নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মৃত্যুর আগের মৃত্যু

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১১:০৮

হঠাৎ করে খেয়াল না হলে; সেই খেয়ালে সাড়া দিয়ে ভরদুপুরে এই মুহূর্তে না কিনলেও চলে এমন জিনিস কিনতে গাউসিয়া মার্কেটে না এলে দৃশ্যটা দেখতে হতোনা এই ভেবে রাব্বি কয়েকটা সংগোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দৃশ্যটা না দেখলেই ভালো ছিলো।

অফিসে রাব্বির হাফ ডে ছিলো। জাতীয় ক্রিকেট দলের মাঝারি মানের এক খেলোয়াড়ের সাক্ষাৎকার নিতে সকালবেলায় স্টেডিয়ামে ছুটেছিলো। সামনে পাকিস্তান ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফর করবে। তার আগে আসন্ন সিরিজ, নিজের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি এইসব নিয়ে সেই খেলোয়াড়ের সাক্ষাৎকার নেওয়ার এসাইনমেন্টটা রাব্বি নিজের আগ্রহেই নিয়েছিলো। সাক্ষাৎকার শেষ করে অফিসে এসে তার আপডেট কামরুল ভাইকে বুঝিয়ে দিয়ে যখন আজকের দিনের জন্য নিজেকে কর্মহীন হিসাবে আবিষ্কার করলো তখন সে ভাবলো গাউসিয়া মার্কেটে যাওয়া যায়। দীপার জন্য ছোটখাটো কোন অর্নামেন্টস কিনে দেখা হবার দিনে তাকে সারপ্রাইজ দেবে।

শীলার সাথে ডিভোর্সটা হয়ে যাওয়ার মাস চারেক পরেই দীপার সাথে পরিচয় হয়েছিলো। শ্যামলা, ছিপছিপে গড়নের দেখতে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে সবেমাত্র মার্কেন্টাইল ব্যাঙ্কে জয়েন করেছে। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ট্র্যাজেডীটার কথা দীপার সাথে সে খোলাখুলিই শেয়ার করেছিলো। তারপরে তাদের ব্যাপারটা জমে উঠতে বেশী সময় নেয়নি। ছোটখাটো, ননফ্যান্সি অর্নামেন্টসের প্রতি দীপার ফ্যাসিনেশনের ব্যাপারটা রাব্বি ততোমধ্যে ভালো করেই জেনে গেছে। সেটা মনে করেই অফিস থেকে সোজা গাউসিয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে গিয়েছিলো রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের উৎপাত নেই এই বাড়তি ইনসেনটিভ সাথে নিয়ে। কিন্তু ম্যান প্রপোজেস, গড ………

ট্রাফিক জ্যামের বিষয়টা বাদ দিলে দিনটা অন্যান্য গতানুগতিক কোন দিনের মতোই। গাউসিয়ার চিত্রটাও চিরাচরিত বাসি মুখস্থ এক চিত্র। লোকজন চিপা জায়গাগুলা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যতোটুকু পারে কাপড়চোপড় দেখছে; অপরজনকে ধাক্কা দিচ্ছে। কেউ কেউ ধাক্কা দিয়ে সরি বলছে। কেউ কেউ এতোসব সৌজন্যতার তোয়াক্কা করছেনা। বিক্রেতাদের বিরস মুখ তাদের দোকানের সামনে দিয়ে কাস্টমার হেঁটে যাওয়া মাত্রই কৃত্রিমভাবে উৎসুক হয়ে যাচ্ছে। ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে মানুষ নামছে তো নামছেই। যাদের গন্তব্য নীলক্ষেতের বইয়ের দোকান তারাও ‘পথ চলতে চলতে দেখি কিছু জামাকাপড়’ ভাব নিয়ে ভীড়কে আরো দুঃসহ করে তুলছে। এমনই এক গৎবাঁধা পরিবেশে রাব্বি মাত্রই ভিড় এড়িয়ে গাউসিয়া যাবার পথে খোলা রাস্তাটায় পা বাড়িয়েছে তখন বিশ গজ সামনে একটা জটলা দেখতে পেলো। মানুষজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাব্বি জটলার দিকে কৌতূহল নিয়ে আগালো। ব্যাপারটা কি?

