নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভারসাম্য মাত্রই কৃতিত্ব নয় ।

আল - বিরুনী প্রমিথ

আল - বিরুনী প্রমিথ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মৃত মাছের চোখ

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত ২:৪১

অফিসে বসে বসে কলিগদের প্রতিক্রিয়া মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছিলো শাহেদ। প্রত্যেকের মুখই কম বেশী উদ্বিগ্ন। যেই উদ্বেগের সাথে তাদের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সম্পৃক্ততা নেই বললেই চলে। কি সেই ঘটনা? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের ফলাফল দিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত জয়ই রাসেল, সাদমান, তোফাজ্জল ভাই, অফিসে সদ্য জয়েন করা আদনান, তমা, নুশাইবা প্রত্যেকের মুখ চুন করে দিয়েছে এই বিষয়ে শাহেদ সংশয়হীন।

‘ধুর শালা, কার মুখ দেখে যে আজকে ঘুম থেকে উঠেছিলা্ম।’ কর্মরতদের মাঝে সবচেয়ে প্রবীণ তোফাজ্জল সাহেবের গলায় আক্ষেপটা স্পষ্ট টের পেলো শাহেদ।

‘এইটা কোন কথা হইলো শাহেদ ভাই? মার্কিন মিডিয়া কি করলো এতোদিন ধরে? তাদের কথাবার্তায় তো মনে হচ্ছিলো ইলেকশনটা স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা। হিলারীর প্রেসিডেন্ট হবার কাগুজে প্রক্রিয়া মাত্র। ফ্লোরিডায় বড় আপা-দুলাভাই তাদের দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে আছে দশ বছর হয়ে গেলো। তাদের কি হবে?' তমার প্রশ্ন শুনে শাহেদ ধন্দে পড়ে যায়। মিঃ ট্রাম্প কি আজকে থেকেই মুসলমান তাড়িয়ে দেওয়া শুরু করবেন?

বাদবাকিরাও নিজেদের অসন্তোষ জানিয়ে যার যার ডেস্কে ফিরে গেলে শাহেদের মনে হয় সে কিছু বলতে পারতো। তবে না বলে ভালোই করেছে বোধহয়। ট্রাম্প সাহেব ইলেকশনপূর্ব বক্তৃতায় যা যা বলেছেন- বিশেষত আমেরিকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষসূচক বক্তব্যগুলো; এই বাঙ্গাল মুলুকে সংখ্যালঘুর প্রতি একই রকম বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলে করেকম্মে খেয়েছে এবং করেকম্মে খাচ্ছে এমন নেতার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, এই কথাগুলো বললে শাহেদ জানে তার কলিগদের মুখ আরো অপ্রসন্ন হয়ে উঠবে।

একাধিক জায়গায় চাকরী করার সুবাদে তুলনামূলক বিচারে এখানকার কলিগরা বেশ সফিসটিকেটেড এবং র‌্যাশনাল বলে শাহেদ মনে করে। অন্যান্য জায়গায় কাজ করার অভিজ্ঞতায় সে দেখেছে এক ধরণের রেষারেষি; যা প্রায়শই কুৎসিততম রুপ নেয়- এমন এনভায়রনমেন্ট এখানে অপেক্ষাকৃতভাবে টোনড ডাউন। তবে বিনোদনের কোন ঘাটতি এখানে নেই। বিশেষত তমা অফিসে জয়েন করবার পর থেকে মেল কলিগদের সাথে একান্ত আড্ডা, প্রাইভেট আলাপচারীতা ক্রমশই রসালোতর হয়ে উঠছে। তবে ওই যে, এখানকার মানুষজন বেশ ডিগনিফায়েড। সেই কারণে একান্তই ব্যক্তিগত গসিপ, যতোই জুসি হোক কিংবা শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করুক- যার উদ্দেশ্যে কিংবা যাকে কেন্দ্র করে করা হয় কখনো তার কান পর্যন্ত পৌঁছায়না। এমনকি এই যে মার্কিন ইলেকশন নিয়ে কিছুদিন যাবত আসন্ন তর্কবিতর্ক বিস্তর আলোচনা চলবে তার কেন্দ্রেও যে তমা, নুশাইবাদের নিজেদের ইন্টেলিজেন্স দিয়ে মুগ্ধ করার বাসনা অনুপস্থিত তার গ্যারান্টি তো দেওয়া যাচ্ছেনা।

