নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঘননীল আকাশ কিংবা রহস্য হারানো বনের গল্প

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:২০

যেদিন অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে পারেন তিনি লক্ষ্য করেছেন সেদিন সন্ধ্যা নেমে আসবার পরে আকাশকে ঘননীল দেখায়। অথচ এই সাধারণ কথাটিই কারো সাথে শেয়ার করতে তিনি দ্বিধান্বিতবোধ করেন। গতো এগারো বছর ধরে যার সাথে সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা-রাত-সাপ্তাহিক দুইটি গভীর রাত পর্যন্ত কেটে যায় সেই স্ত্রীর কাছেও না। যদি তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে? এমনিতেই নিষ্প্রভ নিরীহ বর্ণচোরা ব্যক্তিত্বের বলে তার প্রতি স্ত্রীর মমতাটুকু একটু বেশীই। তিনি পলে পলে এই সত্যকে অনুভব করেন। কিন্তু ওই যে, ঘননীল আকাশের বৃত্তান্ত কারো সাথে শেয়ার করবার ইচ্ছাটা দিনে দিনে তার তীব্র হয়ে উঠছে।

তিনি হাঁটবার গতি বাড়িয়ে দিলেন। অফিস ফেরত পথে সচরাচর তিনি দ্রুত হেঁটে থাকেন। আজকে তার হাঁটবার গতি আশ্চর্যজনকভাবে অতিমাত্রায় শ্লথ। বাতাসের উপস্থিতি সপ্রতিভ না হলেও চ্যাটচ্যাটে গরমে শরীর ভিজে যাচ্ছে আবহাওয়াটা ঠিক এমনও নয়। এই তো তারই চোখের সামনে দিয়ে কি নিঁখুত ভঙ্গিমায় একটি বাচ্চা ছেলে একগাদা কাগজ হাতে নিয়ে ভিড় কাটিয়ে সামনে এগুতে পারলো। এই সময়ে বরাবরই রাস্তাটিতে ভিড় থাকে। মানুষজন অত্যন্ত সন্তর্পণে নিজেদের মানিব্যাগ, হ্যান্ডব্যাগ, হাতে অন্য কোন ব্যাগ থেকে থাকলে সেগুলোকেও সামলে তবেই পথটিতে চলতে সাহস করে। তার হাতে আছে একটি কালো রঙের জীর্ণ ব্রিফকেস। পেশাগত জীবনের প্রথম কর্মদিবসে অফিস শেষে কিনেছিলেন। আজও পরম যত্নে ধুয়েমুছে ব্রিফকেসটি ব্যবহার করেন।

তিনি যা প্রত্যাশা করেছিলেন তাই। সরু রাস্তাটিতে আজ পর্যন্ত যতোবার এসেছেন সবসময়ে লক্ষ্য করেছেন কালো ছাই যুগল রঙের একটি অতিবৃদ্ধ কুকুর অত্যন্ত নিরাসক্ত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে থাকে, কিংবা শ্লথ গতিতে দু কদম আগে পিছে ঘোরাঘুরি করে। বেশীরভাগ সময়তেই তিনি তাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছেন। অতিকায় স্থূল শরীরের, যার দিকে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই টের পাওয়া যায় মৃত্যুর জন্য যার অপেক্ষা ক্লান্তিহীন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু দিলীপের কথা স্মরণ করলেন। ক্যান্সার ধরা পড়েছিলো। লাস্ট স্টেজে। যখন ঢাকা মেডিকেলের বেডে শুয়ে থাকতো তার চোখেমুখ ঠিক এমনটাই প্রাণহীন ছিলো। তিনি আবারো কুকুরটার দিকে তাকালেন। ঘুমিয়ে আছে। এবারে পাশ ফিরে চোখ বরাবর যেই ডাস্টবিনটি আছে সেই বরাবর শুলো।