ব্যাপারটা বেশ আনকমফোর্টেবল। আনফরচুনেটও বটে। এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক, নিথর হয়ে গাউসিয়ার রাস্তায় শুয়ে আছে। ডেড। সাডেন হার্ট এটাক। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে- উপস্থিত আম পাবলিককে এটুকু ভাবার সুযোগও নাকি দেননি। রাব্বি একে ওকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো ভদ্রলোক এই কিছুক্ষণ আগেও গাউসিয়ায় শপিং করেছেন। যেই ভদ্রলোকের সাথে শপিং করতে করতে আলাপ জুড়ে দিয়েছিলেন তার কাছ থেকে রাব্বিসহ অন্যরা জানতে পারলো তিনি মেয়ের জন্য শপিং করতে এসেছিলেন। ব্যাপারটা বিস্ময়কর। আজকাল নিজের বিয়ের শপিং তো তারা নিজেরাই করে থাকে। তারা না করে থাকলে তাদের মা। কিন্তু বাবা কেনো? এইসব ভাবনায় অবচেতনভাবে ইনভলভড হয়ে যেতে যেতে রাব্বি ভদ্রলোকের নিস্পন্দ মৃত শরীরের দিকে তাকালো। তাকিয়ে তার দৃষ্টি জমে গেলো।

পরনে সাদা শার্ট, ছাই রঙা প্যান্ট। বৈশিষ্ট্যহীন সাধারণ চেহারা। যাদের একবার দেখলে দ্বিতীয়বার সচরাচর মনে থাকেনা। মাথায় একটা বড়সড় টাক, এই ভরদুপুরে যাকে উজ্জ্বল সোনালী দেখাচ্ছে। শার্টের বুকপকেটে একটা ছোট্ট কাগজ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। শপিঙের লিস্ট না হয়ে যায়ই না। ডান হাতের পাশে তিনটি শপিং ব্যাগ মাটিতে পড়ে আছে। এইসব সাধারণ বিষয় ছাড়িয়ে যা রাব্বির মনোযোগ কেড়ে নিলো তা হলো ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা নির্ভার নিশ্চিন্ত হাসি। এ কিভাবে সম্ভব? রাব্বি হতবাক হয়ে গেলো। সে নিজের মনেই এনালাইজ করতে শুরু করলো। মেয়ের বিয়ের শপিং করতে নিজেই এসেছিলেন। এ থেকে অনুমান করাটা কঠিন কিছু নয় যে মেয়ের মা জীবিত নেই। পোশাকআশাক দেখেও মনে হবার কোন কারণ নেই ভদ্রলোক জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। এই রিয়েলিটিতে মেয়ের বিয়েটাও বাপ হিসাবে ভদ্রলোকের জন্য নিঃসন্দেহে ক্রুশিয়াল একটা ইভেন্ট। এমন সময়ে তিনি স্পষ্টতই বুঝতে পারলেন তার হার্ট এটাক হয়েছে। আশেপাশের মানুষদের গুছিয়ে কিছু ভাবার অবকাশ না দিয়ে দ্রুত নিস্পন্দ হয়ে গেলেন। তারপরেও মৃত্যুর ঠিক আগে কোন জাদুবলে ঠোঁটের কোনে এরকম হাসি অবশিষ্ট রেখে মরে যাওয়া যায়? এরকমটা রাব্বি আগে কখনো আবিষ্কার করেনি। উপস্থিত অন্য কাউকেই সে নিজের এই মুহূর্তের অনুভূতিটা বোঝাতে পারবেনা। ভদ্রলোকের আকস্মিক মৃত্যুর মতো; কিংবা তার চাইতেও বেশী রহস্যজনক ঠোঁটের কোনে রেখে যাওয়া তার হাসিটা। আরেকবার সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রাব্বি ভেতরে ভেতরে আরো কেঁপে উঠলো। হাসিটা রহস্যজনক শুধুমাত্র এই কারণেই না যে তা ঠিক মৃত্যুর আগ মুহূর্তে্র। আমার মৃত্যু এসেছে এবং আমি তাকে সহজভাবে গ্রহণ করছি- এরকম একটা সূক্ষ্ণ বার্তাও হাসিটায় দৃশ্যমান।

