো বিক্ষিপ্ত। এডমিনিস্ট্রেশন পলিটিক্সের কমপ্লিকেশনসগুলো তার কনসেন্ট্রেশনকে ক্ষতিগ্রস্থ করছিলো। এতোটাই যে ক্লাসেও এক ছাত্রের করা নির্দোষ প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বেশ রূঢ় জবাব দিলে ক্লাসে উপস্থিত প্রতিটি ছাত্রছাত্রীই মৃদুভাষী অন্তর্মুখী শিক্ষকের অচেনা রুপ প্রত্যক্ষ করে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো। ক্লাস নেওয়া শেষে একইভাবে ডান কাঁধে কালো স্ট্র্যাপের ব্যাগটি বয়ে মাসুদ রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে হাঁটছিলো। ফুটপাথে তেমন লোকজন ছিলোনা। সামনের রাস্তাটা দিয়েও রিকশা চলাচল সীমিত ছিলো। এই ভ্যাপসা গরমেও ভরদুপুরে একটি হুডতোলা রিকশায় এক জোড়া যুগলকে প্যাশনেটলী চুমু খেতে দেখা গিয়েছিলো। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে মাসুদের মনে হচ্ছিলো বাসা নয় একটা রিকশা নিয়ে সোজা কার্জন বরাবর চলে যায়। তারপরে শহীদুল্লাহ হলের পুকুরপাড়ে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রাখে পানিতে। হুবহু এরকম অভিজ্ঞতাই তার আগে হয়েছে বলে মাসুদ মনে করে। কিন্তু কবে কোথায় হয়েছে সেসবের কিছুই সে স্মরণ করতে পারছেনা।

মাসুদকে কিছু একটা ভাবাচ্ছে এটা তার সহকর্মীরা বুঝতে পারলেও তাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলোনা। তারা বরাবরই খেয়াল করেছে ব্যক্তিগত জীবনের ভালোমন্দ নিয়ে মাসুদ সচরাচর তাদের কারো সাথে কিছু শেয়ার করেনা। তাছাড়া মাসুদকে তারা উদ্বিগ্ন হিসাবে আবিষ্কার করলেও পেশাগত কোন কাজে সেই উদ্বিগ্নতার নূন্যতম ছাপও নেই। কিন্তু মাসুদের মাতা সুলতানা কিছুদিন যাবত পুত্রের এই উদাসীনতা ঠিকই লক্ষ্য করছিলেন। শেষমেষ একদিন রাতে খাবার টেবিলে ছেলেকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করেই বসলেন,

“তোর কি হইছে আমারে বলতো। কয়দিন ধরেই দেখতেছি কোনকিছুতে তোর মন নাই। সারাক্ষণ ভুঁরু কুঁচকে থাকোস। কথাবার্তা বলোস না। রোবটের মতো চলাফেরা করোস।”

তার ক্লাশ এইট ফেল জননীকে মাসুদ কি করে বোঝায় সেই দুপুরে কালো স্ট্র্যাপের ব্যাগটা ছিঁড়ে যাবার ঘটনাটাই তার জন্য অভাবনীয় হিসাবে উপস্থিত হয়েছে? মাসুদ হৃদয় নিংড়েও যদি নিজের অনুভূতির সবটুকু মহিলাকে দেখায় তবুও কি তিনি বুঝবেন? প্রশ্নই উঠেনা। ছোটবেলা থেকেই তো মাকে দেখে আসছে। ছোট বড় যেই সমস্যাই হোক তাবিজ কবচের অন্য কোন সমাধানের কথা তার মাথাতে আসবেনা। ডান বাহুর উপরের অংশে একটা কালো রঙের তাবিজ বেঁধে মাসুদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সেয়ানা সেয়ানা ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছে, ধূর্ত শেয়ালের চাইতেও কানিং স্বভাবের কলিগদের সাথে হাসিমুখে কথা বলছে মস্তিষ্কে এরকম কিছু খন্ড দৃশ্যের আনাগোনা অনুভব করতেই মাসুদ জননীকে উপেক্ষা করতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেনা।

“না না আমার কিছু হয়নাই। তুমি খামাখাই ভাবতেছো। রুনার কি অবস্থা? তার দিকে একটু খেয়াল রাইখো। ভার্সিটিতে উঠছে। এই বয়সে ছেলেমেয়েদের মাথার ঠিক থাকেনা। আলগা দুইটা পাখা গজায়।”

সুলতানাকে বিস্মিত করে মাসুদ দ্রুতবেগে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সে স্পষ্টতই বুঝতে পারে এই দুর্বল অভয়বাণী তার আনপড় জননীর কাছে আদপেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি।

বারো কি পনেরোদিন পরে দ্রুত ক্লাস সেরে মাসুদ সিদ্ধান্ত নেয় পল্টনে যাবে। অনার্সে থাকবার সময়ে মাঝেমাঝে ক্লাস শেষে পল্টনে চলে যেতো। তোপখানা রোডের সামনে পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে কম দামে অচিন্তনীয় সব বই পাওয়া যেতো। কেবল কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বইয়ের সারিগুলোর দিকে লক্ষ্য করতে হয়। দোকানীদের সাথে মাসুদের সম্পর্ক বেশ ভালো। এখনো তাকে দেখলে চিনতে পারবে নিশ্চিত। টিএসসি বরাবর হেঁটে পৌঁছানোর পর মাসুদ পল্টনের জন্য রিকশা খোঁজে। উদ্ভট সব রিকশাভাড়া বলতে থাকে একেকজন। পঞ্চাশ টাকা থেকে শুরু করে আশি টাকা পর্যন্ত। তখনই ঘটনাটা ঘটে। দিনে এই প্রথম ভ্যাপসা গরমের কাছে সে কাবু মাসুদের শরীর এমন সিগনাল দেয়। আজকে ক্লাস নেওয়ার পূর্বে ইকোনোমিক্সের লেকচারার সাঈদের সাথে সামান্য কথা কাটাকাটি হয়ে গিয়েছে তার। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের একটা ক্লাসের অল্টারেশন নিয়ে। বদনামের সম্পূর্ণটুকু তার ঘাড়ে এসেই পড়বে এই নিয়ে মাসুদ সংশয়হীন। হুডতোলা একটা রিকশা মাসুদের দৃষ্টিসীমানা বরাবর। খুব সম্ভবত টিএসসি অতিক্রম করে শাহবাগের দিকে যাবে। হুড তুলে বসে থাকা যুগল এই অসহনীয় উষ্ণতার মাঝেও চুম্বনের উষ্ণতা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে অপারগ। মাসুদের বাম হাত ডান কাঁধ বরাবর অটেমেশনের কায়দায় চলে যায়। কি আশ্চর্য, হাতটা চেইন পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছেনা!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.