সেই রাত্রে স্ত্রীর সাথে টুকটাক সাংসারিক আলাপ সেরে নিয়ে আট বছরের ছেলে রিয়াদের সাথে অর্থহীন ভালোলাগায় আবৃত বাক্যমালা সেরে যখন তিনি বিছানায় শুলেন তার কিছু সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে তলিয়ে গেলেন। শুধুমাত্র ঘুমের সান্নিধ্যেই তার থাকা হলোনা। দেখলেন একটা বিশাল অরণ্যে তিনি পথ হারিয়ে খুঁজছেন। চারপাশের গাছগুলোর চোখ জীবন্ত। এবং ঝলসে যাওয়া জ্বলজ্বল। তিনি যতোই পথ হারিয়ে বন থেকে পালাতে চাইছেন গাছগুলোর চোখগুলো ততোই বেশী ঝলসে যাচ্ছে। এবং বিস্ময়করভাবেই সেই চোখগুলো তখন হাসছে। তিনি হাঁটছেন তো হাঁটছেন। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। বাম থেকে ডানে। ডান থেকে বামে। তবু অরণ্য ছেড়ে সাধারণ পথের সন্ধান খুঁজে পাচ্ছেন না। এভাবে স্বপ্নের মধ্যেই তার শরীরে ক্লান্তি অকস্মাৎ কুয়াশার মতো আবির্ভূত হয়। কিছু সময় পরে গলা শুকিয়ে আসলে বারবার তিনি ঢোঁক গিলতে থাকেন। এবারে তিনি লক্ষ্য করেন একেকবার ঢোঁক গিলবার পরে গাছেদের চোখগুলো ধীরে ধীরে চোখ ঝলসানো উজ্জ্বলতা হারিয়ে বিবর্ণ হতে থাকে। তারা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। খুব সম্ভবত তারা কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চায়। তিনি স্বপ্নের মধ্যেই প্রবলভাবে চিৎকার করে উঠেন। হঠাৎ দেখতে পান; স্বপ্নে অবগাহনের মাঝেই, তার ছেলে রিয়াদ একেবারে একা একা, বিস্তীর্ণ বৃহৎ অচেনা বনে এসে তার নাম ধরে ডাকছে। বাবা সম্বোধনে নয়, মোঃ এখলাসউদ্দীন নামে। তিনি দেখতে পান বৃহৎ বিস্তৃত বনের যেই রহস্যাবৃত পথে তিনি এতোক্ষণ যাবত দিশেহারা হয়ে ঘুরছিলেন ক্রমশই তার রহস্য বিসর্জন দিয়ে নিজেকে খুলতে শুরু করেছে। এই তো, চোখের সামনেই ডানদিকের পথটুকু আরেকটু বড় হয়ে গেলোনা? সেই পথ ধরে এগোলেই তো রিয়াদের কাছে পৌঁছে যাওয়া যাবে। তিনি সন্তর্পণে ডান পা আগে এগোতেই স্বপ্ন তাকে ছেড়ে গিয়ে ঘুমের অতলান্তে নিজে থেকে পৌঁছে দিলো।

দশদিন পরে বিকাল চারটায় যখন রমনা পার্ক থেকে বেরুলেন তখন চারপাশের মানুষজন তাকে দেখে বিস্মিত হচ্ছিলো। একজন বিশেষত্বহীন চেহারার মানুষ; রাস্তায় আখের শরবত খেলে কিংবা তরমুজ খেয়ে হাত দিয়েই মুখ মুছে ফেললেও যার দিকে সচরাচর মানুষ আগ্রহ নিয়ে তাকায়না, আচমকাই তার চোখজোড়া অসম্ভব তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। তার একেকটি দৃষ্টিতে ট্রাফিকজ্যাম, দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট, জ্যামে আটকা পড়া যানবাহনগুলোর মানুষদের ঠিক ঠিক পড়ে ফেলছেন। তারাও লোকটির দৃষ্টিতে নিজেদের নগ্নতাকে আবিষ্কার করতে পেরে এই প্রথম তার দিকে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখছে। কে এই লোক? আগে তো কখনো একে দেখা যায়নি শহরে। কোন জাদুবলে এমন একজন লোক আমাদের আপাদমস্তক পড়ে ফেলে, আমাদের নগ্ন করে উদ্ভ্রান্তের মতো সামনে এগিয়ে চলেছে? দেখো তার দিকে চেয়ে। পরনের শার্টের অর্ধেকটা প্যান্টের ভেতরে, বাকি অর্ধেকটা ডানদিক থেকে হাস্যকরভাবে ঝুলে আছে। প্যান্টের অবস্থাও যাচ্ছেতাই। বাম দিকের অংশ ধবধবে সাদা। ডানদিকের অংশ দেখে মনে হচ্ছে যেনো কেউ আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে সেখানে। তারা জ্যামের মধ্যে বসে থেকেই বিস্ময়ে মূঢ় হয়ে গেলো।

সেদিনও আকাশের রঙ সন্ধ্যা নেমে আসতেই ঘননীল হয়ে এসেছিলো। তিনি জীবনে প্রথম কথাটি কারো সাথে শেয়ার করতে পেরেছিলেন। রাত নয়টার মতো হবে তখন, পিজি হাসপাতালের সামনে সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কারের বিস্ফোরিত হেডলাইট অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজেকে চূর্ণ বিচূর্ণ হতে দেখবার পরে কথাটি জেনেছিলো। সাথে আবিষ্কার করেছিলো গলা শুকিয়ে আসলে স্বপ্নে দেখা বিস্তৃত বন ক্রমশ তার রহস্য হারাতে শুরু করে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.