নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গন্তব্য নিস্ফল

০১ লা নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:৪৮

রিকশা থেকে নামতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন; কোনভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে যখন সটান দাঁড়িয়ে পড়লেন তখন দেখলেন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, হালকা হালকা কুয়াশা বাতাসে নেমে এসেছে। তিনি কুয়াশায় নাক ডুবিয়ে দিলেন। তার অত্যন্ত প্রিয় সংগোপন একটি অভ্যাস। নাক ডুবিয়ে অনুভব করলেন শৈশবে গাঁয়ের মাঠ পেরিয়ে কালাম চাষীর ঘরের কাছে এসে দাঁড়ালে যেই শিউলী ফুলের গন্ধ পেতেন সেই প্রাগৈতিহাসিক গন্ধটি অনেক অনেকদিন পরে বিস্মৃতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার সাথে মিতালী পাতিয়েছে। গন্ধটির সঙ্গ উপভোগ করতে করতে তিনি ধীরেসুস্থে ভাড়া মেটালেন। তারপরে কার্তিকের সদ্যই সন্ধ্যা নেমে আসা প্রহরে তিনি ডান হাতে কালো ব্যাগটি ধরে হাঁটতে শুরু করলেন, সন্তর্পণে।

তার শরীর এখনো ঈর্ষনীয় মজবুত আছে এই কথা সকলে এক বাক্যে স্বীকার করে। সহকর্মীদের মধ্যে যারা এখনো বেঁচে আছে; যাদের সাথে এখনো তার যোগাযোগ অবশিষ্ট রয়ে গেছে কোন এক দৈবক্রমে, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী, তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছেও তার ছিয়াশি বছর বয়সী কারো জন্য অকল্পনীয় এই শক্ত শরীরটি বিস্ময় জাগানিয়া। এমনকি তেরো বছর আগে তাকে ছেড়ে পরলোকবাসী হওয়া স্ত্রী পর্যন্ত জীবিত থাকাকালীন সময়ে তাকে প্রায়শই বলতো যে এই পোক্ত শরীরটির কারণে তিনি অনেক অনেকদিন বাঁচবেন। তিনি শুনে কেবলই হাসতেন। সবারই এক কথা। তিনি অনেকদিন বাঁচবেন। সেই অনিবার্যতাকে তিনি ভালোবাসেন কিনা, কখনো আদপেই ভালোবেসেছেন কিনা এই প্রশ্নের মুখোমুখি তিনি আজ অবধি হননি। সদ্যই বহুকাল আগের শিউলী ফুলের গন্ধটি তার সাথে মিশে গিয়েছে বলেই কিনা কে জানে; তিনি নির্মোহ হয়ে উঠলেন, নিজেকে এক ধাক্কায় বাস্তবে নামিয়ে আনলেন। ছিয়াশি বছর হলো তিনি বেঁচে আছেন; এই সত্যটি তিনি উপভোগ করেন কিনা, কখনো এই একান্তই প্রাতিস্বিক কৃতিত্বে তার মন আন্দোলিত হয়েছে কিনা এইসব প্রশ্ন তাকে জিজ্ঞেস করবে সেই স্থান কবে কাকে দিয়েছেন? জন্মেছিলেন ব্রিটিশ শাসনামলে। বয়স যখন পঁচিশের ঘরে তখনই সোজা প্রবেশ করেছিলেন সিভিল সার্ভিসে। সেই সময়কার সিভিল সার্ভিসের মর্ম এই সময়ের কেউ বুঝবেনা। সেই যে সরকারী চাকরীতে প্রবেশ করেছিলেন তারপরেও তো জীবনে কতো কি এসেছে। বিয়ে, স্ত্রী, সংসার, সন্তানসন্ততি, দাদা-নানা হবার আনন্দ, সন্তানের আত্মহত্যায় মৃত্যুর তিক্ত স্বাদ, ট্রাক ড্রাইভারের হাত ধরে স্নেহের নাতনীর এক কাপড়ে পালিয়ে যাওয়া, অতঃপর ছয় মাসের অন্তঃসত্তা হয়ে ফিরে আসা- কতো কি ঘটে গেলো; কতো বিচিত্র প্রকৃতির ঝড়ই না দেখলেন ব্যক্তিগত জীবনে, কিন্তু তিনি অবিচলিত রইলেন। সরকারী কর্মকর্তার কাঠিন্য শুধুমাত্র তার সহকর্মীরাই দেখেনি, আজীবন দেখে এসেছে তার পরিবার-পরিজনেরাও। তিনি ভালোভাবেই অবহিত এখন তিনি কেউ নন, তাদের কারো জীবনেই। তবুও তাকে প্রবলভাবেই সমীহ করে সবাই। সহসা তার কাছে যেতে চায়না। কখনো অসুস্থ হলে আত্মীয়স্বজনেরা দূর থেকে তাকে দেখে যায়। সেই দৃষ্টিতে তিনি আজ পর্যন্ত ভয় ব্যতীত অন্য কিছুর ছায়া দেখেননি। তাদের কেউ তার বিছানার কাছে এসে কখনো নরম সুরে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনা।

