নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

হারানো গন্ধের ঠিকানা

১৩ ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:৪৩

সকালবেলায় হাঁটতে গিয়ে সে আবিষ্কার করলো গন্ধটা ভেজা ভেজা; তখনো মসজিদে মুয়াজ্জিন আজান দিয়েছে কি দেয়নি, রেস্টুরেন্টগুলা পরোটার উত্তপ্ত আঁচে ঝলসে উঠেছে কি উঠেনি, বাড়ির অজ্ঞাত শিশুটি ঘুমের ঘোরে কেঁদে উঠেছে কি উঠেনি- এরকম অনেককিছু হয়নির সমাহারে সে আবিষ্কার করলো গন্ধটা ভেজা, কবে কখন থেকে সিক্ত তার হদিস সে জানতে পায়না।

গন্ধের সাথে মিতালী পাতাবার অভ্যাসটা সে পেয়েছে তার বাবার কাছ থেকে। যতোদিন বেঁচে ছিলেন ভদ্রলোক সুযোগ পেলেই প্রাণভরে গন্ধের স্বাদ নিতেন; সদ্য ফোটা শিউলীর হোক কি গনগনে সূর্যের আলোতে রাস্তায় খসে পড়া গাছের রুক্ষ পাতা- গন্ধ নেওয়ার অরুচি কখনো জনকের মাঝে দেখেনি সে। মৃত্যুর পরপর কফিনে মোড়ানো ধবধবে সাদা কাপড়ের মাঝে আবদ্ধ পিতার মুখটি নিবিষ্টমনে দেখেছিলো সে; আসলে সে দেখতে চাইছিলো লোবানের পরিচিত গন্ধের অন্তর্গত অপরিচিত অন্য কোন গন্ধের সন্ধান আছে কিনা। কিন্তু সমবেত শোকের গগনবিদারী বিলাপের মাঝে সে দেখতে পেয়েছিলো তার জনকের মুখে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। তার মনে পড়ে ক্লিন শেভড মুখের ব্যাপারে তার পিতার অবস্থান গ্রীষ্মের রিজিড তপ্ত বাতাসের মতো ছিলো। অনেকদিন পরে তার মনে হয়েছিলো লোবানের পরিচিত গন্ধের বাইরে অন্য কোন গন্ধ নেই বলে সে মানুষের মৃত্যু ছাড়া সচরাচর প্রকাশ্যে উপস্থিত হতে সংকোচবোধ করে।

সে পত্রিকার পাতায় হাত বুলাতে থাকে; মমতা কি ঔদাসীন্যে বোঝা যায়না। শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসী চেয়ে যেদিন থেকে আন্দোলন শুরু হলো সেই সন্ধ্যাতেই সে ছুটে গিয়েছিলো শাহবাগে; সেদিনও গন্ধটার সাথে কিছু অভিজ্ঞতা তার বিনিময় হয়েছিলো, ভেজা ভেজা সেই গন্ধ। যেনো কিছু একটা বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছে সে; শুধু তারই কাছে। যেনো সেই গন্ধটি বলতে চাইছিলো ‘তোমরা চাইলে এখান থেকে শুরু করতে পারো নতুন কোন গান, নয়তো আরো বহু বছর তোমাদের গান কোন নতুন সঙ্গীত শ্রবণের অযোগ্য হয়ে থাকবে।’ কথাগুলো তার হৃদয়কে স্পর্শ করে থাকতে পারতো, কিন্তু থাকেনি। বুকের মাঝে প্রতিদিন হাজারো হাতুড়ির আওয়াজ শুনতে শুনতে সে উপলব্ধি করে। অথচ সন্ধ্যাটিকে কি অসম্ভব দীর্ঘ বলে মনে হচ্ছিলো; ঘাসে ঘাসে নতুন স্পন্দন, হাজার কন্ঠে নতুন আওয়াজের সংকেত, শাহবাগের চায়ের দোকানগুলো মুখরিত, পিজি হাসপাতালের রাস্তাটা ক্রমশ ভরে উঠছিলো নতুন নতুন মানুষে, ক্ষিপ্ত মানুষে- যাদের অসন্তুষ্ট মুখের দিকে চেয়ে স্পন্দিত হচ্ছিলো রাস্তার প্রতিটি চিরকালীন অবহেলিত ইটের টুকরা। হুইসেলের শব্দে তার চমক ভাঙ্গে; সেই দীর্ঘ ছায়ার পাশে নিজেকে তুচ্ছ মনে হওয়া সন্ধ্যা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে সে, তারা প্রত্যেকে, ঘাস-বাতাস-আকাশ-মাটি-বৃষ্টি সব। কন্ঠগুলো প্রাচীন বৃক্ষের মতো নিঃসঙ্গ, মৃত্যুপথযাত্রীদের মতো অসহায়, প্রতিদিনকার মাড়িয়ে যাওয়া ঘাসের মতো প্রাণহীন; তবুও চিৎকার উঠে প্রতিনিয়ত- কিছু না কিছু একটা নিয়ে। সন্ধ্যাগুলো আর দীর্ঘায়িত হয়না। সে গন্ধটা পেতে চায়। প্রতিদিন।