চার কি পাঁচদিন কেটে গেলে শাহেদ একটু নড়েচড়ে বসে। সদ্যসমাপ্ত বিষয়টা নিয়ে অফিস সরগরম থাকবে এমনটা তার অনুমিত ছিলো। কিন্তু যেই এঙ্গেলগুলো থেকে অনুমানটা করেছিলো সেগুলোর সাথে তো মিলছে না। অফিস থেকে বাসায় ফিরে খাওয়াদাওয়া গোসল এইসব সেরে নিয়ে শাহেদ সোজা বসে যায় ল্যাপটপ নিয়ে। ঘেঁটে ঘেঁটে মার্কিন ইলেকশনের ফলাফল নিয়ে লেখা আর্টিকেলগুলো পড়ে। ট্রাম্পের জয়ের কারণ, মিডিয়া ব্যাকিং সত্ত্বেও হিলারীর পরাজয়ের খুঁটিনাটি অনুসন্ধান, ট্রাম্পের এই বিজয়ে মিডিয়ামোড়লেরা সম্ভাব্য কি কি বিপদে পড়তে পারে- শাহেদের উৎসুক মন বিস্তারিত সব তথ্য মস্তিষ্কে যত্ন করে রেখে দেয়। এই নিয়ে স্ত্রী আফরিনের সাথে একচোট ঝগড়া পর্যন্ত তার হয়ে গেছে। এখন বাংলা মাস কার্তিক চলছে। গভীর রাত হলে বাতাসটা এমনভাবে শরীর মনকে গ্রাস করে নেয় যে সেক্সুয়াল আর্জ বেড়ে যায়- এমনটা আফরিন মনে করে। কিন্তু এইসকল যুক্তি, সুন্দরী স্ত্রীর সাথে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের প্রলোভন, তাতে সাড়া না দিলে ঝগড়া অতঃপর মান-অভিমান পর্ব – কিছুই শাহেদের মনকে টলাতে পারেনা।

বিষয়টা এতো প্রগাঢ়ভাবে সকলের মনোযোগ কেড়ে নিতে পারে কোন জাদুবলে? গসিপিং ইস্যু? নাকি স্রেফ কলোনিয়াল হ্যাংওভার? এই পোড়া শহরে হ্যান্ডসাম স্যালারীতে চাকরী করা মানে খোদ তারা নিজেরা স্বভাবে যাপনে নিখাদ পোস্টমর্ডান বলে এমনটাই তো শাহেদ এতোকাল যাবত আবিষ্কার করে এসেছে। এমনও নয় যে ইস্যুর অভাব আছে। আজকে এইটা কালকে ওইটা- সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে এই প্রবণতা মহামারী আকারে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে নিত্যনতুন নুইসেন্স তৈরী করে এই বক্তব্যের সত্যতার পক্ষে শাহেদ হাজারটা সলিড যুক্তি দেখাতে পারে। কিন্তু চার পাঁচদিন ধরেই অফিসে দেখছে সকলের মুখ বেজায় রকমের গুমোট থাকে। এমনকি মাত্রই সেদিন অফিসে জয়েন করা আদনান- হাসিঠাট্টায় চারপাশ মাতিয়ে রাখতে যেই ছেলেটা ওস্তাদ সে পর্যন্ত সারাদিন চুপচাপ নিজের কাজকর্ম সেরে অফিস ছুটি হওয়া মাত্রই বাড়িতে ফিরে যায়। তার মুখে লেগে থাকা দুঃশ্চিন্তাকে অরিজিনাল বলেই মনে হয়েছে শাহেদের। সবার হলোটা কি? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য কোন উত্তরই মাথায় গোছানো আকারে না আসলে সে দিশেহারা অনুভব করে।

এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো। অফিসে আজকে সারাদিনে কাজের চাপ কম থাকবে জানে শাহেদ। তারপরেও সকাল সকাল ব্যস্ত ভঙ্গিতেই বাড়ি থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরুলো। বাংলামোটরের মোড়ের সামনে রিকশাওয়ালার সাথে ভাড়া নিয়ে তুমুল ক্যাচাল বেঁধে গেলো শাহেদের। রিকশায় উঠবার সময়ে ভাড়া ঠিক করে উঠেনি এই ভেবে শাহেদের ইচ্ছা হলো হাত কামড়াতে। ঝগড়াঝাটি আরেকটু হলেই হাতাহাতি পর্যন্ত পৌঁছে যেতো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মজা দেখতে আগ্রহী পাবলিকের সংখ্যা অনেক বেশী, মারামারি দিয়ে সকাল শুরু হলে সেই দিনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শংকা- সবকিছু বিবেচনা করে রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে দুইবার চুতমারানীর পুত শব্দদ্বয় উচ্চারণ করে শাহেদ শান্তমনে অফিসে প্রবেশ করতে উদ্যত হয়।

অফিসে এসে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়েছে কি নেয়নি এমন সময়ে শাহেদের মুখোমুখি চেয়ারে এসে উত্তেজিত ভঙ্গিতে সাদমান বসে পড়ে। অস্থিরতার চোটে সে শাহেদকে যা বলতে এখানে এসেছে তার কিছুই প্রথমে বলতে পারেনা। একটু ধাতস্ত হয়ে উঠলে শাহেদ জানতে পারে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। পিতৃমাতৃহীন তমা তার কলেজপড়ুয়া ছোট বোনকে নিয়ে থাকে এই তথ্য তারা সকলেই জানে। অফিসের উদ্দেশ্যে তমা আজকেও সকাল সকালই বাসা থেকে বের হয়েছিলো। তার বাসা থেকে কর্মস্থলের দূরত্ব নেহায়েত কম নয়। দেড় ঘন্টার মতো। অফিসে পা দিতে না দিতে তাদের বাসায় কাজ করা ছুটা বুয়ার ফোনে জানতে পারলো ছোট বোন রেপড হয়েছে। কে কিংবা কারা এই সর্বনাশটা ঘটালো, ঘটালে কিভাবে সিকিউরিটি গার্ডকে ফাঁকি দিয়ে ঘটাতে পারলো , দারোয়ান কিংবা অন্য কোন স্টাফ কেউই পালায়নি অতএব সন্দেহের তালিকায় তাদের শুরুতেই ফেলে দেওয়া যাচ্ছেনা। মেয়েটা বাঁচবে কি বাঁচবেনা তার নেই ঠিক। খবরটা শুনে সাথে সাথে নাকি অফিসের সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে ডুকরে উঠেছিলো। সাদমান হড়বড় করে আরো সব বৃত্তান্ত শোনাতে থাকলে হঠাৎই শাহেদ তার চোখের দিকে তাকায়। এই তো পরশুদিনই আফরিনকে বটিতে পা রেখে মাছ কুটতে দেখেছিলো। আফরিনের হাত-পায়ের গড়ন বরাবরই খুব সুন্দর। প্রায় নিঁখুত বলা যায়। কিন্তু বারবার শাহেদের চোখ চলে যাচ্ছিলো মাছটার চোখের দিকে। মুখোমুখি বসে অনর্গল বাকোয়াজি করতে থাকা সাদমানের দৃষ্টিও কি তেমনই নয়? শাহেদের মনে হয় মার্কিন ইলেকশন, ট্রাম্পের বিজয়, মুসলমান খেদাও সংক্রান্ত প্রত্যেকের দুঃশ্চিন্তা, গতো কিছুদিনে অফিসের গুমোট পরিস্থিতি- এসবই আসলে বোগাস। মূল প্রণোদনা অন্যত্র। যাকে আড়াল করে প্রত্যেকে মৃত মাছের চোখ নিয়ে দিব্যি হেসেকেঁদে দিন পার করে দিচ্ছে।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:৩৯

সামিয়া বলেছেন: শাহেদের মনে হয় মার্কিন ইলেকশন, ট্রাম্পের বিজয়, মুসলমান খেদাও সংক্রান্ত প্রত্যেকের দুঃশ্চিন্তা, গতো কিছুদিনে অফিসের গুমোট পরিস্থিতি- এসবই আসলে বোগাস। মূল প্রণোদনা অন্যত্র। যাকে আড়াল করে প্রত্যেকে মৃত মাছের চোখ নিয়ে দিব্যি হেসেকেঁদে দিন পার করে দিচ্ছে।

এই কথা গুলো চমৎকার লেগেছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.