সন্ধ্যা বেশ ঘন হয়ে এসেছে; চারপাশে আওয়াজ ক্রমশই বাড়ছে, এমন সময়ে বাইরে থাকতে তার বেশ লাগে। তার এই ভালোলাগা সাম্প্রতিক। চারিদিকে শুধু আওয়াজই নয়, আলোর প্রাবল্যও তাকে যুগপৎ বিস্মিত এবং আলোড়িত করে। শহর কখনো এতোটা আলোকিত হতে পারে কি হবে এমনটা তার ধারণাতেই ছিলোনা। বড় ছেলের বাড়িতে আছেন কম করে হলেও দশ বছর হবে। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে বড় ছেলে; তার অনুমান দয়াপরবশ হয়েই, তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। ততোমধ্যে তার ছেলেরও নিজস্ব জমাট তৃপ্ত নিশ্চয়তার সংসার। কাস্টমসের বড় অফিসার, বাপের সততা না পেলেও মেজাজ পেয়েছে ষোলোআনা। তিনি ছেলের বাড়িতে পা দিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই লক্ষ্য করেছিলেন তার বড় ছেলেকে তার স্ত্রী পুত্র কন্যা সকলেই বেশ ভয় পায়। বিস্ময়কর হলেও সত্য তার নাতি রকিব; যে কিনা আপাদমস্তক এ যুগের ছেলে, নাতনী সুমাইয়া; যে কিনা নিজের অজান্তেই তার দাদীর কিছু বৈশিষ্ট্য পেয়েছে, এরা দুজনেই বাপের চেয়ে তাদের রাশভারী দাদার সাথেই বেশী খোলামেলা। তার সাথে আত্মীয়পরিজনদের যেই সম্পর্ক তার থেকে ব্যতিক্রম তার এই দুইজন। ঠিক বলা হলোনা, আরেকজন আছে। প্রকৃতার্থে ছিলো। তার আরেক নাতনী মেহেরুন। এক কাপড়ে ট্রাক ড্রাইভারের হাত ধরে পালিয়ে ছয় মাস পরে যখন অন্তঃসত্তা হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলো তিনি সেইদিন থেকে আজ পর্যন্ত তার মুখ দেখেননি। কোন খোঁজখবর পর্যন্ত করেননা।

তিনি কালো ব্যাগটিকে শক্ত করে চেপে ধরলেন। আরেকটু হলেই পড়ে যেতে নিয়েছিলো। শ্যাওড়াপাড়ার এই রাস্তাটি কার্তিক মাসের কুয়াশা ভেজা সন্ধ্যায় তার কাছে বেশ জটিল আকার ধারণ করে। অলিগলিগুলো তার কাছে অপরিচিত ঠেকে। তিনি একবার মৃদু হাসলেন। তার ক্রমশই দুর্বল হয়ে আসতে থাকা ধবধবে দাঁতগুলো অন্ধকারে একটুখানি ঝলক দেখিয়ে ফের নিজেদের গুটিয়ে নিলো। তিনি চ্যালেঞ্জ অনুভব করলেন। এই জটিল মনে হতে থাকা পরিচিত রাস্তাটিকে তিনি সহজ করে তুলবেন। নিজের পর্যবেক্ষণ শক্তি দিয়ে তাকে পরাভূত করবেন।