এভাবে কখনো আস্ত একটা রাত্রি চলে আসবে সে ভাবেনি; আসলে ভাবতে চায়নি, না চাওয়া কতোকিছুর সাথেই তো তার বসবাস- তবু এই বসবাস কখনো তার কল্পিত ছিলো, না ছিলো ইপ্সিত। বালিশটা উল্টে সে পাশ ফিরে শুলে পাশের ঘর থেকে মায়ের অত্যন্ত সংগোপন ঐকান্তিক কান্নার শব্দ পেলে সে স্মরণ করে শৈশবে ছমছম করা মফস্বলী গভীর রাতে বৃদ্ধ কুকুরের বিলাপে তার প্রগাঢ় স্পর্শকাতর বুকের ভেতরটা ধকধক করে উঠতো; সে আরামদায়ক বালিশটিকে মাথা থেকে নামিয়ে কানের পাশে রেখে আকাঙ্খা করতো যেনো চারপাশটা নিস্তব্ধতায় ডুবে যাক- এই চাওয়ায় লীন হতে হতে ঘুমের মাঝে সে অন্তর্হিত হতো। পরদিন বাড়ি থেকে প্রথম যখন বেরুতো অবশ করা সেই আতঙ্কের কথা তার কিছু খেয়াল থাকতোনা। কিন্তু এই ভয়াল বর্তমানে বিস্মরণের সেই একান্তই প্রয়োজন; প্রকৃত প্রস্তাবে কাঙ্খিত পলায়ন থেকে সে পালাতে ব্যর্থ, তার সকল ইন্দ্রিয়কে ছাপিয়ে প্রতিদিন অজস্র ঐকান্তিক গোপন কান্না আর গোপন থাকতে পারেনা- তার অন্তর্গত হয়ে যায়।

অনেক অনেকদিন অতিক্রান্ত হয়। এক কার্তিকের অতিক্রান্ত সকালে সে হাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করে সেই পুরনো ভেজা ভেজা গন্ধটা ফিরে এসেছে; কিন্তু কোথাও কিছু একটা নেই, এমনটা সে স্পষ্টতই উপলব্ধি করে। কি নেই কি নেই- প্রশ্নটা বারবার তাকে আঘাত করতে থাকে, ক্ষমাহীন নির্দয়তার সাথে। কিন্তু উত্তরের সন্ধানে ব্যাপৃত হতে গেলে সে দেখতে পায় রাস্তাগুলো ক্রমশই সুড়ঙ্গপথের ধূর্ততায় তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; তার অসম্মতিতে, সে মন্ত্রমুগ্ধের পতনোন্মুখ হতে থাকে- তার জানা ছিলোনা কোন সন্ধ্যাকে যখন দীর্ঘ মনে হতে থাকে; যখন ভেজা সেই গন্ধ পৌঁছে দিতে চাচ্ছে কোন অশ্রুত সঙ্গীতের আগমনী বার্তা, প্রতিটি ঘাস ধুলো পরিত্যক্ত ইটের টুকরাকে যখন জীবন্ত বলে মনে হবে- ঠিক সেই সময়টাতেই সেই স্থান ত্যাগ করা দরকার। নয়তো কে বলতে পারে আরো অজস্র রাত কেটে যাবে প্রত্যাখ্যানের বহুবিধ বেদনাবিধুর ভাষাকে আলিঙ্গন করে নিতে নিতে। তাছাড়া দীর্ঘায়িত সন্ধ্যা বরাবরই ঠিকানাহীন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.