অফিসে কি দীপার সাথে কাটানো সময়গুলোতে রাব্বির অন্যমনস্কতা কলিগরা তো বটেই দীপারও নজর এড়ায়না। ক্যাজুয়ালী রাব্বিকে সেই অন্যমনস্কতার কথা জিজ্ঞেস করলে রাব্বি শ্রাগ করতে চেষ্টা করে।

‘না না তেমন কিছু না। অফিশিয়াল কিছু প্রবলেম চলতেছে। সেগুলা নিয়ে একটু টেনশনে আছি আর কি। অর্নামেন্টসটা তোমার কেমন লাগছে আমাকে আর বললানা তো।’

কিন্তু অফিস সেরে কিংবা দীপার সাথে ডেটিং সেরে মেসে ফিরতেই রাব্বিকে সেই হাসি তাড়িয়ে বেড়ায়। সে এই বিষয়ে সচেতন যে হাসিটা তার চেতনাকে ক্রমশ গ্রাস করতে শুরু করেছে। কিন্তু কার সাথে শেয়ার করা যায়? রাব্বি এই বিষয়ে নিঃসন্দেহ কলিগদের মধ্যে যারা তার ঘনিষ্ঠ তাদের তো বটেই এমনকি দীপার সাথেও যদি সে সেদিন গাউসিয়ায় যা দেখেছে, দেখে তার যে অনুভূতি হয়েছে তা শেয়ার করতে যায় সে নিখাদ পাগল হিসাবে সাব্যস্ত হবে। উপায় নেই গোলাম রাব্বি, তোমার কোন উপায় নেই। সে নিজের মনে বিড়বিড় করে।

দশদিন পর এক দুপুরে পরিস্থিতি খুব অসহনীয় ঠেকলে রাব্বি মেসের ছাদে উঠে। হেস্তনেস্ত কিছু একটা করবে সে আজ। গতোকাল রাতে ছাদে কিছু কাপড় শুকাতে দিয়েছিলো। সেগুলা আগে নিয়ে আসবে। তারপর……রাব্বি দড়িতে ঝুলতে থাকা নিজের কাপড়গুলো হাতে নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে দেয়। আজকে আবহাওয়া ভালো তপ্ত আছে। খালি পায়ে ছাদে এসেছে। গরমের ভাপে পায়ের তালু বুঝি পুড়ে গেলো। রাব্বি কার্নিশের দিকে ক্রমশ আগায়। উপর থেকে নিচে তাকালে সেই একই বাসী মুখস্থ চিত্র। ফুটপাথ দিয়ে গার্লস স্কুলের মেয়েরা স্কুল ছুটি হবার পরে গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে। এলাকার আঁখবিক্রেতা সোবহান মিয়া অবলীলায় নোংরা গ্লাসে করে দশ টাকার আঁখের শরবত খাওয়াচ্ছে। একটা কালো কুকুর কারো ঢিল খেয়ে দৌড়াতে শুরু করেছে। একটা সাদা প্রাইভেট কার হর্ন বাজিয়েও বিশেষ সুবিধা করতে পারছেনা এই আক্রোশে সামনের রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে ধারাবাহিক শাপশাপান্ত করে যাচ্ছে। ডান পা কার্নিশের প্রায় শেষ প্রান্তে রেখে পাটা পিছলে যাক মনে প্রাণে এই প্রার্থনা করলো রাব্বি। পিছলে গেলো কি? আচ্ছা, তার কি কখনো এক্রোফোবিয়া ছিলো? যেনো থাকলেই ঠোঁটের কোনে সেই হাসি চলে আসতে পারতো। নির্ভার, নিশ্চিন্ত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.