সামনে আঠারো গজের মতো পশ্চিমে গেলে মোবাইল ফোনের দোকানে লাল শার্ট পরা যুবক ছোকরাটিকে দেখা যাবে। সে বিরস মুখে মোবাইল গুতাগুতি করে, মানুষের মোবাইলে টাকা পাঠিয়ে দেয়। কোন সুন্দরী যুবতী কি তরুণী মোবাইলে টাকা ভরাতে আসলে তার দিকে আড়চোখে বারবার তাকাবে। মোবাইলে টাকা ভরে দেওয়ার পরে তারা চলে গেলে তাদের নাম্বারগুলো নিজের এক খাতায় টুকে রাখবে। এই তথ্যটি তার ভালোভাবে জানা আছে। নিজের চোখে অসংখ্যবার ছোকরার এই অপকর্ম তিনি দেখেছেন। দোকানটিকে অতিক্রম করে গেলে বাম পাশে ফুচকা চটপটির দোকান। সেখানে তরুণ-তরুণীরা স্বাদ পাবার জন্য চোখ বন্ধ করে ফুচকা খায়। টক বেশী করে নিয়ে। তারপরেই পরপর ছয়টির মতো হাইরাইজ বিল্ডিং। পাশাপাশি। সেগুলোর মধ্যে হালকা সবুজ রঙের এপার্টমেন্টটির তিন তলার যেই বারান্দা রাতেরবেলাতে তিনি প্রায়ই সেখানে বসে বসে বাতাসহীন নির্লিপ্ত গাছের পাতা, চাঁদের আলোতে পরিতৃপ্ত আকাশ এবং নিঃশেষিত কোলাহল দেখেন।

তিনি হালকা বিরক্তবোধ করলেন। সচরাচর এতোটা পথ হাঁটতে তার এতো দীর্ঘ সময় লাগেনা। আজকে অনেক বেশী সময় লেগে গেলো। ঘড়িতে চোখ মেলে দেখলেন। ছয়টা বেজে উনপঞ্চাশ হয়েছে। তিনি স্পষ্টতই বুঝতে পারছেন এই মুহূর্তে তার বড় ছেলের বাসায় প্রত্যেকের মুখই অপ্রসন্ন। এই সন্ধ্যায় তিনি একলা হাঁটতে বেরিয়েছেন। যদি কিছু একটা হয়ে যায়? এই সম্ভাব্যতায় তার উপরে সকলেই বিরক্ত। বিশেষত তার ছেলের বউ এই বিষয়ে তিনি সংশয়হীন। দশ বছর যাবত ঋজু শরীরের মেজাজী মনের শ্বশুরের সেবা করে করে তার উপরে বীতশ্রদ্ধ। যদিও তার মুখের রেখায় সেই ক্ষোভের ছাপ বলতে গেলে পড়েই না। সম্প্রতি তিনি লক্ষ্য করেছেন চারপাশের মানুষজনের এই সকল ছোটখাটো বিষয়কে তিনি বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন ইদানিং। অবচেতনভাবেই। এক ধরণের অপ্রস্তুত অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ তার চেহারায় ফুটে উঠে। তিনি হাঁটবার গতি বাড়িয়ে দিলেন।

হালকা সবুজ রঙের এপার্টমেন্টটির কাছাকাছি এসে তিনি দেখলেন রাস্তার আলোগুলো এই মুহূর্তে কেমন জানি চোখে লাগছে। কেউ তাকে আদেশ দেয়নি; তিনি নিজেও যে ইচ্ছুক ছিলেন এমন নয়, তবু তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। তখন তিনি বন্ধ চোখে দেখতে পেলেন তার সমগ্রতাকে সাথে করে গোটা শহরটি যেনো কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভয়াল, চারপাশকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এমন কোন ঝড়ের পূর্বাভাসে গাছের পাতা সুদূরে আছড়ে পড়ছে, বাড়িঘরে ধ্বসে যেতে শুরু করেছে, মানুষজন নিজ নিজ গৃহ থেকে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে আসছে, তাদের চোখ আতংকে জমে গেছে, রক্তমাংসের এক দঙ্গল মানুষ নিজেদের আশ্রয়ের সবটুকুকে ছুঁড়ে ফেলে কি ঘটবে এই প্রশ্নের উত্তরে সন্ধান করতে গিয়ে মাটির একেবারে ভেতর থেকে আসা এক এবং অদ্বিতীয় সেই সোঁদা গন্ধের প্রবলতায় সম্মোহিত হয়ে মাটিতে ঝুঁকে সেই গন্ধ শুঁকছে। ভয়ে এবং ভালোবাসায়।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:০৫

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: উফ!
ভয়াবহ।
সংলাপ ছাড়া গল্পও হলেও সুন্দর

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.